—ভাই তুই আমারে বাসায় নিয়ে চল। আমি এই ছোটলোকের সাথে আর সংসারই করব না।
—সংসার না করলে না করবা। কিন্তু মেয়ের সামনে মুখ খারাপ করবা না।
—কেন সম্মানে লাগে? ছোটলোক কোথাকার। কোন পাপে যে তোর মতো ছোটলোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হইছিল।
—তুই তোকারি করছ কেন?
—এক শ বার করব, হাজার বার করব। তুই একটা, তুই, তুই তুই।
ইমু বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। কার পক্ষ নেওয়া উচিত। সে তার ভাগনিকে নিয়ে মাঝের সোফায় বসে আছে। আর দুই পাশের দুই সোফায় বসে তার বোন-দুলাভাই ঝগড়া করছে। ইমুর দুলাভাই হাসেম সাহেব ছোটখাটো গড়নের সহজ সরল হাসি খুশি একটা মানুষ। পৃথিবীতে রাগ বলে যে একটা জিনিস আছে, সেটাই তিনি হয়তো জানেন না। কারণ, তাকে কেউ কখনো রাগতে দেখেনি। অপর দিকে ইমুর বোন কেকা রাগী একটা মেয়ে। দুই দিন পর পর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করবে। আর বাপের বাসায় ফোন করে কাউকে না কাউকে ডেকে আনবে স্বামীর বিচার করার জন্য। প্রথম প্রথম ঝগড়া লাগলে বাবার বাসা থেকে কেউ না কেউ আসত। বিচারের চেষ্টা করত। কিন্তু এখন আর ভয়ে কেউ আসে না।
কারণ যিনি বিচারক হয়ে আসেন, তার দুই দিকেই সমস্যা। তিনি যে পক্ষেই রায় দিন না কেন, তাকে সমস্যায় পড়তে হবে। রায় যদি কেকার বিপক্ষে যায়, তাহলে আগুন লাগবে। আবার বিচারক যদি কোনো কারণে তার স্বামীকে শাসন করেন কিছু বলে, তা হলেও আগুন লাগবে। কারণ কেকা তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কেকার সামনে তার স্বামীকে ছোট করে কেউ কিছু বলে পার পাবে না। সে যেই হোক না কেন। যে কারণে এখন আর কেউ ঝগড়া মেটাতে আসে না। তবে আজ ইমুর মা জোর করে ইমুকে পাঠিয়েছে। কারণ কেকা ফোন করে বলেছে, তার স্বামী নাকি আজ তাকে খুন করতে চেয়েছিল। সে নাকি কেকাকে হত্যা করার জন্য কিছু একটা ছুড়ে মেরেছে।
—ভাই তুই তো জানিস আমি জীবনেও রান্না করিনি। তারপরও বিয়ের পর থেকেই রান্নার বই, রান্নার অনুষ্ঠান দেখে দেখে কত কিছু রান্না করে খাওয়াই। তারপরও হারামজাদার স্বাদ মেটে না। বলে আমার রান্না ভালো না।
—এ কথা আমি কখনো বলিনি। দেখো তোমার রান্না নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নাই। তুমি যা রান্না করো আমি খাই। আমি শুধু বলছি, তোমার বান্ধবীর রেসিপি আমারে আর খাওয়াইয়ো না।
—দুলাভাই তোর কোন বান্ধবীর কথা বলছে রে আপা? বোনকে প্রশ্ন করে ইমু।
—আরে না আমার কোনো বান্ধবী না। কেকা ফেরদৌসী আপা আছে না। ওই যে রান্নার অনুষ্ঠান করে। আমার নামে নাম তো তাই টিটকারি মারছে। তোরা তো মনে করিস এই ব্যাটা সহজ সরল। আসলে ব্যাটা একটা মিনমিনা শয়তান।
—তুমি কিন্তু মেয়ের সামনে বারবার মুখ খারাপ করছ। শান্ত হয়ে বসো। আমার বক্তব্যটা আমি আগে ইমুকে বলি, তারপর তুমি তোমার বক্তব্য দিয়ো। ইমু শুনো– প্রথম দুই–তিন রোজায় ইফতারিতে ভাজা পোড়া খেয়ে খেয়ে আমার গ্যাস্ট্রিক বেড়ে গেছে। বুক জ্বালা–পোড়া করে। তো আমি তোমার বোনকে বললাম, এখন থেকে বুট পেঁয়াজু করো না। অন্য কিছু করো। কোনো দিন চিড়া, কোনো দিন নুডলস ইত্যাদি।
ভাইরে এ কথা বলে কি যে ভুল করেছি আর কি যে বিপদে পড়েছি। প্রথম দিন করল নুডলস পাকোড়া। ভালো কথা। পরের দিন করল নুডলস তেহারি। ঠিক আছে তাও খেলাম। পরের দিন নুডলস স্যান্ডউইচ। এখন প্রতিদিন নুডলস। নুডলস আচার, নুডলস মোরব্বা, নুডলস সেমাই, নুডলস ভাজি, নুডলস শুঁটকি, নুডলস মুড়িঘন্ট, নুডলস সমুচা, নুডলস পরোটা, নুডলস দোপেঁয়াজু, নুডলস চটপটি, নুডলস কালা ভুনা। নুডলস দিয়ে যে এত কিছু হয় আমার জানা ছিল না। ভাইরে এই কয়দিনে নুডলসের এত পদ খাইছি যে, আমি এখন স্বপ্নেও নুডলস দেখি।
দুলাভাই দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো নুডলস আমার প্রিয় একটা খাবার ছিল। অথচ এখন এই নুডলসের নাম শুনলেও আমার ভয় লাগে। আমি নুডলসের ভয়ে তোমার বোনেরে বললাম, আমি এখন থেকে ভাত ছাড়া আর কিছু খাব না। কোনো তরকারীও লাগবে না। শুধু একটু ভর্তা কইরো। কারণ, তরকারি চাইলে হয়তো দেখা যাবে নুডলস দিয়ে ডাল বা মাছ রান্না করে ফেলছে। তাই বললাম, একটু ভর্তা কইরো। ভাইরে আজ ইফতারিতে ভাত খাইতে বসে দেখি, নুডলসের ভর্তা বানাইছে। আর সহ্য হইলো না। বাসায় যত নুডলস ছিল, সব ছুড়ে ফেলে দিছি। ছুড়ে মারার সময় একসিডেন্টলি একটা ম্যাগি নুডলসের প্যাকেট তার গায়ে লাগছে। এখন সে সবারে ফোন করে বলতেছে, আমি নাকি তারে খুন করতে চাইছি। নুডলসের প্যাকেট ছুড়ে কাউরে যে খুন করা যায়, আমি জানতাম না। ভাই তুমি বলো এখানে আমার অপরাধ কি? কেন আমি সারাক্ষণ শুধু নুডলস খাব?
—খাবি তুই শুধু নুডুলসই খাবি। নুডলস তোরে আমি গুলায়ে গুলায়ে খাওয়াব। নুডলসরে এত হিংসা লাগে কেন? নুডলস তোর থেকে লম্বা তাই তোর হিংসা লাগে?
—দেখো কেকা, আমি খাটো সেটা তোমার বলার দরকার নাই। আমি জানি আমি খাটো।
—দুলাভাই রাগ কইরেন না। আপা তো মিথ্যা বলেনি। আপনি তো আসলেই খাটো। তবে আপার তুলনাটা কিন্তু আমার জোশ লেগেছে। নুডলসও আপনার থেকে লম্বা। হা–হা–হা।
—ইমু তুই এটা কি বললি?
আমার হাসবেন্ডরে তুই কি বললি? বেয়াদব। তুই এখনই আমার বাসা থেকে বের হ। ইমু আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। বের হয়ে পড়ে বাসা থেকে। বাসা থেকে বের হয়েই হাসতে থাকে। ইমুর সকালে একটা ক্লাস টেস্ট আছে। তাই পড়া বাদ দিয়ে বসে বসে বোন–দুলাভাইয়ের অর্থহীন ঝগড়া শোনার কোনো মানে হয় না। ওর এখনই বাসায় যাওয়া উচিত। সে কারণেই ইচ্ছে করে দুলাভাইকে খাটো বলেছে। ও জানত ওর বোন এটা সহ্য করবে না। ইমু জানে ওর বোন এখন সারা রাত স্বামীকে খাটো বলার দুঃখে কাঁদবেন। হায়রে ভালোবাসা।