পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। আমার সেসময় বিয়ের পিড়িতে বসার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাবার মুখের সামনে না বলার কোনো সাহস ও ছিল না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা করে নিয়েছিলাম। বিয়ের পর আমরা একসাথে থাকলেও তমালের প্রতি আমার কোন অনুভূতি কাজ করেনি। একপ্রকারে বলতে গেলে তমালকে আমার অসহ্য লাগতো। আমাদের জুটি দেখে বন্ধু বান্ধবী সবাই হাসত। আমার তা একটুও ভালো লাগত না। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না।
যে মেয়ে বাবার সামনে বিয়ে করবে না এই কথা বলতে পারে না সে কী করে সংসার ছেড়ে চলে যাবে? দিনেদিনে তমালের প্রতি আমার বিরক্তির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিল। তমালের এক্সটা কেয়ারিং আমার খুব বিরক্ত লাগত। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করা, আমি কী করছি দুপুরে খেয়েছি নাকি এইসব তার কথার অংশ। সপ্তাহে একদিন আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া। ঘুরাঘুরিতে আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল তমালের সাথে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে। আমার পাশে তমালকে বড্ড বেমানান লাগত। কেন লাগত তা আগে বলি। যেখানে আমার উচ্চতা ৫’৭” সেখানে তমালের মাত্র ৫’৫”।
পাশাপাশি হাঁটলে দুজনকে কার্টুনের মতো লাগত। তবে মানুষ হিসেবে আমি তমালকে খারাপ বলবো না। হয়তো ওর শত্রুও “ও” কে খারাপ বলতে পারবে না। মাঝে মধ্যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই, একটা লোক এত ভালো হতে পারে কী করে। কত অবহেলা করি তারপরও আমার প্রতি তার যত্ন কমে না। ঠিকই নিয়ম করে আমার খোঁজ নেয়। আমি কখন কী করি, আমার কী পছন্দ- অপছন্দ সবাই তার মুখস্ত। তমালের প্রতি যে আমার ভালো লাগা জন্মেনি তা নয় তবে তা ক্ষণিকের। কারণ বান্ধবীদের উপহাস মনে পড়লেই সব ভালোলাগা হাওয়া হয়ে উড়ে যায়।
কলেজ জীবনে বান্ধবীদের সাথে তর্ক করতাম যে, ভালোবাসায় উচ্চতা কখনো বাঁধা হতে পারে না। কিন্তু ওরা ছিল এর একেবারে বিপক্ষে। তখন কথায় কথায় বলতাম, যা আমি খাটো ছেলে বিয়ে করে দেখিয়ে দিব। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার কপালে সত্যি একটা খাটো ছেলেই জুটবে। শুনেছি লম্বা ছেলেদের নাকি হাঁটুর নিচে বুদ্ধি থাকে তাহলে সেই হিসেব অনুযায়ী খাটো ছেলেদের মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করার কথা। তাহলে তমাল কেন বুঝে না, আমি ওকে মোটেও পছন্দ করি না। ওর আর আমার সম্পর্কটা অভ্যাসের, ভালোবাসার না। কেন বুঝে না ও, কেন? আচ্ছা আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই ওর জীবন থেকে তাহলে নতুন যে আসবে সেও কি ওর অভ্যাসের সাথে মিশে যাবে। তমাল কি তখন নতুন কারোর জন্যে নিয়ম করে গিফট নিয়ে আসবে? আমাকে কি একটুও মনে রাখবে না? ধুর! কী সব ভাবছি আমি। ওর যা ইচ্ছা তাই করুক আমার তাতে কী? কিন্তু আজ ক’দিন ধরে কিছুই ভালো লাগছে না।
মনে হচ্ছে এইবার আমি নিজেই তমালের প্রেমে পড়ে গেছি। যেসব বান্ধবী ও আত্মীয়রা তমালের নামে কুমন্ত্রণা দিত এবং দেই তাদের সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। এখন অপেক্ষা করি কখন তমাল ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কী করছো? কিন্তু আর ফোন আসে না। কথায় আছে মুখ দেখলে মায়া বাড়ে আমারও হয়তো তাই হয়েছি। কিন্তু তা বোধহয় অনেক দেরিতে। তমালের মধ্যে এখন অনেক পরিবর্তন দেখতে পাই। রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা, অল্পতেই আমার প্রতি রেগে যাওয়া। আমাকে দেখলেই বোধহয় ওর মুখে বিরক্তির ছাপ পড়ে। এখন আমি সারা সপ্তাহ জুড়ে অপেক্ষা করতে থাকি কখন তমাল এসে বলবে চলো না হাফসা, একটু কোথায় ঘুরতে যাই। কিন্তু তা আর হয় না। এখন আর তমাল বলে না, হাফসা শাড়িতে কিন্তু তোমায় বেশ মানায়। কিন্তু আমি এখন প্রতিদিন শাড়ি পড়ি শুধু মাত্র ওর মুখ থেকে একটা কথা শুনার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক বলেছিলেন,
পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নেই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মতো সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছি। যেমন আমি তমালের অবহেলা মেনে নিতে পারছি না। ওর এভাবে দূরে সরে যাওয়া আমার আর সহ্য হচ্ছে না কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছি না। এতদিনে আমি বুঝতে পারছি, তমাল ছাড়া আমার পক্ষে এই পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব না।
আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ভেবেছিলাম তমাল অন্ততপক্ষে আজকের দিনটা আমার সাথে ভালো আচরণ করবে। কিন্তু না, সকাল থেকে তার কোন খোঁজ নেই। ফোন বন্ধ কোথায় আছে কী করছে আমি কিছুই জানি না। রাতে এসে জানালো, আমি খেয়ে এসেছি তুমি খেয়ে নিও। এই প্রথম হয়তো কষ্ট কাকে বলে আমি অনুভব করলাম। এতদিন যে তমাল আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে তাতেও আমার খারাপ লাগেনি কারণ আমিও কম কষ্ট দেইনি ওকে। কিন্তু আজ! কিছু ভালো লাগছিল না। বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করছিল।
ইতিমধ্যে তমাল আমাকে ডাকল, হাফসা তুমি কি একবার বেলকুনিতে আসবে? চোখ মুছে চুপচাপ বেলকুনিতে গেলাম। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই তমাল আমার হাতটা ধরে বলল, “আমার বুকের বাঁ পাঁজর হারিয়ে গেছে। তুমি কি তা খুঁজে দিবে?” আমি যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। চুপচাপ শুধু মাত্র তমালকে অনুভব করছিলাম। এর মাঝে তমাল বলে উঠল, আমি কি ধরে নিব দায়িত্ব তুমি নিয়েছো? আমি মুচকি হেসে বললাম,”চলে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে, চলে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছো।” বেলাশেষে তুমিই আমার।