রনি নীলাকে খুব ভালোবাসে। ভার্সিটি লাইফের সেই প্রথম দিন থেকে। ওরিয়েন্টেশান শেষ হতেই ছেলেটি জানতে পারল মেয়েটি তার সাবজেক্টেই ভর্তি হয়েছে। সেই থেকে টিচারের বদলে সারাদিন মেয়েটির মুখ চেয়ে থাকা, তার প্রতিটি কাজ, কথার ভঙ্গি বুভুক্ষের মত গেলা, হাঁসিতে ভেঙ্গে পড়া দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলা…কিন্তু মেয়েটি এসবের কিছুই খেয়াল করেনা। বন্ধু-বান্ধবের চোখ রাঙ্গানিতে একদিন ছেলেটি হঠাৎই এসে ফোন নাম্বার চাইল। মেয়েটিও কিছু না ভেবেই নাম্বারটা দিয়ে দিল।
সে কি জানত সে কোন স্বপ্নের বীজে নিজ হাতে পানি ঢেলে দিল? ফ্রেন্ডশিপ থেকে রিলেশানটা প্রেমের রাস্তায় গড়াতে গিয়ে ভার্সিটি লাইফের ৩ টা বছর পার হয়ে গেল। কত উত্থান-পতন, ঝগড়া, খুনশুটি আর এক গামলা ভালবাসা। এটাই তো হবার ছিল। টিচার থেকে শুরু করে ভার্সিটির দাড়োয়ান, সবাই জানত এই জুটি ভাঙ্গার নয়। অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এর ভীত গড়া হয়েছে। ভুমিকম্প-জলোচ্ছাসেও এই সুখের নীড় টলাতে পারবেনা। উচ্ছাস, হাসি-আনন্দ আর ভালোবাসায় জীবনটা কানায় কানায় ভরে উঠল। ছেলেটির জব হল। মেয়েটি সারাদিন অপেক্ষা করত কখন ভালোবাসার মানুষটা ঘরে ফিরবে।সারাদিন একটু পরপর ফোনে কথা বলা, সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীরেও একটু সময় হাত ধরে ফুটপাতে বসে থাকা।
কাছাকাছি এলাকায় থাকা হতো শুধু এই ভেবে যে একটিবার চাইলেই ছুটে যাওয়া যাবে। কি অসাধারন ভালবাসা বাইরের রূপটাই কি সব? ঠান্ডা মাটি-পানির পৃথিবির ভেতরটা যেমন গনগনে লাভার সমুদ্র, তেমনি ভালোবাসার আবরনের ভেতরেও থাকতে পারে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর নিচু মানসিকতার উদ্দ্যত ফণাওয়ালা সাপ। মেয়েটির বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হল। বাধ্য হয়ে ভালবাসার মানুষটির নাম বলে দিল সে বাবার কাছে। আর ১০ টা মেয়ের চেয়ে একটু আলাদা ছিল সে। তাই বুক ফুলিয়ে ভয়ের পাশ কাটিয়ে ঠিক বলে দিতে পারল। শুরু হল অকথ্য নির্যাতন। গালাগাল থেকে মারধোর রোজকার ব্যপার হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি হঠাৎ এক সকালে ফোন দিয়ে ছেলেটিকে বলল “আমি ঘর ছাড়লে তোমার বুকে ঠাই দেবে?” ছেলেটি বলল “দেব”। এক কাপড়ে ঘর ছাড়ে মেয়েটি। হোস্টেলে এসে ওঠে। তারপর হঠাৎ একদিন ছেলেটির কাছে মেয়েটির মায়ের ফোন এল। জানতে পারল তাকে তিনি কোনদিন মেনে নেবেন না। ছেলেটিও রাগ করে বলে বসল সে তার মেয়েকে বিশ্বাসই করেনা!!!
সেই থেকে ২ দিকের নির্যাতন সইতে হল মেয়েটিকে। মায়ের ভাষ্য “যে ছেলে তোকে বিশ্বাসই করেনা সে তোকে বিয়ে করবেনা” আর প্রেমিকের কথা “তোমার মা তোমার-আমার সম্পর্ক মেনে নেবে না।কি পাবো আমি তোমার ফ্যামিলিতে?” শুরু হল নৈমিত্যিক সংঘর্ষ। অবিশ্বাস আর কথার হুল ফোটানো!! আশ-পাশ থেকে কিছু বন্ধু নামধারী মানুষ যেন সেই যন্ত্রনা আরো বাড়াতেই অবিরত কানের পাশে ফুসমন্তর দিতে থাকে এই বলে “যার সমস্যা তাকে মেটাতে বল। তোমার এত ঠ্যাকা কেন হতে যাবে?” ছেলেটিও ক্রমশ দুরের মানুষে পরিনত হতে থাকে। এখন আর মেয়েটির গোল চোখে সে পূর্নিমা দেখেনা, বোঁচা নাকে সে নাক ঘসেনা। উচ্চতা নিয়ে ক্ষেপানোর জন্য বলেনা “তুমিতো আমার গলায় মালা ই পড়াতে পারবেনা”, আদর করে বুকে টেনে বলেনা “আমার ছোট্ট পাখি”। সব ভালোবাসা কর্পুরের মত উবে যেতে থাকে।
মেয়েটি খুব চাপা স্বভাবের। ঘটা করে কোনদিন বলেনি ভালবাসি, কখনো হুড খোলা রিকশায় জড়িয়ে ধরে গালে চুমু এঁকে দেয়নি। সে ভাবত ছেলেটি ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারে। হাতে হাত রেখে হৃদয়ের স্পন্দনে নিজের নামখানা শুনতে পায়, অগোছালো মেয়েটি শুধু একটি মুখে হাঁসি ফোটাতে শাড়ি-চুড়িতে নিজেকে জড়াতে শিখেছে। শিখেছে কিভাবে হাত পুড়িয়ে লবন না দিয়ে পায়েশ রাধতে হয়। কখনো ভাবেনি ১৫ মিনিটের মাঝে ৫ বারে বাটি হাতে ৫ তলা বেয়ে উঠা-নামায় ছেলেটি ভালবাসা খুঁজে পাবেনা আর, পারবে না ভাবতে সারাদিন অফিস-রোজা শেষে হোস্টেলের ফ্রীজে রাখা ছোট্ট পানির বোতলটি ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দেয়ার পরও তার যত্ন নেয়া হয় কিনা, ছেলেটির জন্মদিনটি আনন্দঘন করে রাখতে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সারাদিন কাঠফাটা রোদে ঘুরে বেড়ানোয় আর ভালবাসার ছোঁয়া পায়না ছেলেটি যোগাযোগ কমতে কমতে এক সময় অনেকটা দূরে সরে যায় দু’জন। তবু কিসের টানে যেন বারবার ফিরে আসা, ফিরে দেখা।
হয়তোবা স্রষ্টার ইচ্ছেতেই ফিরে ফিরে আসা। পহেলা বৈশাখে চুড়ি-ফতুয়া আদান-প্রদান…ঘুরে ফিরে আবার সেই রমজান। কিন্তু আগের মত দেখা করা, একসাথে ইফতারের ইচ্ছেটা আর নেই ছেলেটির মাঝে।থেকে থেকেই ভালোবাসার ফ্রিকোয়েন্সি হারিয়ে ফেলে সে। ধরে রাখাটা যেন আজ বড্ড কঠিন। ভালোলাগাগুলো কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া অস্পৃস্ম আবেগ। ঈদ-উল-ফিতরের পরদিন মেয়েটি ছেলেটিকে কল দিল। কেন যেন সে খুব ব্যাস্ত। কথা বলারই সময় নেই তার। এক দুই কথায় আবার সেই পুরোনো নোংরা ঝগড়া। কি পাব কি পেয়েছির হিসেব নিকেশের ধুম্রজালে মেয়েটি দিশেহারা । তবু শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ছেলেটি যেন অটল পাহাড়। কিছুতেই খুশি হবেনা পণ করেছে। হাল ছেড়ে দিল মেয়েটি।
এতদিনের স্বপ্ন কি এভাবে নিঃশেষ হতে দেয়া যায়? কিছুদিন পরই ছেলেটির জন্মদিন। ঘুরে ফিরে ১ বছর কিভাবে পার হয়ে গেল। অনেক ভেবে মেয়েটি সারপ্রাইজ দেবে ঠিক করল। নিজেদের সাজানো স্বপ্নের বাগানে ঘুরে-ফেরার দিনগুলোর সব ছবি এক করে একটা এলবাম বানিয়ে ছেলেটিকে গিফট করে সে। অনেক আশা মনে নিয়ে। হয়তো পুরোনো দিনগুলো আবার নতুন করে জীবন ফিরে পাবে। আবার হাত ধরে মনের কথা পড়তে পারবে সে।
কিছুতেই কিছু হলনা। ভালবাসা নতুন করে রঙ ছড়ালো না। বরং সব রঙ শুষে নিয়ে মেয়েটির জীবনটা রঙহীন করে দিল। ছেলেটি বিয়ে করেছে, মেয়েটিকে না জানিয়ে!!! কি ভেবেছিল ছেলেটি? মেয়েটি তার নতুন স্বপ্নে বাধ সাধবে? নাকি নির্লজ্জ বেঈমানিটা সরল মেয়েটি বুঝতে পারার আগেই সব পথ বন্ধ করে দেবার ধান্দা ছিল সেটা? আজ মেয়েটির কি অবশিষ্ট রইল? হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার বিনিময়ে শুধু রক্তাক্ত হওয়াই ছিল ভাগ্যের লিখন? আজ তার সবই আছে। বাবা-মার দোয়া, চাকুরী, থাকার জন্য নিজের বাসা। কিন্তু হৃদয়ের শুণ্যতা কি ঘুচেছে?
পেরেছে ৭ বছরের সব স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে নতুন করে শুরু করতে? পারেনি…