ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঘন্টা টা অনবরত বেজেই চলেছে। যার অর্থ প্যারেড টাইম। বেল বাজার ১৫ মিনিটের ভিতর প্যারেড শুরু হবে। ঘুমের ভিতরেই প্রায় মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি আজ ডিউটি ক্যাডেট। যার অর্থ কমপক্ষে ২০ জন সিনিয়র ভাইয়ের মেটাল ব্যাজ পলিশ, সু পলিশের ব্যবস্থা আমাকে করা লাগবে। সেগুলো তো দূরে থাক, আমার নিজের সু পলিশই ক…রা হয়নি। তাছাড়া ক্লাস 11 এবং 12 এর সিনিয়রদের ঘুম থেকে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। কিছুই হলোনা…আজ নির্ঘাত আমার কেয়ামত। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম বিছানা থেকে। উঠেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কোথায় আমার কাবার্ড, কোথায় আমার টেবিল ! কিচ্ছু নাই। সামনে শুধু একটা বাচ্চা ছেলে স্টীলের প্লেট আর চামচ নিয়ে শব্দ করছে আর জিব্বা কামড়ে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। মাথাটা দুদিকে দু’বার সজোরে ঝাকুনি দিতেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল।
আমি আসলে আমার বাসায়। গতকালই ভ্যাকেশানে এসেছি। আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিচ্চি আমার ছোটভাই। হাইব্রিড প্রজাতির বিচ্ছু। ইচ্ছা হলো কানের নিচে দুটা বসিয়ে দেই। কিন্তু ওর কাছে যে অস্ত্র আছে তা আরো ভয়ঙ্কর। তারস্বরে চিৎকার করে “আম্মুউউ…” বলে কেঁদে উঠবে। ব্যাস…আমার কেয়ামত। তাই অনেক কষ্টে রাগটাকে দমন করলাম।
-কি হয়েছে রে?
-পাশের বাসার আন্তি এতেতে…
-আন্তি কি রে? আন্টি বলতে পারিস না?
-নাআআ…আন্তি এতেতে…তোমাকে দাকে… বলেই একদৌড়ে চলে গেল।
পাশের বাসার কোন আন্টি আবার এসেছেন আল্লাহ মাবুদ জানেন। সকালবেলা বাসায় কোন গেস্ট আমি সহ্য করতে পারিনা। সেটা আমার খাদ্যাভাসের কারনে। ব্রেকফাস্টটা সাধারণত আমি ড্রয়িং রুমে টিভি ছেড়ে দিয়ে মনের সুখে করতে অভ্যস্ত। তাছাড়া ব্রেকফাস্টে আমার খাবার আইটেমের বৈচিত্রতা দেখে সবাই বেশ বাঁকা চোখে তাকায়। নাম না জানা এই আন্টির হঠাৎ আগমনে তাই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলাম। যদিও এই সময়টাকে ঠিক সকাল বলে চালানো যায় না। প্রায় বারোটা বাজে। কলেজ থেকে বাসায় আসলে এই একটা সমস্যা হয়। বেলা করে ঘুম থেকে ওঠাটাকে নাগরিক অধিকার বলে মনে হয়। কিন্তু কি আর করা…আন্টি আমার নাগরিক অধিকার সম্পর্কে অবগত নন। তাছাড়া বেচারি নাকি ঘন্টা দুয়েক হয়ে গেল এসেছেন। অস্বস্তিকর বিলম্বিত ব্রেকফাস্ট সেরে ড্রয়িংরুমে হাজির হলাম।
যে আন্টিটা বসে আছেন তাকেই সবচেয়ে কম এক্সপেক্ট করেছিলাম। আন্টি তার মেজো মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন। বিরক্তি এবং ভয়ের একটা মিশ্র অনুভূতি হল। বিরক্তির কারন এই পরিবারকে আমি দু’চোখে দেখতে পারিনা।আমাদের পাড়ার একমাত্র ছোট মাঠটা এদের বাসার পাশেই। খেলতে গিয়ে এযাবৎকাল যে সকল বল এই বাসার চারদেয়ালের ভিতর ঢুকেছে তারা আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেনি। একজন কিশোরের কাছে একটা পরিবারকে বিরক্ত লাগতে এই একটা কারনই যথেষ্ট। আর আমার ভয়ের কারণটা হলো তার মেজো মেয়ের উপস্থিতি। এই মেয়ে ক্লাস সিক্স নাকি সেভেনে যেন পড়ে। একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে একজন মায়ের আরেকটা উঠতি বয়সের ছেলের বাসায় চলে আসা, এই ব্যাপারটায় খানিকটা বিচার-শালিসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। যদিও আমি নিতান্তই ভদ্র ছেলে। মেয়েঘটিত কোন ব্যাপারে কোনকালেই ছিলাম না।
যা হোক, আমার নিকট তাদের আগমনের কারণ সমূদয় বিস্তারিত জানলাম। সমস্যাটা সংক্ষেপে এরকম যে, এই মেয়ে এ বছর ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছে। কলেজে প্রথম টার্ম কাটিয়ে এসেছে। ক্যাডেট কলেজের বিভিন্ন নিয়ম কানুন, কঠিন শিডিউল, পানিশমেন্ট সব দেখে সে ভয়ানকভাবে আতঙ্কিত। সে আর ঐ জাহান্নামে ফিরে যেতে চায় না। মেয়ের বাবা-মা এটা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। অত্র এলাকায় ক্যাডেট বলতে আর আমিই আছি। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো “ক্যাডেট কলেজ অতীব সুখের স্থান” এই ব্যাপারটা মেয়ের মগজে ইন্সটল করে দেয়া। আপাতত আমাকে এই দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমাদের মাতাগন পাশের কক্ষে মেয়েলি আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আমি তখন পড়ি নবম শ্রেনীতে। আর এই মেয়ে সপ্তম শ্রেনী।বলে রাখা ভাল ক্যাডেট কলেজের হিসাবে দুই বছরের ব্যাবধান একটা জেনারেশান ব্যাবধানের সমান। তার উপর আবার মেয়ে। আমি ব্যাপকভাবে অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কি বলার আছে আমার… “ক্যাডেট কলেজ অতীব সুখের স্থান” এর স্বপক্ষে আমার কোন যুক্তি নেই। সত্যি বলতে এখনো আমার পিঠে সিনিয়র ভাইয়ের ক্রসবেল্ট দিয়ে পিটানোর চিহ্ন আছে। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমিও পানিশমেন্ট ব্যাপারটার পক্ষে। যা হোক, হালকা পাতলা যে লেকচার আমি এই মেয়েকে দিলাম তার শিরোনাম দিলে দাঁড়াবে “ক্যাডেট কলেজ জীবনে পানিশমেন্টের উপকারিতা এবং জুনিয়র সাইজ করার ১০১ টি অব্যার্থ উপায়”।
এই মেয়ে কি বুঝেছিল জানিনা। কিন্তু সে কলেজে ফিরে গিয়েছিল এবং শুনেছি পরবর্তীতে সিনিয়র হবার পর জুনিয়র মহলে সে ছিল মূর্তমান আতঙ্ক। আতঙ্কময়ী এই মেয়ের নাম অন্তি। আমার পরবর্তী জীবনটা অন্তি নামক এই কাঠিন্য এবং মায়ার অদ্ভূত সংমিশ্রনে গড়া মেয়েটাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেন জীবনের মূল যে চ্যালেঞ্জ সেটা হলো “ডাইনিং হল ম্যানারস”। কলেজের প্রথম রাতটাই শুরু হয় ফর্ক এবং স্পুনের কঠিন ধ্বস্তাধ্বস্তি সংঘর্ষ করে খাওয়া দাওয়া শেখার মধ্য দিয়ে। দিন যত যায়, নিয়ম কানুন ততই বাড়তে থাকে। ক্লাস সেভেনে পানিশমেন্টের আশি ভাগ কারনগুলো হয় ডাইনিং হল সংক্রান্ত। ক্লাস এইটে উঠলে এই নিয়মগুলো কিছুটা শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু ক্লাস এইট জীবন ক্যাডেট কলেজের ছ’বছর জীবনকালের সবচেয়ে কঠিন বছর। এই সময় নিজের ভুলের জন্য তো অবশ্যই, জুনিয়রদের ভুলের জন্যও পানিশমেন্ট খেতে হয়। ক্লাস সেভেনের উপর কলেজ কর্তৃপক্ষের কিছুটা সহানুভূতি থাকে, ক্লাস এইটের উপর সেটাও থাকে না। সবমিলিয়ে ক্লাস এইটের একজন ক্যাডেটের সাথে রবীন্দ্রনাথের “ছুটি” গল্পের ফটিকের বৈশিষ্ট সম্পূর্ন মিলে যায়। এ সময় একজন ক্যাডেট “ক্লাস সেভেন” নামক ছোট বাচ্চার তকমাটাও হারায় আবার “ সিনিয়রিটি” নামক যা ইচ্ছা তাই করার গ্রীনকার্ডটাও পায় না। তারা থাকে সবার চক্ষুশূল। আর নবম শ্রেনী জীবন সবচেয়ে টেনশানমুক্ত। এই বছর পার হয়ে যায় চৌর্য্যবৃত্তি শিখতে। কলেজের আম,জাম,কাঁঠাল চুরি করা, স্যারকে নিকনেম দেওয়া, স্টাফদের দাবড়ানি খাওয়া এসবের মধ্য দিয়ে।
দিন যায়, দিন আসে। টার্ম যায়, টার্ম আসে। জীবনটা চলছিল একটা সরলরেখা ধরেই। কলেজের দিনগুলো খুব উত্তেজনাপূর্ন কাটত। সারাবছর লেগে থাকা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, আম-কাঁঠাল চুরি করা, সবাইকে ধোকা দিয়ে মাঝে মাঝে পিটি-প্যারেড ডজ দেওয়া, লাইটস অফ আওয়ারের পর জানালায় কম্বল টানিয়ে লাইট জ্বালিয়ে পড়ালেখার নামে গবেষনাধর্মী আড্ডা, অতঃপর ধরা খেয়ে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে রোলিং,ক্রলিং ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তেজনার কোন না কোন উপকরণ ক্যাডেট কলেজ নামক এই চার দেয়াল ঘেরা জায়গাটায় সবসময় থাকে।
সারাটা টার্ম অপেক্ষা করে থাকতাম কবে ছুটি হবে, কবে এই কারাগার ছেড়ে বাড়ি যাব। অবশেষে একটা টার্ম শেষ করে যখন বাড়িতে আসতাম, তখন সবকিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগত। আমার ছোট্ট শহরটায় আমার বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই। মাঝে মাঝে শুধু অন্তি নামের জুনিয়র মেয়েটা ফিজিক্স কিংবা ম্যাথ বুঝতে চলে আসত বাসায়। আমি কোন আইনস্টাইন কিংবা ইউক্লিড নই যে তাকে এসব বুঝাবো। এসব আমার নিজের মাথায়ই ঢুকে না। তার বদলে আমি অন্তিকে আমার কলেজের কাহিনী শোনাতাম। কিভাবে নাইটগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে একব্যাগ আম চুরি করলাম, কিভাবে গম্ভীর ম্যাথ টিচারের সাইকেলের চাকা পাঙ্কচার করে দিলাম সেসব বীরত্বের কাহিনী।
এসব কাহিনী ওকে আকর্ষন করছে কিনা ঠিক বুঝতে পারতাম না। তবুও বলে যেতাম। বলতে ভালো লাগত। মেয়েটাও বুঝতে পেরেছিল এই ছেলের কাছে ম্যাথ বুঝতে যাওয়া অর্থহীন। তবুও ছুটির দিনগুলো একটা বই হাতে করে চলে আসতো বাসায়। আমার বীরত্বগাঁথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে সেও তার কলেজের কাহিনী কিছু কিছু বলত। একসময় খেয়াল করলাম একটা ছেলে বন্ধুর সমান না হলেও একটা ভ্যাকেশান ফ্রেন্ড হিসাবে অন্তি বিশেষ খারাপ না। ভালোই।
ভ্যাকেশান শেষ করে আবার কলেজে ফিরে যাওয়া অবশ্যই একজন ক্যাডেটের জীবনে একটা অপরিসীম দুঃখময় একটা কাজ যা তাকে ছয় বছরে কমবেশি ২৫ বার করা লাগে। কিন্তু দুঃখটা ব্যাগ চেকিং পর্যন্তই। ব্যাগটা টেনে হাউসে ওঠা মাত্রই বন্ধুদের সংস্পর্শে আড্ডায় সব ভুলে যেতাম। আস্তে আস্তে আবার ফিরে যেতাম রোবটিক রুটিনমাফিক কাজকর্মে।
ক্যাডেট কলেজের রাতগুলো খুব মূল্যবান। পৌনে এগারোটায় প্রতিটা রুমের লাইট অফ করা বাধ্যতামূলক। ঘুম আসুক বা না আসুক, বেডে শুয়ে থাকা বাধ্যতামূলক। রাতের বেলা নিজস্ব আবেগগুলো হৃদয়ের ডানা মেলতে শুরু করে। খুব নিঃসঙ্গ লাগে তখন। আমি হাবাগোবা মানুষ। আমার এসব নিজস্ব আবেগ বলতে তেমন কিছু নাই। হাবাগোবা মানুষ ঘুমায় খুব তাড়াতাড়ি। আমি শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যেতাম।
সমস্যাটা শুরু হলো এসএসসি পরীক্ষার দু’মাস আগে থেকে। আগের মত শোয়ার সাথে সাথে ঘুম আসত না। কোন এক কারনে অন্তি নামক ভাবলেশহীন ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়তো। ফিজিক্স বা ম্যাথ বই খুললেই খুব সহজে এক-দেড় ঘন্টা সময় কেটে যেত এই মেয়েকে নিয়ে ভেবে। অবাক হয়ে একদিন খেয়াল করলাম আমি আমার বইয়ের পিছনের কাভারে আনমনে ১০-১২ বার অন্তি নামটা লিখে ফেলেছি।
অবশ্য এটা অন্যদের প্রভাবেও হতে পারে। আমার দু’জন ক্লোজ ফ্রেন্ড সদ্য রিলেশানে ইনভলভড হয়েছে। তাদের প্রেমকাহিনী শুনতে শুনতে এই প্রতিক্রিয়া হয়তো। বইয়ে নাম লেখা ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবে অভ্রর প্রভাব। অভ্রর যে মেয়েটার সাথে রিলেশান, তার নামের অদ্যাক্ষর “S”. অভ্র তার চেয়ার-টেবিল, বেড, কাবার্ড, প্রতিটা বই এমনকি টেবিল টেনিস ব্যাটেও ডিজাইন করে “S” লিখে রাখে।
যদিও জানতাম প্রেম ব্যাপারটা আমার দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। প্রেম করতে হলে প্রপোজ করা লাগে। আর সেটার জন্য সাহস লাগে। এই সাহস থাকে শুধুমাত্র অসাধারন ছেলেদের। আমি ভীতু এবং সাধারন একটা ছেলে। তবুও কিভাবে কিভাবে একসময় সম্ভব হয়ে যায়। সেখানেই আমার সর্বনাশের শুরু।
কিছু কিছু সময় প্রিয় কোন মানুষের উপস্থিতির থেকে তার অনুপস্থিতিটাই তার অস্ত্বিত্বকে প্রকটভাবে জানান দেয়।আমার ক্ষেত্রেও এটা ঘটল। এস.এস.সি পরবর্তীকালীন তিন মাস ছুটিতে। অন্তি মেয়েটা যে আমার জীবনে বিশেষ কিছু, সে বিষয়ে আমার সকল সন্দেহ দূরীভূত হয়ে গেল এই তিন মাসে। আমি ছুটিতে থাকলেও অন্তি তখন কলেজে। আমি আগেই বলেছি, আমার ছোট শহরটায় আমার তেমন কোন বন্ধু নেই। আর তখন সেল ফোন কিংবা সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোও কিশোর-কিশোরীদের হাতের নাগালে এত বিস্তৃতভাবে ছিল না।
অন্তির শূন্যতাটা প্রকটভাবে অনুভব করতে লাগলাম। সারাদিন বারান্দায় বসে পাশের গাছে চড়ুই পাখিটার অস্থির উড়াউড়ি দেখতাম, ছাদে দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তে সবুজ সরলরেখার পিছনে ক্লান্ত লাল সূর্যটাকে হারিয়ে যেতে দেখতাম। শুনেছি চিড়িয়াখানার জন্তুদেরকে মুক্ত করে দিলেও তারা চিড়িয়াখানায় ফিরে যেতে চায়। আমার মন চলে যেত চারদেয়ালের গতবাঁধা ঐ জীবনটায়, সবুজ সমতল কার্পেটের মত ঐ মাঠটায়, ক্লান্তিহীন ঐ ব্যাস্ততায়।
মনের শূন্যতাটুকু কাটাতে একটা কাজ করতাম। প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখতাম কল্পনার অন্তিকে। চিঠিগুলো আমার ড্রয়ারেই রয়ে যেত। একটা চিঠি যত্ন করে খামে ভরে রেখেছিলাম ওকে পাঠাবো বলে। সাহস হয়ে ওঠেনি। ক্যাডেট কলেজে সকল চিঠি ডেলিভারির আগে পড়ে দেখা হয়। অন্তি সমস্যায় পড়ে যাবে। চিঠিটা কখনো পাঠানো হয়নি। কিন্তু এই চিঠি সে পড়েছিল। আমার বইয়ের ভিতর থেকে দূর্ঘটনাক্রমে পেয়ে গিয়েছিল। সে আরেক ইতিহাস। ওর এক বান্ধবীর কাছে পরে শুনেছিলাম এই চিঠি প্রতিদিন সে বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমাতে যেত। সেটা অনেক পরের কাহিনী।
আড়াই মাস কচ্ছপের গতিতে কেটে গেল। অন্তিও বাসায় এল। আবার সবকিছুতে প্রান খুজে পেলাম। এর মাঝে আমার রেজাল্ট হল। বেশ ভাল রেজাল্ট করলাম। আমার রেজাল্টে আমার থেকেও অন্তির খুশি ছিল অনেক বেশি। বাকি দিনগুলো স্বপ্নের মত সুন্দর কাটল। এবং খুব দ্রুত কাটল। ফিরে যাবার দিন চলে এল। যাবার আগে শেষ যখন দেখা হল খুব খারাপ লাগছিল। নিজেকে নিজেকে অবাক করে দিয়ে ওর এক গালে হাত রেখে বলেছিলাম “ভালো থাকিস, পিচ্চি”। ও মাথা নিচু করে শুধু বলেছিল “আমি পিচ্চি না”। ফার্স্ট ইয়ার এবং সেকেন্ড ইয়ার সময়টা খুব তাড়াতাড়ি কেটেছে। জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ন দু’টা বছর এভাবে চোখের পলকে কেটে যাবে ভাবিনি। যত দিন গিয়েছে, অন্তির সাথে আমার আত্মিক বন্ধনতা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। এতটাই বেশি যে, আমাদের কাছে তখন আপনি, তুমি, তুই সব ডাক মিলে মিশে একাকার। কিন্তু সম্পর্কটাকে তখনো আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। হয়তোবা চাইনি।
একটা সময় আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। অন্তিকে বার্থডে উইশ করতে কলেজ দেয়াল টপকে বাইরের ফোন-বুথ থেকে দোকানদারকে অন্তির বাবা সাজিয়ে ফোন করেছিলাম ওর কলেজে। ঐতিহাসিক ব্যাপার স্যাপার। আমি এদিক থেকে কন্ঠটাকে মধুমার্কা রোমান্টিক করে বলছি “ হ্যাপি বার্থডে, পিচ্চি”। আর ওদিক থেকে স্যারের ফোনে থাকা অন্তি বিস্ময় আর উচ্ছ্বাসভরা কন্ঠে বলছে “জ্বী আব্বু, জী আব্বু”।
একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো। ক্যাডেট কলেজের দেয়াল টপকানোর শাস্তি জেলখানার দেয়াল টপকানো থেকেও ভয়াবহ। আক্ষরিক অর্থে। তখন আমার এইচ,এস,সি পরীক্ষা চলছে। পরদিন জুয়োলজি পরীক্ষা। কেঁচো, ব্যাঙ, তেলাপোকা কোনটার জানি পোষ্টিকতন্ত্র পড়ছি ব্যাপক মনোযোগের সহিত। হঠাৎ হাউস অফিসে ডাক পড়লো। হাউস টিউটর স্যার ডাকছেন। গিয়ে দেখি একটা চিঠি হাতে তিনি বসে আছেন ভাব গাম্ভীর্যের সাথে। আমাকে দেখিয়ে বললেন… “এটা কার চিঠি?”
আমি পড়ে গেলাম মহা টেনশানে। কলেজের ছ’বছরের জীবনে প্রতি সপ্তাহে রুটিনমাফিক একটা চিঠি আমি বাসায় লিখেছি। কিন্তু বাবা-মা কেউ একটারও উত্তর দেননি। চিঠি লেখা ব্যাপারটা তাদের কাছে ফাজলামো মনে হয়। আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম… “ স্যার চিঠি তো আপনার হাতে”।
-অন্তি কে?
আমি বুঝতে পারলাম কেয়ামত আসন্ন। শুরু হয়ে গেল আমার অগ্নিপরীক্ষা। একজন আদর্শ ক্যাডেটের অন্যতম প্রধান গুনাবলির মাঝে একটা হলো “ভাবলেশহীনভাবে অনবরত মিথ্যা বলা”। আমি আদর্শ ক্যাডেট না হলেও এই গুন আমার মাঝে ভালোভাবেই ছিল।
-স্যার আমার ছোট বোন।
-আপন নাকি খালাতো মামাতো?
-আপন স্যার?
-তোমরা কয় ভাই বোন।
-দুই ভাই এক বোন স্যার…
-কে কোন ক্লাসে পড়ে…
ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়তে লাগলেন। আমি চৌকশ খেলোয়াড়ের মত মোকাবিলা করলাম। আধা ঘন্টা পর চিঠি হাতে বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন করলাম। অন্তি তখন ওর এসএসসি’র ছুটিতে ছিল। আমার রোগে হয়ত ওকেও পেয়েছিল। ঐ চিঠিটা আমার সারা জীবনে পাওয়া হাতে লেখা একমাত্র চিঠি। এই চিঠি আমি পরবর্তীতে হাজারবার পড়েছি। প্রতিবারই প্রচন্ড আবেগপ্রবন হয়ে গিয়েছি। চিঠির শেষ লাইনগুলো ছিল “তুই কবে আসবি অনিক? তোকে প্রচন্ড দেখতে ইচ্ছা করে। তোর জন্য কত কথা জমিয়ে রেখেছি…তুই কবে আসবি আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পর আমার আর অন্তির সম্পর্কটা নতুন মাত্রা পেল। ও দু-আড়াই মাস পর পর বাসায় আসে। ১৫-২০ দিন আমাকে অপরিসীম ভালোবাসায় সিক্ত করে আবার উড়াল দেয়। মধ্য যুগীয় ব্যাপার স্যাপার। আমাদের এই ব্যাপারটাকে প্রেম বলা যায় কিনা জানিনা, “প্রেম” শব্দটার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে ভালোবাসা অবশ্যই বলা যায়, ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না আমাদের।
ও যতদিন কলেজে থাকে, প্রতিদিন আমি ওর ফেইসবুক একাউন্টে সুদীর্ঘ একেকটা মেইল পাঠাতাম। ছুটিতে এসে ও সবগুলো একবারে পড়ে। মাঝে মাঝে কি মনে হয়, আনাড়ি হাতে ওর ছবি আঁকি। ছবিগুলো কার্টুন লেভেলেই থেকে যায়। আমার হাস্যকর ছবিগুলো দেখেও ও অনেক খুশি হয়। ভালোবাসাটা ঠিক প্রকাশ করার মতো না। ওর অভাবটা যত অনুভব করি, ভালোবাসা ততই বাড়ে। ওর একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতে পারি।
সাধারণত আমার ভার্সিটির ছুটি আর ওর ছুটি একসময়ে পড়ে না। ও যখন বাসায় আসে তখন তাই আমি থাকি না। তবুও ও বাসায় আসলে সেলফোনযোগেই আমার ছন্নছাড়া জীবনটাকে সিধা বানিয়ে দেয়। ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, ক্লাস, গোসল, ঘুমাতে যাওয়া সবকিছু বাধ্য ছেলের মত সময়মত করি এই মেয়ের শাসনে। ছেলেরা জীবনসঙ্গিনীর মাঝে নিজের মায়ের ছায়া খুঁজে। অন্তি স্বভাবগত দিক দিয়ে আমার মায়ের কার্বন কপি।
ওর ছুটি থাকাকালীন দু’দিনের জন্য বাসায় আসি। এই দু’দিন দুজনে প্রায় আঁঠার মত লেগে থাকি। অন্তি তার জমিয়ে রাখা সব গল্প করে চোখ বড় বড় করে। আমি শুধু অবাক হয়ে চেয়ে দেখি। একটা হাসির কথা বলি। আমার মাঝে মাঝে ওকে পরী মনে হয়। একটা মানবীর চোখ এত সুন্দর হয় কিভাবে ! ওর বাচ্চার মত ছোট ছোট হাতগুলো নেড়ে নেড়ে কথা বলা দেখি। কি বলছে জানিনা, বলছে এটাই বড় কথা। সমস্যা হয় কথা শেষ করবার পর। যখন বুঝতে পারে আমি ওর কথা না শুনে শুধু ওকেই দেখছি, প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জা ঢাকতে শুরু করে দস্যিপনা। আমার চুল-নাক-কান ধরে টানাটানি।
চলে আসার সময়টা খুব কষ্টের। বিবর্ণ ময়লাটে সাদা দোতলাটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার পিচ্চি রাজকন্যাটা আমার প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে। ওর একেক ফোটা অশ্রুবিন্দু আমার বুকে একেকটা তীর হয়ে বিঁধে। নিজের পা দুটোকে অসম্ভব ভারী লাগে। বিদায় সবসময় কেন এত কষ্টের?
অন্তি যখন এইচ,এস,সি দ্বিতীয় বর্ষে তখন হঠাৎ ওর বাবা মারা যান। বাবার প্রচন্ড আদুরে মেয়ে অন্তি। বাবার মৃত্যুর পর শোকে অন্তি অনেকটা জড় পদার্থের মত হয়ে যায়। ওর সাথে যে ক’বার দেখা হয়েছে, ওর চোখে ভয়ঙ্কর শূন্যতা দেখেছি। কোন আনন্দ নয়, কোন উচ্ছ্বাস নয়, দুঃখ-কষ্ট, ভয় কোন পার্থিব আবেগ ছিল না চোখদুটোতে। শুধু গভীর এক শূন্যতা। আমি অনেক চেষ্টা করি ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে। হয়তোবা শূন্যস্থানটা সে আমাকে পূরণ করতে দিচে পারেনি। বুঝলাম ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে।
অবশেষে ঘটনাটা ঘটল। আজ থেকে ঠিক এক বছর সাত মাস এগারো দিন আগে। ও তখন কলেজ পাস-আউট করেছে। সেদিন ছুটির দিন বলেই স্বভাবগতভাবে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। সেল ফোন চেক করে দেখি ইনবক্সে টেক্সট মেসেজ। “জানিনা আমি ক্ষমার যোগ্য কিনা, পারলে ক্ষমা করিস। আর না পারলে আল্লাহ আখিরাতে আমাকে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিব। ভালো থাকিস…সবসময়”।
প্রথমে ভাবলাম কোন ধরনের প্র্যাকটকাল জোক। ওর নম্বরে ফোন করলাম। বন্ধ পেলাম। ওর যতগুলো নম্বর আমার কাছে ছিল সবগুলোতে চেষ্টা করলাম। সবগুলোই বন্ধ। এক ঘন্টা, দু ঘন্টা করে পুরো একটা দিন চলে গেল। আমার মাথা খারাপ হবার উপক্রম। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোও চেক করলাম। কোন আপডেট নেই। অবশেষে না পেরে ক্লাস ল্যাবের খেতা পুড়ে ভোরের ট্রেন ধরে চলে এলাম বাসায়।
কলোনীর মানুষগুলো কেউই ঠিকমত কিছু বলতে পারছিল না।কেউ বলছিল ওর আম্মু ওদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেন, কেউ বলছিল শ্বশুরবাড়ি। আবার অনেকে অন্য কথাও বলছিল। যার কোনটাই সঠিক নয়। আমি সপ্তাহখানেক বাসায় ছিলাম। ওদের বাসার সামনে মাঠটায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। বারান্দাটা বড় শূন্য শূন্য লাগত। পৃথিবীটাই শূন্য লাগতো। এক সপ্তাহ পর ঐ বাড়িতে নতুন পরিবার উঠল।আমি ফিরে গেলাম আমার ভার্সিটিতে। সেই গতানুগতিক জীবনে।
অন্তি চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমি আমার জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছি এই মেয়েকে নিয়ে ভেবে। আমাদের স্মৃতিগুলো কাগজবন্দী করলে ছোটখাটো এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে যাবার কথা। রাতগুলো প্রচন্ড কষ্টের ছিল।মনকে অযথা প্রবোধ দিতাম, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই একদিন কখনো আসে না। এসএমএস আর কল রেকর্ডগুলো শুনতাম আর নিজের অজান্তে অশ্রু বিসর্জন দিতাম।
দিন যেতে থাকল…খুব চেষ্টা করলাম অন্তিকে ভুলতে। মনকে বুঝালাম, ও আমাকে ভালবাসলে এভাবে যেতে পারত না। ফেসবুকে “চলে গেছ তাতে কি, নতুন একটা পেয়েছি” কিংবা “I don’t care you love me or not, I love u forever.” টাইপ স্ট্যাটাস দিলাম কিছুদিন। দু’একটা এফেয়ারও করলাম।
কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে বাঁচতে হবে, এবং অন্তিকে নিয়ে। ছ’মাস খোজার পর তার হদিস মিললো। ঢাকার স্বনামধন্য একটা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। ওর এক এয়ারফোর্স অফিসার দুঃসম্পর্কের কাজিনের সাথে নাকি বিয়েও ঠিক হয়েছে। ফোর্স থেকে ছেলেটা আগামী বছর বিয়ের পারমিশান পেলেই বিয়ে হবে।
এই মুহূর্তে ওর হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আজ পহেলা বৈশাখ। জানি ও বাইরে বের হবেই। শেষ কিছু বোঝাপড়া রয়ে গেছে। মিটিয়ে নিতে হবে। অন্তির দেখা মিলেছে। আমি আর সে এখন বসে আছি জিয়া উদ্যানের একটা বেঞ্চের উপর। আমাকে দেখার পর প্রচন্ড অবাক হয়েছিল ও। কিন্তু কোন কথা বলেনি। আমি শুধু একটা শব্দ বলেছি… “চল”। ওর মুখের দিকে চেয়ে আছি। ও মাথা নিচু করে বসে আছে। চেহারায় পাকাপাকিভাবে একটা কাঠিন্যের ছাপ পড়ে গেছে। এছাড়া তেমন কোন পরিবর্তন নেই। হাতের আঙ্গুলগুলো তেমন পিচ্চি পিচ্চিই আছে। গালগুলো তেমন ফোলা ফোলাই আছে। চোখজোড়া এখনো ততটাই গভীর। আমিই নিরবতা ভাঙ্গলাম…
-ড্রাইভার সাহেব কেমন গাড়ি চালায় ? আমার প্রশ্ন শুনে ও বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি আবার বললাম…
-প্রশ্ন বুঝিস নাই? ড্রাইভার সাহেব কেমন গাড়ি চালায়? লাইসেন্স টাইসেন্স আছে তো? এবার মনে হয় বুঝল।
-ড্রাইভার না পাইলট।
-ঐ হলো। রিকশাচালকও ড্রাইভার, প্লেন চালকও ড্রাইভার। একই কাহিনী।
-ফালতু কথা বলবা না।
-এহ ! পজেসিভ খুব না? আমার সাথে তো কখনো এরকম ছিলি বলে মনে পড়ে না।
-তোমার সাথে আমার পজেসিভ হবার মত কিছু ছিল না।
-থাপ্পড় দিয়ে দাঁত খুলে নিব ২-৪ টা। আমি তোর “তুমি” কবে ছিলাম রে? তুমি তুমি করতেছিস কেন? মেয়ে চুপ।
-আর ড্রাইভার রে নিয়া ব্যাপক পার্ট না? শালা এমন প্লেন বানাবো যাতে কোন পাইলটই না লাগে। শালারা যাতে না খেয়ে মরে।
-তুই জব করছিস এখন?
-না এখনো পড়তেছি। বাচ্চাকালে ড্রাইভারি করার শখ নাই।
-বড় আসছে…বাচ্চা।
-ঐ হলো…
-আদু ভাই নাকি তুই? তোর না পাশ করে যাবার কথা? ফেল মারছিস?
-স্কলারশিপ নিয়ে যাচ্ছি কলোরাডো ইউনিভার্সিটি। Aerospace Engineering এ MS করবো মিশন : ড্রাইভারবিহীন এয়ারক্রাফট বানানো। রাজকন্যা এবার হেসে দিল কিছুটা। ওর সেই রোদ্দুর হাসি। হৃদয় ভাঙ্গা হাসি। মানুষের হাসিতে এত মায়া থাকে কিভাবে কে জানে। আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ছাড়াও আজকের দিনের আলাদা একটা মাহাত্ম্য আছে আমার কাছে। পিচ্চি রাজকন্যার জন্মদিন আজ। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আমি বললাম
-হ্যাপি বার্থডে লিটল প্রিন্সেস। ও আমার দিকে একবার তাকালো। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো “আমি লিটল না”। আমি বললাম “এদিকে তাকা”।
-কি?
-বিয়ে করবি আমাকে?
ওর মুখের অভিব্যাক্তি এবার পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রচন্ড রেগেমেগে ও উঠে চলে যেতে চাচ্ছিল। আমি পিছন থেকে ওর হাত চেপে ধরলাম।
-উত্তর দিয়ে যা। বিয়ে করবি আমাকে? বলে পকেট থেকে আংটি বের করলাম একটা। ও অবাক হয়ে আংটিতার দিকে তাকিয়ে আছে।
-তাকিয়ে আছিস কেন বেটি? রাজি হয়ে যা। ৭৫,০০০ টাকার রিং। টাকাটাই জলে যাবে না হলে।
ও এবার ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রচন্ড আক্রোশে আমার বুকে কিল ঘুষি মারতে লাগল। শার্টের কলার ঘরে টেনে দু’টো বোতাম ছিড়ে দিল। আমি ওকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরি। দ্বিগুন আক্রোশে আমার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। অনেক্ষন। অতঃপর ব্যার্থ হয়ে আমার বুকে ওর মাথাটা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমি কখনো পাইলটকে ভালোবাসিনাই রে। আমি আম্মুকে কষ্ট দিতে পারতাম না”।
ওকে কখনো কেঁদে কথা বলতে শুনিনি। ওর অশ্রুকনা আজো আমার বুকে তীরের মত বিঁধে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই শুধু। কি বলবো জানিনা…আকাশে কালবোশেখীর কালো মেঘ। জানি আজ প্রচন্ড ঝড় আসবে। পৃথিবীর বুকে, আমার বুকে। আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে অন্তি। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাব। আশেপাশের মানুষজন মজা দেখছে। কেউ কেউ কুৎসিত কমেন্টও ছুড়ে দিচ্ছে। দিক। আমাদের লজ্জা লাগছে না। ক্যাডেটদের এত লজ্জা থাকলে চলে না।