দাম্পত্য সুঃখ

দাম্পত্য সুঃখ

ঘরে পা দিয়ে বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে! কি রকম থমথমে পরিবেশটা! অথচ এমন কখনো দেখি নি। ভাবির দিকে তাকালাম। ভাবির চোখ ভিজে আছে। চোখ জোড়া রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে! ফর্সা মেয়েদের মুখাবয়ব লজ্জা পেলে লাল হয়। হাঁসলেও লাল হয়। আবার কাঁদলেও লাল হয়। লজ্জা পেয়ে লাল হওয়াকে বলা হয় লজ্জায় লাল হওয়া। সে হিসাবে এখন ভাবির লাল হয়ে যাওয়াকে বলা যায় কান্নায় লাল হওয়া। ইচ্ছে হলো বলি, ” ভাবি কান্নায় লাল হয়েছেন কেন? ” জিহ্বাপ্রান্ত পর্যন্ত প্রশ্নটা এসেছিল, কষ্টে গুম করে দিয়ে দিলাম। আজ কাল গুম একটা স্বাভাবিক ঘটনা! শত চেষ্টা করেও গুমের ঘটনা রহস্যজট খোলা যায় না । ভাবির কান্না নিয়ে মজা করলে সেটাকে তিনি মজা হিসাবেই নিবেন তার নিশ্চয়তা কি? উল্টো বুঝে দু কথা শুনালে আমার দুঃখ লাগতো নিশ্চই, সেই সাথে ভাবীর দুঃখও আরো বেড়ে যেত!

রাসেল বসে আছে বিছানার এক পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে । সে নিরব। আমি যে ঘরে এসেছি সে নিয়ে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে ও ওর মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে। বাম হাতে মোবাইল – ডান হাত দ্রুত নড়াচড়া করছে মোবাইলের উপর। সম্ভবত ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করছে ও। ওর স্ত্রী কাঁদছে অথচ ও চুপটি করে বসে চ্যাটিং করছে? আশ্চর্য! “কি হয়েছে?” রাসেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম। রাসেল মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। বললো,
” কিছু না! ”

ওর বলার ধরনই বলে দিচ্ছে ও বিরক্ত হয়েছে জানতে চাওয়াতে । ওর বিরক্ত হওয়া বা না হওয়া সেটাকে এড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।

” তাহলে ভাবি কাঁদছে কেন? ”
” সেটা ওকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়! আমার কাছে জানতে চাচ্ছিস কেন? কান্না কি আমি করছি না কি? মেয়েদের চোখের পানি লেবুর রসের মতো, একটুতেই টপ টপ করে পড়তে শুরু করে! ” রাসেল বললো । বলা শেষ হতেই মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিলো।

” একটু তেই না? একটুতেই?” ভাবী তার কান্না ভেজা কন্ঠ নিয়ে রেগে বললো।
” কি হয়েছে ভাবি? ”
” কি আর হবে? কপাল ভাই কপাল! সব কপালের দোষ! মা বাবার কথা না শুনে ওকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল

হয়েছে! চরম ভুল! আল্লাহ আমার গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না, আল্লাহ! ”
বলা শেষ হতেই শুরু হলো ভাবির কান্না । এমন পরিস্থিতি আমার জন্য নতুন। কি বলা উচিৎ ভেবে পাচ্ছি না। এরা দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছিল আদালতে। দুজনের কারো মা বাবাই রাজি ছিল না! কিন্তু ওরা তাদের উপেক্ষা করেছে নিজেদের আপন করে নিয়েছে। সেই হতে ওরা নির্বাসিত ঢাকায়।

” কি হয়েছে সেটা তো বলবেন? ” ভাবিকে কি বলা উচিৎ ভেবে না পেয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।
” কি আর হবে? আপনার ভাই আবার একটা বিয়ে করবে! ” ভাবির জবাব।
” বাড়াবাড়ি করছো বললাম ” মহুর্তেই রেগে উঠলো রাসেল।
” কি বাড়াবাড়ি করলাম? তুমি কুকাম করলে দোষ নেই, আর আমি বললেই দোষ?”
” রাসেল তুই চুপ করে যা করছিস তাই কর। কি হয়েছে ভাবি বলেন তো! ” বললাম আমি।
” আপনার ভাই তার অফিসের একটা মেয়ের সাথে প্রেম করে। ” বললো ভাবি।
” ফের ও কথা বলে? তুমি জানো আমি প্রেম করি ওই মেয়ের সাথে? ” আবার রেগে উঠলো রাসেল।
” প্রেম না করলে ও মেয়ের সাথে তোমার ছবি কেন? তোমার মোবাইল আজ হাতে না নিলে জানতামি না তলে তলে এই? প্রেম যদি করো, তাহলে আমাকে বিয়ে করেছো কেন? ” ” আর একবার ও কথা বললে চলে যাবো আমি? ” বললো রাসেল।

” যাবেই তো! যাবে না? আমাকে আর ভাল্লাগে না? সেটা বলতেই তো পারো! ” আবার শুরু হলো কান্না । আমার সামনে কোন মেয়ে কাঁদলে আমার রাগ হয়, প্রচন্ড রাগ। স্রষ্টার এ অপূর্ব সৃষ্টি নারীদের মুখে থাকবে মুক্তা ঝড়ানো হাঁসি- চোখ তার পূর্ণিমা চাঁদ! তা না সেখানে কান্না ভেজা চোখ – মলিন মুখ বড্ড বেনান। রাসেলের প্রতি রাগ হলো আমার। আমারা সম বয়সী হলেও সে আমার চেয়ে ছ মাসের ছোট। ” কি হয়েছে, তুই ভালো করে বল শুনি ” রাসেলের কাছে জানতে চাইলাম আমি।

” কিছু না রে? আমাদের অফিসে একটা মেয়ের সাথে এক সাথে কাজ করি । মেয়েটা খ্রিষ্টান। তার স্বামীও কাজ করে আমাদের সাথে। তো গত কাল বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। সেটাই তোর ভাবি দেখেছে। আর তার পর হতে… ” বললে রাসেল।

” তুই অন্যের স্ত্রীর সাথে ছবি তুলবি কেন? ” বড় ভাইয়ের মতো জানতে চাইলাম।
” এমনি। আর তুলবো না বলে দে তোর ভাবীকে। এবার কান্না থামাতে ক। না হলে বাসা ছেড়ে চলে যাবো। ” বললো রাসেল। ” কান্না থামাবো। আগে আপনার ভাইকে বলেন তার আজ হতে মোবাইল চালানো বন্ধ। তাহলেই। তার আগে নয়। ” বললো ভাবি। ” তাহলে কাঁদতেই থাকো। তবে আমার বিছানা না ভিজলেই হলো! ” বললো রাসেল।

আমি জানি এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে খুব। খুব ভালোবাসে। ঝগড়া করলে অল্প সময়ের জন্য দুজন অভিমান করে থাকবে। তার পর সব স্বাভাবিক। তবু ঝগড়া থামানো উচিৎ। অন্তত এই মহুর্তে। তাই বললাম, ” ভাবি ক্ষিধে লাগছে খুব, খেতে দেন। ” কাজ হলো। কান্না থামিয়ে ভাবি ব্যস্ত হয়ে পরলো। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। একটা গামছা বেছানো হলো বিছানার উপর। তার উপরে থালা, মগ পানি দিলেন আমাদের জন্য। ভাবিও বসেছে বিছানার এক কোনে। আমি মগ হতে মানি নিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। রাসেল হাত ধুয়ে নিবে সেই মহুর্তে ভাবি তার ডান হাত মুঠো করে বৃদ্ধাঙ্গুলি উচু করে তা বাড়িয়ে দিল রাসেলের দিকে। ” তোমার সাথে এখন হতে কথা বন্ধ। যতদিন না মোবাইল চালানো বন্ধ করো।” বললো ভাবি ।

” ঠিক আছে আড়ি। ” বলেই রাসেল ওর বৃদ্ধাঙ্গুলি এগিয়ে দিল। দুজনের বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটো স্পর্শ করলো একে অপরকে। তার পরই হাত সরিয়ে নিল দুজন।আমি চেয়ে দেখলাম। বিষ্মিত বোধ করছি! বাচ্চাদের মতো এ কি খেলা?
আমাদের দু ভাইকে ভাত তরকারি দিয়ে ভাবি বসে রইলো। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” ভাবি, আপনি খাবেন না? ”
” না। ক্ষিধে নেই। ”
” তাহলে আমিও খাবো না। ” বললো রাসেল। একটু পূর্বের আড়ি, কথা না বলা শর্ত ভুলে গেছে নিশ্চই!
” আমিও না। ” বললাম আমি।
” না খেলে নেই। আমি খাবো না।” জিদের স্বরে বললো ভাবি। ” তোমার আঙ্গুলে কি হয়েছে?” ব্যস্ত কন্ঠে পরোক্ষনেই

প্রশ্ন করলো রাসেলের একটা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে। তাকালাম আমি। এতক্ষণ দেখি নি। রাসেলের একটা আঙ্গুল এক টুকরো কাপরে বেধে রাখা। দেখলে যে কেউ বলবে কোন দূর্ঘটনায় ক্ষত হয়েছে বলে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে আঙ্গুলে।

” কিছু না। ” স্বাভাবিক কন্ঠে বললো রাসেল।
” আমি দেখবো। ” বললো ভাবি।
” আমি দেখাবো না। ”
” আমি দেখবোই। ”
” তুমি আড়ি দিয়েছো আমার সাথে । আর কোন দেখাদেখি নাই। চুপ করে খেতে বসো। ” বললো রাসেল।
” আড়ি ভাঙছি। ” কথাটা বলেই ভাবি তার ডান হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলটা বাড়িয়ে দিলো রাসেলের দিকে।
“শুধু আড়ি ভাঙলেই হবে না। খেতে হবে আমাদের সাথে। ” শর্ত রাখলো রাসেল।
” খাবো। আঙুলটা দেখতে দাও ”
” তার আগে আড়িটা ভাঙি। ”

রাসেল ওর ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল বাড়িয়ে দিল ভাবির হাতের দিকে। দুটো কনিষ্ট আঙুল দুজন দুজনকে জড়িয়ে নিয়ে মিলিত হলো মহুর্তেই। দুজনের মুখে মহুর্তেই ফুটলো হাঁসি। আমি দেখলাম দুটো আকাশে দুটো চাঁদ জোসনার আলো ছড়াতে শুরু করেছে হঠাৎ। কেউ ছাড়ছে না কারো আঙ্গুল। দুজন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এই দৃশ্যটা সুঃখের। দাম্পত্য জীবনে এমন সব দৃশ্য, সুখ মহুর্ত আছে বলেই দামত্য জীবন মধুর হয়। ভাবলাম আমি।
আমি যে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি সে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। হঠাৎ ভাবি রাসেলের আঙুল হতে ছড়িয়ে নিল তার আঙুল। দেখলাম ভাবি আবার লাল হয়েছেন। তবে হাঁসিতে নয়। লজ্জায়। লজ্জায় লাল হওয়া যাকে বলে! ভাসুরের সম্মুখে এতটা রোমান্টিকতা লজ্জারই বটে!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত