পূর্ণতা

পূর্ণতা

ইন্টার্ন এর ১ম দিনে ওয়ার্ডে ঢুকেই কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম,আমার সহকর্মী একজন মেয়ে।কালো বোরকার সাথে সাদা এপ্রোন।মুখ ঢাকা,হাতে মোজা।মেয়েদের সাথে কথা বলতেই আমার ইতস্তত লাগে,আর এখানে আমাকে একসাথে রোগীর চিকিৎসা করতে হবে,এটা ভেবেই খুব সংকোচ বোধ করতে লাগলাম।আমি তাকে আগেও দেখেছি,ব্যাচমেট যেহেতু।কিন্তু চেহারা কখনো দেখি নি,মুখ সবসময় ঢাকাই থাকতো তার।যাই হোক,সব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের মত কাজ শুরু করলাম।

ডাক্তার হিসেবে আমার প্রথম দিন,এই দিনের অপেক্ষায়ই ছিলাম এতদিন। ওয়ার্ডে ডিউটি চলতে লাগলো কয়েকদিন,আমরা এর মাঝে কোনা কথাই বলি নি।পুরুষ রোগীর দেখতে ও ইতস্তত বোধ করত,তাই পুরুষ রোগীগুলো আমিই বেশি দেখতাম।যদিও চাপ পড়ে যেত আমার উপর,তাও আমার ব্যাপারটা ভালই লাগত।আমার মার ইচ্ছা ছিল যে গাইনীর একজন ডাক্তারকে আমার বউ করে ঘরে আনবে,যে নাকি শুধু মহিলা রোগীই দেখবে।বাড়ির মধ্যেই তাকে চেম্বার করে দেওয়া হবে আরো কত কী।এই মেয়ের খবর মা পেলে নির্ঘাত আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

কালো বোরকার সাথে সাদা এপ্রোন,ভালই লাগে। প্রতিদিন ই একই পোশাক,পোশাকের রঙ বদলায় না কখনো;বদলাতে হবেও না।সমুদ্রের নীল রঙ ই মানুষের পছন্দ।সমুদ্রের নীল যদি বদলে লাল হয়ে যায় তবে কখনই তাকে সুন্দর লাগবে না।আমারও তার সাদা-কালো আবছায়াই ভাল লাগে,পরিবর্তন হলে ভাল লাগবে না।কেন জানি ওকে ভাল লাগতে শুরু করল,ও অন্যরকম একেবারে।যাকে পছন্দ হয়,তার নিস্তব্ধতা খুব কষ্ট দেয় মনে।কিন্তু আমার ওর নিস্তব্ধতাকেই ভাল লাগত।দরকার ছাড়া বেশি কথা বলে না নার্সদের সাথে। আমার সাথে তো কোনোদিনও না।ওর আর আমার মাঝের এই নির্জনতার দেওয়াল কে টপকাতে চাই না আমিও;এই নির্জনতা গোধূলির লাল আভায় ঘন অরণ্যের নির্জনতার মতই সুন্দর।ওর ভাবনার অন্তরালে কি আছে আমি তা জানি না।তার হিয়ার মাঝে কোনো ঠাই কি পাবো?কে জানে। একদিন আমি আমার ওয়ার্ডে আমার রুমে বসে আছি।একজন এসে বলল-

-সাউদা ম্যাডাম আছে?একজন রোগীর খুব খারাপ অবস্থা।
-ম্যাম তো নেই,আসে নি এখনো।আমি আসছি দাঁড়ান।

গিয়ে দেখলাম রোগীর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে গেছে,মানে ব্লাড সুগার হঠাৎ অনেক কমে গেছে।রোগীর অভিবাবক রিসেপশনে গেছে দরকারে।আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই চিনি বা মিষ্টি কিছু আছে রোগীর টেবিলে।একটা কৌটাতে চিনির মত দেখলাম।কিছু নিয়ে পানিতে গুলিয়ে রোগীকে খাওলাম।এবার রোগী অচেতন ই হয়ে গেল।সাথে সাথেই সাউদা আসলো। আমি রোগীকে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি,আরেকটু দেরিতে সাউদা আসলে খারাপ কিছু হয়ে যেত।আমি তাড়াহুড়োয় বুঝি নি আসলে যে ওইটা লবণ।সাউদা এসে নার্সদের হালকা বকলো,নার্সরা আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিল।আমি বুঝলাম ও খুব রাগ করেছে,ভুলটা খুবই বড় ছিল।অনুশোচনা হতে লাগলো।কথাও বলি না ওর সাথে,নাহলে মাফ চাওয়া যেত।মাফ তো চাওয়া দরকার রোগীর কাছে,কিন্তু প্রিয়জনের রাগের সামনে আর কারো কিছু বড় হতে পারে নাকি।ছোট একটা কাগজে লিখে দিলাম,আমি খুব দুঃখিত।কিন্তু চিরকুটের কোনো উত্তর পেলাম না।এবার আমিই কষ্ট পেলাম,উত্তর দিলে কি বেশিই ক্ষতি হত?না হয় ছোট করেই লিখতো যে নো প্রব্লেম। বেশ কয়েকদিন ধরেই টানা নাইট ডিউটি।আমি ডিউটিতে এসে ঘুমাই,শরীরটা ভাল না অনেকদিন যাবৎ।একদিন ঘুমিয়ে আছি,হঠাৎ কারো কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।উঠেই দেখলাম সাউদা আমার চেয়ারটায় বসে,আমার রিপোর্টের ফাইলগুলো দেখে কাঁদছে।আমি কিছুই বুজতেছিলাম না কি করব।

-আপনি এত অসুস্থতা নিয়ে কেন আসছেন?আর আপনি কিছু বলেন নি কেন যে আপনি এত অসুস্থ! অবশেষে নিস্তব্ধতার অবসান।সবকিছুরই অবসান একদিন হয়,আমারও হয়ত খুব শীঘ্রই অবসান হবে। থাইরয়েড ক্যান্সার ধরা পড়েছে।সেই রিপোর্টই ওর হাতে।কিন্তু ও কাঁদবে কেনো?আমি একেবারেই হতবাক,এমন কিছুই আমি আশা করি নি।কান্নার জন্যে কথাও বলতে পারছেনা ঠিকমত।সাউদা বলল,

-আপনাকে আমার ভাললাগে সেই থার্ড ইয়ার থেকে।কোনোদিনও কাউকে বলি নি।কিন্তু আজ না পারতে বললাম।আপনার কিছু হলে আমি এটা সহ্য করতে পারব না। আমি আবারও হতবাক।এইবার একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম যেন।মুখ দিয়ে কথাই আসছে না।সাউদা কাঁদছেই।

-আপনি কাঁদবেন না।আপনাকেও আমার ভাল লাগে।
-আমাকে দেখেছেন কখনো?
-না দেখিনি।
-তাহলে কিভাবে ভাল লাগলো?
-জানি না। তারপর নিস্তব্ধতা, অনেকক্ষণ। এইবার এই নিস্তব্ধতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।কথা বলা না কেনো ও।

-আপনার এখন চিকিৎসার দরকার,সম্পূর্ণ বিশ্রাম আর সেবার দরকার।ক্যান্সার ইনিশিয়াল স্টেজে।ট্রিটমেন্ট এ ভাল হবে আল্লাহ যদি চায়।আমি আপনার সেবা করতে চাই,আপনার স্ত্রী হিসেবে।আমি কালই আমার বাবাকে দিয়ে আপনার বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো।আর ইন্টার্ন থেকে ছুটি নিয়ে নিবো। আমার বিস্ময় যেন কাটছেই না কথা গুলো শোনার পর,এটাও কি সম্ভব।

-যদি মারা যাই বিয়ের পর?
-চুপ!আপনার কিচ্ছু হবে না।আপনি ভাল হবেন।
-আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না।বলেন,যদি মারা যাই তাহলে?
-জীবন থেমে থাকে না।কয়েকবছর পর আমি বিয়ে করে নিব আবার।
-বয়স হয়ে যাবে না ততদিনে?
-ডাক্তার মেয়ের জন্যে ছেলের অভাব হবে না।
-অল্প কয়েকদিন হল ইন্টার্ন শুরু হয়েছে।আপনার ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।আমি ছয় মাসের ছুটি নিয়ে নিব কালই।মাকেও জানাই নি।কালই জানাব। যদি কোনোদিন সুস্থ হই তবে আপনার সাথে দেখা করব নি।

-ছুটিও আমিও নিব।আপনার সেবাও বৈধ ভাবেই করব,আপনার স্ত্রী হিসেবেই।

সাউদা এটা বলেই চলে গেল।আমি আর রাতে ঘুমাতে পারলাম না। আমি অপারেশন থিয়েটারে।বাইরে বাবা মা পায়চারি করছেন টেনশন এ।যে কোনো কিছুই হতে পারে,ভালো অথবা খারাপ।হঠাৎ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো,এই কান্না শোনার অপেক্ষাতেই থাকে পৃথীবির সকল বাবা।আমার মেয়ে হয়েছে,সাউদার ডেলিভারির সময় অন্য ডাক্তারদের সাথেও আমি ছিলাম ভিতরে।সাউদার সাথে আমার বিয়ে হয় ঠিক ওই রাতের কয়েকদিন পর ই।আমিও সুস্থ হই পরে,৬ মাস সময় লেগেছে।তারপর দুইজনে ইন্টার্ন শেষ করি আমাদের। সাউদাকে বাসায় আনার পর একদিন ছাদে উঠেছি আমরা।

-তুমি কিন্তু মোটা হয়ে গেছো একটু!
-বারে,মোটা হলে কি আমায় আর ভালবাসবে না?
-ওই চাঁদটা দেখেছো?চিকন থেকে আস্তে আস্তে মোটা হয়ে গোল হয়।কোনো সময় কি তাকে দেখতে খারাপ লাগে?
-বাহ,কবি হয়ে গেছেন দেখি।
-কবির কাব্যতো পূর্ণতা পেয়েছে তোমার মাধ্যমেই।

সাউদা মৃদু হাসল,চাঁদের ম্লান আলো তার চেহারায় পড়ছে। সন্ধ্যার শীতল হাওয়া কৃষ্ণচূড়ার ঘ্রাণ বয়ে আনছে,আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি ওকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত