-নীলরঙা দু’তলা বাসাটার সামনে দিয়েই প্রতি বিকেলে টিউশন এ যেতাম৷ বাড়ির জানালাগুলো হালকা নীলরঙা থাইগ্লাসে আচ্ছাদিত ছিল৷ বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকতো৷ আয়না দেখলেই চুল ঠিক করার অভ্যাসটা আমার বাল্যকাল থেকেই৷ তেমনি নীলরঙা বাড়ির জানালার নীলরঙা গ্লাসে প্রায় প্রতিনিয়ত চুল ঠিক করা হতো৷ অপরপাশ থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে! এই ব্যাপারটা কখনো ভেবেই দেখিনি৷
– সেদিনও নীলরঙা বাড়িটির জানালার সামনে চুলের ভাজ ঠিক করছিলাম৷ হঠাৎ সড়াৎ করে গ্লাসগুলো সরিয়ে ফেলল কেউ৷ জানালার গ্রীলের ঐপাশ থেকে মেয়েটি চোখের ভ্রু নাচিয়ে বলল, প্রতিদিনই তো দেখি জানালায় উকিঝুকি মারেন! উদ্দেশ্য কি হু?
-গোলগাল মুখ আর সরু নাক! সাথে চোখের ভ্রু নাচাঁনো চাহনি! এই বুঝি হূৎপিন্ড আর মস্তিষ্ক একসাথেই জমে হিমশীতল হয়ে গেল৷ মেয়েটির হাতের তুড়ির শব্দ শুনে ভ্রম ভাঙল৷ তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুজেঁ পাইনি তখনো আমি৷ আমার অবস্থা দেখে মেয়েটির ঠোটেঁর কোণে তখন হালকা হাসির উদয় হয়েছে৷ আমি অগোছালো গলায় বললাম, গ্লাসগুলো সুন্দর৷ মানিয়েছে বেশ৷ তাই প্রতিদিন দেখি! মেয়েটার চেহারা দেখে মনে হয়নি, সে আমার কথা বিশ্বাস করেছে৷ তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি দিয়ে বলল,
-ব্যাস! এইটুকুই?
-হ্যা এইটুকুই৷
-আমিতো অন্যকিছু দেখেছি৷
-কি দেখেছেন?
-সময় হলেই জানতে পারবেন৷
-মেয়েটির রহস্যময়ী কথাবার্তা মোটেই সুবিধার লাগেনি আমার৷ সুন্দরীরা একটু রহস্যময়ী হবেই৷
সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এরপর থেকেই মেয়েটা দু’তলার বারান্দায় দাড়িঁয়ে থাকতো৷ আমিও তখন গ্লাসদেখা বাদ দিয়ে মেয়েটিকে দেখার অভ্যাস গড়ে ফেলেছি৷ চোখাচোখি হতো, মুচকি হাসির বিনিময়ও হতো৷ চুল ঠিক করার ঘটনাটা চাপা পড়ে গিয়েছে ততদিনে, আর মনের গহিনে উকিঁঝুকিঁ মারছে প্রেম৷
-বন্ধুদের আড্ডায় কথার ফুলঝুড়িঁ ছোটানো ছেলেটা এখন গালে হাত দিয়ে আকাশপানে চেয়ে থাকে৷ আর মুচকি মুচকি হাসে৷ অকারণে তার মনটা খুশিতে নেচে উঠে৷ টিউশন এ যাওয়াটা যার কাছে ছিল চরম বিরক্তির৷ সে এখন কখন বিকেল হবে সে অপেক্ষায় থাকে৷ ছাত্র পড়া না শিখলে, যে ছেলেটা হাতে বেত নিয়ে ছাত্রের পিঠের উপর ঝড় বইয়ে দিতো! সেই ছেলেটা সে পরিস্থিতে মুচকি হাসে৷ পিচ্চি ছাত্রটা তার স্যারের কান্ডকারখানা দেখে হয়ত ভাবনায় পড়ে যায়৷ অথচ মেয়েটির নামটিও জানা হয়নি তখনো৷ কল্পণাতে আমি তখন মেয়েটিকে নিয়ে আকাশে উড়ছি৷ সবচাইতে বড় ঘটনাটা ঘটলো তার সপ্তাহখানেক পরেই৷ টিউশন গিয়ে চেয়ারে বসতেই আমার স্টুডেন্ট এসেই তার ফোকঁলা দাতেঁর হাসি দিয়ে বলল,
-স্যার একটা কথা বলি?
-হ্যা বল৷
-আপনার বাসায় কি আয়না নেই? রাস্তায় রাস্তায় আয়না দেখে বেড়ান!
-কে বলেছে এই কথা?
-পাশের বাসার নীরা আপু!
-সেদিনের মত ছাত্রকে ধমকি দিয়ে থামানো গেলেও মাসের শেষে আর রক্ষা হল না! ছাত্রের মা বেতনের সাথে ২০০টাকা বাড়িয়ে দিল৷ আমি ভদ্রমহিলার দয়া দেখে তখন উনাকে সালাম করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম৷ তখনই বললেন,
-২০০টাকা বাড়িয়ে দিলাম বাবা! সামনের মার্কেট থেকে ভালো দেখে একটা আয়না কিনে নিবে! মহিলার কথা শুনে খুশির বেলুন চুপষে গিয়েছে ততক্ষণে৷
-রাগে, ক্ষোভে আর দুঃখে ঐদিকটাই আর যাওয়া হয়নি৷ টিউশন ততদিনে ছাত্রের বাসার সামনের পুকুরের পানিতে ছুড়ে ফেলেছি৷ ছাত্রের মা ভদ্রমহিলা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন৷ একবার ও রিসিভ করিনি৷ নীরার প্রতি অজানা অভিমান জমে গিয়েছে৷ অথচ মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে কয়েকবার৷ প্রেমে পড়ার জন্য এতটুকুই কি যথেষ্ঠ? মোটেই নাহ! তারপরও মেয়েটার চাহনী আর হাসি বারবার মন আর মস্তিষ্কে সংকেত দিয়ে যাচ্ছে৷
-ঘুমের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত চোখগুলো ঘুমিয়ে পড়ে৷ খুব ভোরে হুট করেই ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে৷ ভার্সিটি যাওয়া হয়না অনেকদিন৷ সেদিন ঘুম থেকে উঠে হুট করেই ভার্সিটি চলে গিয়েছি৷ নির্ধারিত সময়ের ২ঘন্টা আগে৷ পরেশ কাকার টং দোকানে কড়া লিকারের ৩কাপ চা গিলেছি একটানা৷ ক্লাস শেষ করে আবার সেই পরেশ কাকার দোকান৷ এবার চায়ের সাথে ২খানা সিঙারা৷ চা খাওয়ার ব্যাপারে পরেশ কাকা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন৷ আমিই কাকাকে বললাম,
-সবাই সিগারেট খেয়ে কষ্ট উড়ায়৷ আর আমি চা খেয়ে৷ এই যে শব্দ করে করে চা খাচ্ছি! এই শব্দ করে চা খাওয়াটা বিড়ির শেষটানের মতই৷ আমার অদ্ভূত কথা শুনে তার পানখোঁর মার্কা লাল দাঁতগুলো দেখিয়ে, চা এর কাপ ধোঁয়াই মনযোগ দিল৷
-আজ সারাশহর হাটাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছি৷
হাটঁতে হাটঁতে ক্লান্ত হব, তারপর ছোট্ট রুমটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব৷ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য বের হচ্ছিলাম৷ রাস্তার ওপাশে চোখ পড়তেই দেখলাম নীরা দাড়িঁয়ে আছে৷ রুমাল দিয়ে ঘাম মুছায় ব্যস্ত, মুখে বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠেছে স্পষ্ট৷ চোখাচোখি হতেই হাত দিয়ে ঈশারা করল,যেখানে আছেন ঐখানেই দাড়িঁয়ে থাকুন৷ রাস্তা ফাঁকা হতেই দ্রুত পা ফেলে আমার সামনাসামনি চলে এসেছে৷ মন চাচ্ছিলো মেয়েটার গুলুগুলু গালগুলো টেনে দিই৷ ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিয়ে মুখে যথেষ্ট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি৷ চেষ্টার বিন্দুমাত্র সফল হচ্ছে কিনা জানা নেই৷ নীরার মুখে ক্লান্তিভরা হাসি নিয়ে বলল,
-জানেন কয়দিন ধরে আপনাকে খুজঁছি?
-কেন? আপনিও কি আয়না কেনার টাকা দিবেন?
-না৷ তবে…
-তবে কি?
-আয়নার জায়গায় আমার চোখ দু’টো থাকবে৷
-মানে?
-মানে কাল থেকে আবার টিউশন এ যাবেন৷
-কেন যাব?
-আমি বলছি তাই৷
-কেন বলছেন?
-বুঝে নিবেন৷ এখন রিকশা ডাকুন৷ বাসায় পৌছুতে হবে৷
-বাধ্য ছেলের মতই তারপরের দিন থেকে টিউশন শুরু ৷ জানালার গ্রীল ধরে হাসি মুখে নীরা দাড়িঁয়ে থাকতো৷
আমাকে দেখলেই বলতো, চুল ঠিক আছে৷ মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই চুলগুলো এলোমেলো করে যেতাম৷ আমি চাইতাম নীরা নিজ হাতেই চুলগুলো ঠিক করে দিক৷ ও হয়তো বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা৷ তারপর থেকে আমাক ডাক দিয়ে থামাতো৷ কাছে এসে নিজেই চুলগুলো ঠিক করে দিতো৷ আর আমি পলকহীন ভাবে চেয়ে থাকতাম৷ যখন বুঝতে পারতো আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে, ও মুচকি হেসে আমার নাকটা টেনে দিতো৷ আর বলতো, চুল এলোমেলো করে এসে আমাকে দেখার ধান্দা হু! বুঝি আমি সব৷ মেয়েটার সামনে গেলেই আমি শব্দহীন হয়ে যেতাম৷ মুখ দিয়ে কথা বেরই হতো না৷ অথচ তাকে বলার জন্য এত্তগুলো কথা সাজিয়ে রাখতাম৷ কিন্তু বলতে পারিনি কখনো৷ তখনো কেউ কাউকে বলিইনি ভালোবাসার কথা৷ তবে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম৷ শেষবিকেলে একসাথে নদীর পাড়ে হাটাঁ, ভীষণ রকমের ঝাল দিয়ে ফুচকা খাওয়া, ঝালমুড়িঁ খাওয়া, বৃষ্টিতে ভেজা, উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটাঁহাটিঁ চলতো৷
-হঠাৎ করেই নীরা একদিন গায়েঁব হয়ে গেল৷
সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা৷ কত খুজেঁছি কিন্তু কোথাও পাইনি৷ নীরাদের বাসার দরজার কলিং বেলটা অনেকবার বাজাতে গিয়ে ও থেমে গিয়েছি৷ কেন থেমে গিয়েছি জানি না! এতদিন একসাথে থেকেও যে মানুষটাকে বলতে পারিনি “ভালোবাসি”৷ তার বাসায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে মন সায় দেয়নি হয়তো৷ তারপরও আমি প্রতিদিনই নীলরঙা বাসাটার সামনে দিয়েই যায় প্রতিনিয়ত৷ বাসাটার রঙের সাথে আমার মনে রং মিলে মিশে একাক্ার ততদিনে৷
-সব আশা ছেড়ে দিয়ে রাস্তার ফুটপাত অথবা পার্কের বেন্ঞ্চিতে উদাসীন হয়ে বসে থাকতাম৷ দিন যায় রাত আসে, সূর্য উঠে আবার ডুবে৷ কিন্তু আমার নীরা আর আসে না কিছুতেই৷ চুলগুলো উশকো খুশকো হয়ে গিয়েছে৷ যেদিন থেকে নীরা গিয়েছে সেদিন থেকে আর হাত লাগানো হয়নি৷ আয়নার সামনে গেলেই নিজেকে বিদঘুটে লাগে৷
– ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তার মোড়ে দাড়িঁয়ে ছিলাম৷
মাঝে মাঝে প্রচন্ড শব্দ করে মেঘের গর্জন হচ্ছিল৷ রাস্তা তখন জনমানবহীন৷ শব্দ করে কান্নার জন্য আদর্শ জায়গা৷ বৃষ্টির বেগ বৃদ্ধির সামানুপাতিক হারে আমার কান্নাও বেড়ে চলেছে৷ অল্প দূরে রিক্সার বেল শুনা যাচ্ছে৷ মাথায় পলিথিন জড়িয়ে প্রাণপণে রিক্সা টেনে চলেছে ড্রাইবার সাহেব৷ হঠাৎ রিক্সাটা সামনে এসে থেমে গেল৷ ঘড়ির হিসেবে তখন মধ্যবিকাল৷ প্রকৃতির কারণে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ আবছা আবছা সবকিছুই৷ ঝাপসা চোখে দেখা যাচ্ছে কেউ একজন আমার দিকে আসছে৷ হ্যা আমার নীরা! ধীরপায়ে মেয়েটা আমার সামনে চলে এসেছে৷ হঠাৎ ওর হাতের ছাতাটা বাতাসের ঝাপটাই উড়ে গেল৷ আমার মন তখন নীরাকে পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা৷
মেয়েটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা৷ চোখদু’টো কোটরের শেষপ্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে৷ গালগুলো আর নাদুস নুদুস নেই৷ নিঃশব্দে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল৷ তারপর সারা মুখে দুই হাত বুলিয়ে দিল৷ সবশেষ আমার নাক টেনে বলল, ভালো থেকো শুভ্র! এই জীবনে আর এক হওয়া হলো না৷ আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই রিক্সার ভেতর থেকে কারো কন্ঠ কানে লাগল৷ কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, নীরা হলো তোমার? এইসব পাগলামীর মানে হয় না! চিৎকার শুনে নীরা আমার দিকে শেষবারের মত তাকাই৷ মেয়েটা ফুপিঁয়ে কাদঁছে৷ আমার হাতদু’টো তার মুখে চেপে ধরলো৷ আমার বুকটা তখন ফেটে যাচ্ছিল৷ কিন্তু নীরা তখন অন্যের৷
নীরা তার গন্তব্যের দিকে হাটাঁ ধরেছে৷ রিক্সাতে উঠার আগে শেষবারের মত ফিরে তাকালো আমার দিকে৷ বহুকষ্টে আমার হাতখানা তুলে তাকে বিদায় জানিয়েছি৷ রিক্সাটা দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগ পর্যন্ত চেয়েছিলাম৷ রিক্সার প্যাঢেলের সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে আমাদের এক হওয়ার স্বপ্নগুলো৷ শেষবিকেলের মিষ্টি রোদে প্রথম দেখা মেয়েটাকে শেষবিকেলেই শেষবারের মত দেখেছি৷ শেষটা আর রাঙাতে পারিনি৷ বিমর্ষ মনের সাথে বিমর্ষ প্রকৃতি মিলেমিশে সেদিন ছিল বিমর্ষ বিকেল৷