আমরা বিয়ে করি ২০১০ সালের মাঝামাঝি। আমরা ব্যাচমেট ছিলাম, এরপর বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে জীবনসঙ্গী। দুজনেই তখন মেডিসিনে এফসিপিএসের ট্রেনিং করছি, হাসপাতালে রোগী দেখতে অনেক সময় দিতে হয়। মাস চারেক পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রায়ই জ্বর আসতো, ধারণা করা হয় যে কাজের অনেক চাপ যাচ্ছে দেখে এমন হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছিল। ১০৪-১০৫ ডিগ্রি জ্বর উঠে যাচ্ছিল, সাথে ইউরিনারি রিটেনশনও দেখা দেয়। কোনভাবেই ডায়াগনোসিস করা সম্ভব হচ্ছিল না। এমআরআই করে ডাক্তাররা ধারণা করেন যে আমার সিএনএস টিউবারকিউলোসিস হয়েছে। তখন আমার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। কথা জড়িয়ে যেত, সাথে মেমোরি লস দেখা দেয়। কাছের মানুষদেরও চিনতে পারতাম না, এমনকি আমার স্ত্রীকেও না।
টিউবারকিউলোসিসের চিকিৎসা এবং এর পাশাপাশি স্টেরয়েড নেবার পর আমি কিছুটা সুস্থ হই, হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসি। কিন্তু এসময়ই প্রথম প্যারালাইসিসের লক্ষণ দেখা দেয় আমার মাঝে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আমাকে সিংগাপুর নেয়া হবে। এখানে আমাকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় যার মধ্যে টাকা জোগাড় করাটা প্রধান ছিল। তখন আমার দুই পায়ে শক্তি কম, হুইলচেয়ারে বসিয়ে ক্যাথেটার লাগিয়ে আমাকে সিংগাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল নাফিসা। আমাকে সারাক্ষণ দেখাশোনা করা এবং সেই সাথে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও পালন করে।
ডাক্তারের পরামর্শে সিংগাপুর থেকে আমাকে ইন্ডিয়া পাঠানো হয়। এখানে ওষুধের পাশাপাশি আমাকে ফিজিওথেরাপি দেয়া হয়, ফলে স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়। আমি তখন ওয়াকিং স্টিকে ভর দিয়ে হাঁটতে পারতাম। ২০১২ সালের মাঝামাঝি নাগাদ দেশে ফেরত আসি। এসময় আমি আর নাফিসা এমআরসিপি পার্ট ওয়ান আর টু পাশ করি। ২০১২ সালের শেষের দিকে আমার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হয়। শেষ পর্যন্ত সিংগাপুর থেকে ডায়াগনোসিস হলো যে আমার সিরিনগোম্যায়ালিয়া নামে স্পাইনাল কর্ডের খুব রেয়ার একটা ডিজিজ হয়েছে। কয়েকবার স্পাইনাল সার্জারি করলাম, কিন্তু সেটা খুব একটা ফলপ্রসূ হলো না। এই সময়েই শুরু হলো পুরো শরীরে প্রচণ্ড স্নায়বিক ব্যথা ও আমার শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হয়। সবরকম ওষুধ এমনকি শক্তিশালী ওপিওয়েড ও হাই ডোজ স্টেরয়েড দিয়েও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমার পেটে একটি যন্ত্র বসিয়ে দেয়া হয় যেখান থেকে মরফিন সরাসরি আমার মস্তিষ্কে পাম্প করা হয়।
আমার বর্তমান যে শারীরিক অবস্থা, তাতে আবার পূর্বের মত হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান হলো অসুখটা ও সিমটমগুলো যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা। আমি যে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি তাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আমার স্ত্রীর ও আমার বাবা মায়ের। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে আমার বাবা মাও ডিএমসিয়ান এবং তাঁরাও একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেন। মাঝখানে প্রায় দুই বছর আমি পুরোই বিছানায় ছিলাম। নিজে উঠে বসতে পারতাম না, বাইরের আলো বাতাস পর্যন্ত দেখিনি। এসময় নাফিসার যত্ন আর সঙ্গই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। অনেক ভেবে ওকে আমি বলেছিলাম যে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে। কারণ আমি মাঝখানে কয়েকবার মৃত্যুর সম্মুখীন হই এবং আমার যে শারীরিক অবস্থা তাতে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশা ছিলনা। কিন্তু নাফিসা আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমার কখনোই মনে হয়নি যুদ্ধটা আমার একার। আমার পাশে একসাথে, কখনো বা আমার চাইতেও বেশি কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে নাফিসা আমার সাথে লড়ে গেছে। মাঝখানে আমার রক্তশূন্যতা দেখা দেয়, হিমোগ্লোবিল লেভেল চারের নিচে নেমে গিয়েছিল। তখন নাফিসাই রক্তদান করে আমার জীবন রক্ষা করে।
এত কিছুর পরেও যে আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে পেরেছি, তাতেও নাফিসার অবদান সবচেয়ে বেশি। আমি জীবন নিয়ে কখনোই হাল ছাড়িনি। আমার যত্ন নিতে গিয়ে নাফিসা ওর পড়াশোনা থেকে প্রায় চার বছর দূরে সরে আসে। আমি ওকে আবার পড়াশোনায় ফিরতে উৎসাহিত করি। নাফিসা এমআরসিপি ফাইনাল পার্ট দেবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আমার নামও এন্ট্রি করে দেয়। ফলে আমিও একরকম বাধ্যই হই প্রস্তুতি নিতে। প্রস্তুতি নেবার সময় শারীরিক অংশটুকুই ছিল সবচেয়ে কঠিন। প্রচণ্ড ব্যথা ও অ্যাডিসন’স ক্রাইসিস নিয়ে প্রস্তুতি নেই। এসময় আমার ব্লাড সুগার তিনের নিচে নেমে যেত এবং রক্তচাপও কমে যেত। হাই ডোজ স্টেরয়েড নিয়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তখন। ২০১৭ সালে আমি আর নাফিসা কাছাকাছি সময়ে এমআরসিপি পাশ করি। এখন চেম্বারও করতে পারছি, নিয়মিত রোগী দেখি। নাফিসা কখনোই বিশ্বাস হারায়নি আমার উপর আর আমাকেও বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে যে জীবনে প্রতিকূলতার পরেও ভাল সময় আসতে পারে। ওর কারণেই আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখি, এত কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই। ভালবাসা যে সব প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে, আমার স্ত্রীই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।