নীল ভালবাসা

নীল ভালবাসা

জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা দেখছে আবির। এইতো মাত্রই সে বহুকষ্টে চোখের পাতা খুললো। খুলেই সে দেখতে পেল অধরা তার খাটে পা তুলে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। অধরার এখানে থাকার সম্ভাবনা ১০০ তে শূন্য ভাগ। কারণ আবির কোথায় থাকে তা অধরা জানে না। শুধু অধরা কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জানে না।

আবির একটা বাড়ির সিঁড়ির নিচের একটা ঘরে ভাড়া থাকে। বহু কষ্টে হাতে পায়ে ধরে এই ঘর ভাড়া নিয়েছে সে। কারণ ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া বর্তমানে খুবই কঠিন ব্যাপার। দুইদিন হলো আবির জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। কোথায় খাওয়া কোথায় কি? জ্বরের ঘোরে সে ক্ষুদা টের পায়নি। মাঝে মাঝে গলা শুকিয়ে গেলে পানি পান করেছে। আবির হঠাৎ তার কপালে ঠান্ডা কোনকিছুর স্পর্শ টের পেল। নরম হাতের তালু আর আঙ্গুলের স্পর্শ টের পাচ্ছে আবির, সাথে ধাতব ব্রেসলেট বা চুড়ির ছোঁয়া। আবির আবারো বহু কষ্টে চোখ মেললো। অধরা তখনো ঠায় বসে আছে সেখানে।

— গত দুইদিন ধরে ক্যাম্পাসে দেখি না। দুইদিন ধরেই কি জ্বর?

অধরা প্রশ্নটা করলো। আবির এখনো বুঝতে পারছে না যে এটা কল্পনা নাকি বাস্তব। সে বাস্তবতা আর কল্পনা আলাদা করতে পারছে না। সে আবারো চোখ বন্ধ করলো। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। কিছুক্ষন পর কপালে ঠান্ডা তরল জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব টের পেল আবির। এবার আবির ঝট করে চোখ মেলে তাকালো। অধরা ঝুঁকে আছে তার মুখের উপর। তার চেহারা উল্টো হয়ে আছে। অধরা পানি দিচ্ছে আবিরের মাথায়। আবির একটু নড়ে উঠলো। অধরা আবিরের হাত ধরে বললো,

— নড়বে না। চুপ করে শুয়ে থাকো। পানিতে বরফের টুকরো দিয়ে দিয়েছি। তাই পানি এতো ঠান্ডা। এখন দেখবে জ্বর তরতর করে নেমে যাবে।

অধরার কথায় আবির চুপ হয়ে পড়ে থাকে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। অধরা আবিরের ঠিকানা কোথায় পেল? তাছাড়া ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল। অধরা ভিতরে ঢুকলো কিভাবে? মাথায় পানি দেয়া শেষে আবিরের মাথা যত্ন করে মুছে দিল অধরা। তারপর একটা ভেজা গামছা আবিরের হাতে দিয়ে বললো,

— শরীর মুছে নাও এটা দিয়ে। তারপর কিছু খেয়ে এই দুইটা ঔষুধ খেয়ে নাও। জলদিই ভাল হয়ে যাবে।

আবির মোহিতের মত গামছা হাতে নেয় । অধরার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভেজা গামছা শরীরে ঘষতে থাকে। এই মেয়েটাকে আবির পাগলের মত ভালবাসে। কিন্তু এখনো বলতে পারেনি। কারণ আবির মধ্যবিত্ত আর অধরার বাবা বিশাল ধনী। যুগে যুগে এই দুই শ্রেণীর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক ভালবাসার মর্মান্তিক ইতিহাস। আবির নিজেও জানে যে ভালবাসার কথা প্রকাশ করলে সে নিজেও সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতে পারে।

অধরা আর আবিরের মাঝে সম্পর্কটা বন্ধু আর ক্লাসমেটের মাঝামাঝি। এখনো ভালমত বন্ধুত্ব জমে উঠেনি তাদের। এরই মধ্যে আবিরের এতটা সেবা করছে কেন অধরা? বেশ কয়েকটা রহস্য জট পাকিয়ে যাচ্ছে আবিরের মাথায়। এসব ভাবতে ভাবতে অধরা অমলেট আর পাউরুটি নিয়ে আবিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। এই অমলেট কোথা থেকে নিয়ে আসলো কে জানে? আবিরের ঘরে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা নেই। আবির একটা হোটেলের সাথে প্রতিদিন দুইবেলা হিসেবে পুরো মাসের চুক্তি করে নিয়েছে। মাস শেষে টাকা দিয়ে দেয়।

— এইগুলো খাওয়ার আগে এই ট্যাবলেট খেয়ে নাও। খাবার সব শেষ করে বাকি দুইটা ট্যাবলেট খাবে কেমন! আমি খবর না পেলে তো নির্ঘাত এই জ্বরে মরেই যেতে।

একথা বলেই অধরা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আবির এতক্ষন টের পায়নি। তবে অধরা যাওয়ার পর টের পেল যে তার পেটে দুর্দান্ত ক্ষুদা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই খাবার সব শেষ করে আবির ট্যাবলেটগুলো খেয়ে নিল। খেয়ে আবির আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তার মাথা ভারী হয়ে আছে। তবে এখন তার ঘুম আসছে না। আবির অপেক্ষা করছে, হয়তো অধরা আবার আসবে। কিছুক্ষন পর অধরা আবার এলো। তার হাতে আনারস। আবিরকে আবারো শোয়া থেকে উঠিয়ে তার সামনে আনারসের বাটি রেখে খেতে বললো। আবির কথা না বাড়িয়ে আনারস মুখে দিল। আবিরের মনে হলো সে পৃথিবীর সেরা কোন খাবার খাচ্ছে। আবির খেতে খেতে অধরার দিকে তাকালো। অধরা আবিরের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো যে তার চোখে কৌতুহলের মেঘ দানা বাঁধছে।

— আবির তুমি হয়তো ভাবছো যে আমি তোমার ঠিকানা কোথায় পেলাম। আসলে এটা আমার চাচ্চুর বাড়ি। আমি প্রায়ই এখানে আসি। তুমি এখানে তিনমাস ধরে থাকছো কিন্তু আমি জানিনা। আজকেও হয়তো জানতাম না।

একথা বলেই অধরা থেমে গেল। কোন ফাঁকে বিদ্যুৎ চলে গেল কে জানে? আবিরের কাছে গরম না লাগলেও গরমে ঠিকই অধরার নাকে মুক্তোর মত জ্বলতে থাকা ঘামের বিন্দু দেখা গেল। আবির শেষ আনারসের টুকরো মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আজকে কিভাবে জানলে যে আমি এখানে থাকি?
— তোমার ওই ছাই রঙের টিশার্ট দেখে। বেশিরভাগ সময়ই তোমাকে ওই টিশার্টে ক্যাম্পাসে দেখেছি। ছাদে যখন টিশার্টটা দেখলাম তখন আমি আমার কাজিনকে জিজ্ঞেস করলাম যে টিশার্ট এটা কার? তখন সে বললো এটা নাকি তোমার। তুমি নাকি বাসায় এটা পরেই ঘুরে বেড়াও।

আবির আনারস খাওয়া শেষ করে চুপ করে রইলো । এমন নয় যে আবিরের আর কোন জামা নেই। তবে ওই ছাই রঙের টিশার্টটা আবিরের ছোটবোন আবিরকে কিনে দিয়েছিল গতবছর। এটাই একমাত্র পোশাক যেটা পরে আবির আরাম পায়। তাই এই টিশার্ট পরেই আবির বেশি সময় থাকে । অধরা বাটি নিয়ে বেরিয়ে গেল আবার। আবির আবার শুয়ে পড়লো। অধরার সাথে আবিরের বন্ধুত্ব এখন জমে নি ভালমত। তবুও কেন আবির অধরার প্রেমে পড়ে গেছে? আবির অনেকবার এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। ইউনির সবচেয়ে সুন্দরী বলেই কি অধরার প্রেমে পড়েছে আবির? নাকি ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মেধাবী বলেই প্রেমে পড়েছে? এসব ভাবতে ভাবতে আবির বিরক্ত হয়। আবির যুতসই কোন কারণ খুঁজে পায়না।

আবিরের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। আবির প্রানপনে চেষ্টা করছে চোখের পাতা খোলা রাখার। কিন্তু চেষ্টা সফল হয়না, আবির গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। তারপর একের পর এক স্বপ্ন দেখতে থাকে। দেখতে থাকে অধরা তার মাথায় বরফ শীতল পানি ঢালছে। তাকে ঔষধ খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলছে। আবার কখনো তার সামনে লবন মরিচ মাখানো কাঁচা আম রেখে দিচ্ছে। কখনো দেখছে অধরা পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখছে। কখনো আলনায় কাপড় গুছিয়ে রাখছে।

আরো দুইদিন জ্বরে ভোগার পর আবির সুস্থ হয়। আবির তার এই ছোট ঘরটাকে চিনতে পারে না। এলোমেলো সবকিছুই ছিমছাম গোছানো। ঘরের মেঝে চকচক করছে। পড়ার টেবিলে সবকিছু সুন্দর করে সাজানো। প্রতিটা কাপড় গুছিয়ে রাখা। আবির ভেবে পায়না এসব কে করলো। কিছুক্ষন বাইরে হাঁটাহাটি করে আসার পর আবির ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ঘরের দরজা খোলা। তালা দিয়ে বাইরে গিয়েছিল সে। কিন্তু এখন তালা নেই। আবির দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকে দেখতে পায় অধরাকে। তার চোখে কাজল, কপালে কালো টিপ।

— বাহ বাইরে থেকে ঘুরে আসা হলো বুঝি? জ্বর ভাল হতে না হতেই ঘোরাঘুরি শুরু?

অধরার কন্ঠে অভিযোগের সুর। আবির অধরার কথা শুনে মুচকি হাসে। সে কি বলবে ভেবে পায়না। তারপরেও কিছু একটা বলতে তো হবে।

— এসব কি তুমি গুছিয়েছো অধরা?
— ওমা তো আর কে গোছাবে? এই চারদিনে আমি ছাড়া আর কেউ তো আসেনি তোমার ঘরে।

একথা বলে অধরা এগিয়ে আসে আবিরের দিকে। আবির অপ্রস্তুত হয়ে পিছিয়ে যায়। অধরা আবিরের হাত ধরে ফেলে। তারপর আবিরের কপালে হাত রাখে।

— জ্বর তো নেই। কালকে ক্যাম্পাসে যাবে তো?
— হ্যা যাবো অবশ্যই। যদি আবার জ্বর না আসে।
— আর জ্বর আসবে না।

ব্যস এতটুকু বলেই অধরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অাবির তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। অধরা চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে তার দামী পারফিউমের ঘ্রাণ। আবিরের দৃষ্টি চলে যায় পড়ার টেবিলের দিকে। টেবিলে একটা ডায়েরি পড়ে আছে। ডায়েরির মলাট লাল রঙের। আবির পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। এই ডায়েরি আবিরের এক বন্ধু দিয়েছিল। বন্ধুটি এখন দেশের বাইরে থাকে। আবিরের ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই। তবে এই ডায়েরিতে আবির কিছু লিখেছে। যা লিখেছে পুরোটাই অধরার সম্পর্কে। অধরাকে দেখার পর থেকেই মনে একটা অন্যরকম ভাললাগা কাজ করেছে আবিরের মধ্যে। আবির অধরাকে ভাললাগার কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। এ কারণে সে ছটফট করেছিল। তার দমবন্ধ ভাব হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ভাললাগার কথা বলতে না পারলে সে দম আটকে মারা যাবে। যখন আবির আর পারছিল না তখনই আবির এই ডায়েরি নিয়ে বসে পড়লো। তারপর লিখতে লাগলো তার মনের সকল কথা। প্রতিদিন সে লিখলো একটু একটু করে। এমন ভাবে লিখেছে যে দেখলে মনে হয় আবির অধরাকে চিঠি লিখে তার মনের কথা জানাচ্ছে। এভাবেই মোট একুশটা চিঠি লিখেছে সে। প্রত্যেকটাই অধরার উদ্দেশ্যে।

আবির ডায়েরি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেল। এই ডায়েরি টেবিলে থাকার কথা না। এই ডায়েরি সবসময় আবিরের তোষকের নিচে থাকে। যখনই ইচ্ছে হয় তখনই এই ডায়েরি পড়ে সে। কিন্তু ডায়েরি টেবিলে এলো কিভাবে? আবির কৌতুহলবশত ডায়েরি খুললো। একের পর এক পাতা উল্টাতে লাগলো। যেখানে আবিরের একুশতম চিঠি লেখা শেষ হয়েছে সেখানে নীল কালিতে দুইটা লাইন লেখা।” মনের কথা মনে ধরে রাখতে নেই। এর ফলে কিন্তু মনের পেট খারাপ হতে পারে।” আবির খুব সহজে হাতের লেখা চিনে ফেলে। এটা অধরার হাতের লেখা। তারমানে অধরা এই ডায়েরি পড়েছে? সবকিছু জেনে ফেলেছে সে? আবির খুশি হবে নাকি ভয় পাবে বুঝতে পারলো না। এমন সময় আবার দরজা খুলে গেল। অধরা আবার এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই অধরা বললো,

— আবির, আমার নীল কলমটা রয়ে গেছে তোমার টেবিলের উপর।

অধরার কথায় আবির তাকায় টেবিলের দিকে। একটা কলম পড়ে আছে সেখানে। আবির অধরাকে কলম দেয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করলো না। অধরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো, আবির টেবিলের সামনে। আবিরের টেবিলে অধরার নীল কলম, আর হাতে লাল মলাটের ডায়েরি। সেখানে নীল কালিতে লেখা আছে ভালবাসার কথা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত