অন্ধকার রুমে দরজা বন্ধ করে খাটের একপাশে হাতপা গুটিয়ে বসে আছে মাইশা। চোখ দুটো লোনা জলে ভিজে আছ কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলটা অন করে আরফানের ছবি দেখছে। আরফান হল তার স্বামী। তাদের বিয়েটা হয়েছে কিছুদিন আগে তাও বেশ অদ্ভুত ভাবে। এইতো কিছুদিন আগের কথা বাবা, ভাইবোনের অবহেলা, তিরস্কার আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করার জন্য ট্রেন লাইনে চুপ করে বসেছিল মাইশা। আরফান বাঁচিয়েছিল। কিন্তু মাইশার কোনো ইচ্ছেই ছিল না বেঁচে থাকার। অনেক বুঝানোর পর মাইশা রাজি হয়েছিল। তবে শর্ত দিল তাকে বিয়ে করার। অনেক ভেবেচিন্তে আরফান রাজি হয়েছিল। মাইশা-আরফান খালাতো ভাইবোন। বিয়েতে আরফানের দুই বন্ধু ও মাইশার এক বান্ধবী উপস্থিত ছিল। তাদের বলা হয়েছিল দীর্ঘদিনের প্রেম। অথচ এমন কিছুই ছিল না। একে অপরের বাসায় খুব একটা যাওয়া আসাও হত না।
বিয়ের পর থেকেই নিজেকে রুমের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে মাইশা। কারণ সে ভাবছে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি। মাইশার প্রতি তার বাবা ও ভাইবোনের তেমন কোনো গ্রাহ্য নেই। মাইশা কোথায় আছে, কি করছে, খেয়েছে কিনা কোনো কিছুরই খবর তারা ঠিকমতো রাখে না। এসবের মূল কারণ হল মাইশা বোবা। তবে মা ঠিকই ভালবাসে। মাইশা হল পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। এক বড় ভাই ও এক ছোট বোন আছে। বেশ ধনাঢ্য তারা।
অন্যদিকে আরফানও বিয়েটা নিয়ে কিছুটা ডিপ্রেশনে আছে। তার নিজেরই চলতে কষ্ট হয়। তারওপর এখন একটা মেয়ের দায়িত্ব এসে পড়েছে। কিছু মাস হল আরফানের বাবার মৃত্যু হয়েছে। সেই থেকেই সে তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছে। প্রচুর ঋণের মাঝে ডুবে ছিল তার বাবা। পরিবার বলতে সে আর তার মা। তার একটাই ইচ্ছা, বাবার ঋণ গুলো পরিশোধ করবে। তাই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমও করে যাচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিনই মাইশা আরফানকে ফোন দেয়। আরফান শত ব্যস্ততা রেখেও মাইশাকে সময় দেয়। কারণ সে জানে মাইশা ডিপ্রেশনে আছে। তার এখন একজন ভাল সঙ্গী দরকার। আর স্বামী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব। তবে আরফান কখনো নিজ থেকে মাইশাকে ফোন দেয় না। ব্যস্ততার কারণে সময় পায়না। একদিন একটা রেষ্টুরেন্টে মাইশার সাথে আরফানের দেখা হয়ে গেল। দেখাটা হয়েছে মাইশার বান্ধবী ইমার জন্য। ইমাই দেখিয়ে দিয়েছে। অতঃপর তিনজনে মিলে একটা টেবিলে বসলো। আরফান চেষ্টা করে মাইশার আকার ইঙ্গিত বোঝার, চোখের ভাষা পড়ার, মনের অনুভূতি অনুভব করার। নাস্তা পানি করে আরফান, মাইশা ও তার বান্ধবীকে ভার্সিটির গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
= এমন কিপটা ছেলেকেই বুঝি বিয়ে করতে হল তোর? মানিব্যাগটা দেখিছিস? ভাংতি নোটের বস্তা। বিল যখন পে করছিল আমার তো তখন লজ্জায় মাথা শেষ। কি ভাংতি ভাংতি নোট দিচ্ছিল। হায়রে কপাল! জবাবে মাইশা জানালো, “তোর কাছে যে ভাংতি নোট। আমার কাছে সেটা তার পরিশ্রমে অর্জন করা সম্পদ।” ইমা চুপ হয়ে গেল।
আজ মাইশার সাথে তার বড় ভাইয়ের বেশ ঝগড়া হল। কারণ তার বড় এসাইনমেন্টের খাতা পানিতে ভিজে যায়। আর বড় ভাই এর জন্য মাইশাকেই দোষারোপ করে। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। ছোট বোনও মাইশাকে দোষারোপ করেছে। সব কষ্ট-অভিমান আরফানের সাথে শেয়ার করলো। আরফান দেখা করার কথা বলল। অতঃপর দুজনে নদীর পাড়ে দেখা করলো। মাইশার চোখের পানি দেখে আরফানের মনটাও ডুকরে উঠলো। অনেক ভেবেচিন্তে বলল তার কাছে চলে আসতে। কিন্তু মাইশা রাজি হল না। কারণ সে জানে এই মুহূর্তে আরফানের অবস্থা তেমন একটা ভাল না। আরফানের চোখে নিজের জন্য করুণার পরিবর্তে ভালবাসা দেখে বাঁচার ইচ্ছা জাগলো মাইশার মনের মধ্যে।
আজ মাইশার সকালটা শুরু হয়েছে আরফানের কলের মাধ্যমে। মাইশা বেশ অবাক হয়েছে। এই প্রথম মাইশাকে কল করেছে সে। মেসেজ করতে যেয়ে দেখলো অনেকগুলো মেসেজও করেছে আরফান। কিছুক্ষণ চ্যাটিং করে আরফান নিজের কর্মক্ষেত্রে গেল আর মাইশা উঠে পড়লো। আজ মাইশাকে ভিন্ন দেখাচ্ছে। সর্বদা মনমরা থাকা মেয়েটি আজ যেন আনন্দে উড়ছে।
দিনদিন মাইশার প্রতি আরফানের ভালবাসা বাড়ছে। আরফানের কেয়ারিং ভাবের মধ্যে মাইশা তা বুঝতেও পারছে। আরফানের দেখানো পথ অনুযায়ী মাইশাও নিজেকে ভালবাসতে শুরু করেছে। আগে নিজের উপরই মাইশার অনেক ক্ষোভ ছিল। কেন সে এমন! কিন্তু এখন আর তা নেই। দিনদিন মাইশার পরিবর্তন দেখে পরিবার ও বন্ধুমহলের সবাই অবাক হচ্ছে। সারাদিন অন্ধকারে থাকা মেয়েটি এখন খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায়। বড় ভাই ও ছোট বোন থেকে দূরে থাকা মেয়েটি আজ তাদের সাথে একত্রে চলছে। টিভি দেখা, খাওয়া দাওয়া সবই এক সাথে করছে। অথচ একটা সময় মাইশা এসব কিছুই একা একা করত। এখন ভাইবোন এড়িয়ে চললেও মাইশা লেগেই থাকে। মাইশার এমন পরিবর্তন দেখে তার মা বেশ খুশি হলেন। তিনি এটা অনেক আগ থেকে চাইতেন। মাইশা সামনের রুমে বসে আরফানের সাথে চ্যাট করছে। মাইশার মা বসে বসে কিছু হাতের কাজ করছেন। হঠাৎ তিনি মাইশাকে প্রশ্ন করলেন,
= ছেলেটা কে? মাইশার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। মুহূর্তেই বিচলিত হয়ে পড়লো। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
= আমি তোর মা। তোর সবকিছু দেখাশোনা করা আমার দায়িত্ব। ছেলেটা কে, কেমন, পরিবার কেমন সব তো জানতে হবে তাই না? জীবন তো আর ছেলেখেলা নয়।
মাইশার মায়ের মোবাইলে মেসেন্জারের টুংটাং শব্দ হল। মাইশা সাথেসাথে উঠে দৌড় দিল। মুখে লজ্জার ভাব ছিল। তিনি বুঝলেন যে মাইশা-ই মেসেজটা দিয়েছে। এটা তার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিছুদিন ধরে মাইশা পরিবারের সবার সাথে ফেবু, ইমু এসব দিয়েই যোগাযোগ করছে। কাগজের লেখা বা ইশারা পড়া বা বুঝার সময় বাবা, ভাই ও বোনের নেই। মা তো ছোট থেকেই মাইশাকে বুঝে। মাইশার এই অনলাইনের নিয়মের সাথে এখন তিনি পরিচিত। তিনি মেসেজ চেক করে আরফানের ছবি দেখলেন। তিনি তো ভাল করেই চিনেন। বড় বোনের ছেলে। খুব পরিশ্রমী। তিনি ভেতর রুমে এলেন।
= ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। তোর বাবাকে বলব?
বিয়ের কথা শুনে মাইশা মনে মনে হেসে উঠলো। বিয়ে তো আগেই করেছি। লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাইশা জানালো আরও পরে। আরফান আগে সেটেল হতে চায়। তারপর বিয়ে। অন্যদিকে দিনদিন আরফানের ব্যবসায় উন্নতি হতে লাগল। বাবার সকল ঋণ পরিশোধ করে আরফান এখন ব্যবসাকে সমৃদ্ধ করছে। একদিন মাইশার বাবা মাইশা ও আরফানকে দেখে ফেলে। আসলে খবরটা মাইশার ছোট বোন দিয়েছে। তাদেরকে দেখে মাইশার বাবা বেশ অবাক হল। দুজনে একে অপরের সাথে অনবরত হাতের ইশারায় কথা বলে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ গাড়িতে বসেই লক্ষ্য করলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর ফুসকা-চটপটি খেয়ে মাইশাকে বাড়ির কাছে দিয়ে আসলো। মাইশা যখন বাড়ির গেইটে ঢুকলো তখন আরফান নিজের গন্তব্যে রওনা দিতে লাগল। কিন্তু সামনেই মাইশার বাবাকে দেখে থমকে গেল।
– আ…আ…আসসালামু আলাইকুম খালু।
~ গাড়িতে উঠো, কথা আছে।
আরফান চুপচাপ গাড়িতে উঠলো। বুঝলো যে ধরা পড়েছে। ড্রাইভার বেরিয়ে গেল। এখন গাড়িতে শুধু আরফান ও মাইশার বাবা। তিনি সরাসরি আরফান থেকে জানতে চাইলেন, “তোমার সাথে মাইশার সম্পর্ক কি?” আরফান বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তারপর বলল,
– আমরা একে অপরকে পছন্দ করি। গাড়ির মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করলো। তারপর আরফান বলল,
– কিছু মনে না করলে দু চারটা প্রশ্ন করতে পারি? তিনি গুরুগম্ভীর ভাবে হুম বললেন।
– আপনার দুটা মেয়ে। কিন্তু আপনি কি কখনোই দুজনের সাথে একই আচরণ করেছেন?
দুজনকে একই স্নেহ, ভালবাসা দিয়েছেন? মাইশা বোবা বলে তাকে সবসময় আপনি অন্য চোখে দেখেছেন। কখনো কি ওর মনটাকে বুঝার চেষ্টা করেছেন? কখনো কি ভেবেছেন করুণা নিয়ে বেঁচে থাকা কতটা কষ্টকর? শুধু একবার অনুভব করে দেখুন। তিনি নীরবে শুধু শুনে গেলেন। কিছু বললেন না।
– আপনার নীরবতাই আমার উত্তর। আসি। দোয়া করবেন।
আরফান গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। মাইশার বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়িতে বসে রইলেন। আরফানের কথাগুলো যেন তার চারপাশে গুনগুন করতে লাগল। প্রশ্ন গুলোর কোনো জবাব তার কাছে নেই। বাবা হিসেবে তিনি কখনোই মাইশাকে ভালবাসা দেননি। ভরাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি গাড়ি থেকে বের হয়ে হেটে হেটে বাসায় চলে এলেন। গাড়ি বাসার সামনেই পার্ক করা ছিল। বাসায় তার ভাইয়ের স্ত্রী ছেলেকে (৫বছর) নিয়ে বেড়াতে এসেছে। মাইশা ছেলেটির সাথে সোফার চারপাশে দৌড়াদৌড়ি খেলছে। আজ প্রথম তিনি মাইশার দিকে ভালমত তাকালেন। মেয়েটি এখন আর আগেরমত নেই। আগে মেহমান থাকুক বা না থাকুক সে নিজ রুমেই আবদ্ধ থাকত। এমনকি ভাইবোনের সাথেও মিশত না। কিন্তু এখন সে সবার সাথে মেলামেশা করে। আগে মাইশার মুখটা সবসময়ই মলিন থাকত কিন্তু এখন হাস্যোজ্জ্বল থাকে। এটা ছোট থেকেই থাকত যদি তিনি বাবার ভালবাসা দিতেন। বাবার ভালবাসার অভাবে মাইশা ভাইবোনের ভালবাসা থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। পরিবারের ভালবাসার অভাবে মাইশার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গিয়েছিল।
চাচাতো ভাইয়ের সাথে খেলতে খেলতে মাইশার নজর তার বাবার দিকে পড়লো। এভাবে বাবা আগে কখনো তাকায়নি। তবে মাইশা বুঝতে পারছে না তার বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি ভাইপোর দিকে। মাইশা তার চাচাতো ভাই থেকে কিছু কদম বামে গেল। তারপর আবার কিছু কদম ডানে গেল। শিউর হওয়ার জন্য যে তার বাবা কার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশা বুঝলো যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাইশা মাথাটা হালকা বাকা করে বাচ্চাদের মত বাবার দিকে তাকালো। আয়নার প্রতিফলনের মত মাইশার বাবাও মাথা বাকা করলো। মাইশা দাঁত বের করে হাসির ইঙ্গিত দিয়ে আবার খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুরো ব্যাপারটা মাইশার মা লক্ষ্য করলো। মাইশার মা এগিয়ে এসে বলল,
= তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি নাস্তা দিচ্ছি।
তিনি ফ্রেশ হতে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলেন মাইশা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাইশা গ্লাসটা এগিয়ে দিল। লেবুর তৈরি ঠান্ডা শরবত। তিনি গ্লাসটা হাতে নিলেন। মাইশা চলে গেল। মাইশার বাবার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো।
রাতে সবাই মিলে খেতে বসলো। মাইশা, তার বাবা-মা-ভাই-বোন-চাচী ও চাচাতো ভাই। আগে মাইশা নিজ রুমে খেত। এভাবে সবার সাথে একত্রে খেতে বসতো না। আরফানের ভালবাসা ও সাহস পাওয়ার পর থেকেই চিত্রটা এমন হয়েছে। সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলো। তখন চাচী বলল, “খাবার কেমন হল?” সবাই প্রসংশা করলো। সবাই মনে করলো চাচী বানিয়েছে। মুচকি হাসি দিয়ে চাচী বললেন, “আজ খাবার মাইশা বানিয়েছে। আমাদেরকে একটু হাতও লাগাতে দেয়নি।”
দেখতে হবে তো মেয়েটা কার। এমন সুস্বাদু খাবার কেবল আমার মেয়েই বানাতে পারে। এমন সুস্বাদু খাবার আগে কখনো খাইনি। চমৎকার! কিসের ফাইভ স্টার হোটেল! এটা টেন স্টার হোটেল থেকেও সুস্বাদু খাবার।” এসবই মাইশার বাবার মনের কথা। যখন শুনলেন মাইশা বানিয়েছে তখন এগুলো বলতে চেয়েছেন। কিন্তু মুখ থেকে একটা বাক্যও বের হয়নি। কেন? তা তিনি নিজেও জানেন না। হয়তো এত বছর মেয়ের থেকে দূরে থাকার কারণে আজ মুখ থেকে কথা বের হয়নি। যাকে আমরা ইগো বলে থাকি। চাচী বেশ প্রসংশা করেছে। আরফান ও মাইশা পাশাপাশি বসে চ্যাটিং করছে।
> একটা কথা বলি রাগ করবে নাতো? (মাইশা)
– হুম বলো জান।
> হুহ! ঢং! আচ্ছা তুমি কি আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছ নাকি বিয়ে করেছ তাই সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছ?
– ভালবাসা মন থেকেই হয়।
> না মানে আমাদের বিয়েটা তো একটা দুর্ঘটনা ছিল। বলতে গেলে ব্ল্যাকমেইল করেই বিয়েটা করতে বাধ্য করেছিলাম তোমাকে।
– তোমার কাছে কি তা আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে ভাগ্য পরিবর্তন। তুমি আমার ভাগ্যবতী।
> হিহিহি ভাগ্যবতী! আমার পরিবারের লোকজনই ভাবে আমি অলক্ষী।
– এসব আমি জানি না। তুমি আমার কাছে ভাগ্যবতী।
> কিভাবে একটু শুনি তো।
– তুমি আমার জীবনে আসার পর আমার ভাগ্য খুলেছে। বাবার ঋণ গুলো কিভাবে যে পরিশোধ করে ফেলেছি তা আমি নিজেও জানি না। এখন আল্লাহর রহমতে মোটামুটি ভাল পর্যায়েই আছি।
– ভাগ্য নয় তোমার কঠোর পরিশ্রমই এর ফল।
দুজনের তর্কবিতর্ক নিয়ে সময় কেটে গেল। চলছে তাদের জীবন এভাবেই খুনসুটির মধ্য দিয়ে। এক বিকালে মাইশার বাবা ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন। স্ক্রিনে মাইশার ইনবক্স। কিছু লিখতে চাচ্ছেন কিন্তু কেন যেন পারছেন না। মাইশার সাথে এতদিন যাবত্ কঠোর আচরণ করে এসেছেন। যার ফলে আজ নরম হতে দ্বিধাবোধ হচ্ছে। স্ক্রিনে মাইশার মেসেজ ভেসে উঠলো।
> ভালবাসি বাবা। আসলে দোষটা আমারই। আমিই কখনো তোমাদের সাথে সহজ হইনি। এড়িয়ে চলেছি।
তিনি আশেপাশে তাকিয়ে মাইশাকে পিছনে পেলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। তিনি কিছু বলতে পারলেন না। চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরতে লাগল। মাইশা সামনে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে কোলে মাথায় রাখলো। তিনি মাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আড়াল থেকে মাইশার মা সব দেখলেন। তার চোখ বেয়ে সুখের অশ্রু ঝরতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মাইশার বাবা বলবেন,
– আরফান খুব ভাল ছেলে।
মাইশা উঠেই দিল দৌড়। একদিন মাইশার মোবাইলে তার বড় ভাই আরফানের মেসেজ গুলো দেখে সব বুঝে ফেলল। এই নিয়ে মাইশার সাথে বেশ ঝগড়া হল। দু চারটে থাপ্পড় মেরেছে। অনেক কথাও শুনিয়েছে। বংশের নাম ডুবাতে শুরু করছে, দুদিন পর পালিয়ে যেয়ে সমাজে মুখ দেখানো বন্ধ করে দিবে ব্লা ব্লা ব্লা। মাইশার মা কিছুই বলতে পারেনি। আজ বন্ধের দিন। তাই আরফান নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মায়ের ডাকে ঘুম ভাংলো।
= বাবা আরফান, দেখে যা কে এসেছে।
আরফান এসে দেখলো মাইশা এসেছে। চোখ দুটো কপালে উঠে গেল। এবার যা দেখলো তাতে চোখ লাফিয়ে আকাশে চলে গেল। মাইশার হাতে একটা বড় ব্যাগ। আরফান নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের ডাকে হুশ ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এলো। মা রান্নাঘরে কাজ করছে। মাইশাও সেখানে। মাইশা কিছুক্ষণ পর বের হল। সাথেসাথেই আরফান ধরলো।
– তুমি এখানে কেন?
> সে কৈফিয়ত তোমাকে দিব? (মেসেজিং)
– ব্যাগ কেন?
মাইশা একটা ভেংচি মেরে রান্নাঘরে চলে গেল। আরফানের মন আনচান আনচান শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর আরফানের মা এসে আরফানকে নাস্তা দিয়ে বলল,
= বউ মা বানিয়েছে।
– মানে! কিসের বউ মা! কার বউ মা!
= আর লুকাতে হবে না। আমরা সব জানি।
– আমরা মানে?
= মাইশার মাও জানে, আমিও জানি। আমি আগেই জানতাম।
কিছু বলিনি। ছোট থেকেই মাইশাকে আমার খুব পছন্দ। মেয়েটা ছোট থেকেই বড্ড ভাল। যাক ভালই হয়েছে। কিছুদিন পরেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব। আরফান কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। মাইশা তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া আরফানের বাসায় চলে এসেছে। রাতে মাইশার বাবা আরফানের বাসায় এলো। মাইশা জানত তার বাবা আসবে। তাঁকে দেখে আরফানের মা বললেন,
= আরে দুলাভাই আসেন আসেন। ভেতরে বসেন।
~ মাইশাকে নিতে এসেছি।
= আগে বসেন।
কতদিন পর এলেন। মেয়ে তো নিয়ে যাবেনই। তবে খুব শীঘ্রই ছেলের বউ করে নিয়ে আসব।
মাইশা লজ্জা পেয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আরফান এদিক সেদিক তাকাতে লাগল যেন কিছুই শুনেনি। কিছুক্ষণ পর নাস্তা পানি দেয়া হল। খেয়েদেয়ে মাইশার বাবা মাইশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তবে খুব শীঘ্রই মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে। এটা ভেবেই কেন যেন তাঁর মনটা ডুকরে উঠছে। তবে এটাই নিয়ম। সব পিতাকেই এই ত্যাগ করতে হয়। এখন শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা। ভালবাসা দুর্বলকে সবল করে, দুখীকে সুখী করে। ভালবাসা হাসতে শেখায়। ভালবাসা বাঁচতে শেখায়।