বন্ধুত্বের বাঁধন

বন্ধুত্বের বাঁধন

— দোস্ত আমার একটা মানিব্যাগ কিনতে হবে রে। (আমি)
— মানিব্যাগ কিনে কি করবি? (মেহেদি)
— মানিব্যাগ পানিতে চুবিয়ে তারপর সেই পানি খাবো।
— তাহলে কিনে ফেল। তোকে নিষেধ করেছে কে?
— দোস্ত তাহলে তোর মানিব্যাগটা দে।
— দূরে যা! আমি আমার মানিব্যাগ বিক্রি করবো না।
— তোরে বিক্রি করতে বললো কে? তুই শুধু তোর মানিব্যাগটা আমার হাতে দে। ওখান থেকে আমি মাত্র দুইশ টাকা নিব।
— হারামজাদা গেলি এখান থেকে নাকি দিব মাইর?
— দোস্ত এমন করিসস কেন? দে দুইশ টাকা। অনেক দিনের শখ একটা মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে ঘুরবো।
— নিজের টাকা দিয়ে শখ পূরন কর। আমার কাছে টাকা নাই।
— তুই টাকা দিবিনা? সত্যিই দিবি না?
— এখন কি এইটা ঢোল পিটিয়ে পুরো এলাকাবাসীকে বলে দিতে হবে নাকি?
— না থাক দিসনা টাকা। তারচেয়ে বরং আমি একটু আন্টির কাছে গিয়ে কথাবার্তা বলে আসি। তুমি আর সাদিয়া কি করো তা একটু জানাতে হবে।
— হারামী, আমারে ব্ল্যাকমেইল করিস? এই ধর তোর টাকা। এইমাসে কত টাকা নিলি হিসাব আছে?
— তোকে এককেজি ধইন্যা। আয় তোকে একটা চুম্মা দেই। আর টাকার হিসাব পরে করলেও চলবে।
..
হাহাহাহা! আবারো মেহেদির কাছ থেকে টাকা মেরে দিলাম। অন্যের টাকা নিজের পকেটে আসলে যে কি মজা!
ওহ এতক্ষন ফালতু প্যাচাল শুনে মনে হয় বোরিং হলেন। আসলে আমি আর আমার এই বন্ধুটা একটু বোরিং টাইপ পোলা। কিছু মনে করবেন না।
..
আমি আরমান হোসেন। পড়ালেখা শেষ করে এখন ভবঘুরে কোম্পানির কর্মচারি। আর আমার এই বন্ধুটার নাম ফারহান হোসেন মেহেদি।

ও এখন পড়ালেখা শেষ করে একটা বড় চাকরি করে।
মেহেদি আর আমি ছোটবেলার বন্ধু। একসাথেই আমরা পড়ালেখা করেছি। কিন্তু আমার মাথায় গোবরের পরিমান একটু বেশি হওয়ার

ফলে আমি এখনো বেকার।
মেহেদি আর আমার সম্পর্কটা খুবই গভীর। যদিও ওর সাথে আমার ঝগড়া সবসময় লেগেই থাকে। কিন্তু একজনকে ছাড়া অপরজন অচল।
..
— দোস্ত খুব ক্ষুদা লেগেছে। চল ওই হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিই। (আমি)
— টাকা আছে? (মেহেদি)
— নাহ নাই। পকেট একেবারে খালি।
— ওই তোর লজ্জা করেনা? পকেট খালি তারপরও খালি খাই খাই করিস।
— দোস্ত আজকে তুই চাকরি করিস বলে আমাকে এভাবে খোঁচা মারলি? যাহ খাবো না আমি।
— আহারে! তুমি না খেলে মনে হয় আমি তোমাকে জোর করে খাওয়াবো? ঢং বাদ দিয়ে চল খেয়ে আসি। আমারো ক্ষুদা লেগেছে।
— দোস্ত তোর গালটা একটু এদিকে নিয়ে আয়।
— কেন?
— তোরে একটা চুম্মা দিতে মন চায়।
— দূরে গিয়া মর। কাছে আসিস না।
..
সারাদিন মেহেদির সাথে ঘুরলাম। ওর প্রায় হাজারখানেক টাকা আজ খরচ করিয়েছি।

মেহেদি মুখে আমাকে যাই বলুক আমি জানি ও খুশি মনেই এই টাকাগুলো খরচ করেছে।
ও জানে আমার পকেট সবসময় খালি থাকে। তাই ও মাঝে মাঝে আমাকে টাকা ধার দেয়।

ও এটাও জানে যে এই ধার দেওয়া টাকা আমি শোধ করতে পারবো না, তারপরও দেয়।
..
সকালে প্রায় দশটায় ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠে ছাদে যাওয়া আমার অভ্যাস।

ছাদে উঠে কিছুক্ষন লাফালাফি করলাম। মনটা আজ মোটামুটি ফুরফুরে লাগছে।

তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে সানজিদার। সানজিদা হচ্ছে মেহেদির বোন। আর আমার সারাজীবনের ক্রাশ।

সানজিদা মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় আসে। মেহেদি আর আমার বাসা প্রায় পাশাপাশি।
..
— কি ব্যাপার আরমান ভাই এমন লাফালাফি করছেন কেন? (সানজিদা)
— লাফালাফি কোথায় দেখলে? আমিতো ব্যায়াম করছি। (আমি)
— ও আচ্ছা। আচ্ছা আজ কি আপনার কোন কাজ আছে?
— আছে তো অনেক কাজ।
— দূর আজ সব কাজ বাদ। আজ আপনি আমার সাথে যাবেন।
— কোথায় যাবো?
— শপিং করতে যাবো।
— না না, আমি মোটেও যাবো না। মেহেদি যদি জানতে পারে যে আমি তোমার সাথে গেছি তাহলে আমার হাড্ডি ভেঙ্গে দেবে।
— দূর আপনি ভাইয়াকে ভয় পান কেন? ভাইয়া নিজেই বলেছে আপনাকে নিয়ে যেতে।
— ও তাই? তাহলে মেহেদিকে নিয়ে যাও। আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?
— ভাইয়া নাকি আজ একটু ঢাকা যাবে অফিসের কাজে। আসতে দুইদিন দেরি হবে। তাই আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
— হারামী ঢাকা গেল, কিন্তু আমাকে বলে গেল না? বিশাল হারামী। (বিড়বিড় করে বললাম)
— কিছু বললেন?
— নাহ কিছু বলিনি। ঠিক আছে আমি যাবো।
— ধন্যবাদ আপনাকে, লাভইউ।
— কিছু বললে নাকি আমাকে?
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সানজিদা নিচে নেমে গেল। লাভইউ বলল নাকি লেবু বলল?
..
সানজিদা যাওয়ার পর মেহেদিকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষন ঝাড়ি মারলাম। বেটা আমাকে না বলে ঢাকা যায় কেমনে?
..
— আচ্ছা সানজিদা তোমাকে একটা কথা বলবো? (আমি)
— কি বলবেন বলুন। (সানজিদা)
— আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
— (শুধু একটা লাজুক হাসি)
— তোমার শপিং শেষ হতে আর কতক্ষন লাগবে?
— এইতো আর ঘন্টাখানেক।
— কি!!!!!! আরো এক ঘন্টা? দুইঘন্টা ধরে তোমার সাথে ঘুরছি। আরো একঘন্টা লাগবে?
— হাহা আপনার সাথে মঝা করলাম। আমার শপিং শেষ। একটা জিনিস কেনা বাকি। সেটা কিনলেই বাসায় চলে যাবো।
— ও তাই। ধন্যবাদ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি শপিং শেষ করায়(!)
..
শপিং শেষ করে রিক্সায় উঠলাম। দুজনে পাশাপাশি বসে আছি। আমি একটু চেপে বসেছি যাতে ওর গায়ের সাথে না লাগে।
— কি ব্যাপার আপনি এতো ওদিকে গিয়ে বসেছেন কেন? সোজা হয়ে বসুন।
— না মানে ইয়ে…..
— আজব তো। সোজা হয়ে বসতে বললাম আর আপনি না মানে ইয়ে করছেন কেন? সোজা হয়ে বসুন তাড়াতাড়ি।
অগত্য সোজা হয়ে বসলাম। এটা মেয়ে নাকি এটম বোমা? মাথায় হালকা সন্দেহ হচ্ছে।
..
যেহেতু ওদের বাসা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি সেহেতু আমাদের বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামলাম।

সানজিদা নিজেই ভাড়া দিয়ে দিল। আমার পকেট ফাঁকা, নয়তো আমিই দিয়ে দিতাম।
— আরমান ভাই একটা কথা বলতাম। (সানজিদা)
— হুম বলো।
— এদিকে আসেন, কানেকানে বলতে হবে?
— কেন জোরে বললে কোন সমস্যা আছে?
— আরে এত কথা না বলে কানটা এদিকে আনেন।
অনিচ্ছা সত্তেও কানটা সানজিদার মুখের কাছে নিলাম। আর সানজিদা আমার কানে এমন একটা মন্ত্র

ঢেলে দিল যা শুনে আমি একেবারে মোহিত হয়ে গেলাম।
— আই লাভ ইউ আরমান।
— (ফুললি সকড)
— কি হলো কথা বলছেন না কেন?
— ( আই লাভ ইউ বললো নাকি আমাকে?)
— দূর গাধা একটা।
..
সানজিদা চলে গেছে। কিন্তু তার মন্ত্রের রেষ এখনো কাটেনি। আমি এখনো ঘোরের মধ্যে আছি।

কখন আমি ঘরে প্রবেশ করলাম আর কখনই বা নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম তা টেরই পাইনি।
বালিকা, কি জাদু করিলা? পাগল করিয়া দিলা পুরোপুরি।
..
দুইদিন পর মেহেদির সাথে দেখা হলো। এই দুইদিন ও ঢাকা ছিল আর আমিও ঘরেই ছিলাম।

কারন বালিকার বলে যাওয়া সেই মন্ত্রের প্রভাব এখনো কাটেনি।
— কিরে মাম্মা এমন করে কি দেখিস? (মেহেদি)
— নাহ কিছু দেখি না। (আমি)
— তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? গোসল করিসনি কয়দিন?
— মাত্র দুইদিন দোস্ত।
— ছিঃ ছিঃ ছিঃ? শেষ পর্যন্ত তোর মত একটা খাটাসকে আমার বোন পছন্দ করলো?
..
মেহেদির এই কথা শুনে আমি পুরোপুরি টাস্কি খেলাম। তার মানে মেহেদি জেনে গেছে?

হায় হায়, আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব বুঝি আজ ভেঙ্গে গেল।
— কিরে আবুলের মত হা করে আছিস কেন? (মেহেদি)
— দোস্ত কি বললি তুই?
— বললাম সানজিদা নাকি তোকে প্রপোজ করেছে আর তুই নাকি উত্তর না দিয়ে গাধার মত দাঁড়িয়ে ছিলি?
— না মানে দোস্ত তোর মাথা কি ঠিক আছে?
— মনে হয় ঠিকই আছে। আচ্ছা আরমান তুই কি সানজিদাকে ভালবাসিস?
— (গলা শুকিয়ে গেছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে)
— কিরে কথা বলিস না কেন?
— দোস্ত আসলে আমিও সানজিদাকে ভালবাসি। কিন্তু বলতে পারিনি কখনো।
— কেন বলতে পারিসনি? আমার জন্য?
— হ্যা, আমার ভালবাসার মাঝে তোর আর আমার বন্ধুত্বটা বারবার চলে আসছিল।

যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয় এই ভয়ে আমি সানজিদাকে কখনো কিছু বলিনি। এমনকি বুঝতেও দেইনি।
— তুই আমাকে কি ভাবিস বলতো? মনে রাখিস, সূর্য একদিন নাও উঠতে পারে। চাঁদ চিরদিনের নাও উঠতে পারে

কিন্তু তোর আর আমার বন্ধুত্ব কখনো শেষ হবে না। জন্ম থেকে জন্মান্তরে আমাদের এই বন্ধুত্ব টিকে থাকবেই।
— ( আমি বাকরুদ্ধ। চোখের কোনে অশ্রু জমে উঠেছে। যেকোন সময় বর্ষন হতে পারে।)
— কিরে কান্না করছিস কেন?
— কই কাঁদছি নাতো। এমনি চোখে ময়লা পড়েছে মনে হয়।
— আর ঢং করিসনা। কাল বিকালে সানজিদা তোদের বাড়ির ছাদে থাকবে। ওকে তোর মনের কথা বলে দিবি।

আর একটা কথা মনে রাখিস। যদি কোনদিন আমার বোনকে কষ্ট দিস তাহলে তোকে আমি খুন করবো।
..
মেহেদি নিজেও কাঁদছে। হয়তো এটা আনন্দের কান্না।
— দোস্ত একটা কথা বলি? (আমি)
— (চোখ মুছতে মুছতে) বলে ফেল।
— দোস্ত পাঁচশ টাকা ধার দে। কাল সানজিদাকে প্রপোজ করবো। খালি হাতে তো আর প্রপোজ করা যায় না।
— হারামী!! তোর কি কোন লজ্জা নাই? আমার বোনকে তুই আমার টাকায় গিফট কিনে দিবি? দাঁড়া তোরে আজকে খাইছি।
..
আমি দিলাম দৌড়। মেহেদিও আমার পেছনে দৌড়াচ্ছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন

এই বন্ধুত্বের বাঁধন অটুট থাকবে। কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত