অনুভূতির অন্তরালে

অনুভূতির অন্তরালে

“কিরে ছিচকাদুনী কই যাস? ” অমিত ভাইয়ার ডাকে আমি ফিরে তাকাই। অমিত ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি করে হেসে আমার উত্তর না শুনেই বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়।

আমি আরাধ্য জাহান আরনিয়া। সবাই আরাধ্য ডাকে। আর এবার ইন্টার পাস করে ভার্সিটিতে ওঠেছি। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু শান্ত প্রকৃতির, সবাই বলে। আর অনেকটা বইপোকা ধরনের। অমিত ভাই আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকেন। তিনি এবার পড়ালেখা শেষ করে নিজেদের ব্যাবসা দেখাশেনা করছেন। অমিত ভাই আর আমার ফেমিলির সাথে অনেক ভাল সম্পর্ক। ওনার বাবা মা অনেক ভাল। আমাকে অনেক আদর করে। কিন্ত অই অমিত ভাইটাই জেনো একটা বজ্জাতের হাডিড। আমাকে পচানোর কোনো উপায়ই জেনো মিস করে না। জানিনা আমাকে পচিয়ে কি মজা পান হু।

অনেক ছোটবেলা থেকেই ওনার পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক। পাশাপাশি বাসা হওয়ার সুবাদে ওনার বাসায় ও যেতাম অনেক,ওনার ছোটবোন আয়রা আমার বেস্টি। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়ি। আর ওনার বাবা মাও আমাকে নিজেদের মেয়ের মত ভালবাসতেন। আর আমার কোনো বড় ভাই না থাকায়, আমার বাবা তাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসেন।

অপরদিকে অমিত ভাই আমাকে কোনোভাবে না অপমান আর পচাতে না পারলে জেনো ওনার পেটের ভাত হজম হয় না।  আমি তখন স্কুল এ পড়ি। আমি ছোটবেলা থেকেই কুকুরকে অনেক ভয় পাই। আমি বাসা থেকে বের হতেই দেখি একটা কুকুর দৌড়িয়ে আমার কাছে আসতেছে। আমি ও তা দেখে কাঁদতে কাদতে দৌড় দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতেই অনিক ভাইয়ের সাথে ধাক্কা খাই। অমিত ভাই আমাকে দেখে বলে, কিরে আরাধ্য কাঁদছিস কেন? তখন আমি তাকে কুকুরের কথা বলতেই সে অট্টহাসি দিয়ে বলে, পাগল মেয়ে এর জন্য কেউ কাদে। তারপর থেকে উনি আমাকে ছিচকাদুনী বলে ডাকে।

ছোটবেলা থেকেই আমি স্কুল এ প্রথম হতাম। একবার জ্বরের কারনে ইংরেজী পরীক্ষাই খারাপ করি, অনিক ভাই সেটা জানতে পারে। তাই পরীক্ষার শুরুতেই বলতো কিরে ফেলটু এবার পাশ করবি তো। উহ, আমার তখন খুবই খারাপ লাগতো। অন্য কেউ হলে আমি জীবনও চুপ থাকতাম না, কিন্তু অমিত ভাইকে কেন জানি কিছু বলতে পারতাম না। তবে মনে মনে ঠিকই অমিত ভাইয়ের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতাম।

একদিন আমার ভার্সিটির একটি প্রোগ্রামে এ শাড়ি পড়ে যাই। অমিত ভাই আমাকে দেখে বলে, ও কি আরাধ্য এটা তুই কি পড়েছিস, তোকে তো তালপাতার সেপাই মনে হচ্ছে, এটা শুনে আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। সত্যি কি আমাকে অনেক খারাপ লাগছে। কই কেউ তো বলল না। সত্যি বজ্জাত লোক একটা। একদিন চুল ছেড়ে ছাদে দাড়িয়ে ছিলাম। কোথা থেকে জানি অমিত ভাই উদয় হলেন। আমাকে দেখে বললেন, জানিস আরাধ্য তোর চুল না অনেক সুন্দর। বাইরে বের হলে মাথায় কাপড় দিয়ে বের হবি। ঘরে এসে মনে মনে ভাবলাম, কি হলো উনার আজ আমার প্রশংসা। আমার মামাত ভাই অর্ক আমাদের বাসাই বেরাতে আসে। সে আমার থেকে চার বছরের বড়। আমি তার সাথে অনেক ফ্রি। আর অর্ক আমাকে নিজের বোনের মত জানতো।

অর্ক ভাইয়া আসার পর আমরা ঘুরতে জাই। একসাথে ফুসকা খাই l  সেদিন একটা দরকারে আয়রার সাথে দেখা করতে যাই। অমিত ভাই বাসাই ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, আরাধ্য শুন তো,আমি বললাম কি? সে বললো এই তোর অর্কের সাথে এত কিসের ঘুরা ঘুরি রে। নেক্সট টাইম যেনো আর না দেখি । আমি হা হয়ে গেলাম তার কথা শুনে। কি বলে সে? অর্ক ভাই কে তো নিজের ভাইয়ের মতো জানি।বাসায় আসার পর এই কথাটা মাথায় ঘুরতে থাকে। তার মানে অমিত ভাই আমাকে নিয়ে জেলাসি ফিল করে। এবার কই জাবা চান্দু, অনেক জালাইসো আমারে, এবার বুজবা আরাধ্য কি জিনিস??

আমি ও অমিত ভাইকে দেখাইয়ে অর্কর সাথে বেশি করে ঘুরি। আর অমিত ভাই লুচির মতো ফুলতে থাকে । এরই মধ্যে আমি বুজতে পারি আমি অমিত ভাইকে ভাল বেসে ফেলেছি। আমি বুজতে পারলাম না, কি করে ঐ বজ্জাত তাকে ভালবেসে ফেলেছি। সেদিন আমার বার্থডে ছিলো, সন্ধাবেলা অমিত ভাই আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, আরাধ্য এটা তোর জন্য। রুমে এসে প্যাকেট খুলে দেখি, অনেক সুন্দর নিল কালারের একটা ড্রেস, আর নীল কালারের চুড়ি। এটা দেখে আমি অনেক খুশি হই। মনে মনে একটা ডান্স দিতে ইচ্ছে করল। সেদিন অমিত ভাইয়ের মা, আমাদের বাসাই এসে আমার মাকে বললো, জানেন ভাবি অমিত এর জন্য মেয়ে দেখছি।

আমি পানি খাচ্ছিলাম, এই কথা শুনে আমার হেচকি ওঠলো। জাই হোক কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে রুমে যাই। অমিত ভাই অন্য কারো হবে, ভেবেই কান্না পাচ্ছে। কিন্ত অমিত ভাই তো বলেনি, সে আমাকে ভালবাসে। নাহ আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলব না। সেদিন ভার্সিটি থেকে বাসাই আসতেই, মা বললো আরাধ্য এদিকে আসতো, গিয়ে দেখি, সেখানে আমার বাবা অমিত ভাই, আর তার বাবা মা বসে আসে। অমিত ভাই মাথা নিচু করে বসে আছে।আমি যেতেই বাবা বলল, এসব কি শুনছি আরাধ্য, তোমরা নাকি, দুইজন দুইজনকে ভালবাসো। আল্লাহ কি বলসে এসব, আমার মাথায় জেনো আকাশ ভেংগে পড়ছে। ছি ছি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।  তারপর অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল যে, নেক্সট মান্থে এ আমার আর অমিত ভাইয়ের বিয়ে।

এবার বুঝতে পারলাম সবই অমিত ভাইয়ের প্লান। শয়তান একটা এভাবে সবার সামনে অপমান না করলে হত না। সবসময় নিজের যা মন চায়, তাই করে। একবার ও কি আমাকে বলতে পারতো না। তারপর থেকে অমিত ভাইকে ইগনোর করতে লাগলাম । হঠাৎ সেদিন অমিত ভাই আমার বাসাই আসলেন। আমার মাকে বললেন, আন্টি আরাধ্যকে নিয়ে একটু বাইরে যাই, মা সম্মিতি দিলেন , আমি ও পিছু পিছু যাই।

বাইরে আসতেই অমিত ভাই বললেন, কিরে আরাধ্য আমাকে এভয়েড করছিস কেনো। আমি মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর সে বললো, জানিস আরাধ্য সেই ছোটবেলা থেকেই তোকে ভালবাসি। ভালবাসি তোর ঐ মায়াবী চোখকে, তোর ঐ এলোকেশী চুলকে। ভালবাসি বলেই এত কিছু করেছি। সেদিন বাবা চেয়েছিল তার বন্ধুর মেয়ের সাথে এনগেজড করাতে। তাই বাধ্য হয়ে সেই নাটকটা সাজিয়েছি। আর আমি জানি তুই ও আমাকে ভালবাসিস।

তুই নিজেও যথেষ্ট ম্যাচিউরড নিজের ভালোমন্দ বুঝিস। তাই তোকে জোর করবো না। আর আমি নিজের অনুভূতিটুকু ওতো গুছিয়ে বলতে পারি না। তারপর,হুট করে অমিত ভাই হাটুগেড়ে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে বললেন,”আরাধ্য,ভালোবাসি তো। বিয়ে করবি আমায়, কথা দিচ্ছি আমার হ্রিদয়ের মনিকোঠায় তোকে রাজরানি করে রাখবো”।  আমি চুপচাপ ঠায় দাড়িয়ে অমিত ভাইয়ের কথাগুলো হা করে শুনছিলাম। সে আমাকে এইভাবে তার মনের কথা জানাবে তা আমি ভাবিনি কখনো।

হুট করে শ্রাবনের জলধারা আমার দু গাল বেয়ে ঝরতে লাগলো। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নি। হু হু করে কেঁদে উঠলাম। ওমনি অমিত ভাই আমাকে জরিয়ে ধরে, মাথাটা বুকে চেপে নিয়ে বললেন”আরে পাগলী কাদছিস কেন,সাধে কি আর আমি তোকে ছিচকাদুনী বলি “। এই মুহূর্তে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না,শুধু বিরবির করে বলতে লাগলাম, হ্যা আমি পাইলাম অবশেষে ইহাকে পাইলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত