বাসায় ঢুকেই বুঝলাম আজ আবহাওয়া অনুকূল নয়। বাচ্চা দুটো নিজ নিজ বিছানায় শুয়ে ফোনে গেম খেলছে। বেডরুম থেকে আল্লাহর পবিত্র কালাম ভেসে আসছে। অন্য সময় বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে দুটো উড়োজাহাজের মতো উড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিন্তু আজ আসেনি। সম্ভবত তারা বাসার বিরাজমান খারাপ আবহাওয়ার কারণে উড্ডয়নের রিস্ক নেয়নি। যখনই বাসার আবহাওয়া খারাপ থাকে তখনই মেয়ে দুটো চুপচাপ হয়ে যায়। আর আমার বাসার আবহাওয়া নিয়ন্ত্রিত হয় আমার স্ত্রীর মর্জির ওপর।বেডরুমে উঁকি মেরে দেখলাম, গিন্নি নামাজ পড়ছে। নামাজের ডিস্টার্ব হবে দেখে বেডরুমে না ঢুকে মেয়েদের কাছে গেলাম। মেয়েরা কোনো কথা না বলে নি:শব্দে হাগ করল। ফিশফিশ করে বললাম,
-“কাহিনী কি মা জননীরা ? তোমরা আজ এতো শান্ত কেন ? তোমরা দুই বোন কি আজ বাসায় কোন ঘটনা ঘটাইছো ?“ ছোট মেয়ে আমার মতোই ফিশফিশ করে উত্তর দিল,
-“কথা বলো না। আম্মুর মন খুবই খারাপ।”
-“আমাকে একটা পরামর্শ দাও। বাসায় থাকবো নাকি আবার অফিসে চলে যাব ?” মুচকি হেসে মেয়েকে ফিশফিশ করে বললাম।
-“তোমাকে না বললাম কথা বলো না। চুপ থাকো।”
কী আর করা,কথা না বাড়িয়ে পোশাক পরিবর্তন করে আমিও নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর কম্পিউটারে বাংলা পত্রিকা পড়তে পড়তে গিন্নির নামাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু তার নামাজ শেষ হওয়ার কোন লক্ষণই নেই।
এখন রাত প্রায় এগারোটা । আবারও বেড রুমে উঁকি দিলাম। দেখলাম গিন্নি অনবরত নামাজ পড়েই যাচ্ছে। গিন্নি নামাজ শেষে খাবার দেবে সে আশায় বসে আছি। এদিকে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। আচ্ছা ক্ষিদে পেলে পেট শুধু চোঁ-চোঁ করে কেন ? নো-নো,মো-মো ,হো-হো ,টো-টো তো করতে পারে। এ ব্যাপারে একটা গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। গিন্নির জন্য আর অপেক্ষা না করে ভাত আর গরুর মাংস নিয়ে খেতে বসলাম। খাওয়া শুরু করতে যাব,ছোট মেয়ে এসে নিচু স্বরে বলল,
-” বাবা আজ রান্না কিন্তু পঁচা হয়েছে।গরুর মাংস fish fish টেস্ট করছে।”
আমার এই মেয়েটা মাছ খায়না। কারণ সে মাছ পচ্ছন্দ করেনা। তার ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে পচা খাবার হচ্ছে মাছ। তাই কোন খাবার যদি মজা না হয়, তা হলে সে বলবে ফিশ এর মতো টেষ্ট হয়েছে। আর সে যদি বলে কোনো রান্না খারাপ হয়েছে, তার মানে অবশ্যই খারাপ হয়েছে। কারণ তার টেস্টিং ক্ষমতা আসলেই অসাধারণ। ভাত মাখছি , এসময় মেয়ে লবণ এনে দিল।বাসার সবাই জানে আমি কাঁচা লবণ খাই না। লবণ আনার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল,
-“তরকারিতে লবণ কম হয়েছে। আম্মু রোজা ছিল, তাই লবণ চেক করতে পারেনি।”
এমনিতেই রান্না খারাপ হলে বলতে পারি না, রান্না খারাপ, তার ওপর আজ আবার রোজা। আজকে তো আরও বলা যাবে না। কী আর করা লবণ ছাড়াই ফিশ স্বাদের গরুর মাংস দিয়ে ভাত গিলতে লাগলাম। আচ্ছা এটা তো রমজান মাস না, তা হলে গিন্নি হঠাৎ করে রোজা রাখছে কেন ? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। ইদানীং যে কী হয়েছে অনেক কিছুই ভুলে যাই। অবশ্য আমার গিন্নির ধারণা আমি কিছুই ভুলিনা, এটা নাকি আমার ভড়ং। কিছুক্ষণ চিন্তা করতেই মনে পড়ল রোজা রাখার কারণ। বিষয়টা একটু খুলেই বলি। এটা রমজান মাস না। কিন্তু এক বিশেষ কারণে আজ থেকে আমার গিন্নির রমজান মাস, সরি রমজান সপ্তাহ শুরু হয়েছে। আসলে আমার গিন্নির মানত বিষয়ক একটা রোগ আছে।
মানে পরিবারের যেকোন সমস্যায় বা প্রয়োজনে উনি নামাজ, রোজা,টাকা মানত করে বসবেন। উনি আবার অল্প কিছু মানত করতে পারেন না। ধরা যাক কারও অসুখ হয়েছে। মানত হবে ৭ বা ১৫ টি নফল রোজা, প্লাস ৫০ বা ১০০ রাকাত নফল নামাজ, প্লাস অর্থ দান। এরসঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য তসবি পাঠতো আছেই। অসুখ বা সমস্যার গুরত্ব অনুযায়ী মানত এর পরিমাণ উঠানামা করে। অবশ্য আমি তার এই মানত কর্মসূচিকে সমর্থন করি । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার এই মানতের প্রভাবে বাসার সদস্যদের দুই ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। এক নম্বর সমস্যা-এসময় বাসার সকল বিনোদন, আনন্দ, টিভি ও ফান বন্ধ হয়ে যায়। সারা ঘরময় একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করে।কথা বলতে হয় কম এবং নিচু স্বরে। ঘরের ভিতর হাঁটতে হবে আওয়াজ না করে।
আর দুই নম্বর সমস্যা- এসময় বাসায় রান্নাবান্না হবে খুবই কম। আর সে রান্না সুস্বাদু হবার সম্ভাবনা আরও কম। মেয়ে দুটো অবশ্য বিভিন্ন কৌশলে সে খাবার না খেয়ে এড়িয়ে যাবে। কিন্তু বিপদ হচ্ছে আমার।ওই খাবার না খাওয়ার জন্য আমার কোন কৌশলেই কাজ হবে না। সেই সব খাবার আমাকেই খেতে হবে। শুধু খেলেই হবে না। খেয়ে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছি , সেই ভাবও মুখে ফুটিয়ে তুলতে হবে। না হলে ঘরে আগুন লাগার সম্ভবনা একশত ভাগ।
এবারে গিন্নির মানত ওর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের জন্য। মানে ওর বাবা খান সাহেবের জন্য। আজ ইবনে সিনায় ওনার একটা মাইনর অপারেশন হবে। এক হিসেবে আসলে কোনো অপারেশনই মাইনর নয়। আর বয়স্ক লোকের বেলায়তো নয়ই। গিন্নি মানত করেছে আজ বাবার অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামাজের বিছানা থেকে উঠবেন না। এছাড়াও সপ্তাহব্যাপী রোজা,অর্থ মানত ও অন্যান্য মানত তো আছেই। বিষয়টা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এটা অনেকটা আল্লাহর সাথে জেদাজেদির মতো। মনে হচ্ছে আল্লাহকে বলছে , “আল্লাহ আমার বাবারে ভালো করে দাও, না হয় তোমারে এমন ডাকা ডাকব, বিরক্ত হয়ে যাবা। কোনভাবেই থামাতে পারবা না।”
হঠাৎ বেডরুম থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।কারন গিন্নি মোনাজাতে বসে কাঁদছেন।কান্নার আওয়াজ পেতেই দুই মেয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে গেল।গিয়ে মাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল।কিন্তু কান্না থামাতে পারল না। দুই মেয়ে আবার দৌড় দিল।এই পিচ্চি দুটো সবসময় দৌড়ের উপর থাকে। এক রুম থেকে আরেক রুমে কখনই হেঁটে যাবে না। হাত ধরাধরি করে দৌড় দেবে।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ওরা আওয়াজ না করেই দৌড়াতে পারে। আমি জানিনা কিভাবে ওরা এই কৌশল আয়ত্ব করল।আমিতো হাঁটতে গেলেই আওয়াজ হয়।দুই জনে দৌড়ে লিভিং রুমে আমার কাছে এল।বড় মেয়ে বললো,
-” আব্বু দেখ আম্মু কাঁদছে, তুমি আম্মুকে কাঁদতে না করো।”
-” না মা , বাঁধা দিও না। আম্মুকে প্রাণ ভরে কাঁদতে দাও।” আমি শান্ত গলায় উত্তর দিলাম।
-” কেন বাবা ! ” মেয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
-” এর দুটো কারণ আছে । তোমরা কি চাও আমি তোমাদের কারণ দুটো ব্যাখ্যা করি। ”
-” জি বাবা আমরা চাই।” দুই মেয়ে কোরাসে একসাথে জবাব দিলো।
-” তা হলে শোন। আকাশে যখন কালো মেঘ জমাট বাঁধে , তখন সে মেঘ কীভাবে দুর হয় জানো ? “ দুই জনে একসাথে মাথা নেড়ে বোঝাল তারা জানে না।
-“শোনো বলছি। হয় সে মেঘকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়তে হবে। অথবা প্রচণ্ড বাতাস এসে সে মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। তোমাদের মায়ের মনে কষ্টের অনেক কালো মেঘ জমেছে। এখন কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে তার মনের মেঘ কেটে যাবে। তাই তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত। এটা হচ্ছে ১ নম্বর কারণ।”
-” এবার তোমার ২ নম্বর কারণ বলো।” ছোট মেয়ে ভুরু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল।
-“তুমি আগে ভুরু সোজা করো। তোমাকে না বলেছি বুদ্ধিজীবীর মতো ভুরু কুঁচকে কথা বলবে না। তুমি তো বুদ্ধিজীবী না।”
-“আচ্ছা সোজা করলাম, তুমি তোমার দ্বিতীয় কারণ বলো।”
-“২ নং কারন হলো,যার কাছে দুই হাত তুলে তোমার আম্মু কাঁদছে,তার কাছ থেকে বড় কিছু পেতে হলে কিছুটা কান্নাকাটি করতে হয়।এতে উনি খুশি হন এবং খুশি হয়ে দিয়ে দেন।বুঝেছেন মা জননীরা।” আমার ব্যাখ্যা শুনে এবার দুই মেয়েই একসাথে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। ছোট মেয়ে উত্তর দিল,
-” বাবা,আমরা দুজনেই তোমার কথা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন তুমি চলো, আম্মুকে কাঁদতে মানা করো।”
কথাগুলো বলেই দুজনে আবার দৌড় দিল।দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে গেল। হায় খোদা এতো কষ্ট করে উদাহারণ দিয়ে কাদের বুঝালাম। অবশ্য মা কাঁদছে,সে সময় সন্তানদের উদাহারণ দিয়ে বুঝিয়ে কোন লাভ হওয়ার কথাও না। কিন্তু মেয়েরা যত যাই বলুক আমিতো গিন্নির কান্না থামাতে কিছুতেই যাব না। এখানেও দুটো কারণ আছে।
১ নম্বর কারণ- আমি যদি এখন কাঁদতে মানা করতে যাই, তবে বাসায় আগুন লাগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। হয়তো বলবে,” আমার বাবা হাসপাতালে আর তুমি আমারে কান্না করতে মানা করছ ! রঙ্গো করো ? তুমি কি চাও ? আমি গান গাই আর ধেই ধেই করে নাচি । ফাজলামি পাইছো?”
মাফ চাই। এর থেকে বরং কাঁদুক । কেঁদে কেঁদে হালকা হোক। এটা আমেরিকা। ফ্রিডম অব রাইটস অনুযায়ী কান্না করা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। ২ নম্বর কারণ- বাবা অপারেশন থিয়েটারে, মেয়েতো অবশ্যই আল্লাহর কাছে কাঁদবে।এ কান্না যে ভালোবাসার কান্না ।সন্তানের চোখের জল যদি আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দিতে না পারে,তবে সে কেমন সন্তান ?”
সে রাতে খান সাহেবের মেয়ে সারারাত নামাজের বিছানায় ছিল। ভোর রাতে বাংলাদেশ থেকে ফোন এল অপারেশন সাকসেসফুল।তারপরে সে বিছানায় গেলো ঘুমোতে। আসলে মেয়েরা তো এমনই হয়।ছেলে-মেয়ে দুই জনই বাবাকে ভালোবাসে একথা সত্য। কিন্তু বাবার প্রতি মেয়েদের যে ভালোবাসা সে অন্যকিছু।যেসব বাবাদের মেয়ে আছে সেটা শুধু তাঁরাই জানে।