ইদানীং কাব্যের একটা আজব ব্যামো হয়েছে। অফিস শেষ করে ভদ্র মানুষের মত ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। এদিক সে দিক ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে এবং ঘুরেও বেড়ায়। আজকে যেমন এসেছে কান্দিরপাড় মোড়ের নিউ মার্কেটে। উদ্দেশ্য বই টই কিছু না,এমনিই ঘুরাঘুরি। তারপরও সে অনেক্ষণ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বই টই নেচেচেড়ে দেখল তারপর খেয়াল করল দোকানদার গামছা টাইপের কিছু একটা দিয়ে সমানে বইগুলোর উপর বাড়ি মেরে যাচ্ছে। কাব্যের একবার বলতে ইচ্ছে হল,এটা বইয়ের দোকান,মিষ্টির দোকান না যে গামছার বাড়ি মেরে মাছি তাড়া করতে হবে। কিন্তু পরক্ষনেই মাথায় আসল,কে জানে ব্যবস্থাটা হয়ত মাছি তাড়ানোর জন্য না,তাকে তাড়ানোর জন্যই।
-আপনার কোন বইটা লাগবে বলেন তো? গামছা পদ্ধতি কাজ না করার স্পষ্ট বিরক্তি দোকানীর চোখে মুখে।
-ও রকম কোন বইয়ের নাম তো ঠিক ঠাক করে আসিনি। ভাবলাম ঘেঁটে টেটে দেখি ভাল কিছু পাওয়া যায় কি না।
-ভাই এটা কি মাছের দোকান। ঘেঁটে ঘেঁটে টিপে টুপে মাছ কিনবেন। এসেছেন বই কিনতে। আগে থেকে ঠিক না করে আসলে হবে। আপনি একলা যদি দোকান দখল করে দাঁড়িয়ে থাকেন বাকি কাস্টমার দাঁড়াবে কই? কাব্যের কান গরম হয়ে উঠল। ইচ্ছা করছিলো মাছ না দোকানীর গলাটা আলুর মত টিপে ভর্তা বানাতে। এর পরিবর্তে কাব্য যা করল তা হল, সামনের দিকে হাঁটা দেয়া। সবসময় তাই করে।
-ভাইজান,এই দিকে আসেন,কি লাগবে দেখেন। গামছা দোকানীর পাশের দোকানী বিপুল উৎসাহে তাকে ডেকে চলছে। কাব্য দাড়াবে না দাড়াবে না ভেবেও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
-বই খুঁজতে এসেছেন তো। দাঁড়ান। আপনাকে সেইরকম বই দেখাচ্ছি। এই বলে দোকানী বইয়ের স্তূপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা জরাজীর্ন বই তুলে আনে।
-ধরেন ক্ল্যাসিকের বাপ এটা। এই তল্লাটে আর পাবেন না। অরিজিনাল এডিশন। পড়লে সেইরকম আরাম।
-এর তো মলাট’ই নেই। পেইজ সব আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।
-আররে ধুর মিয়া,মলাট দিয়া কি করবেন,শোনেন নাই বৃক্ষ তোমার নাম কি,ফলে পরিচয়। ফল ভাল লাগলে,বৃক্ষের নাম এমনই জানা যাবে। ঝাকানাকা মলাট দিয়া যদি বই বেচা যাইত, তাইলে আমি আবুল মিয়া,সব ফেলে থুয়ে শুধু নার্সারি কেলাসের বই লাগাইতাম। ছাকনি দিয়া ছ্যাকে ছ্যাকে এইসব খানদানি বই রাখার কোন দরকার ছিল। বলেন ভাই সাহেব।
অকাট্য যুক্তি। প্রতিউত্তরে কাব্যের শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কি করা যায়,ভেবেও পেল না। অতঃপর মিনিট দশেক পর কাব্য কে দেখা যায় ছেঁড়া ফাঁটা বইয়ের স্তূপের একাংশ নিয়ে বাসের খোঁজে হাঁটা দিতে। বাসে উঠার পর খানদানি বইগুলোর কিছু খুলে আসা পাতা বেআক্কেলের মত বাতাসের তোড়ে উড়ে গেল। কাব্য হা হা করেও সেগুলোর নাগাল পেল না।
কাব্য বাসার বেল টিপল ভীষণ অস্বস্তির সাথে। ইদানীং ব্যাপারটা খুব বেশী হচ্ছে। বাসায় ঠিক ঢোকার সময়টায় কেন যেন তার অস্বস্তি লাগতে থাকে। যেন অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে, বিনা দাওয়াতে। আজকে সেই অস্বস্তির মাত্রাটা আরও বেশী। সাথে এতগুলো ছেঁড়া ফাঁটা বই। বই পড়া ছেড়েছে সে অনেক দিন হল। ইরা যদি জিজ্ঞেসা করে কেন বই কিনেছে কিছুই বলতে পারবে না। কিন্তু ভাল সম্ভাবনা আছে ইরা তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। হয়ত খেয়ালই করবে না তার হাতে কিছু আছে। দরজায় যদি এই বেলিং সিস্টেমটা না থাকত তাহলে হয়ত এইটাও খেয়াল করত না কাব্য নামের কেউ এই বাড়িতে থাকে। কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করতে থাকে। দু’বার বেল টেপা হয়ে গিয়েছে। ইরার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় কি নেই। ইদানীং ইরা রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। প্রথম প্রথম কাব্য বেশ চিন্তায় পড়ে যেত। ইদানীং অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আগে মনে হত ইরা কোথায়,কতক্ষণ লাগবে ফিরতে? আর এখন মনে হয়,বহুদিনের চেনা মুখটার পেছনে এই মানুষটা কে,তার ইরা আদৌ কি কোনদিন ফিরবে?
-কাব্য ভাই, ঘটনা কি? বইখাতা নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে যে। ঘরে কারফিউ নাকি? ঢোকা নিষেধ?কথাটা বলেই শফিক সাহেব হাসা আরম্ভ করলেন। হাসির দমকে একবার ডানে হেলে যাচ্ছেন আরেকবার বামে। কাব্য কোন কথা বলল না। এই লোকটার অহেতুক হাসির ব্যামো আছে। সারাক্ষণই হা হা হো হো। আশে পাশের মানুষের জন্য এই রোগটা যতটা বিরক্তিকর। শফিক সাহেবের জন্য ব্যাপারটা মনে হয় ততটাই আরামের। এই ভাবে প্রান খুলে হাসার কপাল কি সবার হয়। কাব্যের মাঝে মাঝে মনে হয় এই রোগটা যদি ছোঁয়াচে হত খুব ভাল হত। শফিক সাহেবের সাথে তাহলে একটু গা ঘষাঘষি করে নিত। শেষ কবে এরকম হা হা করে হেসেছে মনে করতে পারছে না।
-আসেন ভাই। কেচি গেট খুলে দিচ্ছি। প্রথম ধাপ পার। ফাইনাল রাউন্ড কিন্তু বস আপনাকেই ম্যানেজ করতে হবে। ওখানে হেল্পিং হ্যান্ড অ্যালাউড না। হা হা হা।
কাব্য শফিক সাহেবকে হাস্যরত অবস্থায় রেখেই তিনতলায় উঠে এল। দরজা লক করা। ইরা বাসায় নেই। কাব্য টের পায়,তার অস্বস্তিভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। এই অস্বস্তি কি তাহলে ইরার মুখোমুখি পড়ার জন্য। একই মাটির উপর থেকে তারা যে কখন দুই ভিন্ন গ্রহের মানুষ হয়ে গেল,কাব্য জানে না। জানলেও কিছু করার ছিল না। “ভালবাসার সম্পর্কটা গলিত লোহার মত, যখন গরম থাকে যে কোন আকারে ফেলা যায়। কিন্তু যখন শীতল হতে থাকে,হয় ভেঙে ফেলতে হয় নয়ত ছুঁড়ে ফেলতে হয়”। তাদের সম্পর্কটাও এখন শীতল। কে কাকে ছুঁড়ে ফেলবে তারই হয়ত অপেক্ষা চলছে। কাব্য ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। অন্ধকারের ভেতরই বইগুলো সোফার রেখে লাইট জ্বালায়। এলোমেলো একটা ঘর। সকালে যেমন ফেলে গিয়েছিল এখনও তেমনই আছে।
দরজা লাগানোর জন্য পেছনে ফিরতেই দেখে একটা বই পড়ে আছে,দরজার কাছেই। চাবি বের করতে গিয়ে কোন ফাঁকে হয়ত পড়ে গিয়েছে। অন্ধকার থাকায় দেখেনি। বইটা অন্যগুলোর মত এতটা ছেঁড়া ফাঁটা না। পেপার ব্যাক,কিন্তু বাইন্ডিং ভাল। কাব্য বইটা হাতে নিয়ে উল্টে দেখে। প্রচ্ছদটা কিছুটা অন্যরকম। বইয়ের নাম যেখানে লেখা থাকার কথা সেই জায়গাটা উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে কিন্তু প্রচ্ছদের ছবিটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গাঢ় কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর একটা চোখের ছবি। একটা মানুষের চোখ যতটা বড় হতে পারে, প্রচ্ছদের চোখটাও তত বড়,কিন্তু অনেক বেশী জীবন্ত।
মনে হবে বইটা যেন তার পাঠকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিকারী পাখি শিকার করার আগ মুহুর্তে তার শিকারের দিকে যেভাবে তাকায়। ঠিক তখনই চারপাশ হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে গেল। প্রথম দফায় কাব্যের মনে হল লোডশেডিং। কিন্ত পরক্ষনেই মনে হল এই অন্ধকারের কিছু সমস্যা আছে। ঢাকা শহরের লোডশেডিং এ কখনই পুরোপুরি অন্ধকার নামে না। এর ওর বাড়ির চার্জ লাইট, মোবাইলের আলো কিছু না কিছু থাকে। সবচেয়ে বেশী যেটা থাকে সেটা হল শব্দ। কিন্তু অন্ধকার নামার সাথে সাথে চারপাশও যেন নিরব হয়ে গেল। রাস্তার গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে না, শফিক সাহেবের হাসি শোনা যাচ্ছে না। কাব্য যখন পকেট থেকে মোবাইল বের করার জন্য একটু ঘুরল ঠিক তখনই দেখতে পেল সেটা।
একটা চোখ। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটা হলুদ রঙ্গা চোখ জ্বলছে। চোখের উপরে কোন পাতা নেই। অপলক,স্থির,আবেগহীন দৃষ্টি। কাব্য প্রথমে নিজের চোখ বন্ধ করতে চাইল। পারলো না। কেউ যেন তার চোখের পাতাও কেটে নিয়েছে। চিৎকার করতে চাইল কিন্তু জিহ্বা অনড়। একটা তীব্র ভয় তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে যেন একটু একটু করে গুড়িয়ে দিতে থাকে। কাব্য কে শফিক সাহেব যখন উদ্ধার করেন তার গায়ে তখন প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরের ঘোরে কাব্য বিড় বিড় করে উঠে..
-ইরা ও ইরা পানি দাও। ইরা পানি দাও। কাব্য তখনও জানত না ইরা সে রাতে ঘরে ফেরেনি।
ইরার খুব সকাল সকাল উঠার অভ্যাস। তার কাছে দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা হল ভোর বেলা। আর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দিনের প্রথম সুর্য। সকাল বেলায় কেউ যেন বালতি ভরতি নরম আলো চারপাশে ঢেলে দেয়। কাব্য কিন্তু পুরোই উল্টো। তার ধারণা সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি হল ঘুম। সকালে ৫ মিনিট বেশী ঘুমানোর মত সুখ পৃথিবীর আর কিছুতে নেই। একটা সময় ছিল কাব্যের এ জাতীয় কথা শুনলে ইরা হেসে কুটি কুটি হত। কিন্তু এখন প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে। তবে স্বস্তির কথা কাব্য কথা বেশ কমিয়ে দিয়েছে। ইরা দরজাটা খুলে দাও,ইরা লাইট অফ কর,ইরা টিভির সাউন্ড কমাও। ঘুরে ফিরে এইসবই ওদের সাংসারিক আলাপ। কিন্তু আজকের আলাপ এত সংক্ষিপ্ত হবে না। কিছু কথা বলে ফেললেই ফুরিয়ে যায়। আর কিছু কথা বলে ফেললে জীবন্ত হয়ে উঠে। তারপর সারা জীবন তাড়িয়ে ফেরে। আজকের আলাপটাও হয়ত ওরকমি কিছু হবে। ইরা বারান্দা থেকে সরে আসে। কাব্যের ঘরের দরজা খোলা। পর্দা গুটানো। খাটের উপর কাব্য খুব অদ্ভুত কায়দায় জড়সড় হয়ে আছে।
-আমার মনে হয় তুমি উঠে পড়তে পার। সারারাত তোমার খাটের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে যে কেউ বুঝবে রাতে তোমার ঘুম হয়নি। শুধু এপাশ ওপাশ করে খাটটাকে আর জ্বালিও না। মানুষ জ্বালিয়ে মজা আছে। জড় পদার্থ জ্বালিয়ে মজা নেই। কাব্য সাথেই সাথেই খাটের উপর উঠে বসল। ইরা এটা ঠিক আশা করেনি। তার ধারণা ছিল কাব্য আরও কিছুক্ষণ মটকা মেরে খাটে পড়ে থাকবে। থাকলে ভাল হত,কথাগুলোকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়া যেত।
-তুমি শফিক সাহেবকে বলেছ আমি রাতে ফিরিনি। উনি উনার স্ত্রীকে বলেছে। উনার স্ত্রী পুরো বিল্ডিংকে বলেছে। এমনও হতে পারে, একটু পর যখন অফিসের বাস ধরতে স্টপেজে যাব,ওখানকার কন্ডাক্টর জিজ্ঞেসা করবে,আপা,আজকে রাতের প্ল্যান কি? কাব্য কিছুক্ষণ বোকার মত ইরার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইরার একবার মনে হচ্ছিল কাব্য হয়ত আজকে আর কোন কথাই বলবে না,কিন্তু বলল। বেশ স্পষ্ট গলায়ই বলল..
-ইরা কথাটা এভাবে না বললেও পারতে। নিজেকে ছোট করে তো লাভ নাই। কাল রাতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর শফিক সাহেব আমাকে ঘরে নিয়ে আসেন। বেশ কিছুক্ষণ সাথেও ছিলেন। উনি বাসায় তোমাকে দেখেননি। সেটাই হয়ত উনার স্ত্রীকে বলেছেন। এতটাতে তো হৈ চৈ করার মত কিছু না।
-তুমি বলছ এটা হৈ চৈ করার মত না। খুবই সাধারণ ব্যাপার।
-খুব সাধারণ বলিনি। বলেছি হৈ চৈ করার মত না।
-একই কথা..
-না এক কথা না। রাগ করে গ্লাস ভেঙে ফেলা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু রাগ করে কারও মাথা ভেঙে ফেলাটা হৈ চৈ করার মত ব্যপার। এখানে হৈ চৈ করার মত কিছুই ঘটেনি।
-আমি তোমাকে যাবার আগে বলে গেলাম, ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি। তিন দিন লাগবে। দুই দিন আসা যাওয়া। একদিন সাইট ভিজিট। তুমি সেটা বেমালুম ভুলে গেলে। শফিক সাহেব যখন জিজ্ঞেসা করল কিছুই বললে না। এমন একটা ভাব করলে আমি কোথায় সেইটাই তুমি জানো না। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার?
-আমি শকের মধ্যে ছিলাম। মনে করতে পারিনি। ইরা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। দাঁতে দাত চেপে বলে, -আমাকে শক শিখাও তুমি। কি মনে কর তোমার এইসব শকের ঢং আমি বুঝি না? চশমা ছাড়া দুই হাত দুরের জিনিস দেখতে পাও না,আর তুমি অন্ধকারে ঘরের কোনায় চোখ দেখ?
-ইরা আমি সত্যি দেখেছিলাম।
-হ্যাঁ অবশ্যই। কাল বইয়ের মধ্যে চোখ দেখেছ, এর আগের দিন প্লেটের কোনায় রাখা ডিমের উপর দেখেছ,তারও আগে অফিসের ফাইলের ভেতর। এরপর বাথরুমে কমোডের মধ্যেও দেখবে। সকালে একবার দেখবে,দুপুরে একবার দেখবে,রাতে খাবারের পর দেখবে। তিন বেলা নিয়ম করে। একদম সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার।
-ইরা তুমি অসুস্থ্য রোগীর মত আচরণ করছ।
-আমি অসুস্থে্যর মত আচরণ করছি। আমি? তুমি মানুষকে বলে বেড়াবে তোমার বৌ রাতের বেলা ঘরে থাকে না। কই থাকে তুমি জানো না। আর আমাকে অসুস্থ্য বলছ। তুমি জানো,কাল সন্ধ্যায় মোস্তাক সাহেব কি বলছেন,ঘরে অসুস্থ্য স্বামী রেখে রাতে বাহিরে থাকা ঠিক না। ঘরের মেয়েদের ঘরেই ভাল মানায়। সেটা সকাল,দুপুর, রাত যাই হোক। আমি জানতে চাই,উনি এই কথা বলার সাহস কোথা থেকে পায়।
-তুমি হিস্ট্রিয়ার রোগীদের মত আচরণ করছ। একটু খাটের উপর স্থির হয়ে বস। কাব্য ইরা কে টেনে বসানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। ইরা হাত ধরল না। কিন্তু ধপাশ করে খাটের উপর বসে পড়ল। মেয়েটা প্রচণ্ড রেগে আছে। কিন্তু সেই রাগ তার গালের গোলাপী আভাকে ঢাকতে পারে না। সে ভোরের মতই স্নিগ্ধ,শান্ত,সুন্দর।
-আমি যে সত্যি সত্যি চোখ দেখতে পাই,তুমি এটা বিশ্বাস কর না তাই না। তোমার ধারণা সবই আমার ভান। ইরা কোন কথা বলল না। কাব্যের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। তার চোখ বাহিরের দিকে। রোদে আকাশ,বাড়িঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। কাব্যের বুকের ভেতরটা যেমন জ্বলছে।
-ইরা জানো প্রথম যেদিন চোখটা দেখেছিলাম, আমার একটুও ভয় লাগেনি। খুব কৌতুহল হয়ে ছিল। বুঝতে পারছিলাম পুরোটাই আমার উর্বর মাথার কল্পনা। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবার দেখলাম চোখটা। তারপর দেখতেই থাকলাম,দেখতেই থাকলাম। এখন আমার ভয় ধরে গিয়েছে কারণ আমি জানি চোখটা মিথ্যা নয়। চোখটা সত্যি। চোখটা আমাকে এমন কিছু দেখাতে চায় যা আমি খুব কাছে থেকেও দেখতে পাই না। আমি বোঝাতে পারবো না ইরা। কি যে একটা যন্ত্রণা। মনে হয় আমাকেও কেউ মেরে ফেলুক। ইরা,একটু বোঝ প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়। খুব বেশী কষ্ট। একটু কি থাকা যায় না আমার পাশে।
-না,কাব্য থাকা যায় না। অনেক দুরত্ব আমাদের মধ্যে। ইরা ঘরের চারপাশটায় একবার তাকায়। একটা ছোট শ্বাস ফেলে বলে..
-এখানে আমারও খুব কষ্ট কাব্য। আমি এখানকার কেউ নই। আমাকে চলে যেতে হবে।
-এভাবে কেন বলছ ইরা। আমরা এক সাথে থাকব। এতদিন যেভাবে ছিলাম। হঠাৎ কি হয়েছে তোমার। আমি বুঝতে পারি না। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয় ইরা। ইরা এবার কাব্যের দিকে তাকায়,খুব শান্ত স্বরে বলে….
-কাব্য,সাইকোলজির ভাষায়,একটা বিষয় আছে, কমফোর্ট জোন। একটা মানুষ তার মনের ভেতর একটা বাউন্ডারি আঁকে। এই বাউন্ডারির ভেতর থাকে তার পরিচিত কাছের মানুষ,তার বহুদিনের চেনা পরিবেশ। মোট কথা এমন একটা মানসিক এলাকা যেখানে মানুষটা নিজেকে সব চেয়ে নিরাপদ অনুভব করে আর সেখান থেকে সহজে বাহির হতে চায় না। তুমি এতদিন সেই কমফোর্ট জোনের ভেতরে ছিলে। তোমার সেই নিরাপদ এলাকাতে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে। তুমিও সেটা টের পাচ্ছ। চোখ দেখাটা হচ্ছে তার খুব ছোট একটা প্রভাব। যে প্রভাবটা আরও বড়, আরও ভয়ঙ্কর,সেটা তুমি টের পাচ্ছো না। কিংবা বলা যায়,পেতে চাচ্ছো না।
-ইরা,তুমি কি বলছ এসব আমি বুঝতে পারছি না। তুমি তো সাইকোলজির ছাত্রী না। কিভাবে জানো এসব? প্লিজ,বুঝিয়ে বল।
আমি আর আগের ইরা নেই কাব্য। কেন তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেশী। চাইলেও ফিরে আসা সম্ভব না। কিছু কিছু পথ আছে যেখানে হাঁটার সময় পিছনে ফিরে দেখতে হয় না। কারণ পেছনে থাকে শুধু অতীত,যে দিতে জানে না,শুধু ছিনিয়ে নিতে পারে। আর সামনে থাকে ভবিষ্যৎ,যে দিতে চায়। বোকা মানুষেরা নিতে চায় না।
-আমি তোমাকে ছাড়া কোন ভবিষ্যৎ চাই না ইরা।
-তোমার জগৎ এ আমার অস্তিত্ব অতীতে, ভবিষ্যৎ এ না। আমাকে পেছনে থাকতে দাও। পেছনে আর ফিরে তাকিও না।
বলেই ইরা আর বসল না। ধীর পায়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর পর্দা সরিয়ে হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। ঠিক তখনই কাব্য আবার দেখতে পেল চোখ। সেই হলুদ রঙের চোখ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ যেন বলছে, কাব্য চোখ খুল। তোমার চারপাশে তাকাও। তোমার চারপাশের মাটির মানুষ দেখ। যে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে তাকে খুজ না। কাব্যের প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পায়। এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। এই চোখ মিথ্যা কথা বলে। তাকে মিথ্যা দেখাতে চায়। কাব্য চিৎকার করে বলতে চায়,ইরা ও ইরা, যেও না,প্লিজ থাক। একটু পানি দাও। বড় তেষ্টা পাচ্ছে। ইরা পানি দাও। কিন্তু ইরা শোনে না কাব্যের সেই করুন আর্তনাদ।
শফিক সাহেব হাসি খুশি টাইপের মানুষ। কাঁন্না তার ধাতে সয় না। কিন্তু প্রায়ই এই লোকটাকে এই অবস্থায় দেখলে তার চোখে পানি চলে আসে। কাব্য যতক্ষণ অজ্ঞান ছিল,শফিক সাহেব তার হাত ধরে পাশে বসে ছিল। বৌ এসে দু’বার টিপ্পনী কেঁটেছে। কাঁটুক, লকিছু আসে যায় না। আল্লাহ, সবাইকে সব কিছু দেন না। যেমন এই মহিলাকে রুপ দিয়েছেন,বুদ্ধি শুদ্ধি কিছু দেন নাই। কাব্য কে খুব সুন্দর একটা মন দিয়েছেন,কিন্তু শান্তি দেননি। কি সুন্দর একটা সংসার ছিল অথচ বউটা কি ভয়ঙ্কর ভাবে মারা গিয়ে ছিল।
অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে কোথায় যাচ্ছিল যেন। রাস্তায় এক্সিডেন্ট করল। কি চমৎকার একটা মেয়ে ছিল। নামটাও কি চমৎকার,ইরা। যাওয়ার দিনও বলে গিয়েছিল তার বরকে যেন দেখে রাখা হয়। খুব নাকি আলাভোলা। আসলেও তাই। তিনমাস হয়ে গেল অথচ এখনও ভুলতে পারল না। এভাবে কাউকে ভালবাসতে আছে। সব মাথামোটা লোকজনে দুনিয়া ভরে গেল। ঘোরের মধ্যে মরা বৌয়ের খোঁজ করছে,তার সাথে কথা বলছে। লোকটা কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যে কুয়াশায় কোন ভোর থাকে না। কেবলই ব্যামো থাকে। কাব্য আবারও অস্ফুট স্বরে ডাকল..
-ইরা ও ইরা….
শফিক সাহেব পান্জাবীর কোনাটা চোখে চেপে ধরলেন। ছিঃ পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।