ফিরে আসার গল্প

ফিরে আসার গল্প

নীল পান্জাবীটা আমার হাতে দিয়ে নিধি বলল, “গায়ে দে৷” একটু নাড়িয়ে দেখে বললাম, “তোর প্রেমিকের বডি কি আমার মতো রোগা?” নিধি কঠিন ভাবে তাকায় আমার দিকে৷ রাগলে নিধির নাকটা একবার ফুলে আবার সরু হয়৷ এই মেয়ে হুটহাট রেগে যায়৷ বেশি কিছু করলে শপিং মলের মাঝেই চড় বসিয়ে দিবে আমি জানি৷ এই মেয়ে যদিও আমার প্রেমিকা নয়৷ তাও আপাতত তার কথাটা মেনে চলতে হচ্ছে৷

নিধি আম্মার বান্ধবীর মেয়ে৷ মাস ছয়েক হয়েছে লেখাপড়া শেষ করেছে৷ তাও দেশের বাইরে থেকে৷ আম্মার ভাষ্যমতে, নিধি যেদিন তার মায়ের কোলে আসলো৷ সেদিনই আম্মা তার বান্ধবীকে জানিয়ে দিয়েছে এই মেয়েকেই তার ছেলের বৌ বানাবে৷ সেই হিসেবে ছোটবেলা থেকেই নিধির সাথে আমার পরিচয়৷ আম্মার জানের বান্ধবী হুট করে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠে পরলো৷ তিনি নাকি আম্মাকে প্রচুর পরিমাণে মিস করতো তখন৷  তারপর থেকেই নিধি আমার সাথেই বড় হয়েছে৷

ছোটবেলা থেকেই শান্তশিষ্ঠ ছিলাম বলে নিধি আমার উপর ছড়ি ঘোরাতো৷ যদিও সে আবার বছর দেড়েকের ছোট৷
স্কুলেও ভর্তি করানো হলো একসাথে৷ নিধিও আমার মতো শার্ট-প্যান্ট পরে স্কুলে যেতো ছোটবেলায়৷ চুলের কাটিংটাও দিতো আমার মতো৷ সবসময় আমার পাশেই বসতো৷ মেয়েদের সাইডে সে কখনোই বসেনি৷ নিধির সাথে আমার ঝগড়া লাগতো মাঝে মাঝে৷ আমি মারবো কি মারবোনা ভাবতে ভাবতেই এই মেয়ে কামড় কিংবা খামচি দিয়ে বসে থাকতো৷ যেখানে আমার কাঁদার কথা ছিল,সেখানে নিধি কান্না শুরু করে দিতো৷ অন্যদিকে কামড় কিংবা খামচি খেয়ে আমিই দোষী হয়ে যেতাম৷ বড় হওয়ার সাথে সাথে নিধির শার্ট-প্যান্ট পরার অভ্যাসটা গেল৷ চুলগুলোও লম্বা করা শুরু করলো৷ কিন্তু আমার উপর ক্ষমতা দেখানো ছাড়লোনা৷

পড়ালেখায় বরাবরই আমার চেয়ে ভালো৷ রান্নাও শিখে ফেলেছে খুব তারাতারি৷ আম্মার ভাষায় নিধি সর্বগুনে গুনাণ্বিত একটা মেয়ে৷ আম্মা যখন মাঝে মধ্যে আমাকে বলতো, নিধি মেয়েটা দেখেছিস! সবকিছু পারে৷ লেখাপড়াতেও ভালো!” আমি চুপ করে শুনতাম৷ আম্মা আমার প্রতুত্তর শোনার অপেক্ষায় থাকতো৷ আমি আর না পেরে বলতাম, বৌটা কার দেখতে হবে না!” আম্মা মুখ শক্ত করে বলতেন, আমার চিন্তা হয় মাঝে মাঝে! এই মেয়ে তোকে বিয়ে করবে কিনা!” আমি মুচকি হাসতাম মনে মনে৷ আর বলতাম, সামনের বছর দেখিয়ে দিবো লেখাপড়া কাকে বলে৷ তোমার নিধিকে পেছন পেছন ঘুরাবো৷” নিধি দিনের পর দিন নানা গুণ অর্জন করে চলেছে৷ আর আমি আম্মার মুখে সেসব গুণের গল্প শুনতাম৷ পড়ালেখাতে দারুণ ভালো নিধি৷ আর আমার সামনের বছরটা আর আসেনি৷ তারপর হুট করে একদিন আম্মার মনটা খারাপ হলো৷ আম্মার বান্ধবী তার পরিবার নিয়ে বিদেশ চলে গিয়েছে৷ আম্মার সাথে সাথে আমার মনটাও খারাপ হলো প্রচন্ডরকমের৷ আম্মাকে শান্তনা দিতাম আমি৷ আম্মার মন খারাপের প্রথম কারণ, উনার বান্ধবীকে মিস করছে৷ দুই নাম্বারে, গুণবতী নিধিকে মিস করছে৷

আমার মন খারাপের একটাই কারণ,নিধি মেয়েটা আমাকে বিয়ে করবেতো! কিছুতেই ভরসা পাচ্ছিলাম না৷তারপর এসে গেল সেই কাঙ্খিত সামনের বছরটা৷ সারাদিন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখতাম৷ আমার এহেন পড়ালেখা দেখে আম্মাও বড্ড খুশি৷ অবসর সময়ে আম্মার সাথে রান্নাঘরে যেতাম৷ মোটামুটি সব রান্না শিখে ফেলেছি ততদিনে৷ আম্মাকে হুট করে জিজ্ঞেস করতাম, উনার বান্ধবীর কি খবর! যদিও সেটা নিধির খবর নেয়ার জন্যই জিজ্ঞস করা৷ আম্মা চুপ থাকতো সবসময়৷ নিধির বান্ধবীগুলোর সাথে দেখা হতো মাঝেমধ্যে৷ কেউ সদ্য বিবাহিত কারো আবার ফুটফুটে বাচ্চা আছে৷ আমি হুট করে নিধিকে ভাবতাম৷ আচ্ছা নিধিরও কি ফুটফুটে বাচ্চা আছে! সে রাতে আমার আর ঘুম হতো না৷

স্কুলের বন্ধুদের সাথে দেখা হতো৷ এদেরও একই অবস্থা৷ কেউ বিবাহিত কিংবা মেয়ে খুঁজছে৷ আমাকে দেখলে মুচকি হেসে বলতো, আমার শালী আছে একটা! খুব সুন্দরী৷ দেখবো নাকি?” আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম৷ আমার ইচ্ছে হতো আম্মাকে বলে বসি, নিধিকে আসতে বলো! বিয়ে করবো আমি৷” পরক্ষণেই মনে মনে বলতাম, লজ্জা শরম নেই নাকি আমার!” আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিধি আসলো পরিবার নিয়ে৷ আম্মার সাথে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে৷ আম্মার তার বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেছে৷ নিধি মেয়েটা আগের চেয়ে রূপবতী হয়েছে৷ গালগুলো টেনে দেয়ার ইচ্ছে হলেও দমিরে রাখলাম৷ চারপাশে ভালোভাবে তাকালাম একবার৷ নাহ! জামাই কিংবা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আসেনি৷ মনে মনে খুশিই হলাম৷ যাক এবার বিয়েটা হবেই৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে নিধি মেয়েটা টু শব্দও করলোনা আমার সাথে৷

সবচেয়ে বড় ধরনের মন খারাপ হলো খাবারের টেবিলে বসে৷ আম্মা নিধির পছন্দের খাবারগুলোই রেঁধেছে৷ নিধি নাক সিটকে বললো, উফফ আন্টি! এখন এসব খাবার খাইনা আমি৷” কথাশুনে আম্মার দিকে তাকালাম আমি৷ উনি মন খারাপ করার বদলে একগাল হেসে বললো, তোর কি পছন্দ বল৷ আমি এখনই আনিয়ে নিচ্ছি৷” এবার নিধি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেয়ারটেকারকে পাঠান!” আমি অবাক হলাম না৷ আমি জানি সে জেনে বুঝেই বলছে এসব৷ আম্মা আমাকে হুট করে বাজারে পাঠিয়ে দিলেন৷ একবুক বেদনা নিয়ে হাঁটছি৷ আমি জানি নিধি কিছুক্ষণ বাদে বলবে, এই জিনিস আমার পছন্দ নাহ! কি লজ্জার ব্যাপার৷ এই মেয়েকে আর বৌ ভাবা যাবে না কিছুতেই৷ পছন্দের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আকাশ থেকে পরার অবস্থা! আম্মার রান্না করা তরকারিগুলো গিলছে নিধি৷ চোখাচোখি হতেই চোরধরা পরার অবস্থা৷

নিধির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করা হাসি দিলাম৷ নিধি বিরক্তমুখে আম্মাকে বলল, ঘরে রেখে রেখে অলস বানিয়েছেন৷ সামান্য খাবার আনতেই বছর পার করে ফেলেছে৷ আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি নাকি!তাই খেয়ে ফেলেছি৷” আমার দম ফাটানো হাসি আসে৷ চেপে রাখি প্রাণপণ চেষ্টা করে৷ এই মূহূর্তে হাসলেও বিপদ৷ ছোটবেলার খামচি কিংবা কামড়ের কথাগুলো মনে পরতেই ভয় জেঁকে বসে৷ আমি চুপচাপ সরে পরি৷ এরপর থেকেই শুরু হলো অত্যাচার৷ নিধি যেখানে যাক, তার অলিখিত বডিগার্ড আমি৷ রাত বিরাতে নিধির হাঁটতে ইচ্ছে করে৷ আমাকে ঘুম বিসর্জন দিয়ে তার পাশে হাঁটতে হবে৷ কিংবা ঝাল ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে তার৷ আমারও ঝাল খেতে হবে৷ সেদিন হুট করে জিজ্ঞেস করলো,

-প্রেমিকা আছে?
-নাহ৷
-থাকলে বল৷
-থাকলে কি করবেন? বিয়ে দিয়ে দিবেন?”

নিধি হাসলো৷ মুক্তাঝরানো হাসি৷ আমার শার্টের কলারটা খপ করে ধরে বলল, গুলি করে আসবো গিয়ে৷ আমার গার্ডের প্রেমিকা থাকা নিষেধ৷” সকালের ঘুমটা আজকে নিধি ভাঙিয়েছে৷ চোখ কচলে অবাক হলাম৷ খোলা চুল নাকে নোলক পরে আমার পায়ের পাশে বসে আছে নিধি৷ আমি টুপ করে উঠে বসি৷ “তারাতারি উঠ৷ বান্ধবীদের সাথে দেখা করবো৷ আর আমাকে তুই করে বলবি আগের মতো৷” আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম৷ নিধির বিবাহিত বান্ধবীগুলো নিধিকে দেখেই ঝাপিয়ে পরলো একপ্রকার৷ ৪-৫জন বান্ধবী একসাথে হলে যা হওয়ার তাই হলো৷ এতবছরের জমানো কুটনৈতিক গল্প জমে উঠলো৷

বাচ্চাওয়ালা বান্ধবীগুলোর বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব আমার৷ বাচ্চাগুলো মাশাল্লাহ উচ্চবংশীয় শয়তান৷ মনে মনে ভাবলাম, তাদের বাবাগুলো কেমন! কুটনৈতিক আলাপ শেষে বিজয়ের হাসি দিয়ে আড্ডার শেষ হলো৷ আমি ততক্ষণে হাঁপিয়ে গিয়েছি৷ নিধির একমাত্র অবিবাহিত সুন্দরী বান্ধবীটা হেসে বললো, বাহ ভাইয়া৷ আপনিতো খুব ভালো বাচ্চা সামলান! অভিজ্ঞতা আছে নাকি!” আমার রাগ হলো একটু৷ রাগটা চেপে বললাম, হ্যা আছে তো৷ রান্নাটাও ভালো পারি আমি৷ এবার একটা সুন্দরী বৌ হলেই হবে৷ চলুন বিয়ে করে ফেলি৷” অবাক হওয়ার বদলে মেয়েটা হেসে বলল, ইশশ৷ কি বলেন৷” নিধি টুপ করে বেরিয়ে পরলো৷ নিধির পেছন পেছন আমিও৷ রিক্সায় নিধি চুপচাপ ছিল কিছুক্ষণ৷ হুট করে আমার ডান হাতে চিমটি দিয়ে বসলো৷ আমি তাকালাম নিধির দিকে৷ মেয়েটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, কার বাচ্চা সামলেছিস এতোদিন!” আমি বিরক্ত মুখে বললাম, বড় আপার বাচ্চা সামলেছি৷ নিধির মুখে প্রশান্তির হাসি দেখেছি আমি৷

নিধির দেয়া পান্জাবীটা পরে সোফায় বসে আছি৷ খানিক বাদেই আম্মাকে নিয়ে আসলো নিধি৷ আম্মা অবাক দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকায়৷ আমি নিধির দিকে তাকালাম আড়চোখে৷ মুখে লাল আভা ভেসে উঠেছে৷ রাগ নাকি লজ্জা বুঝে উঠতে পারিনি আমি৷ “ভেবেছিলাম একটু বাজিয়ে দেখবো৷ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি! আমি আজকেই বিয়ে করে ফেলবো৷” কাষ্ঠ কন্ঠে বললো নিধি৷ মনে মনে বললাম, আমার চেয়ে বেশরম আছে!” আম্মাকে দেখে খুশি মনে হলো৷ উনার হাসিটা অনেকদিন পর দেখা৷ যথাসময়ে শ্বাশুরি আম্মা উপস্থিত হলো৷ আপাতত আর ঝুঁকি নেই৷ বিয়েটা এবার হয়েই যাবে৷

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত