ঢাকা শহরের অলিগলি কোথাও “টু লেট” লেখা নোটিশের অভাব নেই। নোটিশে উল্লেখ থাকুক আর নাই থাকুক, এই টু লেট এর আশায় থাকায় বাড়িওয়ালারা একেবারে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় যদি কোন ব্যাচেলর ভাড়া নিতে যায়। যেই শোনে বিয়ে হয়নি, কয়েকজন বন্ধু থাকবে বাড়িতে, ভুত দেখার মত চমকে ওঠে তারা, ভাবটা এমন চোখের সামনে সাক্ষাৎ ইবলিশ অথবা কোন নরকের কীট দাঁড়িয়ে আছে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে ভাগিয়ে দেয়ার সময় তাদের চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি ফুটে ওঠে, যেন কস্মিন কালেও তারা ব্যাচেলর ছিলনা। ভালবাসা কপালগুণে যাও বা দু একটা মেলে, “ভাল বাসা” টা এই বাজারে একেবারে দুর্মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্টুডেন্ট লাইফ শেষে হলের রাজা বাদশাহ হালের জীবন ছেড়ে যখন বাসা খুঁজতে বের হলাম, কত বাসায় যে এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তা আর নাই বা বললাম।ভাল কোন মেসে আমরা চার বন্ধু হয়ত থাকতে পারতাম কিন্তু একসাথে চারটা সিট পাচ্ছিলাম না।এইজন্য এই বাসা খুঁজার হ্যাপা। একবার বাসা খুঁজতে গিয়ে একটা বাসা বেশ পছন্দ হল, আসলে ভাড়াটা কম এই কারণে পছন্দ হয়েছিল বেশি। বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে গেলে বাড়িওয়ালা রীতিমত ইন্টারভিউ নেয়া শুরু করল। দুই এক কথার পরই বিয়ে করেছি কি না জানতে চাইলে আমি চোখ মুখ বন্ধ করে বলে ফেললাম, সেই কবে ! পাশে দাঁড়ানো মিজান আমাকে একটা চিমটি কাটলেও পাত্তা দিলাম না। ছোটখাট দেখতে মিজান কে দেখিয়ে বললাম, আমার চাচাত ভাই মিজান, ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে।আমাদের সাথেই থাকবে। বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করল, পরিবার কোথায় থাকে? বললাম, রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে। ছুটি হলে এখানে এসে থাকবে। বড়িওয়ালা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ও! তাইলে সবসময় থাকবেনা ! তাইলে তো বাপু সমস্যা। তোমাদের উঠতি বয়স। এই বয়সে পরিবার ছেড়ে থাকবা। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার না। তোমরা বাপু, অন্য কোথাও দেখ।”
মনে মনে বাড়িওয়ালার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে বের হতে যাব, এমন সময় অফিসের বসের ফোন। বললেন, পরেরদিন কি একটা জরুরী মিটিং আছে, উনি অফিসে থাকবেন না, আরো কিছু কাজ বুঝিয়ে দিলেন।কথা শেষ করতেই বাড়িওয়ালা আবার জিজ্ঞেস করে, কোথায় চাকরি করি। কোম্পানীর নাম বলতেই উনি বলেন যে উনার বোনের ছেলেও নাকি একই অফিসে চাকরি করে।সিনিয়র ম্যানেজার। নাম বলতেই চমকে উঠলাম, কারণ উনার বোনপো ই তাহলে একটু আগে ফোন দিয়েছিলেন। বাড়িওয়ালাকে সেই কথা জানাতেই বাড়িওয়ালা একেবারে গদগদ হয়ে বললেন, আগে বলবা না?তুমি রশিদের অফিসে চাকরি কর? যাক,তাইলে ভরসা পাইলাম। যাইহোক, রশিদের অফিসের ছেলে বলে তোমাকে আমি বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি,কিন্তু আগেই বলে রাখছি কোন রকম উল্টা পাল্টা কাজ কিন্তু এই ফ্ল্যাটে চলবেনা,আশপাশে সব ভদ্রলোক থাকে।রাতবিরেতে চিল্লাচিল্লি একদম সহ্য করব না । জ্বী, আজ্ঞে, অবশ্যই ইত্যাদি মুখস্থ বুলি আউড়ে বাসা থেকে বের হতেই মিজান কষে একটা রামধমক লাগাল আমাকে।বলল, আমি বউ কোথা থেকে আমদানি করব? আমি বললাম, দেখ বাড়িওয়ালা নিজে থাকে রামপুরা, তার খেয়েদেয়ে কাজ নেই উত্তরার প্রায় শেষ মাথায় এসে দেখতে যাবে আমার ঘরে বৌ আছে কি না !আর আসলেও সে পরে দেখা যাবে।আগে বাসায় তো উঠি।
বাসা পাল্টানো ঝামেলা সব শেষ হলে আমরা চারজন ব্যাচেলর কায়দায় সব গুছিয়ে নিলাম। আসবাবপত্রের তো বালাই নেই, ঘরে ঘরে তোষক বালিশেই চলে আমাদের সংসার রাজত্ব। নতুন বাসার বারান্দায় দাঁড়াতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। বারান্দা থেকে একটা ঝিল বা পুকুর টাইপ দেখতে পাওয়া যায়, যদিও কচুরিপানা ভর্তি! কিন্তু তাতে কি, চোখ জুড়ানোর জন্য এতটুকু সবুজই যথেষ্ট । পাশে একটা খেলার মাঠ। আসলে এই ফ্ল্যাটটা একটা ডেভলপার কোম্পানির হাউজিং প্রকল্পের মধ্যে, আশপাশে আরো দশ বিশতলা বিল্ডিং মাথা গজাবে রাতারাতি, তখন না থাকবে ঝিল, না থাকবে খেলার মাঠ। তবুও যতদিন থাকে, ওইটাই লাভ।
আমার চাকরির বয়স এখনো এক মাস হয়নি, বাকি তিনজনেরও মটামুটি এক দশা, মিজান আবার আরেক কাঠি সরেস। সে চাকরি বাকরি করবেনা, ফিল্ম বানাবে! অফিস শেষে বাইরে কিছুক্ষণ আড্ডাবাজি করে বাসায় ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে যায়। একে নতুন বাসা, কোন বুয়া ঠিক করা হয়নি, তার উপরে আমরা যেই সময়ে বাসায় ফিরি ওই সময়ে রান্না করার জন্য বুয়া পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব। তাই চারজন একে অন্যকে রান্নার জন্য ঠেলাঠেলি করতে থাকি। শেষমেশ একেকজনের রন্ধন নৈপুণ্যে যা বস্তু রান্না হয়, তাই গোগ্রাসে গিলি, আর তো কোন উপায় নেই। তবে আমরা চারজনে একটা বিষয়ে একমত, খিচুড়ি আর ডিমভাজা জিনিসটা যেই আবিষ্কার করুক ব্যাচেলর সমাজের দোয়ায় সে জান্নাতবাসী হওয়ার কথা ! এই দুইটা জিনিস না থাকলে ব্যাচেলর সমাজকে বেশিরভাগ দিন অনাহারে থাকা লাগত ।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলেই বাকি তিনজন মোবাইল কানে কেউ বারান্দায়, কেউ ড্রয়িং রুমে, কেউ ঘরের কোণার দিকে আয়েশ করে আল্ট্রাসনিক সাউন্ডে প্রেমালাপ চালাতে থাকে। রাত বাড়ার সাথে সাথে আওয়াজ কমতে থাকে আর সম্বোধনটা পাল্টে গিয়ে বাবুসোনা, বেবি, লক্ষী, কিউটু মিউটু এরকম কত আজব আজব শব্দ বের হতে থাকে। আগে এসব শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতাম, এখন বুঝছি, প্রেমের রাজ্যে কথাবার্তা উন্মাদীয়, ধরতে গেলে চলে না। এই সময়ে আমি গেম খেলি, গান গাই আর ওদের পাশে গিয়ে চিল্লাপাল্লা করে ডিস্টার্ব করি, ওরা অবশ্য আমাকে শাসায়, তোর ও একদিন পালা আসবে, তখন দেখিস, তিনজন মিলে জ্বালাব। আমি হাসি আর ভাবি মনে মনে, সাত মণ ঘিও জুটবে না, রাধাও নাচবে না বাছাধন !
বাসায় উঠার সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন বাসার কেয়ারটেকার জানাল, বাসার মালিক নাকি পরের শুক্রবার আসবে , কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা দেখতে। এই কথা শুনেই তো বিপদে পড়ে গেলাম। বউ নেই সেইটা না হয় বুঝানো যাবে, কিন্তু বাসায় ঢুকলেই তো বুঝা যাওয়ার কথা। চার চারটা ব্যাচেলর ছেলে থাকে যেই বাসায় সেইটার সাথে গোয়াল ঘরের বিশেষ কোন পার্থক্য থাকেনা। অনেক জল্পনা কল্পনা করে ঠিক করা হল, এক সপ্তাহ পরে মিজানের মায়ের আর ছোট ভাইয়ের ঢাকায় আসার কথা, আন্টিকে বলে কয়ে যদি কয়েকদিন আগে আনানো যায়, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান। মিজান বাসায় কথা বলে অবশ্য কিছুক্ষণ পর সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলল। আন্টি একদিন পরেই আসতে রাজি হলেন।
দুইদিন পর আমি অফিস থেকে ফেরার পথে জ্যামে আটকে বসে আছি বাসে। তখন রাত আটটা বেজে গেছে। হঠাৎ ফোনে নিশার কল।ভার্সিটি তে আমাদের যেই হাউকাউ গ্রুপটা আছে, নিশাও সেই গ্রুপের সদস্য, এককথায় বলতে গেলে রাজ্যের যত উদ্ভট কাজকর্ম করাই ছিল আমাদের ডেইলি রুটিন । আমাদের গ্রুপের পাঁচজন ছেলে আর তিনজন মেয়ে, মেয়েদের মাঝে নিশার সাথেই আমার কেন যেন খিটিমিটি লাগে বেশি, ওকে খেপাইতে আমি বিমলানন্দ পাই। নিশার সাথে যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সেটা বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে অন্যকিছুতে রূপ দেয়ার কথা আমাদের কারো মাথাতেই আসেনি, আর কিছুদিন হল, নিশার এক প্রবাসী পাত্রের সাথে বিয়েও ঠিক হয়েছে। ফোন ধরতেই ওপাশে নিশা কান্না শুরু করে দিয়েছে।বারবার আমাকে অনুরোধ করছিল, একবার ওর বাসার নিচে যেতে। ওর অনেক বিপদ। আমি আগেপিছে চিন্তা না করে বাস থেকে নেমেই কিছুদূর জোরে হেঁটে রিকশা নিলাম। ভাগ্য ভাল, নিশার বাসা ওখান থেকে দূরে না খুব একটা। নিশাদের বাসার নিচে এসে ফোন দিতেই নিশা বলল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াতে, ওখানে আছে সে। দেরি না করে ওর কাছে পৌছালাম, ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, প্রচন্ড ভয় পেয়েছে সে। একটা সি এন জি তে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাব। নিশা বলে, জানিনা। এই কথা শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ল। এত রাতে নিশাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব! অত কিছু চিন্তা না করে আমাদের ফ্ল্যাটে নেয়ার চিন্তা করলাম।আন্টি যেহেতু বাসায় আছে, হয়ত বলে কয়ে ম্যানেজ করা যাবে। নিশা একটু শান্ত হলে ও নিজেই জানাল সব কথা- তুই তো জানিস আমি বড় আপার বাসায় থাকি। ছোট আপার কয়েকদিনে বেবি হবে বলে আপা আজ সকালেই ছোট আপার বাসা কুমিল্লা গিয়েছে। আমার দুইটা চাকরির পরীক্ষা আছে সামনে, তাই আর আমাকে নেয়নি। আমি চার বছর ধরে আপার বাসায় থাকি। বয়সে দ্বিগুণ দুলাভাইকে বাবা বলেই জানি। কিন্তু কুত্তার বাচ্চাটা আজ……এইটুকু বলেই ফোঁপাতে শুরু করে নিশা। তারপর আবার বলে, কোনমতে পালিয়ে এসেছি। আনিকা, রাত্রি আর তিন্নিকে ফোন দিলাম প্রথমে। আনিকা, রাত্রি দুইজনেই ঢাকা নেই, আর তিন্নির শ্বশুরবাড়িতে থাকা সম্ভব না আসলে। তাই তোকে বাধ্য হয়ে ফোন দিয়েছি ।
বাসায় ঢুকতেই আমার সাথে নিশাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, এইটা কে ?আমি কিছু বলার আগেই মিজান বলে বসল, আম্মা , এটা আরিফের বউ। রাজশাহীতে পড়ে। ছুটিতে এসেছে আজকেই। নিশা অপ্রস্তুত হয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে আন্টিকে সালাম দিল একটা ।এরপর আন্টি কথা প্রসঙ্গেই নিশার বাবা মা কি করে, কোথায় থাকে, কবে বিয়ে হল, দুজন আলাদা থাকতে কষ্ট হয় কিনা এই ধরনের কান গরম করা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন, কোনরকমে চাপা মেরে উত্তর দেয়া ছাড়া নিশার আর গতি ছিলনা। আমি মিজানকে বারান্দায় টেনে নিয়ে নিশার ব্যাপারটা খুলে বলাতে মিজান বুঝল। এরপর আন্টিকে ওই ম্যানেজ করেছিল।
সত্যি সত্যি শুক্রবারে বাড়িওয়ালা এসে হাজির হলেও মিজানের মা, নিশা কে দেখে উনার আর কোন সন্দেহই থাকেনি। তবুও রক্ষা যে আন্টি ছিলেন, না হলে নিশার থাকা নিয়ে বড় রকমের ঝামেলা হয়ে যেত। প্রথম প্রথম আন্টি বউমা বলে ডাকলে নিশা আড়ষ্ট হত, কয়দিন যেতেই হয়ত সেটা অভ্যাস হয়ে গেছিল। আমাদের হাসি, আড্ডা, পচানি, পিছে লাগা আর বাঁদরামির তোড়েই নিশার সেই সঙ্কোচ হয়ত উবে গেছে। মাঝরাতে আমাদের হাসি ঠাট্টা, মারামারির শব্দে পাশের রুমে থাকা নিশা আর আন্টি কয়েকবার কপট ধমক দিয়ে যায় , মাঝে মাঝে নিশা আমাদের রান্নার ট্রেনিং দেয়, আর এক হাতেই অসাধারন নিপুনতায় আমাদের ব্যাচেলর ফ্ল্যাটের শ্রী ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিছুদিন আগেও ডাইনিং কাম ড্রয়িং এ অফিস থেকে ফেরার পর জুতা, মোজা, কাপড়, অফিস ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় যেত, এখন সেগুলো যার যার জায়গামত দেখা যায় ।আশ্চর্য ব্যাপার হল, নিশাকে গুছিয়ে রাখতে হয়না কিছুই, আমরা নিজেরাই গুছিয়ে রাখি তার মেইল ট্রেনের মত লম্বাচওড়া একটা লেকচারের ভয়ে।বাড়ির বউ এর ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকা নিশা কিভাবে যে আমাদের এই আটপৌরে জীবনের নিদারুণ অভ্যাস হয়ে উঠেছিল, আমরা কেউই খেয়াল করিনি………
একদিন সন্ধ্যায় ফিরেই দেখি নিশা বারান্দায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে, কি হয়েছে জানতে চাইলে এড়িয়ে যায়। জোরাজুরি করলে বলে, আন্টি দুদিন পরে চলে যাবে। এর মাঝে যেন আমি একটা হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেই ওকে। আন্টি চলে গেলে তো আর এখানে থাকা সম্ভব না। কথাটা শুনে সেই প্রথম আমার বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে! এই কয়েকদিন আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এই নিশা আমার না, অন্য কোন রাজপুত্রের জন্য অহর্নিশ অপেক্ষায় দিন গুণছে। আমি শুধু বন্ধু হিসাবে কয়েকদিন ওকে আশ্রয় দিয়েছি, আর কিচ্ছুনা, ও আমার কেউনা ……এই অদ্ভুত অনুভূতিটার নামই হয়ত ভালবাসা। নাকি মোহ কিনা কে জানে! তবুও এই অনুভূতিটা আমার ভীষণ রকম অচেনা, কি জানি মনের কোন গভীরে বিষণ্ণ একটা সুর বেজে ওঠে, সামনে থাকা এই অদ্ভুত মেয়েটাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে কেন বলতে ইচ্ছা করে, “মেয়ে তোর কত্ত বড় সাহস! আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলিস! না, তুই কোথাও যাবিনা, এইখানেই থাকবি,এইখানেই, এখন যেমন আছিস”!!
-আচ্ছা, তুই কি আমার কথা শুনছিস? নাকি তপস্যা করছিস? দেশ ও দশের গুরুতর চিন্তায় তোর পেটের ভাত হজম হচ্ছেনা?নাকি প্রেমে পড়েছিস?
: হু, শুনতেছি তো, কালকে তোর হোস্টেলের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। আর কিছু বলবি?
-আচ্ছা শোন, তোর ল্যাপটপটা আমাকে আজ একটু দিস তো। কয়েকটা জায়গায় সিভি মেইল করব।
:ল্যাপটপ দেয়া যাবেনা, পেনড্রাইভে সিভি দিস আর অ্যাড্রেস দিস ,আমি মেইল করে দেব।
-ক্যান, তোর ল্যাপটপ আমাকে দিলে কি কর্পূরের মত উবে যাবে?
:শোন, তুই আসলে আস্ত গাধী। এটুকুও জানিস না, মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ আর ছেলেদের ল্যাপটপ না বলে ধরতে নাই ??
– আচ্ছা, হইছে থাক, লাগবেনা……দেখ, সামনের পুকুরটা সুন্দর না?আমার খুব ইচ্ছা, আমার বাড়ির সামনে একটা দীঘি, পুকুর যাই হোক এরকম কিছু একটা থাকবে।
:কেন,তাতে কি মাগুর মাছ চাষ করবি?
-আচ্ছা, তুই এরকম বেরসিক কেন, ন্যুনতম সৌন্দর্য বোধ নেই !
:ওরে আমার সৌন্দর্যের ডিব্বা রে, তোর সৌন্দর্য বোধের বলিহারি যাই। আমার মত এরকম হ্যান্ডসাম পোলা রেখে কাতল মাছের মত বিশাল মাথাওয়ালা রাকিব ভাইরে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেলি, আর আমাকে সৌন্দর্য জ্ঞান দিস! যা ভাগ
: এহ! তুই সুন্দর! দেশে কি সুন্দর ছেলের আকাল পড়ল নাকি রে হঠাৎ ? তোকে দেখলেই ডারউইনের তত্ত্বের আই মিন মানুষ যে বান্দরের বিবর্তনের ফল, তার একেবারে ব্যাবহারিক প্রমাণ পাওয়া যায়…
আমাদের এই ঝগড়া জমে উঠার আগেই আন্টি রাতে খাওয়ার জন্য ডাক দিলেন। নিশা চলে যাবে এই চিন্তাতেই বোধ হয় সেদিন রাতে আমার কুম্ভকর্ণ খেতাবটা প্রায় হাতছাড়া হতে বসেছিল। আ মর জ্বালা, এরকম তো হবার কথা ছিল না। নিশা মেয়েটা একটা আস্ত গাধী, নেকু নেকু কথা বলতেও জানেনা, তাছাড়া এক হাবলাকান্তের হবু বউ, ওর জন্য যে আমার পরান জ্বলে যাচ্ছে কেন , সারারাত ভেবেও আমি কূলকিনারা করতে পারলাম না। এমনকি অফিসের লাঞ্চে স্পেশাল যে তেহারী দিয়েছিল, সেটাতে পর্যন্ত আমি কোন স্বাদ খুঁজে পেলামনা। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে নিশার জন্য অনেক খুঁজে পেতে তিনমাসের এডভান্স দেয়ার শর্তে একটা হোস্টেল পেলাম।তেমন আহামরি না হলেও চলে আর কি, আসলে এখন সব হোস্টেলই বলতে গেলে একইরকম, বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। হঠাৎ কি মনে হল, আচ্ছা আজকে বরং বাসায় না ফিরে কোন বন্ধুর মেসে যাই। আসলে নিশার মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছিলনা কেন যেন। মেয়েরা নাকি চোখের ভাষা পড়তে জানে। ভয় হচ্ছিল, যদি ধরা পড়ে যাই!!
বন্ধুর মেসে পৌঁছেই মিজানকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে জরুরী কাজে আটকে গেছে, বাসায় ফিরবনা…আর নিশাকে হোস্টেলের ডিটেইলস জানিয়ে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম। সারারাত বন্ধুর মেসে আড্ডাবাজি করে চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে অফিসে গেলাম। অফিস শেষেও একটু দেরী করে বাসায় ফিরলাম। ভীষণ রকম দোটানায় ছিলাম, খুব চাচ্ছিলাম যেন বাসায় ফিরে নিশার ভেটকি মারা হাসিমুখ দেখতে পাই, আবার মনে হচ্ছিল, মায়া বাড়িয়ে লাভ কি, নিশা যেন আগেই চলে যায়। বিল্ডিং এর নিচে যেতেই রিসেপশনের লোকটা একটা স্ট্যাপল করা খাম আর ঘরের চাবিটা হাতে দিয়ে বলল, “ভাবী আপনাকে দিতে বলেছে।”
“ভাবী” শব্দটা শুনেই বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। কি ভীষণরকম রসিকতা !যে শব্দের মায়াজাল কাটাতেই নিজের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি সেইসব শব্দের অশরীরী ভুতেরা তাড়া করে আমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে !! মাথার মধ্যে তখন এই লাইনটাই কেবল ঘুরছিল- ” যেটা ছিলনা, ছিলনা, সেটা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন” । ঘরে ঢুকে নিশার খামটা খুলে ভেতরের চিঠিটা বের করলাম।মাত্র দুটো লাইন লেখা-
” আরিফ, তেরটা দিন জীবনের হিসাবে খুব বেশিরকম অল্প সময়, কিন্তু তোর বাসায় থাকা এই তেরটা দিন আমার জীবনের সেরা তের দিন। ভাল থাকিস আর আমার চেয়েও সৌভাগ্যবতী রাজকন্যা তাড়াতাড়ি খুঁজে নিস।”
আচ্ছা! এই মেয়েটা এমন কেন! আমার জন্য আর মাত্র একটা ঘণ্টা ওয়েট করে গেলে কি তার মনের রাজ্যের হাতিশালের হাতি আর ঘোড়াশালের ঘোড়া অদল বদল হয়ে যেত! সাধে কি আর আমি তাকে গাধী বলি! আসছে একজন মহিলা হাতেম তায়ী, আমাকে উপদেশ দিচ্ছে-” আমার চেয়েও সৌভাগ্যবতী রাজকন্যা খুঁজে নিস”। ক্যান রে বাপ, ফার্স্ট প্লেস টা নিজে ছেড়ে দিয়ে সেকেন্ড প্লেস টা নেয়ার এতই খায়েশ !? গাধী মেয়েটা কখনোই জানবেও না, আমি শুধু তার চশমার ওপাশের জলপুকুরের থৈ থৈ উপচে পড়া জল মুছে দিতে চেয়েছিলাম, এক শ্রাবণ বিকেলে সামনের মাঠটাতে দুহাত ধরে ভিজতে চেয়েছিলাম, আর শুধু একবার গালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলতে চেয়েছিলাম, তুই একটা আস্ত গাধী, তবে জানিস তো, গাধার জন্যই গাধী পারফেক্ট………
কিছুই বলা হয়নি নিশা নামের পাগলী মেয়েটাকে, তের দিনের মিথ্যে বউ এর অভিনয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া এই আমার মনের জানালাটা বন্ধ করে দেয়ার আগেই সেখানে চৈত্রের খরা জায়গা নিয়েছে, আর সঙ্গোপনে জমে গিয়েছে, কয়েক প্রহরের ভালবাসার ইতিবৃত্ত !!