আজ আমাদের বিয়ে। পুরো বাড়ি লাল-নীল-হলুদ বাতিতে ঝলমল করছে! সকাল থেকে বিয়ের সানাই বাজছে। আমি শেরওয়ানি পরে বর সেজে বসে আছি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। কিন্তু বর-বধূকে নিয়ে আমজনতারকৌতূহল যেন শেষ হচ্ছে না। আমি এখন ছাদে, দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি আরভাবছি বাসর ঘরে কি করে ঢুকব?আচ্ছা নিতুরও কি আমার মতো ভীষণলজ্জা লাগছে?
লাগবেই তো! এ বয়সে আবারও বর-বধূ সেজে দুজনে কি করে যে মুখোমুখি হব? আমি তো মুখের সামনে থেকে রুমালটা সরাতেই পারছি না। ছেলেমেয়েগুলো হয়েছে নাছোড়বান্দা। কোনো কথা শোনে না। এত নিষেধ করলাম, তাও শুনল না।আমাদের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতেআবারও নতুন করে আমাদের বিয়ে দিয়েই ছাড়ল। সব আকাশ সংস্কৃতিরপ্রভাব। কিন্তু কেন যেন ভালো লাগছে। ভালো লাগছে বললে ভুলহবে। ভীষণ ভালো লাগছে। যদিও আজ সমস্ত দিন ছেলেমেয়ের সামনে এমনএকটা গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে ছিলাম যে, আমি এই অহেতুক অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী। সব আমার অভিনয়। আসলে খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে। বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ পঁচিশ বছর যে কথাটা নিতুকে বলতে পারিনি আজ বলব। তাই তো চুপচাপ ছাদে এসে বসে আছি। রিহার্সাল করছি। কিন্তু লজ্জা লাগছে। নিতু আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে নাতো?এত বছর পর।
নিতুকে যেদিন প্রথমবার দেখতে গেলাম, সেদিন ও টুকটুকে লাল একটা শাড়ি পরে এসে বসেছিল আমারসামনে। খিলখিল করে হাসছিল! কীনির্লজ্জ! পাত্রপক্ষের সামনে এভাবেকেউ হাসে? আর পাত্রপক্ষ দেখতেআসলে কেউ এমন বউয়ের মতো লালশাড়ি পরে আসে? ভাবখানা এমন যে এখনই বিয়ে করে আমার ঘাড়ে জন্মের মতো চেপে বসবে। পেতনি কোথাকার। আমিতো মায়ের চাপে পরে পাত্রী দেখতে এসেছি। মায়ের তার ছেলের বউ দেখার বড্ড শখ! একমাত্র ছেলের জন্য বউ এনে তিনি একটামেয়ে পেয়ে যাবেন। এতই যখন মেয়ের শখ, একটা পালক মেয়ে আনলেই পারত। আমাকেও ভাইয়া ডাকত। আমি একটা বোন পেতাম। বউ এনে কি লাভ? ভার্সিটি লাইফে বন্ধুদের একের পর এক ছ্যাঁকা খেয়ে দেবদাস হতে দেখে প্রেম-বিয়ের প্রতি আগ্রহ আমার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। মা আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল না করলে আমি জীবনেও পাত্রী দেখতে আসতাম না।
ঠিক করেছিলাম, পাত্রী দেখে বলব, পাত্রী আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু এই মেয়ে ভয়ংকর সুন্দরী! তার ওপর যথেষ্ট মেধাবী। পছন্দ হয়নি সে কথা বলার মতো কোনো পথই খোলা রাখেনি এই মেয়ে। সেদিন আমার মামা আমার সঙ্গে সবচেয়ে বড় বেইমানি করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, শুধু পাত্রী দেখতে যাব। কিন্তু মার সঙ্গে যুক্তি করে সেদিনই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন যা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। যথারীতি আমাকে বলদ বানিয়ে সেদিন জোরপূর্বক বিয়ের পিঁড়িতেবসানো হয়েছিল। আজীবন চিরকুমার থাকার শপথ সেদিনই ভঙ্গ হয়েছিল। মা আমার তার অতি সাধের পুত্রবধূকে বরণ করতে কোনো কার্পণ্য করেননি। কাবিনের সাত দিনের মধ্যে ঘটা করে নিতুকে তুলে এনেছিলেন। সেদিনওঠিক এভাবেই ছাদে এসে বসেছিলাম।যে বিয়েটা আমি মানতে পারিনিসেখানে কেন মিছেমিছি বাসর ঘরেঢোকা?পঁচিশ বছর আগের সেই বাসর রাত!
—বাবা পাগলামি করিস না। বাসর রাতে কোনো স্বামী বউকে একারেখে ছাদে এসে বসে থাকে? বউমাকি মনে করবে?
—দেখো মা? তোমার ছেলে বিয়ে করানোর শখ ছিল, বিয়ে করিয়েছ। মেয়ের মতো বউ পেয়েছ। এখন তুমিইতোমার মেয়ের খাতির যত্ন কর। এবিয়েতে আমার মত ছিল না। কিন্তুতুমি আর মামা যুক্তি করে আমাকেফাঁসিয়েছ। আমি ওই মেয়ের কাছেযাব না।
—জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এই তিন বিধাতার হাতে। তোর সঙ্গে নিতুর বিয়ে লেখাছিল বাবা। আমরা তো উছিলা মাত্র।মেয়েটার মনে কষ্ট দিস না। একটামেয়ে কত স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরেআসে।
—ওই মেয়েকে আমার ঘরে কে আসতেবলেছে? অন্য কাউকে বিয়ে করত।মাথায় তুলে রাখত। যাও তো মা। আমিআজ ছাদেই রাত কাটাব। কাল সকালেতোমার প্রিয় বউমাকে বলো। উনি যেনগেস্ট রুমে থাকেন। আমার রুম যেন আরদখল না করেন।
—নতুন বউ গেস্টরুমে থাকবে? আর তুই আরাম করে তোর রুমে ঘুমাবি? দরকারনাই তোর মতো ছেলের আমার। তুইপারলে রাস্তায় গিয়ে থাক। মা মরামেয়েটাকে বউ করে এনেছি। বাসররাতেই মেয়েটার কপালে এমন কিছু থাকবে কে জানত?মা হয়তো সেদিন মনের কষ্টে আমাকেঅভিশাপ দিয়েছিলেন। সে রাতে যতক্ষণ ছাদে ছিলাম, মশা আমাকে দুদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেয়নি। মনে হচ্ছিল মশাগুলো মার পাঠানো সৈন্যবাহিনী। তারা কোনোভাবেই বাসররাতে আমাকে ছাদে থাকতে দেবে না। কী আর করা, অবশেষে পরাজিতসৈনিকের মতো ছাদ থেকে বহিষ্কার হলাম। রাত তিনটা। চুপচাপ পা টিপে টিপে নিজের রুমে যাচ্ছি। মা টের পেলে আমার প্রেস্টিজ থাকে না। বলেছিসারা রাত ছাদে থাকব। এভাবেতিনটার সময় ফিরে এলে মা হাসবেন।
আস্তে করে রুমের দরজা খুললাম। ভেতরে আলো জ্বলছে। আমার ধারণাছিল, মেয়েটা মাথায় লম্বা একটাঘোমটা দিয়ে এত রাতেও তার স্বামী পরমেশ্বরের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তুনা, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! রুমে ঢুকেই দেখি ফুলে ফুলে সাজানো আমার অতি পরিচিত বিছানাটায় একটা লাল অপ্সরী পরি ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছে।কি ভয়ানক সুন্দরী সে! চোখ ফেরাতেপারছি না। কিন্তু সেদিন ওকে কেন পেতনির মতো দেখাচ্ছিল? সত্যিই কিপেতনির মতো দেখাচ্ছিল? নাহ,বিয়ে করব না বলে কোনো মেয়েকেইআমার ভালো লাগত না। নারীরসৌন্দর্য আমার চোখে ধরা দিত না। আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোপুরিনারীবিরোধী। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেওআমি যে মানুষটা ছিলাম, রুমে ঢোকারপর কী আগের সেই মানুষটা আছি?নিতুকে এই মুহূর্তে কেন শুধু আমারনিজের খুব কাছের মনে হচ্ছে? বাসরঘরে নতুন বউকে একা রেখে মাঝরাতপর্যন্ত ছাদে কাটিয়ে এসে এখনবাসরঘরে নববধূকে দেখে যে আবেগআমার জেগে উঠছে, তা কী প্রমাণকরে না আট-দশটা পুরুষের মতো আমিও।
দু পা পিছিয়ে গেলাম। আবারও নিতুকে দেখলাম। ভীষণ মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। আমার জন্য হয়তো কত রোমান্টিক স্বপ্ন নিয়ে বাসরঘরেঅপেক্ষা করছিল। কতই না আজেবাজেকথা বলেছি ওকে নিয়ে। অনুশোচনারা দল বেঁধে তাড়া করছে এখন। নিজের এই আকস্মিক পরিবর্তনে নিজেই অবাক হচ্ছি। মা কোনো জাদু করেনিতো? ধীরে ধীরে বিছানার কাছে গেলাম। বিছানার পাশে ছোট টেবিলটার ওপর চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম, টেবিলে রাখা দুধের গ্লাসটা খালি পড়ে আছে আর প্লেটে রাখা অর্ধেকটা মিষ্টি। পেটুক নাকি? গ্লাসের পুরো দুধ একাইসাবাড় করল? হঠাৎ একটা প্রতিধ্বনি কানে আসল।তোর মতো গর্দভের জন্য রাখবে নাকি?যে কিনা নববধূকে বাসরঘরে একারেখে ছাদে মাঝরাত পর্যন্ত কাটায়তার জন্য দুধ তো দূর এক গ্লাস পানিওরাখা ঠিক না!কে? চারদিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখে বুঝে নিলাম, মশার মতো আমার বিবেকও আমার পেছনে লেগেছে। আর কিছু চিন্তা না করে নিঃশব্দে বিছানায় গিয়ে বসলাম।
—এতক্ষণে তোমার আসার সময় হলো? ঘুমন্ত রাজকন্যার এমন আচমকা জেগে উঠে কথা বলতে দেখে ভয়ে আমার কলিজা গলা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল।এক লাফে বিছানা থেকে নেমেদাঁড়িয়ে পড়লাম!
—জি?
—রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?
আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছিল তাই দুধ আর মিষ্টি খেয়ে ফেলেছি। জায়গা পরিবর্তন হলে আমার ঘুম আসে না। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। নিতুর এমন সহজ আচরণ দেখে অবাক নাহয়ে পারলাম না। বাসরঘরে নববধূ লজ্জায় স্বামীর দিকে তাকাতে পারে না, প্রেমের বিয়ে হলে অন্যকথা কিন্তু নিতুকে দেখে মনে হচ্ছে সে পূর্বের জন্মে এ বাড়িতেই ছিল,আমার মায়ের মেয়ে হয়ে। তাহলে কিসে আমার বোন ছিল? ছি, কী যা তাভাবছি!
—এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার খোঁপা খুলে দাও। পারলারে এমনভাবে খোঁপা বাঁধে কেন?কিছুতেই খুলতে পারছি না!আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। এক সমুদ্র জড়তা নিয়ে বসলাম নিতুর সামনে।যেহেতু জীবনে কোনো প্রেম করিনি,কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসিনি, তাই ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। নিতু চোখ বড় বড় করে তাকাল আমার দিকে।
—ঘামছ কেন? পারবে না? এতরাতে মাকে বিরক্ত করতে চাইনি। সারা দিনের ধকলে উনি ক্লান্ত!কিছু বললাম না, চুপচাপ নিতুর পেছনেগিয়ে বসলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে নিতুর খোঁপার একটা একটা কাঁটাতুলতে লাগলাম। আমার মনের অজান্তেই কেমন করে যেন পৃথিবীটা বদলে যেতে শুরু করেছে। সবকিছু রঙিন আর সুন্দর মনে হচ্ছে। বাসরঘরে নতুন বউয়ের খোঁপা খুব যত্ন করে খোলার মাঝে কী ভয়ানক চমৎকার অনুভূতি হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না। কেন এমন হচ্ছে? যে মেয়েকে আমি আমার রুমেজায়গা দিতে চাইনি, সে এই অল্প কিছু সময়ের মধ্যে কি করে আমার সমস্ত ভুবন দখল করে ফেলল?
—লুডু খেলবে?
—লুডু? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলাম।
—অবাক হচ্ছ কেন? বাসরঘরে লুডু খেলা নিষেধ? আমি বোকার মতো উত্তর দিলাম।
—জানি নাতো? নিতু বালিশের নিচ থেকে লুডু বেরকরল।
—চলো খেলি।
আমি নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বয়সে নিতু আমার থেকে দশবছরের ছোট হবে। মা মরা মেয়ে।বাবার আদরে বড় হয়েছে। হয়তো মা নেই সেই কারণে বাবা তার কোনোআবদার অপূর্ণ রাখেননি। স্বামীর কাছেও হয়তো বাবার মতো ভালোবাসা খুঁজে পেতে চাচ্ছে। মনে মনে লজ্জিত হলাম। বিয়েটা নিয়ে মার সঙ্গে কতই না রাগারাগি করেছি। একবারও নিজের বিবেকটাকে প্রশ্ন করিনি। বিয়ের পর একটিবারের জন্য নিতুর সঙ্গে কথা বলিনি। কাবিনের পর ওদের বাসাথেকে চলে আসার পর একবার ফোনকরেও মেয়েটার খোঁজ নিইনি। আজওমাঝরাত পর্যন্ত। নিতু কষ্ট পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। খুব সহজভাবে আমার কাছ থেকেপাওয়া কষ্টগুলো মেনে নিয়েছে। কোনো অভিযোগ নেই তার অভিব্যক্তিতে। কীভাবে পারে মেয়েরা যন্ত্রণাগুলো হাসির ভাঁজে লুকিয়ে ফেলতে? নিতুর কাছে ক্ষমা চাইব? কিন্তু কি বলব?
—কই শুরু করো। আমি লাল আর তুমি নীল। চুপচাপ সায় দিলাম। নিতু আহ্লাদের সুরে বলল, সাপলুডু খেলবকিন্তু। আমি মৃদু হেসে বললাম, ঠিক আছে। নিতু কিছুটা রহস্য করে বলল, আমি কিন্তু একটু অন্যরকম করে সাপলুডু খেলি। অন্যদের মতো না।
—কি রকম করে খেলো?
—সাপলুডুতে সাপের মুখে পড়ো তো সোজা মুখ থেকে লেজে আর মইয়ের নিচে আসতেই মই বেয়ে এক্কেবারে চূড়ায়। আমি সিরিয়াস হচ্ছি, হুমম সেভাবেই তো সবাই খেলে।
—আমি কিন্তু উল্টোটা করি।
—মানে?
—মানে হচ্ছে, আমার খেলায় মইয়ের মাথায় আসলে সোজা মই বেয়ে নিচে আর সাপের লেজে পরলেই সোজা লেজ বেয়ে ওপরে। মজা না?
—এভাবে কেউ খেলে নাকি?
—খেলেই দেখো না।
নিতুর অনুরোধে শুরু করলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই চরম মজা পেতে শুরু করলাম! মইয়ের মাথায় আসতেই যখন সুর সুর করে নিচে নামতে থাকলাম, নিতুর সে কী বাঁধভাঙা হাসি। আবার যখন সাপের লেজ ধরে ওপরে উঠি ওর চোখে জয়েরআনন্দ। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মায়াভরা মুখটার দিকে। রাত প্রায় শেষ। নববধূকে নিয়ে বাসররাতে লুডু খেলে পার করলাম, ইতিহাসে বোধ হয় এটাই প্রথম। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। খেলায় নিতুর জয় হয়েছে। আমি পরাজিত হলেও ভীষণ খুশি নিতুর বিজয় দেখে। নিতু ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে দাঁড়াল। দুহাত দিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিল। পুরোটা রুম সূর্যের সোনালি আলোয় ভরে উঠল। মনে হলো যেন আমার নবজন্ম হয়েছে। এ জন্মে আমার পাশে প্রিয় একটা মুখ যেন উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে বিধাতা। ঠোঁটের কোণে একচিলতে স্নিগ্ধ হাসির রেখা টেনে নিতু বসল আমার পাশে।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সংসার জীবনটা খুব কঠিন। এ জীবনে সুখী হতে হলে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। পুলসিরাতের মতো কঠিন আর ভয়ংকর পথ অতিক্রম করে তবেই সুখেরঠিকানা পাওয়া যায়। মই পেলেই তো সবাই তরতর করে ওপরে উঠে যায় কিন্তু সাপ দেখলে ভয়ে পালায়। সংসার জীবনে প্রতিটা পদক্ষেপেই বিষধর সাপ ফণা তুলে তাড়া করবে। যারা এই সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হবেতারাই হবে আসল সুখী। সুখকে উপলব্ধি করতে হলে কষ্টকে আলিঙ্গন করতে জানতে হয়। এতক্ষণে আমার বুঝতে বাকি রইল না কেন নিতু বাসরঘরে সাপলুডু খেলতে বসেছিল। খেলার ছলে মেয়েটাআমাকে চরম এক বাস্তবতা শিখিয়েদিয়ে গেল। আমাদের নতুন সংসার শুরু হলো। মা আমার ভীষণ খুশি। সেদিনের পর আমি আর কখনই নিতুর বিরুদ্ধে মাকে কিছু বলিনি। আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনদেখে মা নীরবে আনন্দ-অশ্রু ঝরাতেন।
আমি বুঝতাম।অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিতু পুরোসংসারটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিল। মা তাঁর অতি আদরেরছেলেকে নিজের কোল থেকে নিতুরকোলে স্থানান্তর করে বাবার সেবাকরতে পরকালে রওনা দিলেন। বাসরঘরে যে মেয়েটাকে আমিজায়গা দিতে চাইনি সে কখন যেআমার পুরো জগৎটা দখল করে ফেলেছেটের পাইনি। এতগুলো বছর একসঙ্গে থাকার পরও কেন জানি কখনো নিতুকে ভালোবাসি এ কথাটা বলা হয়নি। বলতে চেয়েছি কিন্তু যতবারই বলার চেষ্টা করেছি, নিতুর আদা-রসুন-পেঁয়াজের লিস্টের নিচে চাপা পড়ে গেছে। জানি না মেয়েটা মনে মনে কি ভাবে আমাকে নিয়ে। বিয়ের পঁচিশ বছর পার হয়ে গেলকিন্তু আজও নিতু তোমাকে অনেকভালোবাসি বলা হলো না। তাই ঠিককরেছি আজ পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতে নিতুর হাত ধরে বলেইফেলব আমি ওকে উন্মাদের মতোভালোবাসি আর।
কিরে গর্দভ! আজও কি মাঝরাত পর্যন্ত ছাদেই কাটিয়ে দিবি? আর কত রিহার্সাল করবি? তুই সারা জীবন গাধাই থেকে গেলি। বউমার কাছে যা! কে? চমকে উঠলাম। মায়ের কণ্ঠ মনে হয়!ছাদে আমি ছাড়া তো কেউ নেই! মা খেপেছে! আর দেরি করা যাবে না। আজও নিতু বধূ সেজে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আজ আর ওকে প্রতীক্ষার অণলে দগ্ধ করব না। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমার রুমের দিকে। রুমের বাইরে দরজারসামনে লাল রঙের ফিতা ধরেদাঁড়িয়ে আছে আমার ছেলেমেয়ে, ভাগনে-ভাগনি, পাড়ারআবালবৃদ্ধবনিতা সব। কী ভয়ানকব্যাপার! একে তো এই বয়সে বিয়েরঅনুষ্ঠান তার ওপর এসব উটকোআদিখ্যেতা। এখন আমার বিরক্তলাগছে। এতক্ষণ ছাদে বসে কতরিহার্সাল করলাম। ভাবলাম সবারচোখকে ফাঁকি দিয়ে টুক করে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ব। তা না সবাই দরজার সামনেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করেদাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে কোত্থেকে এক শ্যালিকাও এসে হাজির হয়েছে।
—দুলাভাই…রুমে ঢুকতে হলে দশ হাজার টাকা দিতে হবে কিন্তু, তা না হলে নো এন্ট্রি। দশ হাজার? আমার চোখ কোটর ঠিকরে বের হয়ে যাচ্ছিল। ডাকাত নাকি? মনে মনে বললাম।
—তুই আমার কোন জনমের শালিরে?
দশ হাজার টাকা নিয়ে আমারই বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দিবি। গুলি মারি তোদের। আর আমার বউতো একমাত্র মেয়ে। তার তো কোনো বোন নেই। বিয়ের সময় ওদের বাড়িতে কেউ গেটও ধরেনি। আর এখন কিনা। আচ্ছা আমার ছেলেমেয়ে প্ল্যান করেশালা-শালি ভাড়া করেআনেনিতো? আমার ছেলে অর্ণবের দিকে তাকালাম। কোনো লাভ হলো না। ওর ভাবখানা এমন ও কিছুই জানে না। মেয়েরও একই হাল। রাগে আমি গরগর করছি। আর এই ভাড়া করা শালি টাকা না নিয়ে কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি এই মহাবিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাব? আমার যেকোনো বিপদে, সুখে-দুঃখে নিতুই তো পাশে ছিল। ও তো দরজার ওপারে বউ সেজে চুপ করে বসে আছে। আমিতো অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু দশ হাজার টাকা দিয়ে ফিতা কেটে ঘরে ঢোকার পক্ষপাতী আমি না।
—কি দুলাভাই টাকা ছাড়েন আর রুমে ঢোকেন।
—কিসের টাকা? এসব কি হচ্ছে?
বুড়ো বয়সে আমাকে নিয়ে তামাশা? অর্ণব? এসবের জন্য তোমরা আবার আমাদের বিয়ের আয়োজন করেছ? বলেছি না কোনো ঝামেলা যেন না হয়? আমি আরেকটু উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েছিলাম কিন্তু এরই মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চুপ হয়ে গেলাম। নিতু দরজা খুলে তথাকথিত সেই শ্যালিকাকে কানে কানে কি যেন বলল আর তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো। কী মধুর সে ডাক। আমি চুপচাপ নিতুর পেছন পেছন রুমের ভেতর ঢুকে পরলাম। নিতু আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিল।
—কি নার্ভাস লাগছে? সত্যি নার্ভাস লাগছে কিন্তু নিতুর কাছে প্রকাশ করা যাবে না।
—নার্ভাস লাগবে কেন? আমি কি বিয়ের কনে যে নার্ভাস লাগবে?
—তাহলে ঘামছ কেন?
—আমি ঘামছি। দরদর করে ঘাম পড়ছে।
নিতু হাসছে। ওকে আজ ঠিক নতুন বউয়ের মতোই সুন্দর লাগছে। মনেই হচ্ছে না পঁচিশ বছরের সংসারের বোঝা বয়ে যাওয়া এক সংগ্রামী নারী। নিতু খুব গোছানো একটা মেয়ে। সংসার আর নিজেকে সব সময় পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখত। এতসব ও কীভাবে ম্যানেজ করত জানি না। অফিস শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম তখন ওর কপালের কালো টিপ আর গাঢ় কাজলের গভীরতায় হারিয়ে যেতাম। আজও ঠিক তেমনই আছে। বয়সের রেখা ওকে মোটেও ছুঁতে পারেনি। মাঝখান থেকে আমার বয়স হু হু করে বেড়ে গেছে। কাচা পাকা চুল আর ভুঁড়ি সব মিলিয়ে নিতুর পাশে আমাকে দেখলে যে কেউ বলবে বাবা-মেয়ে, হা হা হা।
—কি ব্যাপার? এভাবে হাসছ কেন? মুখে রহস্যের রেখা টেনে নিতুর সামনে এসে দাঁড়ালাম। তোমাকে একটা কথা বলব আজ। নিতু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি বলবে? বলো?
—ইয়ে মানে তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে। ঠিক পরির মতো। লাজুক স্বরে নিতু বলল, তাই? ছেলেমেয়েরা কী যে করে, এই বয়সে আবার নতুন করে…বলেই নিতু বিছানায় গিয়ে বসল। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। নিতুকে আসল কথাই তো বলা হলো না। আমিও নিতুর পাশে বসলাম। ইয়ে মানে নিতু? নিতু আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরও কিছু বলবে?
—পানি খাব।
নিতু বিছানার পাশে রাখা টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল আমাকে। এক ঢোক করে পানি গিলছি আর ভাবছি, তোমাকে অনেক ভালোবাসি এ সাধারণ কথাটা এতকঠিন কেন? কেন পারছি না? আমিতো সত্যিই নিতুকে ভালোবাসি।
—নিতু?
—হুমম!
—আসলে নিতু!
—বলে ফেলো।
—আমি টয়লেটে যাব!
নিতু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আশ্চর্য! যাও। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আবারও রিহার্সাল শুরু করলাম। যেভাবেই হোক, আজ আমাকে বলতেই হবে। আমার এত দিনের জমানো না বলা কথা তোমাকে আজ বলবই নিতু।আমার মুখ থেকে যে কথাটা শোনার জন্য তুমি এতগুলো বছর প্রতীক্ষা করেছ আজ সে কথা তুমি শুনবেই শুনবে…। তোর মতো গাধাকে দিয়ে কিছু হবে না। তুই একজীবন পার করে দিবি কিন্তু সাহস করে বউকে তোর মনের কথাটা বলতে পারবি না।
চমকে উঠে চারদিকে তাকালাম, বাথরুমে কে কথা বলে? মা না? মা আজ ভীষণ খেপেছে। বারবার আমার কল্পনার মাথায় বাড়ি দিচ্ছে। নাহ্ অনেক রাত হয়ে গেছে। আল্লাহর নাম করে নিতুকে বলেই ফেলি। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি নিতু বিছানার ওপর মাথার ঘুমটা লম্বা করে টেনে দিয়ে একেবারে নববধূর মতো বসে আছে। আমি ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে বসলাম। অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি নিতুর দিকে। ভালোবাসি কথাটা গলার কাছে এসে আটকে আছে। ঢোক গিলতে পারছি না। নিতু কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। ও মনেপ্রাণে চাইছে ঘোমটাটা আমি খুলি। সাহস নিয়ে আস্তে আস্তে ঘোমটা খুললাম। নিতু দুচোখ বন্ধ করে নতমুখে বসে আছে। তাকিয়ে থাকলাম নিষ্পলক। কী মায়া এই মুখে। এ মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে এক জনম পার করে দেওয়া যায়। নিতুর দুহাত আমার হাতের মুঠোয় ভরে ফেললাম।
নিতু আমি জানি তোমার মনে আমার প্রতি অনেক অভিমান, অভিযোগ। তুমি প্রকাশ না করলেও আমি বুঝি। কি করব বলো? তোমার বরটা এমনই। আমার মনে জড়তার ভান্ডার। খুব চেষ্টা করেও আমি সহজে মনের কথা প্রকাশ করতে পারি না। তার মানে এই না যে আমি চেষ্টা করি না। খুব চেষ্টা করি, মনের সব না বলা কথা তোমাকে খুলে বলি। নিতু বিয়ের এই পঁচিশটা বছর আমি সংসারের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এক নারীকে দেখেছি যে কিনা নিজের সবটুকু দিয়ে আমাকে সুখী করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। নিজের স্বাদ, আহ্লাদ, সুখ হাসিমুখে বিসর্জন দিয়েছে। আমি তোমাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি। কিন্তু তুমি কোনো দিন এ নিয়ে অভিযোগ করোনি। প্রত্যেকটা মেয়েই তার প্রিয় মানুষটির কাছে ভালোবাসার কথা শুনতে চায়। আমি সে কথাটাও বলতে পারিনি। তাই ঠিক করেছি, আজ আমি বলবই আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। দুহাত দিয়ে নিতুর নতমুখটাকে তুলে ধরলাম।
—নিতু আমার চোখের দিকে তাকাও? নিতু ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাল। ওর জলে থই থই চোখের গভীরতায় মুহূর্তেই হারিয়ে গেলাম, আমার প্রাণের গহিনে দীর্ঘদিন জমে থাকা না বলা কথাগুলো দল বেঁধে বেরিয়ে আসতে লাগল।
—নিতু আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
ঠিক কতটা ভালোবাসি তা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি এতগুলো বছর একই ছাদের নিচে তোমার সঙ্গে থেকেছি কিন্তু কখনো মুখফুটে বলতে পারিনি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। সে জন্য কত যে অনুতপ্ত হয়েছি! কত যে চেষ্টা চালিয়েছি। ভালোবাসা দিবস এলেই ছেলেমেয়েদের দেখাদেখি মোড়ের দোকান থেকে একগুচ্ছ ফুল এনে তোমার হাতে দিয়ে বলেছি, নিতু দেখো তো কি কাণ্ড? ফুল বিক্রেতা ছেলেটা জোর করে হাতে ফুলগুলো দিয়ে দিল। ফুল না বেচতে পারলে আজ নাকি তার অন্ন জুটবে না। কী আর করা, কিনে আনলাম! তুমিও হাসিমুখে তোমার প্রিয় ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে। কখনো বলোনি, ও তাহলে ফুলগুলো আমার জন্য আনোনি। আমায় ক্ষমা করে দিয়ো নিতু! পঁচিশটা বছর তুমি কেবল আমাকে দিয়েছ বিনিময়ে কিছুই চাওনি। স্বামীর মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শোনার জন্য হয়তো তোমার অযাচিত মন ছটফট করেছে কিন্তু…। নিতু এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল।
-তুমি কেন এত অনুতপ্ত হচ্ছ বলতো?
ভালোবাসা মানুষের চোখে থাকে, অভিব্যক্তিতে থাকে যা আমি বিগত পঁচিশ বছরের প্রতিটি মুহূর্তে তোমারমাঝে পেয়েছি। তুমি তো সব সময়আমার পাশে ছিলে। রাতেরগভীরতায় যখন তোমার বুকের পাঁজরেআষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে তখন আমার কর্ণকুহরে কেবল একটা গুঞ্জনই বারবার প্রতিধ্বনিত হতো, নিতু তোমাকে অনেক ভালোবাসি…তোমার হৃদয়ের গভীরের সমস্ত না বলা কথা আমি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতাম। ভালোবাসি কেবল মুখে বললেই হয় না। প্রমাণ দেওয়া লাগে।
-আমি প্রমাণ দিতে পেরেছি? নিতুর আহ্লাদী সুর…হুমম পেরেছ।
-কীভাবে? আমি জানতে উৎসুক।
-বলব না…নিতুর কণ্ঠে রহস্য।
-প্লিজ বলো!
নিতু কিছু বলল না। চুপ করে আমার বুকের মাঝে মুখ লুকাল। দুহাত দিয়ে শক্ত করে নিতুকে জড়িয়ে ধরলাম! চোখের কোণে কোত্থেকে যে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়েছে, বুঝলাম না।
-জানো নিতু বুকের ভেতর থেকে বড় একটা বোঝা আজ অপসারণ হলো।
-কিসের বোঝা?
-এই যে ভালোবাসি বলতে না পারার বোঝা?
-বলেছ তো?
-কখন?
-সব সময়। নিতু হাসছে। বোকা বরটাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
-আহা, এত টেনশন নিয়ো নাতো। আমি বাংলা সিনেমার নায়িকা না যে আই লাভ ইউ না বললে কেঁদে বুক ভাসাব। চলো খেলি…।
-লুডু?
নিতু বালিশের নিচ থেকে লুডু বের করল। আমরা আবার খেলতে শুরু করলাম। সাপের লেজ বেয়ে যখন নিতুর গুটি তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে, নিতুর কী বাঁধভাঙা আনন্দ! সে আনন্দে আমিও ভাসছি। সংসার জীবনের যুদ্ধে নিতুর জয় হয়েছে। আজ সে জয়ের হাসি নিতুর চোখেমুখে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিতুর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখ বলছে নিতু তোমাকে ভালোবাসি, আমার মন বলছে নিতু তোমাকে ভালোবাসি। সত্যি ভীষণ ভালোবাসি! আমার না বলা কথারা চিৎকার করে বলছে, নিতু তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি…! শাহীন আক্তার স্বাতী: প্রবাসী বাংলাদেশি। কানাগাওয়া কেন, জাপান।