সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে রাসুর। টাকা জমানোর জন্য স্কুলে যাওয়ার পথটা সে হেঁটেই যায়। লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না বটে! তবু এসেম্বলির টাইমটা অসহনীয়। কিন্তু ড্রিল স্যার তা মানতেই চান না। তিনি এই গরমেও ওদের দিয়ে পিটি করিয়েই ছাড়বেন। এভাবে হয় না। রাসু তার একটা ভাবনা ওর সাথে থাকা কয়েকজন বন্ধুদেরকে বললো। আজ তাদের এই পরিকল্পনাটা কার্যকর হলেই কেল্লাফতে। এসেম্বলি চলছে। সবার শপথ বলা শেষ। হঠাৎ দ্বিতীয় সারি থেকে কয়েকটা ছেলে বলে উঠলো, এই ধর ধর… ওকে ধর। দেখতো কী হলো ওর?
এই বলে তারা লাইন ভেঙে গালিবকে ঘিরে দাঁড়ালো। এদিকে স্যারও ছুঁটে এসেছেন। তিনি দেখলেন, গালিব মাটিতে পড়ে আছে। স্যার তাড়াতাড়ি করে গালিবকে ধরে ক্লাসে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, এই তোরা পানি নিয়ে আয়, যা।
কয়েকজন পানি আনতে চলে গেলো। রাসুসহ গালিবের বন্ধুরা তখনও গালিবের পাশে দাঁড়িয়ে। তারা মৃদু স্বরে বলতে লাগলো, সব দোষ স্যারের। এই উত্তপ্ত গরমের মধ্যে ফাঁকা মাঠে পিটি করানোর জন্যই এমনটা হয়েছে।
পানি আনা হলে স্যার গালিবের মাথায় পানি দিলেন। খানিকবাদেই গালিব চোখ মেলে তাকালো। স্যারের চোখে তখন জল টলমল করছে। তিনি গালিবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বাবা আমায় ক্ষমা করে দে। তোদের ভালোর জন্যই আমি তোদের পিটি করাই। দেখিস কোনো একদিন এই পিটিই তোদের কাজে লাগবে। কোনো এক সময় আসবে, যখন তোরা এই পিটি, এই স্কুল, তোদের এই হতভাগা স্যারকে খুব মিস করবি। আর হ্যাঁ শোন, আমি আর তোদের কখনও পিটি করাবো না। আজ থেকে ‘পিটি’ নামক অসহনীয় কিছু এই স্কুল থেকে বিদায় নিলো। স্কুল ছুটি হলে যখন রাসু, গালিব এবং তার বন্ধুরা বাড়ি ফিরছিলো। তখন গালিব রাসুকে বললো, কিরে কেমন দিলাম? রাসু সহাস্যে বললো, একদম ফাটিয়ে দিয়েছিস। বড় হলে তুই ভালো একজন অভিনেতা হতে পারবি।
বছর দশেক পর আজ গালিব, রাসু, দু’জন দুই প্রান্তে। ফোনে কথা বলা ছাড়া তাদের মধ্যে আর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। আজ গালিবের মেডিকেল টেস্ট হবে। সে সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলো। গালিবের অনেক স্বপ্ন ছিলো সে দেশের স্বার্থে, দেশের প্রতিটি মানুষের স্বার্থে কাজ করবে। অন্যদিকে রাসু একটা বেসরকারি ছোটখাটো চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে নিত্যদিন। কিন্তু চাকরি তার মিলছে না। একদিন রাতে গালিব তাকে ফোন করে বললো, দোস্ত একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছেরে। রাসু বললো, “কী সমস্যা?”
“সেনাবাহিনীতে চাকরি হয়েছে আমার। কিন্তু প্রতিদিন পিটি, ব্যায়াম, সাথে আরও অনেক কিছু করতে হয়।” “তোর তো একটা গতি হয়েছে। আমার তো তাও হলো না।” “দোস্ত প্রতিদিন এই পিটি, ব্যায়াম করতে ভালো লাগে না। আর একটু ভুল করলেই তপ্ত রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখে।” “সেটা তো তোর ভালোর জন্যই করে।” “রাসু, ড্রিল স্যারকে খুব মনে পড়ছেরে আজ। তিনি আমাদের পিটি করাতেন বলে আমরা তার উপর বিরক্ত হতাম, পিটি না করার জন্য নানান ফন্দি আঁটতাম।” “হ্যাঁ রে দোস্ত স্কুলের সেই দিনগুলোকে খুব মনে পড়েরে। সেই দিনগুলো না কতই ভালো ছিলো। বিশেষ করে ড্রিল স্যারের কথা বেশি মনে পড়ে। স্যারটা আমাদের সবাইকে তার নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। আর আমরা কিনা তার সাথে বেয়াদবি করেছিলাম!”
“দোস্ত স্যারের সাথে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করতে পারবি?”
“তোর যেদিন সময় হয়। সেদিন আমার এখানে চলে আসিস। আমরা সেদিন গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো।”
“আচ্ছা তাহলে আগামী বৃহস্পতিবার আসছি তোর ওখানে।”
“আচ্ছা।”
বৃহস্পতিবার রাতে রাসু আর গালিব তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ড্রিল স্যারের মুখটা তাদের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। তারা পরিকল্পনা করেছে, তাদের বেয়াদবির জন্য তারা স্যারের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে। পরদিন সকালে তারা গ্রামে পৌঁছায়। তাদের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। কতদিন বাদে তারা তাদের সেই স্মৃতিবিজড়িত স্কুলটাকে দেখতে পাবে। সাথে তাদের স্যারকেও। “রাসু, গালিব, বাবা তোমরা কখন এলে?” রহমান চাচার ডাকে তারা পেছনে তাকায়। বলে, “এইতো চাচা মাত্রই এলাম। কেমন আছেন চাচা?” “আল্লাহ রাখছে বাবা। তোমরা কেমন আছো?” “জ্বী চাচা, আলহামদুলিল্লাহ।” “তোমাদের স্কুলের ড্রিল স্যার তোমাদের কথা বারবার বলতেন। তোমাদের দু’জনকে তিনি খুব মিস করতেন।” “চাচা আমাদের গ্রামে আসার উদ্দেশ্য মূলত স্যারের সাথে দেখা করা।” “তা তো আর সম্ভব না বাবা।” “কেন চাচা? কেন সম্ভব না?”
“তিনি তো মাস খানেক আগে গত হয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে বারবার তোমাদের দু’জনের কথা বলছিলেন, তোমাদের দু’জনকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা তো ছিলে দূর্লভ বস্তুর ন্যায়। তোমাদের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর ছিলো।” “কী বলছেন চাচা এসব?” “হ্যাঁ বাবা। যদি পারো তবে কবরস্থানে গিয়ে একবার তার কবরটা জিয়ারত করে এসো।” নিজেদের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা বইতে লাগলো তাদের। তারা যে স্যারের সাথে চরম বেয়াদবি করে ফেলেছিলো। তাদের ক্ষমা চাওয়াটা যে অতীব জুরুরী ছিলো। তারা পরিকল্পনা করলো কবরস্থানে গিয়ে স্যারের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে স্যারের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে।