আজ বাড়িতে আপা, দুলাভাই আসবে।এজন্য আমি ভীষণ খুশি।যদিও দুলাভাই আসলে শালিরা যেই কারনে খুশি হয় আমি সেই কারনে খুশি না।আমার দুলাভাই বেজায় কিপ্টা।আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে এক পাতা কালো ক্লিপ ছাড়া আমি আর কিছুই পাইনি।তাও তিনি প্রতিবার আমাদের বাড়িতে এসে সেই ক্লিপের গল্পই বলবেন।ছলে বলে কৌশলে তাকে সেই কালো ক্লিপের কথা মনে করাতেই হবে।হয়ত সবাই মিলে গল্প করছি।হঠাত উনি যেকোন কথার মাঝখানে বলা শুরু করবেন,আজকালকার মেয়েরা এত সাজে কেন আমি বুঝিনা।এত সাজার কি দরকার?চুলটা একটু আঁচড়ে কালো ক্লিপ লাগালেই ত হয়।মিতু তোমার মনে আছে তোমাকে সেই যে এক পাতা কালো ক্লিপ কিনে দিয়েছিলাম?আমাকে তখন গদগদ হওয়ার অভিনয় করতে হয়।আপার মুখটা তখন দেখার মত হয়।মনে হয় তার জামাই আমার জন্যে মিতু মহল বানিয়েছে।যা দেখতে দেশ বিদেশ থেকে লোকজন আসবে।
আমরা দুই বোন।রিতু আর মিতু।দুই বোন হলে কি হবে আমাদের স্বভাবে কোন মিল নেই।আপা উত্তর মেরু হলে আমি দক্ষিণ মেরু।আপা খুবই শান্তশিষ্ট আর বোকা প্রকৃতির।আমি চঞ্চল আর মোটামুটি বুদ্ধিমতী। আপার গায়ের রং শ্যামলা।আর আমি ধবধবে ফরসা।আপা আমার চাইতে ৫ বছরের বড়। আমার তখন এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ।আপুর জন্যে পাত্র দেখা শুরু হল।আমি খুব খুশি ছিলাম। আমার আপার বিয়ে হবে।কতই না মজা করব আমি।পাত্র পক্ষের সামনে আপাকে নেয়া হল।আমিও আপার পিছনে পিছনে গেলাম।পাত্রপক্ষ আপাকে দেখল।১৫ রকমের নাস্তা সাবাড় করে চলে গেল।যাওয়ার সময় আপাকে ৫০০ টাকা দিয়েও গেল।আপাতো বেজায় খুশি।৫০০ টাকা দিয়ে কিকি করা যায় আমরা দুই বোন তা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে লাগলাম।হঠাত মা অগ্নিমূর্তি ধারন করে আমাদের সামনে এলো।আপার কাছ থেকে ছো মেরে টাকাটা নিয়ে চলে গেল।আমরা দু বোন কিছুই বুঝলামনা।পরে জানলাম পাত্রপক্ষের আমাকে পছন্দ হয়েছে।এরপর থেকে আপাকে দেখতে এলে আমাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখা হত।
অনেক পাত্র দেখানোর পর ও আপার বিয়ে হচ্ছিলনা।একদিন বড় খালা সকালে এসে জানালো বিকেলে এক সম্ভ্রান্ত ঘরের পাত্র আসবে।পাত্রপক্ষ আপার ছবি দেখেছে।সব ঠিক থাকলে আজই বিয়ে হবে।আপার মুখটা সেদিন খুশিতে ভরে উঠেছিল।সকাল থেকেই মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।দুপুরের পর আপাকে সাজানো হল।আমি আপাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কি দেখিস ওমন করে? তোকে দেখে আজকে দুলাভাইয়ের মাথা ঘুরে যাবে রে আপা। আমার কথা শুনে আপা ভীষন লজ্জা পেল। মাথা ঘুরে পরে গেলে আমাকে বিয়ে করবে কি করে? আমরা দু বোন খিলখিল করে একসাথে হেসে উঠলাম।
পাত্রপক্ষ আসার পর আমি আর ঘর থেকে বের হইনি।হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আপার ডাকে আমার ঘুম ভাংল।
এই মিতু ওঠ। আমি ঘুম ঘুম চোখে আপার দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।আপাকে এখন আর আগের মত সুন্দর লাগছেনা।মুখটা কেমন জানি বিষন্ন লাগছে। কি হয়েছে বল। দেখত বড় খালা আমার জন্যে কি বিশ্রী একটা পাত্র ঠিক করেছে।লোকটা দেখতে যেমন কালো।তার উপর বড় একটা ভুড়ি। ওমা তাই বুঝি? আপা আমার নির্লিপ্ততা দেখে আশাহত হল। তুমি জানোনা আপা,ভুঁড়িওয়ালা লোকেরা বউকে খুব ভালবাসে। আপা আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
ঘর থেকে বেড়িয়ে আপা সোজা আব্বার কাছে গেল। আপাকে দেখে আব্বা ভীষণ রেগে গেলেন। কি ব্যাপার আজজ তুমি এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?জানোনা বিয়ের কনেদের এভাবে ঘুরতে নেই। আব্বা আপনি পাত্র দেখেছেন? দেখবনা কেন।অবশ্যই দেখেছি। পাত্র একটু বেশিই কালো। তাইনা আব্বা? আপার কথা শেষ না হতেই বড় খালা সেখানে এসে উপস্থিত হল। তা তুই কোন সুন্দরী শুনি।পাত্রের সাথে তোকে মানাবে ভাল।বিয়ের কয়েক বছর পর তুই ও যখন মোটা হয়ে যাবি,তখন দেখিস দুজনকে কত সুন্দর মানিয়েছে। বড় খালার কথা শুনে আপা নিজের ঘরে চলে গেল।
বিয়ের পর থেকে আপার অন্য রুপ।সারাক্ষন দুলাভাই ছাড়া যেন কিছুই বোঝেনা।এ বাড়িতে আসলে আপার হম্বিতম্বিতে বাড়ি থাকা দ্বায় হয়।দুলাভাইয়ের জন্য স্পেশাল রান্না হয়।তার খাতির যত্নের কোন ত্রুটি যে না হয় সেদিকে আপার সার্বক্ষণিক নজর।বিয়ের পর থেকে দুলাভাই এ বাড়িতে আসে ২ কেজির প্যাকেটে ১ কেজি মিষ্টি নিয়ে।সারা রাস্তা আপাকে দিয়ে প্যাকেটটা ধরিয়ে বাড়ির কাছে এসেই ওটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।তারপর সোফায় পা উঠিয়ে বসে সেই মিষ্টির গুণকির্তন করতে করতে ৭/৮ টা মিষ্টি সারাড় করে ফেলে।তারপর নাস্তায় বাকিগুলো শেষ করে।বাড়ির সবাই শুধু মিষ্টির গন্ধ শুকেই খুশি হয়।
আজ দুলাভাই এসেছে অনেকক্ষন হল।আমি একবারও ও ঘরে যাইনি।এক সপ্তাহ পর আমার পরীক্ষা।এখন আমি দুলাভাইয়ের পিছনে সময় নষ্ট করতে চাইনা।আমি না চাইলে কি হবে।দুলাভাই ঠিকই আমার ঘরে এসে হানা দিল।
কি খবর শ্যালিকা। আমি এলাম আর তোমার কোন খবরই নেই? এই ত একটু ব্যস্ত আছি। তা কি নিয়ে এত ব্যস্ত শুনি।এই বয়সের মেয়েরাতো অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে।আছে নাকি তোমার সেরকম কেউ? কিযে বলেন দুলাভাই।সত্যি আমার কেউ নেই। তোমরা দুই বোন ত দেখছি একই রকম।একটা প্রেমও করতে পারলেনা। আপার মত কপাল কি আমার আছে বলেন।আপার ত প্রেমিকা কপাল ছিল। আমার কথা শুনে দুলাভাইয়ের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
আর বলেন না,আপার বিয়ের আগে ত আমাদের বাড়িতে খালাতো,ফুফাতো ভাইদের লাইন পরে থাকত।একজনের পর একজন আসত।আর এই সুযোগে আপাও সবার সাথে আলাদা করে প্রেম করতে পারত।আমি যাতে সেসব কথা আব্বাকে না বলি সেজন্য আমাকে ঘুস ও দেয়া হত।এই বলে আমি ড্রয়ার থেকে আমাকে পছন্দ করা ছেলেদের দেয়া উপহারগুলো একে একে বের করলাম।আমার কি আর সেই কপাল আছে? আমার কথা শেষ না হতেই দেখি দুলাভাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেছে। যাক বাবা বাঁচা গেল। আপদ বিদায় হয়েছে। কিছুক্ষন পর দেখি দুলাভাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।তার পিছু।পিছু আপাও। আমি এবার একটু ভয় পেলাম।সবকিছু জানলে মা আমার খবর করে ছাড়বে।
পরদিন কলেজে যাওয়ার সময় দেখি আপা দুলাভাই আবার এসেছে।আমার আর বুঝতে বাকি নেই এবার আমার কপালে কি আছে।আমি লুকিয়ে কয়েকটা জামাকাপড় ব্যাগে ভরে আস্তে করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলাম।ক্লাস শেষ করে সোজা চলে গেলাম মেজো খালার বাড়িতে।সারাদিন মোবাইল অফ করে রাখলাম।সন্ধ্যায় মোবাইল অন করতেই দেখি আপার ম্যাসেজ।
“মিতু আর বাড়ির বাইরে থাকিসনা।তোর দুলাভাই আমাদের সব বলেছে।প্রথমে শুনে আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম।তোকে নিয়ে আমাদের কত আশা ছিল বল।তা আর কি করব বল।সবই আমাদের কপাল।তোর দুলাভাই আব্বাকেও বুঝিয়েছে।আব্বা রাজি হয়েছে।জানিস তো আব্বা তোর দুলাভাইয়ের কথা ফেলতে পারেনা।ছোট হয়ে না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছিস তাই বলে কি আমরা তোকে মানবনা?একটা এতিম ছেলেকে বিয়ে করে এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?আমরা ত আছি না?তাড়াতাড়ি জামাইকে নিয়ে বাড়ি আয়।দেরি করলে আব্বা কিন্তু তার মত বদলে ফেলতে পারে।” আপার ম্যাসেজ পরে সেই থেকে আমি একটা এতিম ছেলেকে খোঁজার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।