– স্যার আপনি কি কানে কম শোনেন? ছাত্রীর মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা চমকে তাকালাম। আমার চাহনি দেখে ও হয়তো ভয় পেয়েছে। তাই ঢোক গিলে বলে উঠলো,
– না মানে স্যার এতবার ডাকার পরও শুনলেন না তাই…
– কেন ডাকছিলে?
– স্যার হিসাববিজ্ঞানের জনক কে যেন? বারবার শুধু ভূলে যাই।
– লুকা প্যাসিওলি। এই শেষবার বললাম, এরপর জীজ্ঞেস করলে কান টেনে ছিড়ে ফেলবো বলে দিলাম।
– আচ্ছা স্যার।
আসলে আমি মনে মনে একটা কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম এবার গ্রামে গেলে ইরার বাসায় বিয়ের প্রস্তাবটা পাঠিয়েই দিব। আর কত লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা যায়? তাছাড়া বাবা মা অনেক চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য। তাই এবার বিয়েটা করেই ফেলবো। এসব ভাবছিলাম, এর মাঝেই আমার ছাত্রী আমাকে বারকয়েক ডেকেছিল। আমি শুনেছিলাম, কিন্তু ভাবনার জগতে থাকার ফলে আর সাড়া দিতে পারিনি। আমার ছাত্রীর নাম তানজিলা। লেখাপড়ার মাথা খুব একটা খারাপ না আবার ভালও না। মাঝারি মানের মেধাবি যাকে বলে আরকি। আমাকে খুব ভয় করে। যদিও আমি ওর উপর কখনো হাত তুলিনি বা ধমক দিয়ে কথা বলিনি। তারপরও আমাকে খুব ভয় পায়, কিন্তু এর কারণ আমি জানি না।
আমার পরিচয়টা দিয়ে ফেলি। আমি আরমান হোসেন, মাস্টার্সে পড়ছি। পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়ি থাকে, শুধুমাত্র আমি একাই থাকি এই ঢাকায়। একটা পাঁচ তারকা মেসে থাকি। পাঁচ তারকা বলতে ঠিকমত তিনবেলা খাবার, পানির কোন সমস্য নেই। এই কারনেই আমি এই মেসের নাম দিয়েছি পাঁচ তারকা মেস। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি শুধু এই একটা টিউশনিই করাই। তাও করাতাম না, যদি না তানজিলা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রাশেদের বোন না হতে। তানজিলাকে পড়ানো শেষ করে রাস্তায় বের হলাম। আজ ইচ্ছে আছে একা কিছুক্ষন হাঁটবো। তাই হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষন পরই রাশেদের ফোন এলো।
– হ্যালো আরমান কই তুই?
– আমি তো রাস্তায় দোস্ত।
– রাস্তায় তো বুঝলাম। কিন্তু কোন জায়গায় আছিস?
– এইতো আছি কাকরাইল মসজিদের আশেপাশে।
– যেখানে আছিস সেখানে থাক, আমি আসছি।
– জলদি আয়।
কাকরাইল মসজিদের পাশেই রমনা পার্ক। চারপাশে জেলখানার মত আটকানো। বেশকিছু বিশাল দেহের অধিকারি মানুষ পার্কের ভেতর দৌড়াচ্ছে। এদেরকে সারাদিনই দেখি ব্যায়াম করে। কিন্তু ব্যায়াম করে এরা কি পায় বুঝিনা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাশেদ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।
– কিরে ডায়বেটিসের কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? ওর কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম। দেখি ও মুচকি হাসছে।
– ডায়বেটিসের কারখানা মানে?
– মানে এখন যাদের দেখছিস এদের বেশিরভাগই এই রোগে আক্রান্ত। রোগটাকে কাবু করতেই তাদের যত দৌড়ঝাঁপ।
– আহ আফসোস। আচ্ছা রাশেদ আজ কই যাওয়া যায় বলতে পারিস?
– চল আজ শুধু হাঁটবো।
– ওহ আমিও এই চিন্তা করছিলাম একটু আগেই। চল পার্কের ভেতর যাই।
– হুম চল।
রাতে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিলাম। ফেসবুকে অনেককেই দেখি গল্প লেখে। আমিও চেষ্টা করি লেখতে। কিন্তু লেখা শেষে দেখা যায় পুরাই অখাদ্য হয়েছে। তাই আর কখনো পোষ্ট করা হয়ে উঠে না। তবে আজ মাথায় দারুন একটা গল্প সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। লেখা শুরু করতেই দেখি মনের সব আবেগ ঝড়ের গতিতে কলমের ডগায় নেমে এসেছে। লিখছি তো লিখছিই। কোন দিকে কোন খেয়াল নেই। নায়ক নায়িকাকে বলছে,
– আচ্ছা নীলা এই সম্পর্কের পরিনতি কি হতে পারে জানো?
– আমি জানিনা, জানতে চাই না।
আমি শুধু তোমাকে এমন একটা চরম মূহুর্তে আমার বেয়াদব মোবাইলটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। আমি বসেছি টেবিলে আর মোবাইলটা বিছানায়, তাই আর উঠলাম না। এখন উঠলেই গল্পটার আবেগ হারিয়ে যেতে পারে। আমি একমনে গল্প লিখছি আর এদিকে মোবাইলটা একটানা বেজে চলেছে।
একঘন্টা লেখার পর গল্পটা শেষ হলো। আহ কি গল্পটাই না লিখলাম। নিজের গল্প পড়ে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। নাহ আরমান লেখালেখির দুনিয়ায় তুই নতুন রত্ন। তোকে দিয়েই হবে। নিজেকে নিজেই বাহ, মারহাবা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন কিছুক্ষন আগে ফোন দিয়েছিল। তারাতাড়ি করে মোবাইলটা হাতে নিলাম। নাম্বারটা দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড়। পনেরটা মিসডকল। তাও আবার ইরার নাম্বার থেকে। গল্প লেখার ধান্ধায় কখন যে নিজের কপালে বিপদ ডেকে এনেছি বুঝতেই পারিনি। কাঁপা কাঁপা হাতে ইরাকে ফোন দিলাম। দুইবার রিং পর ইরা ফোন রিসিভ করলো,
– হ্যালো ইরা।
– কে বলছেন?
– আমাকে চিনতে পারছো না? আমি আরমান।
– সরি, আমি আরমান নামে কাউকে চিনি না।
– ইরা, ইরা আমি সরি। আসলে ফোনের শব্দটা কান পর্যন্ত পৌছায়নি তো, তাই ধরতে পারিনি। সামনে পরীক্ষা তো তাই পড়ছিলাম।
– তুমি যে কি পড়া পড়তে পারো আমি জানি। এতবার ফোন দেওয়ার পরও তুমি শোনো নাই হুম?
– এতবার কই ফোন দিলে? মাত্র তো তিনবার। (মিথ্যা বললাম)
– তিনবার দিয়েছি ফোন? বিশবার ফোন দিয়েছি আমি। মিথ্যা বলার জায়গা পাও না?
– হুহ মিথ্যা আমি বলি নাকি তুমি? পনেরবার ফোন দিয়ে বলো বিশবার দিয়েছো? মগের মুল্লুক নাকি?
– এই মাত্র না বললা আমি তিনবার ফোন দিয়েছি? এখন পনেরবার হলো কেমনে? এইরে ধরা খেয়ে গেলাম। শালার মিথ্যাটাও বলতে পারি না ঠিকমত। কথার মোড় ঘোরাতে বললাম,
– ইরা জানো এবার গ্রামে এলে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাবটা পাঠাবো।
– তুমি কচু পাঠাবে। প্রতিবার এই একই কথা বলো।
– নাহ এবার সত্যিই পাঠাবো।
– সত্যিই পাঠাবে? তাহলে আজই চলে আসো প্লীজ। আর কতো লুকিয়ে প্রেম করবো?
– ধীরে ধীরে একটু ধীরে। সবুরে মেওয়া ফলে।
– ও তাই?
– হুম তাই আমার পাগলীটা।
– আর আমার পাগলটা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে গল্প টাইপ করা শুরু করলাম। আমার আনার মোবাইলে টাইপিং স্পীড খুব ভাল। বিশেষ করে বাংলা। তাই আধাঘন্টার মধ্যেই গল্প টাইপ করে ফেললাম। তারপর পোষ্ট করলাম ফেসবুকে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। দুপুরের দিকে আবার ফেসবুকে লগইন করলাম। বাহ মোটামুটি ভালই সাড়া পেয়েছি। অনেকে অনেক রকম কমেন্ট করেছে। বাহ আরমান, এবার তোর লেখক হওয়া ঠেকায় কে? বিকেলে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। আজ শুক্রবার, তাই বন্ধুদের সাথে লম্বা আড্ডা দিতে যাচ্ছি। এমন সময় হতভাগা ফোনটা বেজে উঠলো, ইরা ফোন দিয়েছে।
– হ্যালো ইরা।
– এই নীলা কে?
– মানে?
– মানে নীলা নামের মেয়েটা কে?
– নীলা? এইটা আবার কে?
– ন্যাকামি করো আমার সাথে? মেরে তোমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব। সত্যি করে বলো নীলা কে?
– আরে আজব নীলা নামের কোন মেয়েকেই চিনি না। নামটাই মনে হয় প্রথম শুনলাম।
– আবারো মিথ্যা বলো? গল্পে তো ঠিকই নীলা নীলা বলে একেবারে ঝড় তুলে দিয়েছো। আর এখন বলো নীলা নাম প্রথম শুনছো? এইরে কাজ সেরেছে। ইরা দেখি গল্পের চরিত্রকে বাস্তবে নামাতে চাইছে।
– হাহাহাহা ওইটা? ওইটা তো আমার মনের কল্পনা।
– ও তাই? আমাকে রেখে নীলাকে নিয়ে কল্পনা করা হচ্ছে তাই না? বুঝছি ঢাকা গিয়ে নতুন কাউকে পেয়েছ তাই গ্রামের এই মেয়েটাকে ভূলে গেছো।
– এই পাগলী কি বলো এগুলো? তুমি ছাড়া কি আমি অন্য কাউকে ভালবাসতে পারি বলো?
-(কাঁদতে কাঁদতে) বুঝি বুঝি সবই বুঝি। আমাকে আর ভালবাসো না।
– এই চুপ একদম বাজে বকবে না। তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি তা বলে কখনোই বোঝাতে পারবো না।
– যদি এতই ভালবাসো তাহলে নীলাকে নিয়ে কেন কল্পনা করো? গল্পে তো আমার নামও দিতে পারতে।
– আরে পাগলী কোথাকার, নীলা নামটা রোমান্টিক গল্পের সাথে ভাল মানায় তাই ওই নামটা ব্যবহার করেছি।
– ও আর আমার নামটা গল্পে মানায় না তাই না? মানাবে কেমনে? আমার নামটাতো পঁচা একটা নাম। দেখেন কান্ড, কোথাকার প্যাচ কোথায় গিয়ে লাগে।
– আরে কে বললো তোমার নাম পঁচা? তোমার নাম যদি গল্পে দিতাম তাহলে তো সবাই আমার এই ইরার প্রেমে পড়ে যেত, তাই নীলা নামটা দিলাম।
– সত্যি বলছো তো?
– আমি কখনো মিথ্যা বলি?
– তাহলে বলো ভালবাসি।
– ভালবাসি, ভালবাসি, হাজারবার ভালবাসি।
– মাত্র হাজারবার?
– ঠিক কতবার ভালবাসি তা বলতে পারবো না। এমন সংখ্যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ভালবাসি আমার পাগলীটাকে।
– আমিঔ ভালবাসি আমার পাগলটাকে।
যারা সত্যি আপনাকে ভালবাসে তারা কখনো আপনার ভালবাসার ভাগ অন্য কাউকে নিতে দেবে না। বাস্তবে তো দেবেই না, এমনকি কল্পনাতেও এই ভালবাসার ভাগ কাউকে দিতে নারাজ।