অপ্রাপ্তি

অপ্রাপ্তি

আমি মিরাকে আবারো ফোন দিলাম৷ সে ফোন তুলল না। এতক্ষনে বহুবার ফোন দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷ তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি খানিকটা টেনশনে পড়ে গেলাম৷ অথচ আমার টেনশনটা একদমই অপ্রয়োজনীয়। অযথা। জানি না, কেন অযথাই মেয়েটার জন্যে এত টেনশন হয়৷ কেনইবা তার সাথে কথা বলার জন্যে এত আকাঙ্ক্ষা। এত টান! আমি বুঝতে পারি, আমার বুকের ভেতর কী ভীষণ অস্থিরতা কাজ করে তাকে নিয়ে৷ তার কিছু হলেই আমি অস্থির হয়ে যাই৷ আমার হার্টবিট বাড়তে থাকে৷ বুকের ভেতর এক অদম্য যন্ত্রণা অনুভব করি। আমি বুঝতে পারি, তাকে কতটা ভালোবাসি আমি। সে আমার কতটা জুড়ে আমি তা অনুমান করতে পারি। অথচ মেয়েটা এসব কিছুরই ভ্রুক্ষেপ করে না আজকাল৷ ফোন দিলে ফোন তুলে না৷ তুললেও কথা বলতে চায় না৷ আমাদের দেখা হয় না আজ অনেকদিন। ওর কী হয়েছে আমি সেটাও বুঝতে পারছি না৷ ভীষণ টেনশন হচ্ছে আমার। আমি আবারও মিরাকে ফোন দিলাম। রিং হলো৷ হঠাৎই খট করে একটা শব্দ হয়৷ শব্দটা একদম কলিজায় গিয়ে লাগে৷ একঝাঁক প্রশান্তি ঝেঁকে বসে যেন আমাকে ঘিরে। আমি অস্থির হয়ে বলি,

-কী ব্যাপার। ফোন তুলছো না কেন তুমি? সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি৷ ও খানিকটা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
-দেখেছি। তুলিনি ইচ্ছে করেই৷ পড়ছিলাম৷
-সারাক্ষণ পড় নাকি?
-সন্দেহ করছ?
-তা কখন বললাম?
-তাহলে জানতে চাচ্ছো কেন যে সারাক্ষণ কী করি?
-জানতে চাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?

ও এই প্রশ্নটার জবাব দিল না৷ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। সেই দীর্ঘশ্বাসটা আমার কাছে বড় কষ্টদায়ক লাগল। যেন আমাকে হেয় করা হয়েছে। আমার মনটা কেমন জানি করে উঠল৷ মিরা বলল,

-মেডিক্যাল আমার স্বপ্ন। জানো তো?
-তোমার কোনো স্বপ্নের কথা কি আমার অজানা?
-আমাকে পড়তে হয় সারাক্ষণ।
-বেশি পড়লে মাথা হ্যাং হয়ে যায়। জানো?
-জানি৷ তবে কী করব বলো৷ প্রেশারই কমাতে পারি না।
-আমার বড় হিংসে হয় জানো! তুমি আমার থেকে ওই মেডিক্যালকে গুরুত্ব দাও বেশি। আমার খোঁজই রাখো না।
-রাখি কী করে বলো? আমি আসলে আমার স্বপ্নটা যেকোনো মূল্যে পূরণ করতে চাই। একজন ভালো ডাক্তার হতে চাই। তাই সব ফোকাস সেদিকেই দিচ্ছি৷ তুমি মন খারাপ করো না কেমন?

-এভাবে বললে আমি মন খারাপ করতে পারি?
-বিকেলে একটু দেখা করতে পারবে? আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম৷ এত খুশি লাগল যা বলার মতো না৷ আমি বললাম,
-তুমি কেবল বলো কোথায় দেখা করতে হবে?
-আমরা একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করব। রেড রোজ রেস্টুরেন্ট। ঠিকাছে?
-হ্যাঁ। ঠিকাছে। আমি চলে আসব৷
-আচ্ছা৷ বিকেল চারটা৷ দেরি করা চলবে না৷

আমার আনন্দের সীমা থাকল না৷ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকল আমার৷ কতদিন পর মেয়েটাকে দেখব! আমার বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে৷ শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়৷ আমি প্রচণ্ড আনন্দ অনুভব করি৷ পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমার চারপাশে খেলা করতে থাকে৷ আমি ঘিরে রাখে৷ আমি বেশ ভালো লাগা নিয়েই রেড রোজ রেস্টুরেন্টে গেলাম৷ সময় তখন দুটো৷ বেশ জলদিই গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার অপেক্ষার যেন শেষ হয় না৷ আমি অধীর আগ্রহে আমার প্রিয়তমার অপেক্ষা করি৷ মেয়েটা কখন আসবে? কখন তাকে দেখব আমি। আমার পিপাসু হৃদয় তাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে আছে৷ সময় গড়িয়ে যায়। মিরার দেখা মেলে না৷ চারটা বেজে গেলেও সে আসে না৷ আমি ভীষণ মন খারাপ করি৷ দুপুর থেকে যে ভালো লাগাটা আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা যেন দ্রুতই আমায় ছেড়ে চলে যেতে থাকে। আমি মন খারাপ করে বসে থাকি৷ এমন সময় একটা ফোন আসে। স্ক্রিনে মিরার নাম। আমি দ্রুত ফোন তুলি৷ ওপাশ থেকে মিরা বলে,

-সরি৷ আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি কি আমার হোস্টেলের দিকে আসতে পারবে? আমরা পাশের পার্কে দেখা করব৷
-আচ্ছা আসছি।

আমি সেখান থেকে বেরিয়ে মীরার হোস্টেলের দিকে যেতে থাকলাম। পার্কের ভেতর ঢুকতেই মিরাকে দেখতে পেলাম৷ সে চুপচাপ বসে আছে। মোবাইল টিপছে। আমি প্রাণে যেন পানি এল। আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয় যেন মহানন্দে লাফাতে থাকল। আমার তখন এক অনিন্দ্য অনুভূতি হচ্ছিল৷ অথচ আমার জানা ছিল না সেই অনিন্দ্য অনুভূতি মিরার প্রতি আমার শেষ অনুভূতি ছিল৷ আমি গিয়ে ওর পাশে বসি। বলি,

-এত শুকিয়ে গিয়েছো কেন তুমি? কী হয়েছে?
-এই পড়ার চাপ আরকি।

বাদ দাও৷ তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলার জন্যে ডেকেছি আমি। মন দিয়ে শুনবে। আমাকে ভুল বুঝবে না৷ ঠিকাছে? আমি যেন হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কিছুই বলতে পারলাম না৷ আমার মনের ভেতর তখন কেমন একটা অনুভূতি হলো৷ আমার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই৷ আমার সাথে বেশ খারাপ ধরনের কিছু হবে। মিরা নিজের চুল গুলোকে কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলল,

-তাসফি, আমি আসলে পারছি না৷ এই প্রেমের বোঝা আমি আর নিতে পারছি না৷ একে তো পড়ার চাপ, তার উপর তুমি, তোমাকে সময় দেয়া, কথা বলা, সম্ভব হয়ে উঠে না আমার পক্ষে। বয়ে নিতে পারছি না আর। ইটস ঠু হার্ড ফর মি। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি৷ আমার প্রাণ বায়ু নিয়ে যেন কেউ খেলা করছে৷ আমার মনে হলো আমি মারা যাবো৷ এক অসহ্য যন্ত্রণা আমায় ঘিরে ধরতে শুরু করল। মিরা আবার বলে,

-তুমি আর কত করবে? একজনের পক্ষে একটা সম্পর্ক পরিনতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না। অসম্ভব। তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? সত্যি বলতে আমি একদমই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। একদম নিষ্প্রানের মতো৷ মিরা বলল,

-আমি জানি, আমি কাজটা ঠিক করছি না। কিন্তু আমার কাছে আমার কেরিয়ারটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট তাসফি। আমি তোমাকে কীভাবে বুঝাই বলো৷ আমি চাইছি না আর এই রিলেশন। আমি সব এখানেই থামিয়ে দিতে চাই৷ অনেক হয়েছে। আর না৷ আমরা দেখা করব না আর৷ ফোন করব না৷ সব যায়গা থেকে মুছে ফেলব দুজন দুজনকে। কেমন?
মিরার গলাটাা ভারী শোনাল। আমার বেশ কিছু বলার ইচ্ছে জাগল৷ মনে অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, কেন তাহলে আমার সাথে প্রেম করলে?

তুমি নিজেই তো প্রপোজ করলে। আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলে। কেন? আমার দোষ কি? এখন কেন আমায় চলে যেতে বলছো। কেন? আমার তো একটা হৃদয় আছে৷ আমারও তো কষ্ট হয়৷ কেন এমন করলে? আর মুছে দিতে বলছো? এত সহজ মুছে দেয়া? এটা কোনো সাদা কাগজে কালো কলম দিয়ে লেখা প্রেম নয় যে তুমি চাইলেই ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলতে পারবে। এটা আমার মনের গভীর থাকা কোনো এক নিষ্পাপ পবিত্র অনুভূতি। একে তুমি চাইলেও পৃথিবীর সমস্ত ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলতে পারবে না। সম্ভবই না। এমন অনেক গুলো কথা বলার ছিল আমার। অথচ আমি এর কিছুই বলতে পারছি না৷ পারি না৷ মুখ দিয়েই আসে না৷ আমি যেন কথাই বলতে পারি না। বোবা হয়ে গিয়েছি৷ মিরা আমার হাতের উপর হাত রাখল। বলল,

-নিজেকে ঘুছিয়ে নিও৷ ভালো থেকো৷ আর পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও৷

কি মিস্টি করে একটা সম্পর্কের শেষ করে গেল মেয়েটা। ইশ! যদি এর কষ্ট গুলোও এভাবে মিস্টি করে শেষ করা যেত! কতো ভালোই না হতো৷ মিরা হাঁটতে থাকল সামনের দিকে৷ আমি বেঞ্চিতে বসে মিরার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলাম। মিরা হাত উঁচিয়ে কাউকে ডাকছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম এক সুদর্শন যুবক মিরার দিকে এগিয়ে আসছে৷ তার মুখ ভর্তি হাসি। আমার কষ্টটা যেন আরো বেড়ে গেল৷ তাহলে কি এই কারণ? এর জন্যে আমাদের ব্রেকাপ হয়েছে? আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম বুকের ভেতর প্রচণ্ড বেদনা করছে আমার।

ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অথচ আমি কান্না করতে পারছি না। আমার চোখে জল জমে না। বুকের ভেতরটা কি এক চাপা কষ্টে জ্বলতে থাকে৷ আমি চুপচাপ বসে থাকি৷ অনেকটা সময় বসে থাকি। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যায়। একজন গার্ড এসে আমাকে ডাকতেই আমার চেতনা ফিরে৷ আমি অনেকটা উন্মাদের মতো হয়ে যাই৷ ধীর পাঁয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসি। সমস্ত শরীরের সকল শক্তি যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। হাঁটতেও যেন বড় অনিহা জাগে৷ আমি ফুটপাতের উপর বসে পড়লাম। মনের ভেতর কেমন জানি করছে। আমার দম নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে৷ গাঁ কাঁপতে থাকে। কেমন জানি লাগতে থাকে আমার। তবুও আমার কান্না আসে না৷ আমি কান্না করতে পারি না৷ কান্না করলে একটু যা হালকা লাগত! আমি কোনো মতে বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।

নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানার উপর পড়তেই আমার বুক ফেটে কান্না এলো। আমি বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করতে থাকলাম৷ আমার সকল যন্ত্রণা যেন আমার চোখের জল হয়ে বেরিয়ে এল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার। বুকের কাছে কেবল ধপ ধপ করছিল৷ আমি নিজের হাত দিয়ে বুকের বাঁপাশটায় হাত বুলাতে থাকলাম। ব্যাথা কমে না আমার। ব্যাথা যেন আরো বাড়তে থাকে৷ জ্বলতে থাকে বুকটা। কী অসহনীয় যন্ত্রণা। আমার গা কাঁপতে থাকে৷ আমি কান্না করি ভীষণ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। অসহ্য যন্ত্রণা আমায় গ্রাস করে নেয়৷ আমি প্রেম যন্ত্রণায় ডুব দিতে থাকি। আমার জীবনটা একটু একটু করে নিঃশেষের দিকে যেতে থাকে। আমি আস্তে আস্তে কষ্ট নামক গভীর খাদের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকি৷

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত