তোর দেহ ও অন্তর কালা

তোর দেহ ও অন্তর কালা

তোর সাথে তো আমার শরিরের কালারই ম্যাচ করেনা, ফেয়ার এন্ড লাভলির স্কেল এনে মেপে দেখ তুই আমার চেয়ে কয় স্তরের কালা। তোর সাথে প্রেম ক্যামনে করলাম আমি, দোষ তো আমার। তোর দেহ কালা অন্তর কালা।

–আর কিছু?

-তুই কি ব্রেকআপ করবি আমি ব্রেকআপ করতেছি। মর্ডান ড্রেসআপ করলেই স্টেটাস বেড়ে যায়না, কাউয়া কাউয়াই থাকে যতোই সে ময়ূরের পেখম লাগাক না কেন।

–আমি যাচ্ছি।

-ওয়েট রিক্সাটা আমি ডেকে দিচ্ছি, সাথে ভাড়াটাও দিয়ে দিচ্ছি।

–থ্যাংক ইউ…

প্রেমের সম্পর্কের শুরুটা যতোটা মিষ্টি হয় শেষটা ততোটাই তিক্ত হয় ইহা যেন অলিখিত চিরন্তন সত্য।
জুয়েল হাপিয়ে উঠেছিলো সিনথিয়ার আচরনে। সিনথিয়া মনে মনে চাচ্ছিলো সম্পর্কটার ইতি টানতে কিন্তু দোষটা নিতে চাচ্ছিলোনা। এমনটাই হয় সম্পর্ক ভাঙ্গার সময় একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারলেই যেন বাঁচে। কেনা মিনিট মেসেজগুলো থেকে যায় কিন্তু সেগুলো খরচ করার জন্য প্রিয় মানুষটা থাকেনা। মানুষটা যোগ হয়ে যায় খরচের খাতায়।

সিনথিয়ার সাথে জুয়েলের সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। সবকিছুর ন্যায় ভালোবাসারো এক্সপায়ার ডেট থাকে। তাই হয়তো ভালোবেসে বিয়ে করে একসময় কেউ ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে দেয়, অথবা পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাঁজে বিষয়টা হলো ভালোবাসা দুজনকে ছেড়ে পালায় না। সম্পর্কের শেষ হলেও তখনো একজন খুব করে ভালোবাসে।

যেমনটা হয়েছে জুয়েল এবং সিনথিয়ার ক্ষেত্রে। পড়ালেখার সুবাদে যখন দুজনে ঢাকায় আসে তখনো ভালোবাসাটা ছিলো। কিন্তু শহরের চাকচিক্য সিনথিয়াকে দ্রুত বদলে দিতে থাকে। ড্রেসআপ, চলাফেরা, চাহিদা দ্রুত বদলাতে শুরু করে বন্ধুদের সাথে পাল্লা দিতে দিতে। জুয়েল চেষ্টা করে সিনথিয়ার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে কিন্তু হয়ে ওঠেনা। রেস্ট্রুরেন্টের দামি বিল, দামি গিফ্ট, পোশাকের ভাড় বহনে অক্ষম মানিব্যাগ একসময় সম্পর্কের সামনে নিজের মাথা নত করে ফেলে।

স্মার্ট বন্ধুটির বাইকের পেছনে যেদিন সিনথিয়াকে দেখেছিলো সেদিনই জুয়েল হেরে গিয়েছে। সিনথিয়ার আচরন বলছিলো সে মুক্তি চায় এ সম্পর্ক থেকে কিন্তু কোন কারনে মুখ ফুটে বলতে পারছেনা। তার এই সমস্যার সমাধানটা জুয়েল করে দিয়েছি। হ্যাঁ কিছু বাজে রকমের কঠিন কথা বলেছে কিন্তু সেগুলো আবেগের একপ্রকার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

সুতরাং জুয়েল বর্তমানে সিংগেল। জুয়েলের মতোই আলিফ ভাই সিংগেল। তার মতে প্রেম করা মানে কোন সম্পর্কের কাছে নত হয়ে থাকা। একা থাকা মানে স্বাধীন থাকা। যদিও মেসের সকলে জানে তিনি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন অনলাইনে মেয়ে পটানোর, পটিয়েও ফেলেন কিন্তু দেখা করার পরে মেয়েটির আইডি খুঁজে পাননা। এ এক রহস্য বটে। মেসের আরেকজন হলেন কুচুপু বাবুলে সোনা জামিল। তার নামের একটা রহস্য আছে। একদিন খুব সকালে আলিফ ভাই সবাইকে ডেকে তুললো, জুয়েল চোখ ডলতে ডলতে বললোঃ

-কি ভাই ডাকেন কেন?

–এই দেখ।
বলে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলেন। জুয়েল পড়ে দেখলো একজন মেসেজ পাঠিয়েছেঃ
“আমার কুচুপু বাবুলে সোনার ঘুম ভেঙ্গেছে?”
জুয়েল বললোঃ
-কি ভাই আপনার গার্লফ্রেন্ডের মেসেজ আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?

–আরে আমি তো জাত সিংগেল। এটা জামিলের নাম্বার, গার্লফ্রেন্ডকে মেসেজ দিতে গিয়ে আমাকে পাঠাইছে।

জুয়েল ফোনটা হাতে নিয়ে রিপ্লাই দিলোঃ
“কুচুপু বাবুলে সোনা জামিল মেসেজ দেয়ার আগে চেক করছনা কারে মেসেজ দিতাছস। তোর কুচুপু বাবুলে সোনা ঘুম থেকে উঠে কমোডে বসে আছে।”
সেদিন থেকে জামিলের নাম কুচুপু বাবুলে সোনা জামিল। সেদিন হঠাৎ বাড়িওয়ালা এসে বলে তোমাদের কুচুপু বাবুলে সোনা জামিল কোথায়। বাড়িওয়ালা কিভাবে জামিলের এই নাম জানলো সেটা আলিফ ভাই ভালো জানেন।

যাই হোক জুয়েলের সময় কাটছে মেসের রুমে বসে। বেশ কিছুদিন হলো ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছেনা। চুল দাড়ির সাথে ভুঁড়িও বাড়তে শুরু করেছে। ডিপ্রেশন বড়ই খারাপ জিনিস একেকবার আসে জীবনের বেশ কিছু সময় সাথে নিয়ে যায়। সাথে কিছু শিক্ষাও দিয়ে যায়। আলিফ ভাই কাল বলছিলেন, বুঝলি জুয়েল ছ্যাঁকা না খেলে ছেলেরা বড় হয়না। তাদের মধ্যে বাচ্চামিটা থেকেই যায়। ছ্যাঁকা খেলে ছেলেরা হুট করে বড় হয়ে যায়। তখন দেখবি চিন্তা ভাবনা, কথা বার্তা সবকিছুতে ম্যাচিউরিটি চলে আসে। প্রত্যেক ছেলের জীবনে ছ্যাঁকাটা খুব বেশি দরকার।

এক দিক দিয়ে তার কথাটা ঠিক কেননা যেহেতু তিনি এখনো ছ্যাঁকা খাননি সেহেতু তার মধ্যে বাচ্চামিটা রয়ে গেছে সেটা তার কাজে প্রমাণ পায়। পাশের বিল্ডিং এ দুটো সুন্দরী মেয়ে এসেছে তারপর থেকে তিনি রোজ জানলার সামনে সেজেগুজে বসে থাকেন। তিনি দাবি করেছেন দুটো মেয়ের মধ্যে একজন তার দিকে তাকায় কিন্তু ইহা আজ অবদি কেউ লক্ষ্য করেনি। একদিন মেসের ছোট ভাই মুনির সকাল সকাল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোকে দেখছিলো, আলিফ ভাই এক হ্যাঁচকা টানে তার প্যান্ট হাটু পর্যন্ত নামিয়ে দিলেন। সেদিন থেকে মেয়েগুলোকে তেমন ছাদে দেখা যায়না, মুনির ও ভুলেও জানালার সামনে যায়না।

সময় কারো জন্য থেমে থাকেনা, ভালোবাসার যেমন এক্সপায়ার ডেট থাকে ঠিক তেমনি ডিপ্রেশনের একটা এক্সপায়ার ডেট থাকে। মানুষের মন এমন এক যন্ত্র যা সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারে। সদ্য সতীত্ব হারানো পতিতা মেয়েটি যে সারাক্ষন বাথরুমে শরির থেকে কলঙ্কের ময়লা ধুতে চিৎকার করে কাঁদে, রাতে ঘুমে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদে সেও একসময় কয়েকটি পুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে শুধু চোখে পানি দিয়ে ঘামে ভেজা লোকটিক জড়িয়ে ঘুমাতে শিখে যায়।
কিন্তু দিনশেষে মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট রয়েই যায়।

জুয়েল সেই চাপা কষ্টের সাথে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে। বেড়ে যাওয়া দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার হয়েছে। ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করেছে। মেসের সাবার হাসি তামাশার সাথে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছে।

প্রায় তিন ঘন্টা ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে জুয়েল। যেই বাসগুলো আসছে তাতে পা রাখার মতো জায়গা নেই। জুয়েলের অদূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তিত হওয়াই স্বাভাবিক কেননা রাত ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েটা চেষ্টা করেও কোন বাসে উঠতে পারছেনা। শেষমেষ ফাঁকা বাস পেয়ে জুয়েল উঠে পড়লো। মেয়েটাও উঠলো তার পিছুপিছু। দুজনে পাশাপাশি বসেছে।

মেয়েটার চুল থেকে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। বাসের বাইরে বেশ বৃষ্টি নেমেছে। অর্ধখোলা জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপটার সাথে হালকা বৃষ্টির পানি এসে জুয়েলের মুখের উপর পড়ছে। জুয়েলের মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে হেঁটে গেলে বেশি ভালো লাগতো।

–এই যে ভাইয়া জানালাটা একটু বন্ধ করবেন প্লিজ পানি আসছে।

মেয়েটির কন্ঠ সুন্দর, শুধু কন্ঠ সুন্দর তা না কথা বলার ভঙ্গিও সুন্দর। কিছুটা বিরক্তির সাথেই জানালাটা বন্ধ করলো জুয়েল। মেয়েটা বললোঃ
-থ্যাংকস।

জুয়েল মেয়েটার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা শক্ত করে ব্যাগটা ধরে রেখেছে। মেয়েটার চোখ তার কোলের দিকে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছেনা। কোন কারনে মেয়েটা চিন্তিত সেটা বুঝা যাচ্ছে। জুয়েল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলোঃ

-আপু যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করি?

–জ্বী…

-আপনি কি কোন কারনে চিন্তিত বা কোন সমস্যা?

–না…

-ও… আসলে আপনাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছিলো তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

জ্যামের কারনে গাড়ি কিছুটা মন্থর গতীতে এগুচ্ছে, বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু ঠান্ডা বাতাস বইছে। জুয়েলের ঘুম পাচ্ছে।

–এই যে মামা নামেন, মামা…

কন্টেকটারের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো জুয়েলের। গাড়ি তার স্টপে চলে এসেছে। জ্যামের কারনে রাত বেশ হয়েছে। গাড়ি মোটামুটি ফাঁকা। গাড়ি থেকে নামার সময় মেয়েটার দিকে একবার তাকালো জুয়েল। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর, কপালের চিন্তার ভাঁজগুলো একরকমের মায়া তৈরি করে মনের মধ্যে।

–কি হইলো মামা নামেন। গেটের মধ্যে দাঁড়াইয়া রইবেন নাকি।

কন্টেকটারের তাঁড়া খেয়ে বাস থেকে নামলো জুয়েল।
বাসের মধ্যে যেই মেয়েটি বসে ছিলো তার নাম ঈষা। লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে। আর অফিস থেকে বেরুতে একটু লেট হয়েছে তার উপর বাস পাচ্ছিলোনা। তাই টেনশন হচ্ছিলো। বেশি লেট করলে হোস্টেলের গেইট খুলবেনা, রিকুয়েস্ট করলেও লাভ হবেনা। তাতে খুব বেশি সমস্যা নেই কোন বান্ধবীর মেসে চলে যাওয়া যাবে কিন্তু ঈষার ভয়ের কারন হলো বাসের মধ্যে বর্তমানে সে একাই মেয়ে। বাসে ওঠার সময় সামনে চার-পাঁচজন মহিলা ছিলেন কিন্তু তারা অনেক আগেই নেমে গেছেন। ঈষার ইচ্ছে করছিলো তাদের সাথে নেমে যেতে কিন্তু ফিরতে তো হবে।

ঈষার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। বাস প্রায় ফাঁকা বাসের লোকগুলো কেমন বাঁজে ভাবে তাকাচ্ছে।
পাশের সিটের ছেলেটাও নেমে গেলো। ঈষার ইচ্ছা করছে ছেলেটার পিছু পিছু নেমে যেতে, হঠাৎ বাস চলতে শুরু করলো। ঈষা প্রায় চিৎকার করে বললোঃ

-মামা বাস থামান নামবো আমি।

–কন্টেকটার বললো আপু আপনার স্টপ এখনো আসেনি বসেন।

কথাটা বলে লোকটা হাসলো, ঈষার পিঠ বেয়ে যেন ঠান্ডা ঘামের একটা বিন্দু গড়িয়ে পড়লো। এমন সময় বাসের গেটের হাতল ধরে প্রায় দৌঁড়ে একজন উঠলো। ছেলেটাকে চিনতে পারলো ঈষা। তার পাশের সিটের ছেলেটা। ঈষা গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা ঢোকটা গিললো। ছেলেটা এসে তার পাশের সিটে বসলো। কন্টেকটার বিরক্তির সাথে বললোঃ

–মামা আপনার স্টপে তো নামায় দিলাম আবার উঠলেন ক্যান?

-সামনের স্টপে নামবো মামা, ইমাজেন্সি। পাঁচটাকা ভাড়া বেশি নাও, সামনে নামায় দিয়ো।

কথাটা বলে ছেলেটা ঈষার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ঈষা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। ঈষার চোখের কোণে একফোটা অশ্রুবিন্দু চকচক করছে। ঈষা দ্রুত চোখ মুছে বসে পড়লো।
প্রথমে ঈষা তারপরে জুয়েল বাস থেকে নামলো। ঈষা জুয়েলের দিকে তাকিয়ে বললোঃ

–ধন্যবাদ।

-কিসের জন্য…

–আপনি জানেন কিসের জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছি।

-সে কথা থাক, এখন ফিরতে পারবেন নাকি এগিয়ে দিবো?

–হোস্টেলে এখন যাওয়া সম্ভব না। কাছেই বন্ধবীর মেস আছে পারবো যেতে।

-চলুন সেখান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে কেউ তেমন কোন কথা বলছেনা। মেসের সামনে এসে বান্ধবীকে কল করলো ঈষা। ঈষার বান্ধবীকে জুয়েল ভালোভাবেই চিনে। কেননা জীবনের অনেকটা সময় সিনথিয়ার খরচের খাতায় লিখে দিয়েছে সে।
এই সময় বাস পাওয়া যাবেনা, আর রিক্সা বা সিএনজিতে ওঠা মানে বিলাসিতা তারচেয়ে হেঁটে ফেরাটাই উত্তম সিদ্ধান্ত। হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরছে জুয়েল।

বান্ধবীরা সবাই ঈষাকে ঘিরে বসেছে, ঈষার বাসের ঘটনাটা শুনছে। কিন্তু ছেলেটার নাম ঠিকানা কোনকিছুই জানা হয়নি। ঘটনা শুনতে শুনতে একজন বললোঃ
–বুঝলি এই মানুষগুলোই হলো বাস্তবজীবনের সুপারম্যান। কিন্তু আমাদের নায়িকা সুপ্যারম্যানের নাম ঠিকানাই জানলোনা।

কথাটা শুনে সবাই হাসলো। ঈষাও হাসলো, ঈষার বিশ্বাস কখনো আবারো দেখা হবে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত