হারানো বউকে আবার ফিরে পাওয়া

হারানো বউকে আবার ফিরে পাওয়া

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পরই বাসায় ফিরলো সাকিব।নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দেখতে পেলো বিছানায় বসে সাকিবের স্ত্রী মীম আর বড় ভাবী গল্প করছে। আজ এতো তাড়াতাড়ি সাকিবকে ফিরতে দেখে ওরা দুজনই বেশ অবাক হলো।মীম উঠে দাড়িয়ে বললো

– আমি চা নিয়ে আসছি
-না লাগবেনা।আমি এইমাত্রই খেয়ে আসলাম বাইরে থেকে।
-আচ্ছা মীম,আমরা নাহয় আর একদিন গল্প করবো ,তুমি বরং এখন তোমার জামাইকে সময় দাও
বলেই ভাবী রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন।সাকিব তখন বললো
– আরেহ না না,তোমরা দুজন গল্প করছিলে করোইনা।আমি শুধু শুধু ডিস্টার্ব করলাম।তোমরা কথা বলো আমি না হয় ড্রয়িং রুমে বসছি
-তুমিও বসো আমাদের সাথে গল্প করি সবাই।

অনিচ্ছা সত্বেও চেয়ার টেনে বসলো সাকিব।ভাবীর সাথে কথা বলতে ওর সমস্যা নেই,সমস্যা হলো মীম।মীমের সাথে খুব বেশী কথা হয়না বলেই ওর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায় সাকিব।ভাবী হঠাৎ সাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন

-সাকিব,তুমি মেহেদী আনোনাই কেন?
-ওহহো ভুলেই গেছি।
-ভুললে চলবে?তোমাদের বিয়ের পর এই প্রথম ঈদ,মীম তোমার সাথে এই প্রথম বার ঈদ করছে আর ঈদের আগের রাতে মানে আজকে ও মেহেদী লাগাবেনা?এটা কেমন কথা?
-মীম তো আমাকে আনতে বলেনি।
-আনতে বলে দিতে হবে?তুমি জানোনা যে ঈদের আগের রাতে মেয়েরা মেহেদী লাগায়?দাড়াও তোমার ভাইয়া বাইরে আছে,তাকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।
-পরে ফোন কইরো,তোমরা কি নিয়ে কথা বলছিলে?
-মীমকে আমার আর তোমার ভাইয়ার প্রেম কাহিনী শোনাচ্ছিলাম।

কারও কাছে নিজের সফল প্রেম কাহিনী শোনাতে ভাবী বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।এমনকি নিজের পাঁচ বছরের ছেলেটাকেও সেই পিচ্চিকাল থেকেই এই প্রেম কাহিনী বলেই ঘুম পাড়াতেন তিনি।সাকিব এতোবার শুনেছে যে ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।

-একবার হইছে কি সাকিব,তোমার ভাইয়া ঈদের আগের রাতে আমার বাসায় গেলো আমার হাতের মেহেদী দেখতে।তখনো আমাদের বিয়ে হয়নি আর আমাদের সম্পর্কের কথা কেউ জানতোনা।আর তখন তো এতো কিছু ছিলোনা যে আমি ছবি তুলে সাথে সাথে পাঠিয়ে দিবো
-তারপর?
-তারপর হইছে কি মীম শোনো,আমি বারান্দায় দাড়িয়ে হাত নেড়ে দেখাচ্ছিলাম শাহিদকে আর ও তখন গেইটের বাইরে ,হঠাৎ আমাদের কুকুর টা ওকে তাড়া করলো।
-তারপর?
-তারপর শাহিদ কি যে দৌড় টাই না দিলো ,আমার এখনো মনে আসলে হাসি পায় হাহাহা।এরপর বিয়ের আগ পর্যন্ত ও আর আমাদের বাড়ির সামনে যায়নি কখনো।

ভাবী অনেক্ষণ ধরে শব্দ করে হাসলেন। মীম একটু মুচকি হাসলেও সাকিব হাসলোনা বরং ওর মুখে এখন বিরক্তির ছাপ।ওর ইচ্ছে করছিলো ওদের দুজনকে ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে। কিন্তু তবুও চুপচাপ ভাবীর বকবকানি শুনতে হচ্ছিলো ওর।মীম মাঝে মাঝে “ও,আচ্ছা,হুম” বলে তাল মিলাচ্ছিলো ভাবীর সাথে

-তোমার ভাইয়া তো বাইক চালাতেই পারতোনা।আমাকে নিয়ে বাইক চালানোর সময় কি ভয়েই না থাকতো।ওর ভয় দেখে আমিও ভয় পেতাম।
-তুমি পড়ে যাবে তাই হয়তো কেয়ারফুল ছিলো
-কিজানি।কাপলরা বাইকে চড়াটা কতো রোমান্টিক তাইনা মীম?
-হুম,তবে আমার কাছে সাইকেলে চড়াটা রোমান্টিক লাগে।
-সাকিব কিন্তু খুব ভালো বাইক চালাতে পারে,কি বলো মীম?তুমি তো অনেক বার উঠেছো?আমি অবশ্য কখনো ওর সাথে বাইকে উঠিনি।
-হুম আসলেই

সাকিবের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা হাসি দিলো মীম।সাকিব কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলো।মীম ওর সাথে কখনোই বাইকে ওঠেনি।আসলে ঠিক তা না ,সাকিব নিজেই মীমকে ওঠাতে চায়নি।একদিন না পারতেই মীম সাকিবকে বললো

-ইয়ে মানে বলছিযে আমার আজকে অনেক দেরী হয়ে গেছে।এখন বাসে করে গেলে ক্লাস মিস করবো।আপনি যদি আমাকে একটু ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে আসতেন

– আই এম সো সরি।আসলে আজকে অফিসে একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে।দেরী হলে চাকরী টাও চলে যাবে।আপনি বরং সিএনজি বা রিক্সায় চলে যান।আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে
-থাক লাগবেনা,আমার কাছে আছে।আপনি মনে হয় আপনার বাইকের পিছনের সিটিটাতে অন্য কোন মেয়েকে এলাউ করেননা তাইনা?

-একচুয়্যালি ঘটনা সেটাই। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ।বাট আই এম সো সরি।
-ইট্স ওকে। হঠাৎ ভাবীর ডাকে কল্পনায় ছেদ পড়লো সাকিবের।

-কোথায় হারিয়ে গেলে?
-কোথাও না
-জানো মীম,সাকিবের জিএফের বিয়ের পর ও যে কতোটা ভেঙে পড়েছিলো।
-তাই নাকি?(মীম)
-ওতো বিয়েই করতে চাচ্ছিলোনা ,পরে বাবা মা কান্নাকাটি করে রাজি করাইছে।আমি তো ভেবেছি ও তোমাকে মানতেই পারবেনা অথচ দেখো বিয়ের পর ও একদম বদলে গেছে।আসলে তুমিই ওকে বদলে দিয়েছো।তোমরা এখন মাশাল্লাহ কতো সুখী
-পৃথিবীতে একেক মানুষের সুখের ধরণ একেক রকম

কথাটা বলে সাকিবের দিকে আবার সেই বিভ্রান্তিকর চাপা হাসির পুনরাবৃত্তি করলো মীম।নিজের মধ্যে কেমন জানি অপরাধ বোধ হলো সাকিবের।

-অনেক গল্প করলাম আজকে।মীম আসো,টেবিলে খাবার দেই।আর সাকিব সালামি রেডি রাখো,কালকে মীম তোমাকে সালাম করবে।মীম,তুমি আগে সালামি নিবা তারপর সালাম করবা।নয়তো সাকিবও ওর ভাইয়ের মতো চিটারি করবে।

-আচ্ছা

প্রতিদিনের মতোই আজ দেরী করে বাসায় ফিরলো সাকিব।কিন্তু আজ মীমেরে বদলে ভাবী এসে দরজা খুলে দিলো।সাকিব ভাবছে মীম হয়তোবা নিজের ঘরে পড়ছে আর নয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।সাকিব ঘরে গিয়ে দেখে মীম নেই।হয়তোবা ওর মায়ের ঘরে গিয়ে উনার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে।কিন্তু এতক্ষণে তো মা ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী করলো সাকিব।মীমকে তখনো দেখতে পেলোনা।হয়তোবা ক্লাসে গিয়েছে।মীমকে নিয়ে এতো ভাবার সময় নেই সাকিবের।কিছু না খেয়েই অফিসে চলে গেলো সাকিব। সন্ধ্যায় দরজা খুলতে সাকিবকে দেখে বেশ অবাক হলেন ভাবী।

-ওমা,তুমি যাওনি?
-কোথায়?
-তোমার শ্বশুরবাড়িতে
-আমি ওখানে গিয়ে কি করবো?
-হ্যাঁ সেটাই তো,এখন মীমের পরীক্ষা চলছে ,এখন তুমি গেলে আরও ডিস্টার্ব।ভালো করে পরীক্ষা দেয়ার জন্যই তো মীম বাবার বাড়িতে গেলো।
-সেটাই

মীমের পরীক্ষা অথচ সাকিবকে জানায়নি ও।ওকে না জানিয়েই বাবার বাড়িতে চলে গেলো?অবশ্য জানালেও কিছু হতোনা।সাকিব মীমকে একটা সিএনজি তে উঠিয়ে দিতো এইটুকুই।ভালোই হয়েছে গিয়েছে।এবার নিজের ঘরে একা একাই শান্তিতে থাকবে ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছিলো সাকিবের। রাতের খাবার শেষে মায়ের ডাক শুনে উনার ঘরে গেলো সাকিব।

-তোমাদের বিয়ের প্রায় একবছর পার হচ্ছে,এবার তো আমি তোমার সন্তানের মুখ দেখার আশা করতেই পারি
-আমরা এখনো এইসব নিয়ে কিছু ভাবিনি মা।আর মীমের পড়াশোনাওতো এখনো শেষ হয়নি।তুমি এইসব নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়োনাতো মা ,তুমি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করো যেন আমরা তোমাদেরকে সুখে রাখতে পারি।
-তোমরা সুখে থাকলেই তো আমার সুখ।পরীক্ষা শেষ হলেই মীমকে নিয়ে আসবা আর মাঝে মাঝে ওকে দেখতে যাবা।
-আচ্ছা মা,তুমি এখন ঘুমাও

নতুন এক সমস্যায় পড়লো সাকিব।বাবা মা কে কিভাবে বোঝাবে?কিছুতেই বলা যাবেনা যে মীমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি সাকিব আর কখনো পারবেওনা।কেবলই সুখী দম্পতির অভিনয় করে যাচ্ছে সবার সাথে।উনাদেরকে বলতে হবে যে সাকিব কখনো বাবা হতে পারবেনা।মীম আসলে ওর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে।মীম কি বলে আল্লাহই জানে তবে এই মিথ্যা বলা ছাড়া সাকিবের আর কোন উপায় নেই। প্রায় একমাস হয়ে গেলো মীম বাবার বাড়ি গিয়েছে।এতোদিন ধরে সাকিবের সাথে মীমের কোন যোগাযোগ হয়নি।মীম একবারের জন্যও সাকিবকে ফোন করেনি।সাকিবও নিজের ভাবের কারণে ফোন দেয়নি মীমকে।কিন্তু মীম চলে যাওয়ার পর থেকেই কেন যেন ওকে খুব মিস করছে সাকিব।মা অনেক বার মীমের কথা জিজ্ঞেস করেছে সাকিবকে

-কি ব্যাপার সাকিব?এবার বাবার বাড়ি যাওয়ার পর মীম একবারও আমাকে ফোন দিলোনা।অথচ আগে যতোবার যেতো দিনে একবার হলেও ফোন দিতো।আমি ফোন দিলাম আর বন্ধ পেলাম,তোমার ভাবী ফোন দিলো সেও বন্ধ পেলো

-আমার সাথে তো কথা হয় আর ও তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে।ফোন সাথে থাকলে সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলতে চায় তাই বললাম ফোন টা অফ করে যেন দূরে রাখে,আর ভালো করে পরীক্ষা দেয়

-এখনো পরীক্ষা শেষ হয়নি?শেষ হলেই কিন্তু নিয়ে আসবা ওকে।

ঘরের কারও সাথেই কথা হয়না মীমের?ব্যাপার টা সাকিবের কাছে কেমন অদ্ভুত লাগলো।মেয়েটা কি ওকে একটুও মিস করছেনা?মীম যাওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই দেরী করে অফিস যেতে হচ্ছে সাকিবকে।মীম থাকতে ও কখনো সাকিবকে ডেকে না তুললেও ভেজা চুল ঝাঁড়ার সময় ইচ্ছে করেই সাকিবের গায়ে চুলের পানি ছিটাতো।বিরক্তি নিয়ে সাকিব ঘুম থেকে উঠতো

-আপনাকে না বলেছি এখানে চুল ঝাঁরবেননা
-সরি।তাড়াতাড়ি উঠুন,অফিসে যেতে হবে

মীম চলে যাওয়ার পর থেকে পুরো ঘর জুড়েই কেন জানি একটা শুন্যতা বিরাজ করছে।সাকিবেরও কিছু ভালো লাগছিলো না।নিজের বাড়িতে নিজেকে খুব একা আর অসহায় মনে হচ্ছিলো সাকিবের। মাঝরাতে সাকিবের হঠাৎ মনে হয় মীমের পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।তাকিয়ে দেখে পাশে কেউই নেই।বিছানায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাত জেগে গুনগুন শব্দ করে পড়তো মীম।সাকিব বেশ বিরক্ত ও হতো এতে।বুঝতে পেরে মীম ও তেমন একটা পড়তোনা

সাকিবের মনে হলো ওকে কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে।এ আর নতুন কিছুনা।ঘুমের মধ্যে প্রায়ই মীম ওকে জড়িয়ে ধরে আর সাকিব আস্তে করে ওকে সরিয়ে দেয়।আজ তড়িঘড়ি করে চোখ খুলেই জিজ্ঞেস করলো “কখন এসেছেন আপনি?” অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না আর কোন সাড়া না পেয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখলো সাকিবের পাশে মীম নেই।বুঝতে পারলো যে ও স্বপ্ন দেখেছে।আজ মীমের অভাবটা একটু বেশীই অনুভূত হচ্ছিলো সাকিবের।

নিজের ইগোর কাছে হার মানতে বাধ্য হলো সাকিব।ফোনটা হাতে নিলো মীমকে কল করার জন্য।”এতো রাতে কল করা কি ঠিক হবে?ঠিক বেঠিক কি?নিজের বউকে যেকোন সময় ফোন করা যাবে।তাতে কার কি আসে যায়?”কয়েক বার কল করেও মীমকে পাওয়া গেলোনা।ফোন সুইচড অফ ছিলো।মীম কি সাকিবের উপর অভিমান করেছে?যেখানে ভালোবাসা নেই ,সেখানে মান অভিমানও নেই।মীম কি ওকে ভালোবাসে? দরজা খুলে সাকিবকে দেখে বেশ অবাক হলেন মীমের আম্মু।

-স্লামালাইকুম
-ওয়ালাইকুমআসসালাম,এসো বাবা,ভেতরে এসো। ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো সাকিব।এই প্রথম নিজের ইচ্ছাতেই মীমদের বাড়িতে আসলো সে।

-তোমার মা কেমন আছে?ঘরের আর সবার কি খবর?
-জি সবাই ভালো।আপনার শরীর কেমন?
-এইতো ভালোই।মীমের আব্বুও বাসায় নেই ।আচ্ছা তুমি বসো আমি চা নিয়ে আসি।
-না না আপনি ব্যস্ত হবেননা।

এতক্ষণ হলো সাকিব এসেছে অথচ মীম একবারও সামনে এলোনা।মীম কি বাসায় নেই?জিজ্ঞেস করবে ভেবেও এতক্ষণ জিজ্ঞেস করলোনা সাকিব।

-মীম কি বাসায় নেই?
-আসলে কি বলবো আমার নিজেরি কেমন খারাপ লাগছে।মীম এমন একটা কান্ড করে বাসায় চলে আসবে ভাবতেও পারিনি।লজ্জায় তোমাদের কারও সাথে যোগাযোগও করিনি আর

মীম কি কান্ড করেছে সাকিব কিছুই বুঝতে পারছিলোনা।ও বাড়িতে সাকিব কিংবা অন্য কারও সাথেই মীমের ঝগড়া তো দূরে থাক কথা কাটাকাটি ও হয়নি কখনো।মীম ঐরকম মেয়েই না।তাহলে কি করেছে ও?

-আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তুমি ওকে নিতে আসবে তাই ইচ্ছে করেই পেপার টা পাঠাইনি।মীম আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলো পাঠাইছি কিনা আমি বলেছি পাঠাইছি সাকিবের দিকে একটি খাম এগিয়ে দিলেন তিনি।
-কিসের পেপার এটা?
-ডিভোর্স পেপার।

কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলো সাকিব।এমনটা ও মীমের কাছ থেকে আশাই করেনি কখনো।কিছুদিন আগেই সাকিব নিজেই ভেবেছিলো ডিভোর্স দিয়ে দিবে অথচ আজ ডিভোর্স পেপার হাতে পেয়ে সাকিবের মনে কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো।

-তুমি তো সব জানোই বাবা।আমরা এক প্রকার জোর করেই মীমের দিয়েছি তোমার সাথে।কোথাকার এক অশিক্ষিত গাইয়া ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছে তার হাত থেকে বাঁচাতেই।তোমাকে দেখে মনে হলো তুমি আমার মেয়েকে সুখে রাখতে পারবে।তোমাকে পেলে হয়তো ওই ছেলেটাকে ভুলে যাবে।কিন্তু আমার মেয়ে এতোই জেদী যে তোমাকে মেনে নিতেই পারেনি সাকিব বেশ অবাক হচ্ছিলো কথাগুলো শুনে।ওর মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিলোনা।মীমের আম্মু একাই সব বলতে লাগলেন

-মা হয়ে নিজের মেয়ের সংসার ভেঙে যাওয়া দেখবো এটা ভাবতেও পারিনি।তাই পেপার টা পাঠাইনি আমি

তোমাকে।অনেক বুঝিয়েও লাভ হলোনা ওকে।ও তোমার সাথে কিছুতেই সংসার করতে পারবেনা জানিয়ে দিয়েছে।মেয়েটা আমাদেরকে লজ্জায় ফেলে দিলো

-মীম এখন কোথায়?
-ভার্সিটির কাছেই একটা হোস্টেলে আছে কিন্তু কোথায় সেটা বলেনি আমাদেরকে
– ওর ফোন তো সুইচড অফ
-নাম্বার চেঞ্জ করেছে মনে হয় সেটাও আমাদেরকে দেয়নি।আগের নাম্বার থেকেই মাঝে মাঝে কল করে আবার অফ করে দেয়
-আচ্ছা আমি তাহলে আসি এখন।
-মনে কষ্ট রাখিওনা বাবা।ওকে জোর করে বিয়ে দেয়াটা ঠিক হয়নি আমাদের।জীবন এখানেই থামিয়ে রেখোনা।আমি কি বলেছি বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই।

রাস্তায় হাটতে হাটতেই সাকিব মীমের কথাই ভাবছে।মীমকে দেখে কখনো মনেই হয়নি যে ওর আগে কারও সাথে সম্পর্ক ছিলো।কখনো ওর কাছ থেকে এ সম্পর্কে কিছু জানাই হয়নি সাকিবের।কিভাবে জানবে?মীমের সাথে তো খুব একটা কথাই বলতোনা সাকিব।

খামটা খুলে ডিভোর্স পেপারের সাথে একটা চিঠিও পেলো সাকিব। “কি বলে সম্বোধন করবো ঠিক বুঝতে পারছিনা।কি লিখবো তাও বুঝতে পারছিনা। অনেক জেদী মেয়ে ছিলাম আমি।ভেবেছিলাম আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।কিন্তু বিয়ের দিনই আমি কেমন যেন বদলে গেলাম।ভাবতেই পারিনি এতোটা বদলে যাবো।তিনবার কবুল আর খাতায় একটা সাইনের যে এতো পাওয়ার তা আগে বুঝতে পারিনি।আপনার সাথে সবকিছু নতুন করে শুরু করবো ভেবেছি।কিন্তু বিয়ের রাতেই যখন আপনি বললেন আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবেননা,কেবলই সুখে থাকার ভান করতে হবে আমাকে। বিশ্বাস করেন কেন জানি আমি একটুও অবাক হইনি সেদিন।হয়তোবা একটু আশা করেছিলাম যে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু কিচ্ছু ঠিক হওয়ার ছিলোনা।তবুও যেভাবে চলছিলো তাতে আমি অসুখী ছিলামনা।কিন্তু আপনি সুখী হতে পারেননি আমার সাথে।নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হতো তখন।

বিয়ে মানেই কেবল শারীরিক সম্পর্কের বৈধতা নয়,বিয়ে মানে মানসিক সম্পর্কও।যার কোনোটাই আমাদের মধ্যে কখনোই ছিলোনা।আর এটা আমার ব্যর্থতা।মনে হয়েছে আমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে আপনি হয়তোবা তাকে ভালোবাসতে পারতেন।তাই আমি সরে যাচ্ছি ।কাহিনী টা সিনেমার মতো মনে হচ্ছে তাইনা?মাঝে মাঝে নাটক সিনেমা গুলোও কেন জানি মিলে যায় আমাদের জীবনের সাথে। ডিভোর্স,বিধবা এইসব শব্দ শুনতে আমার অনেক ভয় করতো অথচ আজকে আমি নিজেই ডিভোর্স দিচ্ছি।পেপার টা আমি নিজেই পাঠাতে পারতাম কিন্তু কেন জানি অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।

অনেক কিছুই লিখে ফেললাম।এতো বড় চিঠি পড়ার ধৈর্য্য হয়তো আপনার নেই।আমার জন্য আপনার জীবন এইভাবে হেলায় ফেলায় রসকসহীন চলবে তা আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছিলো।মনের মতো কাউকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করুন।ভালো থাকবেন।বাবা,মা,ভাইয়া ভাবী সবাইকে আমার সালাম দিবেন।উনাদেরকে বলবেন আমাকে যেনো ক্ষমা করে দেয়। মীম” ভার্সিটি গেইট দিয়ে বের হতেই রাস্তার ওপাশে সাকিবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো মীম।জিজ্ঞেস করতে যাবে কেন এসেছে কিন্তু আবার নিজেকে থামিয়ে নিয়েছে।হয়তোবা কোন কাজে এসেছে এখানে।সাকিবের গায়ে সবুজ টি-শার্টটা দেখেই চোখ বড় করে তাকালো মীম।ভুল দেখছেনাতো মীম।সেবার সাকিবের জন্মদিনে ওকে এটা গিফট করেছিলো মীম।

-সবুজ রং?কেমন জাতীয় পতাকা মনে হচ্ছে।এই রংটা শুধুই পতাকাতেই মানায়
-আপনাকেও বেশ ভালোই মানাবে মনে হচ্ছে।
-আমাকে কি আপনার পতাকা লাগানোর বাঁশ বা লাঠি মনে হয়?আমি এতোটাও দেশ প্রেমিক না যে জাতীয় পতাকা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াবো।আই এম সো সরি।আমি এটা পড়বোনা
-তাহলে চেঞ্জ করে নিয়ে আসি?
-না থাক,আপনাকে এমনিতেই ধন্যবাদ।

ঘটনা টা মনে উঠতেই মীমের ঠোঁটে কিছুটা চাপা হাসির আভাস দেখা দিলো।যেই হাসির মানে ও নিজেই বুঝতে পারলোনা হোস্টেলের দিকে হাটা ধরলো মীম।

-এই মীম দাড়াও পেছন থেকে সাকিবের ডাকে বেশ অবাক হয়েই দাড়ালো মীম।সাইকেল থেকে নামলো সাকিব
-কোথায় যাচ্ছো তুমি?
-এইতো বাসায়

কিছুটা কনফিউজড হয়েই জবাব দিলো মীম।সাকিব ওকে তুমি করে বলছে!কেইস টা কিছুই বুঝতে পারছিলোনা মীম।হাটতে হাটতেই কথা বলছিলো দুজন।

-নতুন সাইকেল?বাইক কোথায়?
-বাইক চালাতে ভালো লাগেনা।
-ও আচ্ছা,অফিস নেই আজকে?

-যাইনি।বাদ দাও সেইসব।তুমি কেমন আছো?
-এইতো ভালোই,আপনি?
-ভালোনা
-কেন?নতুন বউকেও পছন্দ হয়নি?
-বিয়েইতো করিনি।আসলে মনের মতো মেয়েই পাচ্ছিনা।তাই তোমাদের ভার্সিটির সামনে এসে দাড়িয়ে মেয়ে পছন্দ করছি
-পছন্দ হয়েছে কাউকে?
-একজনকে পছন্দ হয়েছে কিন্তু মেয়েটার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে।
-সো স্যাড,খুঁজতে থাকেন,পেয়ে যাবেন
-তুমি একটু হেল্প করোনা।একটা মেয়ে খুঁজে দাওতো
-হাসালেন।নিজের হাজব্যান্ড এর জন্য মেয়ে খুঁজবো আমি?অবশ্য এখন তো আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।

কথাটা শুনেই দাড়িয়ে পড়লো সাকিব।সাইকেল টা পাশে দাড় করিয়ে রাখলো

-মীম
-হুম
-ফিরে চলো
-মানে?
-আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছিনা।তুমি জানোনা আমি তোমাকে সারাটাক্ষণ মিস করি।আমি তোমাকে ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ।
-ভেরি ফানি।আমি এখন আসি।একটু পরেই আমার একটা টিউশনি আছে।ভালো থাকবেন
-মীম দাড়াও।আমাকে কি তোমার সিরিয়াস মনে হচ্ছেনা?
-না
-কেন?

-কারণ আপনি এখন সিরিয়াস না।এই সময়ে প্লিজ মজা করবেননা
-আমি সত্যি বলছি মীম।প্লিজ ফিরে চলো (মীমের হাত ধরে বললো সাকিব)
-আপনি এইসব কি বলছেন?পাগল হইছেন আপনি?
-তোমার কাছে যদি পাগলামো মনে হয় তবে সেটাই।
-এইসব পাগলামীর কোন মানে হয়না।আপনি প্লিজ চলে যান।ডিভোর্সের পর উনি আসছে আমাকে ফিরিয়ে নিতে।
-তো?সমস্যা কি?
-সমস্যা কি মানে?আপনি কি বলতেছেন আপনি বুঝতে পারতেছেন?যত্তোসব ভিত্তিহীন কথা।মজা নিতে আসছেন?
-রেগে যাচ্ছো কেন?
-রাগবোনা?নাচবো আমি?

-এখানে?চলো বাসায় গিয়ে একসাথে নাচি,আরে আরে কোথায় চললে?মীম দাড়াওনা
-হাত ছাড়েন প্লিজ
-ছাড়লাম।
-কি হইছে?এমন পাগলামো কেন করতেছেন?
-বলছিতো ভুল হইছে।চলো আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করি
-কিভাবে শুরু করবো?আপনি তো সব শেষ করে দিছেন।এখন কি আমি আপনাকে আবার বিয়ে করবো?
-করবা,প্রবলেম আছে?
-বলে কি?প্রবলেম নাই মানে?ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে?তাও আগের হাজব্যান্ড কে?আপনি জানেন কতো নিয়ম আছে এর?
-সমস্যা নাইতো।আমি লোকটাকে বুঝিয়ে বলবো যেন তোমাকে টাচ না করে
-কি?ছিঃ!আপনি যানতো এখান থেকে প্লিজ
-প্লিজ প্লিজ প্লিজ তুমি আমার জন্য আর একটা বিয়ে করতে পারবানা?আমি হইলে তোমার জন্য দশটা বিয়ে করতাম

-আমার মাথা এতোটাও খারাপ হয়নি।দরকার হলে আমি সারাজীবন একাই থাকবো তবুও দ্বিতীয় তারপর তৃতীয় বিয়ে কিছুতেই করবোনা।থাকতেই যখন পারবেননা তখন সাইন করেছেন কেন?
-করিনি
-মানে?
-সাইন করিনি।এই দেখো
-দেখি আমি
-দাও,এখন এটা তোমার সামনে ছিড়ে ফেলে দিলাম।
-এতক্ষণ ধরে বলেননি কেন?এতো নাটক করছিলেন কেন?

গলা চেঁচিয়ে বলতে লাগলো মীম।রাগে ওর পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।সাকিবকে রেখেই হাটতে লাগলো মীম।সাকিব ও পেছন পেছন হাটছিলো

-সরি,সরি সরি অনেক সরি
-আমি ইট্স ওকে বলবোনা

ভালোবাসার সম্পর্ক গুলো এমনি।মান,অভিমান,রাগ,জিদ,ভয়,সন্দেহ,হিংসা,আল্লাদ,পাগলামী থাকবেই।চুপচাপ ,লাজুক ছেলেটাও তার ভালোবাসার মানুষের সাথে পাগলামী,দুষ্টুমি করে আবার চঞ্চল হাসিখুশি মেয়েটাও তার ভালোবাসার মানুষের চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা পায়।ভালোবাসার শক্তি অনেক যা মানুষকে মুহুর্তেই বদলে ফেলে। মানুষ তার সাথেই অভিমান করে যে তার অভিমানের কদর করে,যে তাকে ভালোবাসে,যাকে সে ভালোবাসে।মীমেরও আজ অভিমান হচ্ছে।খুব বেশী অভিমান।

-মীম দেখো আমাকে এই গ্রিন টিশার্টে কেমন লাগছে?স্মার্ট না?
-বলদ লাগছে।আজকে কোন জাতীয় দিবস না যে জাতীয় পতাকা গায়ে দিয়ে হাটতে হবে
-জাতীয় পতাকা?পাগল তুমি?এই কালার টা অনেক বেশী জোস
-হুহ,কচু জোস
-দেখো ঐ মেয়ে দুইটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তোমাদের ভার্সিটির মনে হয়।খোঁজ নিয়ে দেখবে সিঙ্গেল কিনা?
-কেন?
-বিয়ে করবো
-মেরে তক্তা বানিয়ে দিবো একদম।একটা বউ ভালো লাগেনা তাইনা?
-না,আর হাটতে ভালো লাগছেনা।ক্ষিদা লাগছে অনেক
-আমিতো কাউকে বলিনি আমার পাশে পাশে হাটতে
– আমি হাটবো, তোমার সমস্যা?ইক্সকিউজমি,ভাইয়া আপু একটু এদিকে আসবেন?

মীম তাকিয়ে দেখলো সাকিব দুইজন ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলছে।তারপর ওরা তিনজনি মীমের কাছে আসলো।
-মীম,এরা হচ্ছে আমাদের বিয়ের সাক্ষী
-মানে?
-মানে এদের সামনে আমি আর তুমি এখন আবার বিয়ে করবো
-মানে কি?
-মানে কিছুনা।ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দাও আর চট করে তিনবার কবুল বলে ফেলো।
-আমি এইসব পাগলামীর মধ্যে নেই।
-আরে বলোইনা।নতুন করে সব শুরু করতে যাচ্ছি তাই আবার নতুন করে বিয়ে

অগত্যা সাকিবের জোরাজুরিতে মীম আবার কবুল পড়লো।মীমকে অপেক্ষা করতে বলে সাকিব একটু কাছেই দাড় করিয়ে রাখা সাইকেল টা আনতে গেলো।

-উঠে পড়ো
-সাইকেলে?
-হুমম,সন্ধ্যা পর্যন্ত আজকে আমরা সাইকেলে করে ঘুরবো
-তোমার না ক্ষিদে লাগছে?
-উধাও হয়ে গেছে।ভালোবাসলেই কেন ক্ষিদে পায়না বলোতো?
-হতচ্ছাড়া মনটাকে আটকে রাখা যায়না,গানটা সুন্দর না?

পিচঢালা রাস্তার এক পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরাচ্ছে সাকিব।মাঝে মাঝে বাতাসে সামনে বসা মীমের চুল ওর মুখে এসে পড়ছে।এটা কি কোন সুখের মুহুর্ত নয়?সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়।ওরা দুজনও এগিয়ে চলেছে নতুন এক জীবনের পথে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত