মানববন্ধনে গিয়ে কখনো প্রেম হতে শুনেছেন? শুনে থাকলে জানাবেন, না শুনে থাকলে শুনুন। তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির মানববন্ধনে গিয়েছে আব্বু। সকাল থেকে না খাওয়া সে, তারমধ্যে মায়ের কাছে শুনেছি রাত থেকে নাকি তার একশোর উপরে জ্বর। ভার্সিটি থেকে এসেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আব্বু লোকটাকে আমি যতটা ভালবাসি তার চেয়ে বেশি রাগ করি। সারাদিন এটা সেটা যত্নাদি করা লেগেই থাকে। আমি কোনরকম কাপড় টা পাল্টেই টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ছুটলাম।
মা একবারও ডাকলোনা, কারন জানে আমাকে ডেকে লাভ নেই। আর মা ও রেগে ছিল আব্বুর দিকে। সরকার কী ওসব দাবি মানবে? ঘুরে ফিরে তো ওই পারমাণবিক কেন্দ্র হবেই। যাই হোক, আমার মাথায় তখন ওসব কিচ্ছু নেই। প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে হাতেগোনা দশ পনের জনের মত লোক একটা ব্যানার, কয়েকটা প্ল্যাকার্ড আর কিছু গামছা বেধে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বুর মাথার ওপর একেবারে রোদটা পড়েছে। তার অসহায় মুখখানা দেখে আমার কেঁদে দিতেই ইচ্ছে করছিলো। মানববন্ধনে গিয়ে সামনে থেকেই তাকে টানতে টানতে পাশে নিয়ে এলাম ছায়াতে।
পেছন থেকে একজন বলছে, ‘কী ভাই, পালাচ্ছেন নাকি? ‘ আমার উঠলো রাগ, মুখের ওপর বলে দিলাম, কোনদিন পালাতে দেখছেন আব্বুকে? চাইলে তো যুদ্ধ থেকেও ইন্ডিয়া পালাতে পারতো। এটা তো একটা মানববন্ধন। ‘মধ্যবয়সী আংকেল আমার জবাব শুনে থ। বুঝলাম কথাটা একটু ভারি হয়ে গেছে। আব্বু ইশারায় আংকেল কে বলল, ‘মা আমার ক্ষেপেছে, কিছু মনে নিয়েন না কমরেড। ‘ ওভারব্রিজের কোনায় বসে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার বের করলাম। আব্বু বলল,’ মা খাবার আরেকটা ভাগ কর।’ আমি কিছুটা অবাক, কারন আব্বুর সাথের কেউ খাবেনা এখন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য খাবার। আব্বু বলল, ‘ একটা ছেলে আছে ঢাকা ভার্সিটির, এই বয়সে এমন তেজ আজকাল দেখিনা। একাই সেই ভোর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। একটু পল্টন গেছে মিডিয়ার জন্য, এখনি চলে আসবে।’
আমি খাবার ভাগ করে রাখবার পরও আব্বু খেলনা, সে ওই ছেলে আসলে তারপর খাবে। আমি ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি কারন, সাধারণত আব্বু আজকালকার ছেলেদের চেতনা ও আদর্শ নিয়ে সবসময় সন্দিহান থাকেন। কেউ যে বিনা দ্বিধায় বুক চিতিয়ে দেশের জন্য দাঁড়াবে, তেমন পাওয়াই যায়না। ঘন্টা পার হয়ে গেল। আমি রাগে যখন কিছু বলতে যাব, তখন দেখি আব্বুর মুখে হাসি। শেষ কবে তাকে এতটা সন্তুষ্ট হতে দেখেছি মনে পড়েনা। পেছনে তাকিয়ে দেখি, গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা একটা লিকলিকে ছেলে একটা বাইসাইকেলে চড়ে মানববন্ধনের কাছে এসে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলাম, সেও আব্বুকে খুঁজছে। আব্বু দু একবার ডাকলেও সে শুনতে পায়নি গাড়ির শব্দে।
আমি মহাঝামেলায় পড়লাম। বুঝলাম আমাকেই ডেকে আনতে হবে। কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললাম,’ শুনছেন, আব্বু আপনাকে ডাকছে, ওদিকে। একটা ফর্সা ছেলে রোদে পুড়লে যেমন তামাটে ভাব আসে তেমন চেহারা। একটা হাসি দিয়ে বলল,’ কে? আজাদ স্যার?” আমি মাথা নাড়াতেই সে আব্বুকে দূর থেকে দেখে বিদ্যুৎকাকায়াক গতিতে চলে গেল। আমি ফর্সা নই, যতটা বুঝি চেহারাও এমন না ছেলেরা দেখেই হা হয়ে তাকিয়ে থাকবে। তাই বলে, এভাবে একবারও কিছু না বলে, একটুও না তাকিয়ে ছেলেটি যেভাবে চলে গেল তাতে আমার লাগলো খুব। মানুষ সুন্দরের ভক্ত, এটুকু ভেবে সবসময়ের মত সান্ত্বনা দিলাম। খাওয়ার মাঝে আব্বু আর ছেলেটির কথা হচ্ছে, আমি যেন নিস্ক্রিয় দর্শক।’ বুঝলে হেমন্ত, খুব একটা লাভ হচ্ছেনা। প্রকল্পটা হয়েই যাবে। ‘
আব্বু বলে চুপ করে রইলেন। ছেলেটি একটু দেখেই হেসে দিল, বলল’ স্যার, আপনি একথা বলতে পারেন না। রাস্তা অন্য মানুষের কাছে হেটে যাবার জায়গা কিন্তু আমাদের কাছে তো প্রতিবাদের প্রকাশ। প্রজন্ম এসে যদি বলে তোমরা জোয়ান থাকতে কী করেছো, তখন আমরা কি এভাবেই হতাশার কথা বলে বাচতে পারবো?’ আব্বু কি মনে করে একটু হাসলেন, তারপর নিজের হাতে তরকারি ডাল ছেলেটির পাতে তুলে দিলেন। সে খুব আয়েশ করে খেল। হঠাৎ খেয়াল করলাম সে টিফিন ক্যারিয়ারে তার খাবারের অংশটুকুও পুরোটা খাচ্ছেনা। আব্বু জিজ্ঞেস করলো,’ হেমন্ত, পুরোটা নিয়ে নাও। ‘
ছেলেটির বোধহয় হাসিরোগ আছে, একগাল হেসে বলল,’ নটরডেমের একটা ছেলে আসবে, ও খুব দৌড়াদৌড়ি করলো। এসে যদি দেখে আমি এভাবে আব্বু বুঝতে পেরে আমার দিকে তাকালো, এবার তার মনে পড়লো অতি চঞ্চল কন্যা এতক্ষণ গুরু শিষ্য পর্যবেক্ষণ করতে করতে চুপ হয়ে গিয়েছে। আব্বু ছেলেটিকে বলল, হেমন্ত, খাবার যে আনলো তার কথাই তো বললাম না। আমার মেয়ে পদ্মা, ও পড়াশুনা করছে এটুকু বলতেই ছেলেটি আব্বুকে থামিয়ে বলল,’ স্যার, আর বলতে হবে না। আপু লজ্জা পাচ্ছেন। আপাতত আমাদের খাদ্য বিভাগের দায়িত্বে আছেন, এটাই যথেষ্ট। আব্বু আর ছেলেটি হেসে দিল। আমার রাগ হল, আমি কোন কথাই বলতে পারছিলাম লজ্জায়। ছেলেটি তবু নিজ থেকেই বলল,’ আপু, আপনি কাজের কাজ করেছেন। স্যারের শরীর আসলেই ভাল না, তারমধ্যে আবার না খাওয়া। ‘হুট করে একটা ছেলে এসেই বলল,’ হেমন্ত দা, তুমি হলে যাওনি? তোমার শরীর’
হেমন্ত ছেলেটিকে ইশারায় থামিয়ে খাবার দিল, অথচ ছেলেটি হেমন্তের জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে এসেছে বলে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। আব্বু হাত ধুয়ে বলল,’ দেখেছ হেমন্ত, এই তোমাদের পরের প্রজন্ম।’ আব্বু একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কখন চলে গেল টের পেলাম না। হেমন্ত ধীরে ধীরে বাকি খাবার খেতে লাগলো আর আমি তাকিয়েই থাকলাম। এরমধ্যে দুএকবার চোখাচোখি হল, ছেলেটি লজ্জায় চোখ ফেরালো। হাত ধুতে গিয়ে বলল,’ এভাবে তাকিয়ে ছিলেন, আমার অমঙ্গল হবে নাতো?’ আমি বললাম, ‘ আপনি কুসংস্কার মানেন?’
: না, মজা করলাম। রেগে গেলে মজা ফিরিয়ে নিচ্ছি।
– রেগে গেছি, সেটি বা কেন ভাবছেন?
: শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাওয়া আর একইসাথে নাকের নিচে কয়েকফোটা ঘাম রাগের লক্ষন বলেই জেনেছি।
আমি ওড়না দিয়ে মুখ মুছতেই ও আবার হেসে দিল, বলল,
এভাবে অচেনা লোকের কথা শুনেই সব মুছে ফেলবেন না আবার। পরে নিজেকে খুঁজে পাবেন না।’ আমি কিছুটা ভাব নিয়ে বললাম, ‘ আপনি কি দার্শনিক? এত অগ্রিম বোঝা ঠিক না।’ ‘তাহলে গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে যে নিজেকে বেশি লুকিয়ে রাখেন, সেটি বললেও কি অগ্রিম বলা হবে?’ আমি এবার কিছুটা অপমানবোধ থেকে বললাম, ‘ মোটেই ঠিক না’ হেমন্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘ স্যার আপনার কথা প্রায়ই বলে, আপনি যে ওসব ভেবে বিয়ে নিয়ে মন খারাপ করেন তাও বলে। আমি ঠিক না হলে আপনার আব্বাও ভুল।’ আমি আরো লজ্জায় পড়ে গেলাম, আব্বু ছেলেমানুষি করে এসব বলে বেড়াচ্ছে। হেমন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’ কলার মোচার তরকারি টার জন্য আন্টির একটা গিফট পাওনা, আপনাকে ধন্যবাদ অধমকে খাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। ভাল থাকবেন। ‘
বলে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। আমি পেছন থেকে কী মনে করে তাকিয়েই রইলাম আর চাচ্ছিলাম ও যেন না তাকায়। তাহলে হয়তো লজ্জার ষোলআনা পূর্ণ হবে। খেয়াল করলাম নাকের নিচে আবার ফোটা ফোটা ঘাম, যেটা এতদিনেও আমি আবিষ্কার করিনি। রিক্সায় উঠে আব্বুর দিকে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি একজন মুচকি হাসি দিয়ে অবিকল তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারলাম জল আরো গড়াবে, সে গল্প আরেকদিন।