নীল খামে কাব্য

নীল খামে কাব্য

ফিলটারে শেষ টানটা দিয়ে ছুড়ে ফেলে হাটা শুরু করে অলক।

– এই যে শোনেন
– হু
– আপনাদের মতো মানুষের জন্যই তো এতো প্রবলেম আমাদের দেশে।
– কি? মানে কি? কি অসহ্য উথাল পাথাল করা চোখ মেয়েটার, কথা গুলো বলতে বলতে চিন্তা করে সে।
– এই যে সিগারেটটা খেয়ে না পিষে ফেলে গেলেন,যদি কোন বিপদ আপদ ঘটে?
– ওহ স্যরি।হ্যা হ্যা আমার আসলেই ভুল হয়েছে।
– আচ্ছা ইটস ওকে।

চোখ বড় বড় করে ছড়ানো এলোচুলের মেয়েটার চলে যাওয়া দেখে অলক। নদীর ধারে ঘুরতে এসেছিলো কাজিনের সাথে,কি একটা কাজ আছে দেখে অলককে রেখে চলে আসে কাজিন রিয়াজ।এসে এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হবে বুঝে নাই অলক। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।ফিরতে যাবে বাসায়,এমন সময় আবার দেখা সেই মেয়েটার সাথে।একটাই রিকশা দেখা যাচ্ছে পুরা এলাকা জুড়ে।সন্ধ্যার পরে এই এলাকায় বেশি লোকজন আসা যাওয়া করে না বলে রিকশাও কম।ওরা ওদের ব্যাবসাটা ভালোই বুঝে।

– এই রিকশা
– এই রিকশা
– ওহ আপনি আগে ডেকেছেন আপনার যাওয়া উচিৎ
– আরে না কি বলেন আপনি মেয়ে মানুষ এমনিতেও সন্ধ্যা হয়ে গেছে,আপনারই যাওয়া উচিৎ।
– আপনার বাসা কোন দিকে?
– এইতো এই দিকে।
– তাহলে চলুন একসাথে যাওয়া যায় তো এখানে আর কোন রিকশাও তো দেখা যাচ্ছে না।
– না আপনি যান সমস্যা নেই।

অলকের চোখে দেখতে পায় মেয়েটা একটা কাঠিন্য,পুরুষত্ব,আবেগ আর কিছু অনুকম্পা।রিকশার হুডের ফাকা দিয়ে তাকায়ে থাকে হৃদি। সাথে সাথে কাজিন রিয়াজ কে ফোন করে অলক, “হ্যালো তুই কি একটু তাড়াতাড়ি নদীর পারে আসতে পারবি ৩ মিনিটের মধ্যে” “হু পারবো তো,কাছেই আছি আমি।”

মিনিট ৪ এর মাঝেই রিয়াজ এসে হাজির।সাথে সাথে অলক বাইকে উঠে একটু টেনে চালাতে বলে রিয়াজ কে।
কিছুই বুঝতে পারে না রিয়াজ কিন্তু সে কিছুর কোন প্রতিবাদ না করে সব ঠান্ডা মাথায় শুনে যায়।কারন সে জানে তার ভাইয়া কোন খারাপ কাজ করার জন্য তাকে ফোর্স করছে না। চুপি চুপি রিকশার পিছু নেয় অলক।গিয়ে বাড়িটা দেখে আসে। এর পর প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে অলক হৃদিদের বাড়ির সামনে একটা চায়ের দোকানে বসে থাকে। প্রথম প্রথম হৃদি ব্যাপারটা খেয়াল করেনি,কিন্তু যেদিন করলো ওর খটকা লাগা শুরু হয়ে গেলো।আর হৃদিও এরপর প্রতিদিন দেখতো অলক বসে আছে। একদিন কলেজ থেকে আসার সময় হৃদি একটু সাহস করে চায়ের দোকানটায় যায়। হকচকিয়ে যায় অলক হৃদিকে দেখে…

– আরে আপনি এখানে?
– হু,এটা আমার এলাকা এখানে আমি তো আসতেই পারি,কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আপনি এখানে কেন আজ বেশ কয়েক দিন ধরে খেয়াল করছি।
– চা খেতে আসি…মোজাম্মেল ভাই চা ভালো বানায়।
– হু তা বুঝলাম কিন্তু সেদিনের পরে আর কথা হয়নি আপনার সাথে,আপনার ধন্যবাদটা পাওয়া ছিলো।
– ব্যাপার না।এটাকে এভাবে দেখবেন না।ওখানে আর একটা রিকশা ছিলো না এইটাই প্রবলেম। না হলে তো কিছু এসে যেতো না। যাই হোক চা খাবেন এক কাপ?
– না আমি দুপুর রোদে চা খাই না।আচ্ছা আপনার বাসা কি এই এলাকায়,মনে তো হয় না তাহলে তো আপনেকে দেখার কথা আমার আগেই।
– না আমি রিয়াজদের বাড়ি বেড়াতে আসছি,ওটা আমার ছোট ফুফির বাসা।
– ও…আমাদের সামনে বাড়িটা?আচ্ছা একদিন আসবেন বাসায়।

এরপর থেকে হৃদি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখতে লাগলো প্রতিদিন অলক ফুফির বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে। একদিন হঠাৎ চোখ আটকে যেতেই হৃদি দেখতে পায়,অলক হাত নেড়ে নেড়ে ডাকতে থাকে হৃদিকে।হৃদি একটু মনোযোগী হতেই হাত তুলে নিজের মোবাইল নাম্বারটা ইশারায় বুঝিয়ে দিতে থাকে অলক। হৃদিও বুঝে নেয় 01778******।

হৃদি রাতে শুতে যেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বার বার “উপকারী” নামে সেইভ করা অলকের নামটা দেখতে থাকে আর ভাবে কল দিবো কি দিবো না।ভাবতে ভাবতে টেক্সট অপশন বের করেই একটা ছোট্ট টেক্সট করে “আমি হৃদি”।
টেক্সট টা দিয়েই ভয়ে খুশিতে আনন্দে হৃদি আরও আধা ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।তারপর কোন রিপ্লাই পাচ্ছে না দেখে ফোনটা অফ করে মন খারাপ করে ঘুমিয়ে যায়। সকাল হতে হতে সূর্যের রশ্মি এসে ভরে দেয় হৃদির ঘর।আম্মু পর্দাটা টানতে টানতে বলে ওঠ এইবার অনেক বেলা হলোতো। কাল রাতের কথা হঠাৎ হৃদির মনে পরে যায় আর ভয়ে ভয়ে ফোনটা অন করে দেখে…টিন টিন করে ৫ টা টেক্সট ফোনে।মেজাজটা বরাবর খিচরে যায় হৃদির।ধুর মিস কল অ্যালার্টের ম্যাসেজ …কিন্তু হঠাৎ করে মুখটা অ্যানার্জি স্যাভিংস এর মতো জ্বলে ওঠে হৃদির।আরি!!! ২১টা কল উপকারীর নাম্বার থেকে।

এবার মনোযোগ দিয়ে টেক্সট চেক করতে যায় হৃদি।বাকি ৪টা টেক্সটই অলকের।শুধু একটা কথাই লেখা প্রতিটা মেসেজে “অবশেষে অলকানন্দায় হৃদি আমি অলক” কোন ভাবে দাঁতটা ব্রাশ করে মা’কে ব্রেকফাস্টের খুধা নেই জানিয়ে কল ব্যাক করে অলকের নাম্বারে।কিন্তু বিপ বিপ করে লাইনটা কেটে যায়। হৃদি দেখে একটা টেক্সট “১০ মিনিট পর কল করবো।” রাগে হৃদির মাথায় আগুন উঠে যায় আর মনে মনে ভাবে ইশ কতো ভাব  আমি ফোন দিসি এইতো অনেক। কাটায় কাটায় ১০ মিনিট শেষ হতেই হৃদির ফোনে কল অলকের

– কেটে দিলেন কেন?ভাব বেশি নাকি আপনার,ভাবছেন কি ফোন দিলেই আমি ইজি হয়ে গেলাম সেটা কখোনোই ভাবা উচিৎ হবে না অনর্গল কথা বলে গেলো হৃদি।
– হৃদি আমি নাস্তা করছিলাম।নাস্তা করা লান্চ করা আর ডিনারের সময় আমি ফোন তুলি না কারো।

এভাবে ২/৩দিন কথা হয় দুজনের একটু একটু।কথা বলতে বলতে সম্পর্কটা আপনি থেকে দুজনেরই তুমিতে নেমে যায়। একদিন সকালে অলেকের টেক্সট “একটু দেখা করতে পারবে,দরকার ছিলো।” পাল্টা টেক্সট হৃদির “হু আজ বিকেলে অমুক কফিশপে।” “আচ্ছা বিকেলে দেখা হবে।”

বিকেলে সুন্দর করে সেজে গুজে কফিশপে যায় হৃদি।দেখা হয় অলকের সাথে।কফি মগে টুংটাং চুড়ির ধাক্কা লাগে আর আওয়াজ হয়। অলক প্রতিটা ব্যাপার মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে…কিন্তু সেদিকের হৃদির কোন খেয়াল নেই কথা সে বলতেই থাকে। নীরবতা ভাঙ্গে অলক “হৃদি আমার ব্যাপারে তোমাকে বলা হয় নি কিছুই কিন্তু আমি তোমার সব কথা জেনেছি রিয়াজের কাছে,আমি বাংলাদেশ নেভিতে আছি…লেফ্টেনেন্ট পদে।বাড়ি রাজশাহী।এখানে ফুফির বাসায় এসছিলাম ছুটি কাটাতে,যেকোন দিন চলে যাবো।যদি তোমাকে বলে যেতে না পারি তুমি মন খারাপ করো না। আর তাছাড়া তোমার সাথে আমার এমন কোন সম্পর্কও হয়নি যে তোমার মন খারাপ হবে।

তোমার জন্য কিছু চকলেট এনেছিলাম নাও আর আমার সামনে প্লিজ একটা খুলে খেয়ে যাও।জানি তোমার গ্লাডিওলাস পছন্দ আর কফি খেতে ভালোবাসো তুমি।গ্লাডিওলাস নিয়ে এসেছি,তোমার জন্য কফি পাঠাবো আমি শিপে গিয়ে।তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও।” চোখ দুটো টলটল করতে থাকে হৃদির কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এটা,অলকের জন্য ওর কেন খারাপ লাগছে….তাই অগোচরে মুখ লুকিয়ে শুধু এটুকুই বলে “আমার চকলেট আর ফুল কই আমি চকলেট খাবো।” বিদায় নিয়ে চলে আসে যে যার বাসায়।অলক টেক্সট পাঠায় হৃদিকে “ভালোবাসি,মনের ছোট্ট চিলেকোঠাটা একদম ফাঁকা পরে আছে ওখানে আমার সংগী হবে???” হৃদি আর কোন উত্তর জানায় না অলককে।

এই ঘটনার দুই দিন মাথায় অলক চলে যায় শিপে।আর এর ৭ দিন পর হৃদির ফোনে অলকের টেক্সট “আগামী ১৩ তারিখ আমার সিল কোর্স করার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে,আমার ফ্লাইট সন্ধ্যা ৭.৩০টায়।তুমি কি আসবে?”এই কদিনেই হৃদি ফিল করা শুরু করে সে অলককে পছন্দ করা শুরু করেছে।তাই সে পাল্টা টেক্সট করে… “আমি অবশ্যই আসবো অলক।”১৩ তারিখ: বিকেল ৫টার দিকেই হৃদি গিয়ে হাজির হয় এয়ারপোর্টে,দেখা হয় অলকের সাথে।কেঁদে দেয় হৃদি। অলক বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে হৃদির। সে বলে ওঠে হৃদিকে….

-কি হয়েছে হৃদি?
-কিছু না তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম।আমি চলে যাওয়ার পরে খুলবে।
-আচ্ছা…হৃদি আমার সাথে এককাপ কফি খাবে?
-হু….চলো।এয়ারপোর্টে থেকেই কফি খায় দুইজন।হঠাৎ ঘড়িতে চোখ চলে যায় হৃদির।৭টা প্রায় বাজলো বলে।
-অলক আমাকে চলে যেতে হবে এখন,রাত হয়েছে অনেক।তুমি সাবধানে যেও।
-আচ্ছা আমি কি তোমাকে একটা সিএনজি ঠিক করে দিবো?
-লাগবে না আমি পারবো আর তাছাড়া তোমার এখানে থাকা উচিৎ কখন কি এনাউন্স হয় কে জানে?

বিদায় দেয় দুইজন দুইজনকে।হৃদি যেতে না যেতেই প্যাকেটটা খোলে অলক।চোখদুটো অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকে “শেষের কবিতা”।এ যে তার পড়াই হয়নি কখোনো…তবে কি…আর ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে একটা নীল খাম আর তাতে একটা চিরকুট।চিরকুটটায় লেখা“সৃষ্টি হবে নতুন কোন কাব্য হয়তো তোমার আমার তৈরী হবে নতুন কোন গল্প হয়তো ভালোবাসার ভালোবাসি তোমায়” ঠিক এমন সময় একটা এনাউন্স হয় ইউ এস এ গামী এয়ার লাইন্স ১.৩০ ঘন্টা ডিলে হবে। সাথে সাথে ঘড়ি দেখে অলক।মানে রাত ৯টা।

দৌড়ে রাস্তায় বের হয়ে দেখে তখনো হৃদি সিএনজি ঠিক করা নিয়ে ব্যাস্ত।অলক পেছন থেকে হৃদিকে টেনে ধরে…
“হৃদি,আমার দিকে তাকাও বাবু….দেখো আমি মাত্র ৭ মাসের জন্য যাচ্ছি সময় গুলো বলতে বলতে কেটে যাবে,তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে না?তোমাকে এনগেজ করে রেখে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু আমি কখোনো আংটি পড়ি না তাহলে কি করা যায় বলোতো???আচ্ছা দাড়াও হাতটা একটু আগাও বাবু” বলেই নিজের হাতের ব্রেসলেট খুলে হৃদিকে পড়িয়ে দেয় অলক।আর বলতে থাকে হাটু গেড়ে “আমার বউ হবে হৃদি?” হৃদি অলককে টেনে তুলে অলকের বুকে দু ঘা লাগিয়ে দেয় আর বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে। ৮ মাস পর: বাসর ঘরে হৃদি আর অলক…

হৃদি: আমার চকলেট কই অলক

অলক: বাবু চকলেট তো নাই কফি খাবা??? বানায়ে নিয়া আসি

হৃদি: নাহ লাগবে না তুমি আমার পাশে বসো

উৎসর্গ: বাংলাদেশ নেভি আর্মি আর এয়ারফোর্সের সকল কর্মীদের,আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এরা আসলে অ্যান্জেল আর কৃতজ্ঞতায় জিসান বাপ্পি,কিছু ইনফো ওর কাছ থেকে নেয়া।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত