গাড়িতে তিথির পাশের সাড়িতে পাশাপাশি বসে কথা বলছেন দুইজন ভদ্রমহিলা। তিথি তাদের কথা শুনে মুচকি হাসছে, তিথির দিকে চোখ পড়তেই একজন বলছেন, “লেখাপড়া করেছি কি বাসায় বসে কাজের বুয়ার কাজ করার জন্য? আমাদেরও স্বাধীনতা আছে… কি বলেন, ম্যাডাম?” তিথি কিছু বলার আগেই দ্বিতীয় মহিলা আরেকটু যোগ করে বললেন,” আমরা স্বাবলম্বী, স্বামী -শাশুড়িকে তোষামোদ করার জন্য লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছিনা।
যদি ঘরের কাজই করতে হয় তাহলে এমন ছেলেদের উচিৎ কাজের মেয়েকে বিয়ে করা। ঠিক না? ” এখন দুজনই তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায় “যদি আপনারা আমার উত্তর শুনতেই চান আশা করি উত্তর শুনে দুঃখ পাবেননা তিথি এইটুকু বলে দুইজনের দিকেই তাকালো এবং সম্মতি পেয়ে বলল,”আমরা লেখাপড়া করি নিজের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে,বিশেষ করে মেয়েদের জন্য শিক্ষিত হওয়াটা জরুরি একজন আদর্শ মা, একজন আদর্শ স্ত্রী এবং সবশেষে একজন আদর্শ গৃহিণী হওয়ার জন্য।
তাছাড়া আপনার স্বামী যদি চায় আপনি তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করুন সেটা আপনার ইচ্ছে অথবা নিজের প্রয়োজনেও যদি সংসারের পাশাপাশি অন্যপেশা বেছে নেন তখনও আপনার প্রধান দায়িত্ব আপনার সংসার।
আর সংসারের কাজ করলেই কেউ কাজের বুয়া হয়ে যায়না,স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সেবা,মা হিসেবে সন্তানের যত্ন,ছেলের বউ হিসেবে শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন কখনোই কোনো কাজের বুয়ার কাজ নয়,একজন নারী হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব,এটাই আমাদের একমাত্র কর্ম হওয়া উচিৎ। তাছাড়া এসব পাওয়ার জন্য যে কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে বলে সে কি এসবের বিনিময়ে তার স্বামী,সন্তান কোনো কাজের মেয়েকে দিয়ে দিতে পারবে? ” তিথির কথা শুনে দুজনই চুপ থেকে নিজেদের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে,এক পর্যায়ে প্রথমজন বলছে,”আসলে সারাদিন অফিসে থেকে বাসার কাজকর্ম করার মানসিকতা বা শারীরিক অবস্থা থাকেনা।”
তিথি আবার বলল”জ্বী,এটাই স্বাভাবিক কারণ আমরা মানুষ এবং মেয়ে মানুষ কিন্তু একটু নিজে নিজেই ভেবে দেখুন,অফিসের সিনিয়র কেউ যখন দুইঘন্টা বেশি কাজ করে যাওয়ার কথা বলে তখন কি তার মুখের উপর কিছু বলে চাকরিটা ছেড়ে আসেন? আসেননা..টাকার মায়ায় যদি এত অসুস্থতা,ব্যস্ততার মাঝেও আপনি অফিসের কাজটা চালিয়ে যেতে পারেন সেই আপনি সংসারের মায়ায় সারাদিন সংসারের কাজ করতে পারবেন কোনো ক্লান্তি ছাড়াই। আর এরজন্য বেশি প্রয়োজন নিজের সংসার,সংসারের প্রত্যেকটা মানুষকে ভালোবাসা,নিজের মনে করা!”
এখন আর কেউই কিছু বলছেনা,হয়ত তাদের কিছুটা সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে অথবা তিথির সাথে কথা বলাটাই নিরর্থক মনে করছে। তিথি একজন শিক্ষিকা,সবার প্রথমে সে একজন আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ মা এবং একজন আদর্শ স্ত্রী।এক মেয়ে, স্বামী,শাশুড়ি, ননদ,দেবর,জা(রিমি) সবাইকে নিয়ে ওর যৌথ পরিবার।
সে তার কর্মস্থল থেকে ফিরেই হাসি মুখে সংসারের কাজে লেগে যায়। সে ভালোবাসে তার সংসার আর সংসারের প্রত্যেকটা মানুষকে। ননদটা অনার্সে পড়ে,ভার্সিটি অন্য জেলায় হওয়ায় সে হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করে। দেবর এবং স্বামী দুইজনই ব্যবসায়ী, রিমি মাস্টার্সে পড়ে। ওদের একটা চার বছরের ছোট ছেলে আছে। এই পরিবারে কেউ যেন তিথির পর নয়।শাশুড়ি বয়োবৃদ্ধা, তিথি তার শাশুড়ির সেবাযত্নেও কোনো ত্রুটি রাখেনা, নিজের মায়ের মতোই সে তার শাশুড়ির যত্ন নেয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের মেয়ের গোসল,খাওয়া,টিফিন বানিয়ে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং রাতে মেয়ের হোমওয়ার্ক করানো সব তিথি নিজেই করে।স্বামীর ক্ষেত্রেও একজন স্ত্রীর দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করেনা সে বরং ভালোবেসেই সব পরিস্থিতিতে সে তার স্বামীর পাশে থাকে। রিমি পড়াশোনার অজুহাতে শাশুড়ির সেবা করতে আসেনা তবে তিথিকে রান্নায় সাহায্য করে।যদি কখনো শাশুড়ির দায়িত্ব অর্ধেক ওর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই ভয়ে সে তার স্বামীকে বুঝিয়েছে” শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা উচিৎ, উনার কারণে তিথির কষ্ট বেশি হয়।”
রাতে খাবার টেবিলে রিমি শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথাটা তুলে,তখন তিথি বলে কাল রাতে আমার মতামত জানাবো। পরদিন কেউই নিজ থেকে কথা তুলার সাহস পাচ্ছেনা। রাতে তিথি শাশুড়িকে উনার রুমে খাইয়ে দিয়ে এসে খাবার টেবিলে বসেই বলছে”রিমি,আমি একটা ভালো এতিমখানার খোঁজ নিয়ে এসেছি আজ।” সবাই চমকে গিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে আছে। কথা হওয়ার কথা বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে সে কেন অনাথাশ্রম নিয়ে বলছে!!তাদের পরিচিত কারোর মধ্যেইতো অনাথ নেই। রিমি জিজ্ঞেস করে “কেন?” “আমি দেখছি বাবুকে(রিমিদের ছেলে) নিয়ে তোমার পড়াশুনা,ঘুম,খাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে তাই ওকে এতিমখানায় রেখে আসলে তুমি ভালোভাবে ভালো থাকতে পারতে। ”
তখন রিমির স্বামী বলে,”আমার ছেলেকে নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছে কবে বলেছি? ওর বাবা মা বেঁচে থাকতে আপনি ওকে অনাথাশ্রমে রেখে আসার কথা বলেন কিভাবে? এটা কি ঠাট্টা করার মতো উক্তি?” তিথি নরমস্বরেই বললো,”আমি অবশ্যই ঠাট্টা করছিনা,তুমি বেঁচে থাকতে তোমার ছেলেকে অনাথাশ্রমে না দেওয়া গেলে তুমি বেঁচে থাকতে তোমার মাকে কিভাবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা ভাবো? উনাকে নিয়ে আমার কষ্ট হচ্ছে এটা তোমরা ভাবছো কি করে? তুমি যতটা আগলে রাখছো নিজের ছেলেকে তোমাদের মা তার চেয়েও বেশি কষ্ট করে তোমাদের আগলে রেখে মানুষ করেছেন। উনি কোনো ক্যারিয়ার সচেতন নারী ছিলেননা,উনি রূপ সচেতন নারী ছিলেননা। নিজের সবটা বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়দের মানুষ করেছেন তার বিনিময়ে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার জন্য? ”
তিথি আরো কঠিনভাবে আঘাত করে ওদেরকে কথাগুলো বলতে চেয়েছিলো কিন্তু ওদের চোখেমুখে অনুতাপ দেখে থেমে যায়,শুধু এইরকম চিন্তা করার ফলে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে যায়।
তিথির স্বামী ওকে নিয়ে গর্ব করে,ওর স্বামী ওর প্রেরণার উৎস। রাতের ঘটনার পর তিথির স্বামীর চোখেমুখে প্রশান্তির উচ্ছাস নিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, “তুমি এত ভালো কিভাবে হতে পারছো?” “ভালো! কোথায়? আমার যা দায়িত্ব…” কথা শেষ না করতেই ওর স্বামী বলল” শুধু দায়িত্ব? ” “জ্বী না,ভালোবাসার প্রতিদান! তুমি ভালোবাসো বলেই আমি ভালো হতে পারি।