কালাই গলার মালা

কালাই গলার মালা

জাতের মেয়ে নাকি কালোও ভালো। হ্যাঁ, আমার বউ কালো। তবে বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তিত আমার প্রতিবেশীরা। ‘কি বিয়ে করলো রে বাবা, বউ তো নয় যেন আকাশের মেঘখন্ড!’, ‘আর বলিসনা তোরা, ছিঃ ছিঃ, রাকিবের মা তো একেবারে দিলো ছেলেটার জীবনটা নষ্ট করে! এমন পাতিলের কালির মতো কালো মেয়েকেও মানুষ বিয়ে করায়!’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়িতে নতুন বউ দেখতে এসে এমনটিই বলাবলি করছিল প্রতিবেশী কিছু মহিলারা৷ কথাগুলো ওরা বিড়বিড় করে বললেও আমি যেহেতু বারান্দার রুমে বসা ছিলাম তাই শুনতে কোন অসুবিধা হয়নি। দাঁত কামড়ে সবকথা হজম করি আমি।

অপেক্ষা করতে থাকি কখন এরা ঘর থেকে যাবে। এরপর হঠাৎ করে কানে ভেসে আসলো, ‘এটা কোন কথা হলো, একে তো মেয়ে কালো আবার জিনিসপত্রও কিছু দেয়নি। তোদেরকে বোকা বানিয়েছে রে রাকিবের মা।’ আর বসে থাকতে পারলামনা। ঘরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে রীতিমতো সবাই অবাক। বুজতে আর বাকি রইলোনা যে ওদের সবকথা আমি শুনে নিয়েছি। মহুর্তের মধ্যেই পিনপতন নিরবতা নেমে এলো গোটা ঘরে। নিরবতা ভেঙ্গে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতক্ষণ জিনিসপত্র নিয়ে কে কথা বলছিল এখানে?’ ‘চুপ কর বাবা! যা, তুই একটু উঠোনে যা। আমি ওদেরকে মিষ্টি-পানি খাইয়ে বিদায় করছি।’ -মা আমার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্ত আমি নাছোড়বান্দা। সবাইকে বসতে বলে মাকেও পাশে নিয়ে বসলাম।

উপস্থিত মহিলাদের অধিকাংশেরই বিয়ে হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে এবং এর আশেপাশে। আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় একজন আমাকে বলে উঠলো, ‘বিয়ে করে বউ ঘরে আনতে না আনতেই বউয়ের জন্য দরদ একেবারে উতলে পড়ছে দেখা যায়! যা বলেছি বেশ বলেছি।’ আমি উনাকে থামতে বললাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার চেহারা আর সুরতহাল দেখে তো মনে হচ্ছেনা যে ভরা যৌবনে বিশ্বসুন্দরী ছিলেন! তা সে যাইহোক, বিয়েতে আপনার বাবা আমার চাচাকে কিসের হাতিঘোড়া দিয়েছিল আমাদেরকে একটু বলেন তো শুনি!’ আমার এমন প্রশ্নে মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা উনার।

তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আপনারাও কোন না কোন মায়ের পেঠে জন্মেছিলেন। আপনারাও বিয়ে হয়ে আমাদের এখানে পাড়া প্রতিবেশী হয়ে এসেছেন। একটি বার ভাবুন তো নিজেদের বিয়ের সময়ের কথা। নিজেদের অবস্থার কথা। হ্যাঁ, আমি জানি আমার বউ কালো। আর আমি জেনেশুনেই তাকে বিয়ে করেছি। কালো হওয়াটা একজন মানুষের পরিচয় হতে পারেনা কখনো। পরিচয় হবে তার ব্যাবহার, চলাফেরা, আচার-আচরণ ইত্যাদিতে। আমার এমন বয়ান শুনে কেউ কেউ নিজেদের ভুল বুজতে পারলেও অধিকাংশই নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কিনা কি বলতে বলতে বেড়িয়ে যায়।

বিয়ের প্রথম দিনেই বউয়ের পক্ষ নিয়ে আমাকে রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখে বউ আমার অবাকই হয়েছে। রাত প্রায় বারাটা বেজে যায় তার কক্ষে আমার গমন ঘটতে! ছোটবোন তুলি কানে কানে বলে দিয়েছে আমায়, ‘ভাইয়া, ভাবী কিন্তু এসব কথাবার্তা শুনে এখনো কিছু খায়নি।’ ওর কথা শুনে খারাপই লাগলো আমার। এসব ভাবতে ভাবতেই কানে ভেসে আসলো মৃদুস্বরে সালামের শব্দ- ‘আসসালামুআলাইকুম’ আমি থমকে দাঁড়াই এবং জবাব দিই, ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম।’ আর কোন শব্দ নেই আর কোন কথা নেই। আমি এগিয়ে যাই বিছানার দিকে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আবছা আলোয় বিছানার মাঝখানে একখণ্ড হীরার টুকরা পড়ে আছে! ঝলমলিয়ে উঠছিলো আমার চোঁখে! পাশে গিয়ে বসি এবার। প্রশ্ন আসে, ‘রাতে খেয়েছেন?’ -নাহ, সময় আর সুযোগ দুটোর কোনটিই হয়নি তাই খেতে পারিনি। তুমিও নাকি খাওনি? -পাল্টা জানতে চাইলাম। আর কিছু বললোনা ও।

রাত তখন একটা বাজে। যে যেখানে পারে ঘুমিয়েছে। ভেবেছিলাম আমরা দুজনেই শুধু সজাগ। কিন্ত না, রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছি এমন সময় মা বলে উঠলেন, ‘রান্নাঘরে টেবিলের উপর বক্সে খাবার রাখা আছে, দুজনে খেয়ে নে!’ -মনে মনে বললাম, মা তো মা’ই। খাবার নিয়ে গিয়ে দুজনে খেয়ে নিলাম। সারারাত কেটে গেল গল্প করেই! কালো বউ নিয়ে ঘরসংসার করতে থাকলাম। আমার ঘরে শান্তি থাকলেও এই শান্তি দেখে প্রতিবেশীদের অনেকেরই যে শান্তি লাগছিলনা সেটা বেশ ভালোই বুজতে পারছিলাম। কিছুদিন পর বউকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসে জানতে পারি আমার ঐ প্রতিবেশী চাচীর সুন্দরী মেয়ে সুইটি এক ছেলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় পার্কে ধরা খেয়েছে এবং এনিয়ে থানা-পুলিশও হয়েছে।

এর মাসখানেক পরে খবর ছড়ায় ও প্রেগন্যান্ট! যার পরিসমাপ্তি ঘটে গলায় দড়ি দিয়ে তার আত্মহত্যায়! সেদিনের কথা আমার আজো মনে পড়ে, যেদিন মেয়ে হারানোর যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা আমার প্রতিবেশী ঐ চাচীর সবচে বড় আশ্রয় হয়েছিল আমার স্ত্রীই। ওই উনাকে শান্তনা দেয়। খাবার খাওয়ায় এবং প্রায় প্রতিদিন অনেকটা সময় ধরে নিজের কাছে বেশকিছুদিন উনাকে রাখে এবং স্বাভাবিক করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। একদিন দুপুরের খাবার খেতে এসে ঘরে ঢুকতে যাবো এমন সময় শুনতে পাই কেউ বলছে, ‘মা, আল্লাহ্ তোমার ভালো করুক। তোমার পেটে ওলী-আউলিয়ার জন্ম দিক। সারাজীবন সুখী হও। আমার মাথার চুল পরিমাণ তোমার হায়াত হোক।’ এরপর যাকে আমি আমার ঘর থেকে বের হতে দেখলাম আপনাদের নিশ্চয় আর বুঝার বাকি নেই যে, তিনি আসলে কে হতে পারেন!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত