মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ারের সময় একটি মেয়ে আমাকে প্রায়ই বিরক্ত করতো। এটাকে ঠিক ‘বিরক্ত’ বলা যাবে কীনা সন্দেহ। বিরক্ত না বলে এটাকে ‘উত্যক্ত’ বলাটাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত। কেননা, ফ্রেন্ড সার্কেলে ‘হাড় বজ্জাত’ টাইপ এমন অনেকেই ছিলো, যারা আমাকে বিরক্ত করে একরকম পৈশাচিক আনন্দ পেতো। বন্ধুমহলে আমি ছিলাম একটু ভোলাভালা টাইপের। চোখে হাল আমলের মোটা, কালো ফ্রেমের একটি চশমা থাকতো। এই চশমাটির জন্যে ক্যাম্পাসে আমার নাম রটে যায় ‘কালিদাস পন্ডিত’। কি বিচ্ছিরি নাম! মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে স্যারের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। দুষ্টুমি, আড্ডা সহ অন্যান্য সবকিছুতে সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও, পড়াশুনায় বরাবরই আমি ভালো ছিলাম। থার্ড ইয়ারে আমাদের একজন নতুন স্যার আসেন। বড় বড় চোখে সবার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকান। চেহারায় সবসময় একটা ‘সিরিয়াস সিরিয়াস’ ভাব থাকে। মেডিকেল কলেজের প্রফেসর বলেই হয়তো এরকম একটা মুড নিয়ে চলেন।
প্রথম ক্লাশেই স্যার এসে জিজ্ঞেস করলেন,- ‘একটি প্রশ্ন করবো।যে সঠিক উত্তর দিতে পারবে, ধরে নেবো সেই-ই হবে এই ব্যাচের সবচেয়ে সেরা সাইকিয়াট্রিষ্ট।কে আগে উত্তর দিতে চাও হাত তুলো।’ রুমকি ক্লাশে চঞ্চলা হিসেবে পরিচিত ছিলো।যথেষ্ট মেধাবী এবং বুদ্ধিমতী। সেই-ই একমাত্র হাত তুললো। স্যার বললেন,- ‘Very good girl. Anyone from the gentlemen?’ আমাদের কেউই হাত তুলিনি।স্যারকে উত্তর দেবো কী, স্যারের চেহারার অবস্থা দেখেই আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। স্যার রুমকিকে প্রশ্ন করলেন,- ‘বলো দেখি, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের শরীরের কোন অঙ্গটি স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বড় হয়ে যায়?’
এতক্ষণ ক্লাশে যারা চুপচাপ ছিল সবাই স্যারের দিকে মাথা তুলে হাঁ করে তাকালো। অবস্থা এমন,- এই প্রশ্নের উত্তর এমন কিছু, যা জনসমক্ষে বা ক্লাশ রুমে সবার সামনে দেওয়া যাবে না। রুমকির অবস্থাও সেরকম। সে লজ্জায় লাল হয়ে বললো,- ‘স্যার, দুঃখিত! উত্তরটি আমি জানি। কিন্তু বলতে পারবোনা।’ ক্লাশের সবাই হঠাৎ হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলো।কেন হেসে উঠলো আমি বুঝিনি।আমি চুপচাপ। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,- ‘সবাই হাসলো, তুমি চুপচাপ কেনো?’ আমি মাথা নিঁচু করে বললাম,- ‘স্যার, সবাই কেন হাসলো আমি ঠিক জানিনা। May be I’ve missed the point’ স্যার বললেন,- ‘তুমি কী প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারো?’ আমি বললাম,- ‘জ্বি।’ ‘Fine। বলো দেখি, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের শরীরের কোন অঙ্গটি স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বড় হয়ে যায়?’… এটা নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে।গল্পটি আমার জানা ছিলো। আমি বললাম,- ‘স্যার, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের চোখের মণি স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বড় হয়ে যায়।’
স্যার খুশিয়াল গলায় বললেন,- ‘Exactly. You are absolutely right my son. I’m looking a very bright future of you…’ এরপর স্যার ক্লাশে আরো ৩০ মিনিট লেকচার দিলেন। লেকচারের সারমর্ম ছিলো- ‘মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেগেটিভ জিনিসের প্রতি বেশিই আকর্ষিত। জগতে যাদের সফল মানুষ হিসেবে আমরা চিনি, তাদের ন্যাচার অনুসন্ধান করে জানা গেছে, কোনকিছুর ব্যাপারে তারা নেগেটিভ জিনিসটা ভাবার আগে, পজিটিভ জিনিসটা ভাবতেন এবং পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে কাজ করতেন।’ দীর্ঘ লেকচার শেষ করে স্যার আবার আমার দিকে তাকালেন।বললেন,- ‘তোমার নাম?’ আমার নামটি আমাকে বলার কেউই সুযোগ দিলোনা। ক্লাশের সবাই একযোগে বলে উঠলো,- ‘কালিদাসসসসসসস পন্ডিত।’ এটা তো আমাকে বিরক্ত করার একটা ঘটনা মাত্র।আমাকে তারা যে কী পরিমাণ জ্বালাতন করতো তা ল্যাব,লাইব্রেরি আর আমার চশমাটাই জানে। কিন্তু ফাইনাল ইয়ারে এসে এই মেয়েটির জ্বালাতনকে ঠিক বিরক্ত বলতে পারছিনা।
ফাইনাল ইয়ারে আছি।লাষ্ট প্রফটা শেষ হলেই ইণ্টার্ণি। দিন-রাত এক করে পড়তে হচ্ছে। টেবিলেই খাওয়া,টেবিলেই পড়া, টেবিলেই ঘুম। মেয়েটির জ্বালাতনের ধরনটি বড্ড অদ্ভুত ধরনের।মাঝরাতে ফোন দিতো।ফোন দিয়ে বলতো,- ‘আপনার কী একমিনিট সময় হবে,প্লিজ?’ আমি তখন আছি ভীষণ প্যারার মধ্যে। তখন একমিনিট আমার কাছে এক বছরের মতো। তবু আমি বলতাম, – ‘জ্বি, বলুন?’ মেয়েটা বলতো,- ‘আমাকে একটি মরার রাস্তা বলে দেবেন?’ কী বিদঘুটে প্রশ্ন।এত রাতে এরকম ফাজলামো করার কোন মানে হয়? মেয়েটা বলে যেতো,- ‘আমি বাঁচতে চাইনা। ওরা আবার আসবে।ওরা আমাকে আবার নিয়ে যাবে।আমি তার আগেই মরে যেতে চাই,প্লিজ।’ আমি ফোনের লাইন কেটে দিই।মেয়েটা আবার ফোন করে,- ‘আপনার কী একমিনিট সময় হবে,প্লিজ?’ আমি বলতাম,- ‘বলুন।’
– ‘আমাকে একটি মরার রাস্তা বলে দেবেন?’
আমি কিছু না বলেই লাইন কেটে দিই।একবার ভাবি, আমার বন্ধুদের কেউ এই ফাইজলামিটা করছে না তো? পরক্ষনে ভাবি, ‘ধুর! তারাও তো আমার মত পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত! এসব করার তাদের সময় কই?’ তাহলে কে এই মেয়ে? মেয়েটা প্রত্যেকদিন ওই সময়েই আমাকে ফোন দিতো।ফোন দিয়ে খালি একই প্রশ্ন করতো। ‘একটি মরার রাস্তা বলে দেবেন?’ প্রথম প্রথম দু’চার কথা শোনাতাম।পরে ফোন আসলেই কেটে দিতাম।উপদ্রব!! ফোনের সুইচ অফ রাখতেও পারতাম না বিভিন্ন কারনে।মেয়েটা ফোনে না পেয়ে ম্যাসেজ করতো।লিখতো- ‘আমাকে একটি মরার রাস্তা বলে দেবেন?’ আমি বিরক্ত হতাম প্রচন্ড। এরকম প্রশ্নের কোন উত্তর হয়? মেয়েটা এভাবেই আমাকে টানা দুই মাস বিরক্ত করে।পরে কোথায় চলে গেলো কে জানে।বেঁচে আছে না মরার কোন রাস্তা পেয়ে সত্যিই মরে গেছে জানিনা।আমিও আর পরে কোন খবর নিইনি।ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা।
আমি তখন দেশের একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিষ্ট।আমার নিজের দুটো রিচার্স পেপার এ্যামেরিকার ‘মেডিকেল অফ সান ফ্রান্সিস্কো’ তে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। ‘পেপার অফ সাইকোলজি’ নামক বিশ্বখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয় আমার পেপার দুটো। বিদেশের নামী-দামী জায়গা থেকে অফার আসে জয়েন করার জন্য। কিন্তু আমি দেশেই রয়ে যাই। একবার আমার চেম্বারে একজন মহিলা রোগি আসেন।সাথে মহিলার স্বামী। মহিলা হালকা-পাতলা গড়নের। একটি খয়েরি রঙের শাড়ী পরে এসেছেন। মহিলার স্বামীর গায়ে একটি চকোলেট কালারের শার্ট। লোকটির মনে হয় রঙ সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। এরকম কাঠফাঁটা রোদে কেউ চকোলেট কালারের শার্ট গায়ে দেয়? রঙটা দেখতেই তো গরম গরম লাগে।
মহিলা আমার চেম্বারে ঢুকা মাত্রই আমার ঠিক সামনের চেয়ারে এসে ধপাস করে বসলেন। বুঝলাম, ইনিই রোগী।বসার স্টাইলটাও স্বাভাবিক।একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের চেম্বারে রোগীরা এভাবে বসবে না তো কিভাবে বসবে? এটা মেণ্ট্যাল ডিস-অর্ডারের ফল।এদের কাছে এটাই ঠিক।এটাই শুদ্ধ। আমি উনার স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,- ‘কি সমস্যা উনার?’ মহিলার স্বামী কিছু বলার আগেই মহিলা আমার হাত ধরে বললেন,- ‘আপনি কী আমাকে মরার একটি রাস্তা বলে দেবেন,প্লিজ? ওরা আবার আসবে।ওরা আমাকে নিয়ে যাবে।তার আগেই আমি মরে যেতে চাই,প্লিজ?’ ঘটনার আকস্মিকতা এবং মহিলার কথায় আমি মূহুর্তে চমকে উঠি। এই মহিলাই কী সেই, যে আজ থেকে আট বছর আগে আমাকে মাঝ রাত্তিরে ফোন দিয়ে মরার উপায় জানতে চাইতো? এটা কী করে সম্ভব? আমি অবাক হই।
আমার হাত ধরা অবস্থাতেই মহিলা সেন্সলেস হয়ে পড়ে যান। আমি উনার স্বামীর কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম।তিনি বলতে লাগলেন- ‘আজ থেকে আট বছর আগে আমাদের দেখা। কমলাপুর রেল স্টেশানে।রাতের ট্রেনে করে আমি চিটাগং যাবো।ট্রেন ছাড়ার একটু আগে, ট্রেনে উঠতে যাবো, এমন সময়ে আমি দেখলাম, রেল লাইনের উপর একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।আমি দ্রুত গিয়ে মেয়েটাকে টেনে সরিয়ে নিই।’ আমি খুব মনোযোগী শ্রোতা। এটুক বলে মহিলার স্বামী থামলেন। আমি বললাম,- ‘তারপর?’ লোকটা পাশের বেডে শোয়া তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এরপর বললেন,- ‘মেয়েটা তার নাম, ঠিকানা কিছুই বলতে পারেনা।শুধু বলে, – আমাকে একটি মরার রাস্তা বলে দেবেন,প্লিজ? ওরা আবার আসবে।তার আগেই আমি মরে যেতে চাই….ওরা মানে কারা আমি বুঝতে পারিনা।মেয়েটিও বলতে পারেনা।’
– ‘এরপর?’
– ‘এরপর মেয়েটিকে আমি বিয়ে করি।’
– ‘বিয়ে? কেনো?’ লোকটি আমার এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি। আমি আবার বললাম, – ‘আপনার পেশা?’
– ‘মেয়েটিকে যখন বিয়ে করি, তখন আমি ছিলাম একজন সরকারী কর্মকর্তা।’
– ‘আপনি কী জানতেন না যে, মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ?’
– ‘জানতাম…’
– ‘তবুও বিয়ে করলেন?’
লোকটি আমার এই প্রশ্নটিরও কোন উত্তর দিলেন না। উনি উনার মতো বলে যেতে লাগলেন- ‘বিয়ের পরে যখন তাঁর ম্যান্টাল সমস্যাটা বেড়ে যেতো, তখন সে ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে ফেলতো।হাতের কাছে যা পেতো, ছুঁড়ে মারতো। আমাদের প্রথম সন্তানকে একরাতে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে সে।’ এই কথা শোনার পর আমি শিউরে উঠি। কী সাংঘাতিক! কিন্তু লোকটাকে খুব শান্ত মনে হলো।
উনার সন্তানকে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী গলা টিপে মেরে ফেলেছে এটা যেন খুব স্বাভাবিক কোন ব্যাপার! লোকটা বলে যেতে লাগলো- ‘একরাতে আমি অফিসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ফাইল রেডি করছিলাম।এমন সময় তাঁর মধ্যে পাগলাটে ভাবটা চলে আসে।’ আমি আমার মোটা, কালো ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললাম,- ‘তারপর?’ ‘এরপর সে আমার টেবিল থেকে ফাইলটা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।’ আমি আবারো শিউরে উঠি।বললাম,- ‘এরপর?’ লোকটা বলেন,- ‘এরপর আর কী! আমার সরকারি চাকরিটা চলে গেলো।’ আমি তৃতীয়বারের মতো চমকে উঠলাম।বললাম,- ‘বলেন কী? এতোকিছুর পরও আপনি ঘর-সংসার করছেন?’ লোকটা স্মিত হাসলো।খুবই সুন্দর হাসি।এরকম হাসিটা খুব সুখী মানুষরাই কেবল হাসতে পারে।একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট হিসেবে এটা আমি ভালোভাবেই জানি।
লোকটা বললেন,- ‘ডাক্তার সাহেব! আমি আমার স্ত্রীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।তার জন্য চাকরি, সন্তান কেনো, আমি আমার প্রাণটাও দিতে প্রস্তুত।’ লোকটার কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো।জীবনে এই প্রথম আমি এতোটা আবেগাপ্লুত হলাম। আজ থেকে আট বছর আগে যাকে আমি ফোনে দুই মিনিট সহ্য করতে পারিনি, তাকে এই লোকটা কীভাবে এতোগুলো বছর, এতোটা ভালোবেসে যাচ্ছেন? এতোটা সহ্য করে যাচ্ছেন? এটাই মনে হয় প্রেম! এটাই মনে হয় ভালোবাসা। এরাই তো তারা, যারা পৃথিবীতে ভালোবাসা ফেরি করে বাঁচে। আমি মনে মনে বললাম,- ‘হাজার বছর বেঁচে থাকুক এই ভালোবাসা।’