স্পর্শের অনুভুতি

স্পর্শের অনুভুতি

নীল আকাশে মেঘের ঘনঘটা ঠিক যেনো তার দুটি চোখের মতো কিভাবে জানি না, তোমায় বেসেছি ভালো, নীল দুটি চোখে সেই তুমি কি তা জানতে প্রশ্নটা আগের মতো থেকেই গেলো নীল, রঙটা কি তোমার চোখের আলো?

স্মৃতির অগোচরে কতো কথাই তো আমরা ভুলে যাই যেগুলো একসময় ভুলবোনা বলে কথা দিতাম সবাইকে। কিন্তু নির্মম এক বাস্তবতা তো এটাই যে আমরা ভুলে যাই অনেক কিছু। শুধু মনে থাকে নিজের ত্যাগ গুলো। আর মনে থাকেনা সেই ত্যাগ গুলো যেগুলো আমাদের জন্য কেউ করে যায়। এটাকি স্বার্থপরতা নয়?

আর কতোটা অভিমান জমিয়ে রেখেছো বলোতো? তুমি নিজে কি চাও তা তুমি জানো কি? অফিস শেষে যখন ক্লান্ত শরীরে টাই টা আধাখোলা করে হেঁটে বাসায় আসছিলাম তখন মনে হলো অনেকদিন ছোটন মামার দোকানে চা খাওয়া হয় না। আজ একটু ঘুরে আসা যায়। অবশ্য ওখান থেকে রিধির বাসা খুব একটা দুরে না। ওর সাথে দেখা হলেও যে কথা বলা যাবে না সেটা মাথায় রেখে দোকানের পথেই যাচ্ছি। সেখানে যেতেই দেখলাম রিধি দোকানের পাশে একটা টুল নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। দোকানে ছোটন মামা আর একজন মধ্যবয়স্ক লোক ছাড়া শুধু রিধিই বসে আছে। আমি এটা দেখে যাবো কিনা দোটানায় পরে গেলাম। ভাবলাম চলে আসি। উল্টো ঘুরে চলে আসতে যাবো এমন সময় ছোটন মামা জোরে ডাক দিয়ে বললো, মামুন মামা না? মামা কই যান? অগত্যা তার ডাকে আমাকে ফিরে তাকাতে হলো।

উনার ডাক শুনে রিধিও আমার দিকে তাকিয়ে আমায় দেখছে। আমি বিধিবাম কি করবো না করবো ভেবে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই ছোটন মামা বললো, এরকম তো কথা ছিল না মামা। একসময় প্রতিদিন আসতেন আর গেলো ছয়মাসের মতো, আপনি একবারও আসলেন না। আমি মৃদু হেসে তাকে বললাম, দাও দেখি, এক কাপ চা দাও। ছোটন মামা চোট করে বাইরে রিধির পাশে একটা টুল দিয়ে দিলেন। বললেন, মামা আপনি বসেন আমি চা দিতেছি। আমি রিধির দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিটাকে ফেরাতেও পারছি না। তাই অগত্যা তার কাছে যেয়েই বসতে হলো। টুলের ওপর বসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছো? ও কিছু বলছে না।

ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ও আমার দিকে একমনেই তাকিয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। একটু পরে ছোটন মামা এসে দু কাপ চা দিয়ে গেলো। চা হাতে নিয়ে বসে আছি তখনি রিধি বললো, আমি জানতাম তুমি আসবে তবে এটা জানিনা, কেনো এসেছো এখানে? একা করে রেখে গিয়েছো তো ফিরে এলে কেনো? একটু চুপ থেকে ও বললো, প্রতিদিন ঐ দুকাপ চা একাই শেষ করি জানো? ভালবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে আর হয়তো চায়ের কাপ দুটোর একে অপরের সান্নিধ্য শেষ না করতে। আমি কিছু বললাম না শুধু টুল থেকে উঠে চলে আসবো তখনি রিধি আমার হাতটা ধরে ফেললো। বললো, কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছো কেনো? আমি বললাম, এসবের উত্তর আমার কাছে নেই তাই বলতে পারছি না।

ও আমাকে টেনে টুলে বসিয়ে নিচু গলায় উপরের কথাটি বললো, আর কতোটা অভিমান জমিয়ে রেখেছো বলোতো? তুমি নিজে কি চাও তা তুমি জানো কি? আমি হাসলাম। অনেকখানিই হাসলাম। বললাম, আমি শুধু এটুকু জানি যে আমি তোমার ভালো চাই আর অভিমানের কথা বলছো, ওটা দেখার মতো কেউ নেই আমার। আর তোমাকে ভালো রাখার মতো আমার কাছে কিছু নেই তাই বলতে পারো নিজে থেকেই সরে এসেছি তোমার থেকে। একা জিবন রচনা করার অমানবিক চেষ্টা আরকি। এসব বলেই যখন চায়ের কাপে এক চুমুক দিচ্ছি তখন ও বললো, তো জিজ্ঞেস করবে না আমি ভালো আছি কি না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ভালোর জন্যই তো সরে এসেছি তাই সেটা জিজ্ঞেস করা কেমন না? একটু চুপ থেকে হঠাৎ ও আমার হাতটা ধরে বললো, আমি ভাল নেই মামুন।

আমি ভালো নেই। এখন আর কেউ সকালে সূর্য দেখানোর জন্য ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গায় না। সন্ধ্যাবেলা চায়ের কাপটা দেওয়ার ছলে কেউ আঙ্গুলগুলো ছুয়ে দেয় না। তুমি জানো? এখন আমি গান গাইনা। গানের সুর যেনো কেউ নিয়ে নিয়েছে। এখন কেউ আর কচুরীপানা ফুল তুলে এনে কানে গুজে দেয় না। সবচেয়ে বড় কথা আমি অনেক একা হয়ে গেছি মামুন। আমি অনেক একা। এতোসব বলে ও ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। আমি চুপ করেই আছি। একটু পরে ও আবার বললো, আচ্ছা, আমি কি তোমাকে খুব বেশি বিরক্ত করি মামুন? ভালোবাসি এটাও তো তুমি জানো তবে তুমি কেনো বাবাকে না বলেছো বলতো? এটা শুনে আমার কেমন যেনো গা শিহরিত হলো। আমি কি রিধির বাবাকে না বলেছিলাম?

আমি অনেকটা ছন্নছাড়া স্বভাবের ছিলাম। সেরকম ভাবে খুব একটা পড়াশুনায় মনোযোগী ছিলাম না। কিন্তু ক্লাসের এতো মেয়ের মাঝে রিধিই এসে যখন বললো, মামুন একটু সাহায্য করবে আমায়? তখন আমি বেশি কিছু ভাবতে পারি নি। আমি মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করতাম তবে কখনও মুখ ফুটে কথা বলার সাহস হয় নি। আর সেই মেয়েই এসে যখন সাহায্য চাইলো তখন আমি কি আর না করতে পারি। কিছু না ভেবেই বলে দিলাম, হ্যা বলো, কিভাবে সাহায্য করতে পারি? রিধিই তখন বইয়ের তিন নম্বর অধ্যায় টা বের করে ওটার নোটস্ গুলো চাইলো। যদিও আমার কাছে কোন নোটস্ ছিল না তবুও ওকে বলেছিলাম, আমি তো নোটস্ নিয়ে আসিনি তবে তুমি চাইলে কাল নিয়ে আসতে পারি।

ও তখন হাসিমুখে বলেছিলো, তোমার ফোন নাম্বার টা দাও। কাল আমি তোমার থেকে নিয়ে নিবো। মেয়েটা এতো ফ্রি হয়ে কিভাবে কথা বলতে পারে জানিনা। এর আগে যদিও কখনও কথা হয় নি। ওকে কিছু না বলে নাম্বার টা দিয়ে দিলাম। ও হাসিমুখে চলে গেলো। বাসায় এসে যেই ছেলে আমি পড়তে বসতাম না সেই ছেলে হঠাৎ বই খাতা নিয়ে বসে পড়লাম। এতো বড় অধ্যায় নোট করছি অথচ আমার মাঝে কোন বিরক্তি নেই। প্রায় অর্ধেক রাত জেগে নোট করা শেষ করলাম। তবুও চোখমুখে উত্তেজনা। কখন তাকে নোটস্ গুলো দিতে পারবো। বারবার মনে হচ্ছে এটাই বুঝি ভালবাসা। আমি মনে হয় তাকে ভালবেসে ফেলেছি।

পরেরদিন তাকে নোটস্ গুলো দেওয়ার সময় সে খানিকটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছিলো, তোমায় কি বলে ধন্যবাদ দিবো বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলবো, অনেক উপকার করলে তুমি আমার। আমি কালই তোমাকো নোটস্ গুলো দিয়ে দিবো। আমি কিছু না বলে শুধু মৃদু হেসেছিলাম। তারপর সে চলে যায়। আবারো পরেরদিন সে নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে নোটস্ গুলো দিয়ে দেয়। সাথে আমাকে কফি খাওয়ার অফার করে। সে জোর করাতে আমিও আর না করিনা। এভাবে মাঝে মাঝেই তার সাথে ভাল গল্প হতো কফির সাথে। একটা ভাল সম্পর্কের শুরু এভাবেই হয়ে গেলো বলা যায়।

সেমিস্টার শেষ হলে আমি একসময় লক্ষ করলাম যে আমি নিজে কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছি। আগের সেই ছন্নছাড়া ছেলেটি আর নেই। বন্ধুরাও কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে এক প্রকার নিয়মের মাঝে নিয়ে এসেছি আমি। এর পেছনে হাত রয়েছে শুধুই রিধির। তাই পরের সেমিস্টারে রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরে টিস্যু পেপারে ফুল বানিয়ে প্রপোজ করেছিলাম ওকে। মেয়েটা হেসেছিল। শুধু হাসেি নি, অনেক অনেক হেসেছিল। হাসি থামলে আমি যখন উত্তরের অপেক্ষায় আছি তখন ও টিস্যু ফুলটা নিয়ে বললো, না। আমি ভালবাসি না। বলে আবারও হাসি। আমি মুখ নিচু করে যখনি চলে আসতে যাবো তখনি ও পেছনে হাত ধরে বললো, ভালো না বাসলে কি ফুলটা নিতাম। গাধা একটা। এটা শুনে আমি খুশিতে উত্তজিত হয়ে ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরছিলাম কিন্তু তখনি ও হাত দিয়ে ঠেলে দিয়ে বললো, শুরুতেই শরীরে হাত দেওয়ার ইচ্ছে তাই না? কথাটা তখনি একটু অন্যরকম লেগেছিল কারন আমার চিন্তাভাবনা কখনও এ ধরনের ছিল না।

এরপরে আমি তার থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলি। যদিও এটা বুঝতে পেরে সে হাসতো তবে কিছু বলতো না। তবে তার সাথে কাটানো সময় গুলো নিঃসন্দেহে আমার কাটানো সেরা সময়। সকালে ওকে ঘুম থেকে তুলে প্রথম সূর্য দেখার আমন্ত্রন জানাই। প্রথম দিকে ও আসতো না। কিন্তু একদিন এসে সেই শান্ত ঠান্ডা বাতাসের অনুভুতি পেয়ে সে প্রায়ই আসতো। এর পরেই একদিন সকালে সূর্য দেখার জন্য এসে রাস্তা দিয়ে হাটার সময় বলেছিলাম, তোমার হাতটা ধরে কি হাঁটতে পারি রিধি? খুব ইচ্ছে করছে।

মুচকি হেসে ও আমায় তার ওরনা ধরিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর কিছু বলিনি। আবারও হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, সে কি এতোদিনেও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না? এভাবেই হেঁটে চলেছি নিজের অভিমানি মুখটা নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে। তখনি ও আমার হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে হাঁটতে লাগলো। ওর দিকে তাকালেই শুনতে পেলাম, গাধা কোথাকার। অভিমানটা কোথায় যেনো ফুরুৎ করে উড়ে গেলো। এরপরে প্রায় প্রতিদিনি তার সাথে প্রথম সূর্য দেখার সময় হাত ধরে রাস্তায় চলতাম। এভাবেই একদিন সে আসতে পারলো না অসুস্থতার জন্য৷ সেদিন আমি একা এসেছি। গভীর ভাবে মিস করেছিলাম তাকে। বুঝেছিলাম সেদিন, এতোদিনে তার সৌন্দর্যকে পছন্দ করতাম কিন্তু এখন তার অস্তিত্বকে অনুভব করি। তাকে সত্যিই আমি অনেকটা ভালবেসে ফেলেছি।

ভার্সিটি শেষে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তার সাথে ছোটন মামার দোকানে চা খাওয়ার জন্য আসতাম। প্রথমেই সে দুটো চায়ের কপেই চা খাবে তারপর আমকে একটা খেতে হতো। এটা প্রায় একটা অন্যায় আবদার ছিল তার। কিন্তু সত্যি বলতে তার এই অন্যায় আবদারটাও আমার খুবি পছন্দের ছিলো। ভার্সিটির পুকুর পারে কচুরীপানা ফুল ফুটতো। একদিন একটা ফুল তুলে তার কানে গুজে দেই। আমার তো দেখে ভালই লাগছিলো কিন্তু ও ফুলটা নিয়ে ফেলে দিলো। বললো, এসব ফুল কেউ কানে দেয়।

আমি কিছু বললাম না। তার কথা ঠিক যে এসব ফুল কেউ কানে দেয় না তবে আমি ভালবেসে ফুলটা দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ রাখতে তো পারতো। এসবই যখন ভাবছি তখন ওকে দেখলাম ফুলটা কুরিয়ে এনে আবার কানে দিয়ে বললো, এবার ঠিক আছে? আমি হাসতে হাসতে ভাবলাম, এই মেয়েটা কি মনের কথা শুনতে পায় নাকি? রিধি গান গাইতে খুব পছন্দ করতো। রোজ ক্যাম্পাসে বন্ধুর থেকে ধার করা একটা গিটার নিয়ে আসতাম রিধির জন্য। গিটারের তারে সুর বুনতাম আমি আর ও সুর বুনতো গলায়। মাঝে মাঝে তো গিটার থামিয়ে শুধু ওর গাওয়া গান শুনতাম। এতটাও মিস্টি কি কারও গলার সুর হতে পারে? এসব মিলিয়ে ভালই যাচ্ছিলো দিনকাল।

ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বড় ভাইদের পরিচিতি তে একটা চাকরী পেয়ে যাই আমি। ছোট হলেও এটাই বর্তমানে কয়জন পায়। জিবনের প্রথম চাকরী একটু উত্তেজনা তো থাকেই। এই চাকরীর জন্য রিধির সাথে দেখা করা কমে গেলো। বলতে গেলে কিছুই হতো না আর। সকালে প্রথম সূর্য দেখা, ওর সাথে গানের রেওয়াজ এসবের কিছুই হতো না। তবে ছোটন মামার চা টা একসাথেই হতো। সেও মানিয়ে নিয়েছে এসবে। তবে ঘটনা ঘটলো সেদিন যেদিন রিধি আমাকে ডেকে ওর বাবার সাথে কথা বলতে বললো। ওর বাবার সাথে কথা বলার জন্য উনার অফিসে গেলাম। অফিসে যেয়েই বুঝলাম যে এরা কত বড় মানের মানুষ। রিধির বাবা এই অফিসের মালিক।

রুমে টোকা দিয়ে দরজা খুলে বললাম, আসতে পারি স্যার? শাফিন সাহেব (রিধির বাবা) দরজায় না তাকিয়েই বললেন, জি আসুন। আমি সামনে এসে দাড়িয়ে আছি। উনি মাথা উচু করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, তুমিই তাহলে মামুন? আমি একটু হাসিমুখে বললাম, জি স্যার। রিধির বাবা হেসে বললো, আরে আমাকে স্যার বলছো কেনো? আংকেল বলে ডাকতে পারো কারন তুমি রিধির বন্ধু। আমি একটু হাসলাম। মনে একটু আশা পেলাম উনার ব্যবহার এতো ভাল দেখে। উনি বসতে বলে বললেন, কি খাবে বলো? আমি কিছু খাবো না বললাম। তখনি উনি বললেন, রিধি বলেছে তোমার ব্যপারে। ও আসলে এই পৃথিবীর বাস্তব রুপটা সম্পর্কে খুব একটা অবগত নয়৷ তোমাকে এসব বলছি কারন তোমাকে দেখে মনে হয়েছে তুমি যথেষ্ট বোঝো সবকিছু।

তুমি যতদুর সম্ভব কিছুদিন হলো চাকরী করছো। স্যালারী যা পাও তাতে টেনেটুনে একটা সংসার করা সম্ভব। তবে তুমি কি জানো যে বাসায় রিধির জন্য একজন লোক রাখা আছে যার বেতন তোমার সমান। সে যেগুলো কাপড় পরে তার একেকটার দাম কতো হতে পারে? তুমি নিজেও জানো যে এসব তুমি ওকে চাইলেও দিতে পারবে না। তাহলে এখানে তুমি কি যুক্তি নিয়ে এসেছো বলতো? তুমি কি জানোনা অভাব যখন ঘরে ঢোকে, ভালবাসা জানালা দিয়ে পালায়। এসব বলে উনি কিছুক্ষন থামলেন। আমি মাথা নিচু করেই উনার কথা শুনছি। আসলে একটা কথাও উনি অযৌক্তিক বলেন নি। একটু পরে আবার বললেন,

আমার এক বন্ধুর ছেলে লন্ডনে পড়াশুনা শেষ করে এখন দেশে ফিরে আসতে চায়। বাবার ব্যাবসা নিজে সামলাবে সে। দেশেই থাকবে। আমি ওর সাথেই রিধির বিয়ের কথা ভাবছি। সেখানে রিধির কোন অভাব থাকবে না আর ভালবাসা, সেটা এমনিতেই হয়ে যাবে। বলতে পারো যে এক প্রকার সুখেই থাকবে সে। আশা করি বুঝতে পারছো তুমি, আমি কি বলছি? আর তুমি তোমার ভালবাসার মানুষটার সুখের জন্য নিজের ভালবাসাটা মেরে ফেলতে পারবে না? উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি বললেন, পারবে।

তুমিই পারবে। আমি তোমার মাঝে নিজেকে দেখি জানো। তোমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হবে এই জিবনে। উনি থামলেই আমি হাসলাম। বললাম, আমি বুঝেছি স্যার। তবে এসব আপনি আপনার মেয়েকেই বলতে পারতেন। আমি মধ্যবিত্ত এক পরিবার থেকে এসেছি। আমার মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় না। তবে কি ভালবাসি তো স্যার, একটু খারাপ লাগবে। আপনি চিন্তা করবেন না। যেটা ওর জন্য ভাল মনে হবে সেটাই করুন। আমি বিশ্বাস করি একজন বাবাই তার মেয়ের জন্য সবথেকে ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে খেয়াল রাখবেন, রিধি যেনো সুখে থাকে স্যার। এটা বলেই আমি বেরিয়ে আসি। সেদিন থেকেই ওকে রিধিকে এরিয়ে চলছি। ফোনের নাম্বার বদলেছি। বাসা পাল্টিয়েছি। তার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করার পথ খোলা রাখিনি।

আর আজ এইতো ছোটন মামার দোকানে তার সাথে দেখা হয়ে গেলো। এর মাঝেও তাকে কয়েকবার লুকিয়ে দেখতে এসে ধরা খেয়েছি রিধির কাছে। আমি ভেবেছিলাম তার বাবা তাকে সত্যিটা বলবে কিন্তু এখন দেখছি ঘটনা উল্টো। রিধি চায়ের কাপটা রেখে বললো, “আজ একটু হাঁটবে আমার সাথে তোমার হাতে হাত রেখে? জানিনা কেনো তুমি না বলেছো বাবা কে তবে আমার এই ইচ্ছেটা কি পুরন করবে? অনেকদিন এই স্পর্শ টার অভাবে আমি ছটফট করেছি মামুন।” আমি কিছু না বলে উঠে দাড়ালাম। ওকে নিয়ে হাঁটছি রাস্তায়।

ওর বাড়ির দিকে এগোচ্ছি আমরা। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে রিধিকে সবটা খুলে বলার কিন্তু ওর বাবাকে আমি ওর কাছে খারাপ হতে দিতে চাচ্ছি না। কারন আমি জানি, সবার আগে বাবা মা। ওর বাসার কাছে চলে আসতেই ওকে বললাম, তোমার যাওয়া উচিৎ। ও করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, তোমায় কি একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? আমি হেসে বললাম, কি লাভ বলতো? এই হাত ধরে হাঁটার অনুভুতি টাই ভুলতে পারছো না তবে জড়িয়ে নিলে ভুলবে কি করে? এটা শুনে ও মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকে গেলো। আমি ওর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। একটু পরেই একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামলো রিধির বাবা। আমার ঠিক সামনে এসে দাড়ালেন উনি। আজ আমি বললাম, ওকে আপনি ভাল রাখতে পারছেন না আংকেল। আপনি নিজেই বলেছিলেন যে আমার মাঝে আপনি নিজেকে দেখতে পান। আমিও জানি রিধি আমাকে ভালবাসে।

শুধু কি টাকা থাকলেই সবাই সুখে থাকে আংকেল? এই অভাবটা একসাথে মানিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার মাঝেও যে ভালবাসাটা আছে সেটা কি টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন আংকেল? রিধির বাবা আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, তোমার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর আমার জানা। তবে মেয়ের বাবা হিসেবে একটু খতিয়ে দেখাটা আমার অধিকার। আমি জানতাম তুমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না। একটু দেরী হয়েছে হয়তো তবে তুমি এসেছো। আমিও তোমাকে ফোনে খুজেছিলাম কিন্তু সেটাও বন্ধ। তাই আর কিছু করিনি। আমার হাত ধরে বললো, আমার সেরকম কোন বন্ধুর ছেলে নেই বুঝেছো? আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি আমার সমন্ধে মিথ্যা বলেছেন রিধিকে।

এটা শুনে রিধির বাবা হেসে বললো, আমার মেয়েটাকে আমি কখনও কোন কিছুর অভাব দেই নি। ওর আবেগ একটু বেশি। তাই তাকেও খতিয়ে দেখলাম এটা তার আবেগ নাকি ভালবাসা? তবে বুঝলাম, তোমায় ছাড়া সেও যেনো নিজের মাঝে নেই। তাই বলছি স্বাভাবিক হয়ে যাও ওর সাথে। আর আমাকে ক্ষমা করো। এটা বলেই যখন উনি আমার হাতটা চেপে ধরলেন তখন আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ আংকেল, আমার জিবনটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আংকেল মৃদু হেসে বললো, তোমার মা বাবার ঠিকানাটা দিয়ে যাও। সমন্ধ পাঠাতে হবে তো। এটা বলেই উনি হাসলেন। আমি হেসে ফেলি এটা শুনে।

পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রিধির বাড়ির সামনে গিয়ে ফোন দিলাম ওকে। রিধি ঘুমঘুম চোখে হ্যালো বললেও যখন আমি বললাম, এই, কোথায় তুমি? জলদি বাড়ির নিচে আসো। তখন বেলকনি থেকে ও আমাকে দেখলো। বলা যায় এক প্রকার দৌড়ে ও নিচে আসলো। আমায় দেখে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। ও একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সকালে বাতাসের শীতল ছোয়া সাথে শরীরে মৃদু শিহরন আর প্রিয় মানুষটার হাতের স্পর্শের অনুভুতি যেনো সুখের শিখরে পৌছে দেয়।

রিধি হয়তো ভাবছে হঠাৎ কি হল আমার? কিন্তু সে কি জানে এসব এখন রোজ হতে যাচ্ছে? সারাদিন ঘুরোঘুরি আর সন্ধ্যায় ছোটন মামার চা খেয়ে রাস্তায় হাঁটছি। এমন সময় মা ফোন দিয়ে বললো, কাল আসছি তোর ওখানে। তোর শ্বশুর ফোন দিয়েছিলো। মেয়ে তাহলে নিজেই পছন্দ করলি? আমি হেসে রিধির দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার বউমার সাথে কথা বলবে? মা হেসে বললো, না থাক, কাল এসে একবারেই নিজের মেয়ে করে নিবো। এখন রাখি। আমিও সালাম দিয়ে কথা শেষ করলাম। রিধি দেখি আমার দিকে আছে। আমি বললাম, কি হয়েছে, তাকিয়ে আছো কেন? ও কিছু না বলে আমাকে জরিয়ে ধরলো। অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে সে।

আমি হেসে ওকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, পাগলি আমার। ও জড়িয়ে রেখেই কাঁদতে কাঁদতে বললো, এতোদিন কেনো কষ্ট দিলে আমায়? আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, দেখতে হবে না তুমি আমাকে ভালবাসো কি না? এমনিতে তো স্পর্শও করতে দাও না তোমায়। তাই আর কি? ও অভিমানি কন্ঠে বললো, তো এখন কি বুঝলে? আমি বললাম, বুঝলাম এটাই যে আমার সুখের নীড় তুমি ছাড়া অপুর্ন। তুমিই আমার সুখের আলো তাই তোমাকেই ভালবাসি। এটা শুনে ও বুকে মাথা রেখে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বুঝলাম তারও স্বস্তিটা আমার মাঝেই। শুকনো রাস্তা সাথে শুকনো পাতার কিচিরমিচির, এখানে একদিন সবজ ঘাস হবে যেখানে জমবে তোমার আমার সুখের শিশির…..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত