— এই যে শুনছেন?(মেয়েটা)
— জ্বি আমাকে বলছেন? (আমি)
— হ্যা আপনাকেই!
— জ্বি বলুন!
— আচ্ছা নীল রঙ কি আপনার খুব পছন্দ?
— কেন বলুন তো?
— না মানে আপনাকে রোজ দেখি ভার্সিটিতে আসলে আপনি নীল রঙের টি শার্ট পরে আসেন তাই বললাম!
কথাটা শোনা মাত্রই বুক থেকে বেড়িয়ে আসল শামুকের খোলসে জমে থাকা সেই দীর্ঘশ্বাস। এই অদ্ভুদ প্রশ্নের সম্মুখীন বেশ কয়েকবার হতে হয়েছে। হ্যা এটা আমার কাছে অদ্ভুদই লাগে। তবুও দ্বিধাবোধ করি না, সাফ সাফ উত্তর দিয়েছি। এখন আবারো দিতে আমি প্রস্তুত!!
— আসলে আমার একটাই জামা। যেটা নীল রঙের। রোজ রাতে ধুয়ে দিই তারপর সকাল হতেই শুকিয়ে যায়, সেটা পরেই রোজ ভার্সিটিতে আসি। আমার বলার ভঙ্গি আর তার প্রশ্নের এমন অদ্ভুত উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তীর মুখটা কেমন যেন চুপসে গেল! মুখটাতে মায়া মায়া আভার ছাপে দেখতে অনেকটা যুথিকার সৌরভের মতোই লাগছিল!! ঘোর কেটে দিয়ে বললাম…..
— আর কিছু?
— আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে?
— নাহ মজা করব কেন? যা সত্যি তাই বললাম। আসলে আপনার অবাক হবারই কথা। তবে হ্যা আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি সদা সত্য কথা বলতে। আর সত্য কথা বলতে আমার কোন লজ্জা লাগে না।
— আচ্ছা আপনার বাবা কি করেন?
— তিনি নেই! আমার বয়স যখন ৪ কি ৫ তখন তিনি গত হয়েছেন! এখন আমি আর মা ই আছি। জীবিকা নির্বাহ আর আমাকে মানুষের মতো মানুষ করার তাগিদে আমার মা মানুষের বাড়ি কাজ করার পথ বেঁছে নেন! আজ তিনি অসুস্থ। আমি দুইটা টিউশনি করে আমাদের ছোট্ট সংসার চালাই। মায়ের ওষুধ, আমার পড়ার খরচ আর দৈনন্দিন খরচ চালাতে চালাতে আমি ভুলে গেছি আমার শৌখিনতা, ভোগ বিলাসতা। ইচ্ছা করলেই আমি নতুন জামা কিনতে পারি। কিন্তু আমি যদি ওই টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনতে পারি তাহলে মায়ের মুখের মমতা ভরা হাসি দেখতে পারব! আর আমার মায়ের মুখের হাসি দেখার জন্য সব করতে পারি। আমার এমন জবাবে তার দু চোখ ছল ছল করে উঠল!
— বন্ধু হবেন?(মেয়েটা)
আমি কোন জবাব ছাড়া ওইখান থেকে চলে আসলাম। পিছু ডাকাতেও দাড়ালাম না। কেনই বা দাঁড়াবো..? গরিবের তো কোন বন্ধু হয় না! ওরা বন্ধুত্বের নামে প্রতারনা করে, দয়া করে, করুনা করে। আমি কারো দয়া বা করুনার পাত্র হতে চাই না আর। হ্যাঁ আমি গরিব তাই বলে কি আমার মান সম্মান নেই? গরিব বলে আজ মেয়েটা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ওটা দয়ার বা করুনার হাত পরের দিন ভার্সিটিতে আসলাম। আর জানতে পারলাম আজ নাকি বিশ্ব বন্ধু দিবস। লক্ষ্য করলাম সবাই সবাইকে উইশ করছে, গিফ্ট আদান প্রদান করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্তি নামক একটা গাছের নিচে বললাম। কেন জানি না খুব করে কান্না পাচ্ছিল। আচ্ছা গরীব হয়ে জম্নানোটা কি খুব বড় অপরাধ?? আচ্ছা এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি..? “”একাকিত্ব””?? ভাবতে ভাবতে চোখের কোন থেকে দু ফোটা অশ্রু জমা হয়ে গেল। সব কেমন ঝাপসা লাগছে! ঠিক সে সময় পেছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম
— হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে!
সব কিছু ঝাপসা দেখাতে কে যেন আমাকে উইশ করে বসল মুখটা ভাল করে দেখতেই পাচ্ছি না। তাই চোখ মুছে তাকিয়ে দেখলাম সেই প্রশ্নকর্তী।
— কি হল? আমাকে উইশ করবেন না? আমি আপনাকে বন্ধু বানাতে চাই, সুখ দুঃখের বন্ধু! কি হবেন না? আমি তখনও নীরব। আসলে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
— কি হল! আজ ফ্রেন্ডশিপ ডে তে আমাকে ফরিয়ে দিবেন?
— হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে টু ইউ!
— এই নিন আপিনার গিফট!
— কি এটা?
— খুলেই দেখেন না!
খুলে দেখলাম একটা নীল রঙের টি শার্ট ! গিফ্টটা হাতে নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম! আজ ফ্রেন্ডশিপ ডে। আজকে না হয় আমি ভুলে থাকলাম যে আমি গরিব। না হয় হলাম কারো দয়া বা করুনার পাত্র।
— কি এভাবে তাকিয়ে আছেন যে? আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে করুনা করছি? ট্রাস্ট মি সেটা ভেবে আপনাকে গিফ্ট দিই নি। আজ তো ফ্রেন্ডশিপ ডে। এই দিনে বন্ধুই তো বন্ধুকে গিফ্ট দেয়। তাই আমিও আমার বন্ধুকে দিয়েছি। , মেয়েটা মাথা নিচু করে ফেলল। আজ মনে হচ্ছে এটা কোন দয়া বা করুনা নয়। এটা হয়ত বন্ধুত্ব। গরিবের বন্ধুত্ব।
— আমার গিফ্ট কোথায়?(মেয়েটা)
— আসলে আমার কাছে তো গিফ্ট নেই এই মুহুর্তে!
— আমি জানি না আমাকে এখনই দিতে হবে না হলে আমি খুব রাগ করব!
— দিতেই হবে!
— হ্যা এখনই (চোখ বড় বড় করে)
— এই নিন!
— উয়াও! কানের দূল!!! এই আপনি না বললেন আপনার কাছে কোন গিফ্ট নেই??
— আসলে ছোট্ট বেলায় টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ২০ টাকা দিয়ে ফেরিওলার কাছ থেকে এক জোরা কানের দুল কিনেছিলাম। কেন কিনেছিলাম জানি না। তবে এটা এখন আমার কাছেই রাখি।
— হাহাহাহাহাহা!! তাই বুঝি??
— জ্বি হ্যা!
— অনেক সুন্দর হয়েছে! আমার খুব পছন্দ হয়েছে!
— এত ছোট্ট মূল্যের একটা গিফ্ট সত্যিই আপনার পছন্দ হয়েছে?
— আমার কাছে গিফ্ট মানে ছোট্ট একটা ভালবাসা। হোক সেটা খুব সামান্য মূল্যের। আমি আবারো অবাক চোখে মেয়েটাকে দেখছি। যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। কে এই মেয়ে? সত্যিই কি গরিবের বন্ধু হয়..? বিধাতা মনে হয় প্রত্যকটা গরিব ছেলের জন্য এমন একটা করে বন্ধু পাঠিয়েছে। আমি মনে হয় আমার সেই বন্ধুটাকে পেয়েয়ে গেছি!
— চলো!(মেয়েটা)
— কোথায়?
— ফুচকা খাওয়াতে! বাহ রে আজ ফ্রেন্ডশিপ ডে নাহ?
— কিন্তু আমার কাছে তো ৩০ টাকার বেশি নেই!
— তাতে কি! ওতেই হবে চলো তো!
যাচ্ছি ফুচকা খাওয়াতে। মেয়েটা জানে না এই নিয়ে ৩০ টাকাটা ছিল আমার দুপুরের খাবার। থাক আজ না হয় আমার নতুন বন্ধুর জন্য একবেলা না খেয়েই কাটিয়ে দিলাম!!!