বৃষ্টি ছুঁয়ে

বৃষ্টি ছুঁয়ে

পকেটে এক হাত দিয়ে, আরেক হাতে ফোনে কি যেন টাইপ করতে করতে হনহন করে এমবিএ বিল্ডিং এর করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সৌভিক। পিছে পিছে অরণী বই,খাতা,ব্যাগ সব কিছু হাতে নিয়েই রীতিমত লাফাতে লাফাতে দৌড়াচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে তার এই কান্ড দেখছে। সে বিষয়ে ভাবার সময় নেই অরণীর। “ভাইয়া প্লিজ, আর হবে না। আমার পরীক্ষা, আমি কিছু পারি না” বলতে বলতে সৌভিকের পেছন পেছন ছুটেছে সে।

ঘটনা আর কিছুই না। পরের সপ্তাহে অরণীর ফিন্যান্স পরীক্ষা। ম্যাথ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য গতকাল সৌভিকের কাছে গিয়ে প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। তাই আজ নিজের দুইটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস বাদ দিয়েছে অরণীকে ম্যাথ বোঝানোর জন্য। অথচ মেয়েটা পড়া বাদ দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছে। সেটা দেখা মাত্রই কবিতা লেখা কাগজটা ছিড়ে নিয়ে, অরণীকে বিশাল একটা ঝাড়ি দিয়ে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে আসে সৌভিক। অন্যসময় হলে অরণী নাক,মুখ লাল করে এক তুলকালাম কান্ড করে ফেলত। কিন্তু এখন এমন করলে তারই বিপদ। তাই সৌভিককে মানাতে পিছে পিছে দৌড় দিয়েছে সে। এখন সৌভিককে কে বোঝায় যে এমন বৃষ্টি আসি আসি ওয়েদারে দুই একটা কবিতা লিখে ফেলা দোষের কিছু না? অথবা রাগলে যে তাকে ভুতুমের মত লাগে সেটাই বা কে বোঝায়?

তাদের পরিচয়টাও হয় বেশ অদ্ভুত ভাবে। প্রায় এক বছর আগে। সেবার বৈশাখে অনেক গরম পড়েছিল। বৃষ্টি হওয়ার কোন নাম গন্ধই ছিল না। প্রতিদিন ছাতা নিলেও সেদিন ছাতা নেয়নি অরণী। আর সেদিনই বাঁধল বিপত্তি। ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখে আকাশে ঘন মেঘ, পরিবেশটা কেমন ভারি হয়ে আছে। ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ। এদিকে বের হয়ে একটা রিক্সাও পাচ্ছিল না অরণী। সৌভিকও একি দিকে যাওয়ার জন্য রিক্সা খুঁজছিল। শেষমেশ একটা রিক্সা রাজি হয়, সাথে সাথে সৌভিক সেটায় চড়ে বসে। “আপা চাইলে ভাইয়ের লগে কথা কইয়া রিশকা শিয়ার করতে হারেন। এহন আর পাইবেন না রিশকা”, কথাটা শোনা মাত্রই সাতপাঁচ না ভেবে লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠে পড়ে অরণী। কিন্তু পর মুহূর্তেই বুঝতে পারে কাজটা কতটা বোকামি ছিল। পুরোটা রাস্তা দুইজন লজ্জায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর সৌভিকের সাথে আবার দেখা হয় অরণী একটা ক্লাবে জয়েন করার পর। সেখানকার ভাইস প্রেসিডেন্ট সৌভিক। সেদিনের ঘটনা নিয়ে অরণী একটু বিব্রতবোধ করছিল প্রথমে, কিন্তু সৌভিক নিজে থেকেই খুব ফ্রিলি কথা বলতে শুরু করলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। সিনিয়র-জুনিয়র হলেও, এরপর থেকে দুইজনের মধ্যে বেশ খাতির।

ভাল স্টুডেন্ট হিসাবে সৌভিকের বেশ সুনাম থাকায়, তার কাছ থেকে কঠিন কঠিন সাবজেক্টগুলা বুঝে নেয়ার সু্যোগ ছাড়েনি অরণী। তবে তাদের মধ্যে আজকের মত এমন খুনসুটি প্রায়ই লেগে থাকে। তবে বরাবরের মত ইনিয়ে বিনিয়ে অরণী মানিয়েই নেই শেষমেশ। অরণীর সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হয়, বেশ ভাল রেজাল্টও করে। এরপর এই দুইজনের মধ্যে যে এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে তার আর হিসেব নাই।  সৌভিক সহ আরো অনেকের জন্যই ভার্সিটিতে এটাই শেষ সেমিস্টার। আর প্রায় দুই মাস পরেই ফাইনাল, এরপর শেষ। কিন্তু তার আগেই এরা সবাই ক্লাস, কুইজ, টেস্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাই ক্লাবের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদায়ী বড় ভাইয়া, আপুদের জন্য সবাই মিলে একটা বড় পার্টি অরগানাইজ করবে ক্লাবে। সেটার জন্যই কাজ চলছে। অরণী বসে বসে ডেকোরেশনের কাজ করছে।

“এই অরণী! তুই তো কিছু করছিস না। তাহলে আমার কথা শোন”
“নাহ আমি বসে বসে হাওয়া খাচ্ছি” মাথা না তুলেই জবাব দেয় অরণী।
“আহহা! শোন না! আমার না একটা মেয়েকে অনেক ভাল লাগে”
“তো? আমি কি করব?”

“কি করবি মানে কি? হেল্প করবি। মেয়েটাকে কেমনে মনের কথা জানাবো, সেটা নিয়ে আইডিয়া দিবি”
“আর আপনার মতে মেয়েটা নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যাবে? এমন গম্ভীর, খিটখিটে, চশমা পড়া ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না। মেয়েদের কিউট ছেলে পছন্দ”
“তো? আমি তো কিউটই”
“হাহাহা…আরো কিছু বলেন, আরেকটু হাসি”
“এই তুই এত নেগেটিভ কথা বলিস কেন? ব্লাড গ্রুপ নেগেটিভ নাকি? ক্লাবে সবার সামনে কানে ধরে উঠবস করালে হাহাহিহি বের হয়ে যাবে”
“আচ্ছা দেখবো নি কোন মেয়ে আপনাকে পছন্দ করে”
“হুম দেখিস। এই শোন না। ইয়ে মানে তোদের ক্লাসে একটা সামান্তা আছে না?”
“হুম”
“ও কেমন? একটু খোঁজ খবর দিস তো”
“আমি তার খোঁজ নিতে যাব কোন দুঃখে?

আমার অতো খাজুরা টাইম নাই। আপনার এত ভাল লাগলে, আপনিই নেন” কথাটা বলেই সবকিছু নিয়ে আরেক টেবিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করে অরণী। সামান্তা ওর সাথে, একই ক্লাসে পড়ে। প্রথম থেকেই মেয়েটাকে তার মোটেও ভাল লাগে না। নিজের প্রিয় ভাইয়ার সেই সামান্তার প্রতি এই অতি আগ্রহ দেখে তো পুরাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে অরণী।

ইদানীং সৌভিককে একটুও সহ্য হয় না অরণীর। সামান্তার সাথে সৌভিকের সেই ভাব জমে উঠেছে। যখনই দেখে দুইজন এক সাথেই থাকে। সামান্তার ঢং-ও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। “ইশ, ভাব দেখে আর বাঁচি না! মেয়ের ভাবখানা এমন যেন সৌভিক ভাইয়াকে না, উনি টম ক্রুজকে পেয়ে গেসে! যত্তসব”, সকাল সকাল ক্যান্টিনে ঢুকে দুজনের কেলানো হাসি দেখে, মুখে ভেংচি কেটে এসব বিড়বিড় করতে করতে ক্লাসে চলে যায় অরণী।  প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট ধরে ক্যাম্পাসে বসে আসে অরণী। আজকে খুব সকালে হঠাত ফোন দিয়ে সৌভিক ওকে আসতে বলছে। ওয়েদারেটাও যেন কেমন হয়ে আছে সকাল থেকে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, আকাশে ঘন মেঘ। যেকোন সময় বৃষ্টি হবে, ঝড়ও হতে পারে। একটু পরেই সৌভিক চলে আসে।

“ওহ তুই এসেছিস?”
“হ্যা অনেকক্ষণ ধরেই। কিন্তু হঠাত এভাবে ডাকলেন যে?”
“আগে বল আমাকে কেমন লাগছে? শার্টটা মানিয়েছে? নতুন কিনলাম কালকে”
“হ্যা মানিয়েছে। কিন্তু এত সাজগোজ করে? হঠাত কি হল?”
“ফাইনালি আমি ডিসিশন নিয়েছি যে, আজকে যাই হোক নাই হোক, আমি আমার ড্রিমগার্লকে মনের কথা বলবই”
“ওহ! তো আমি কি করব?”
“ওমা! একটু সাহসের দরকার আছে না?!”

বলেই কিছুক্ষণ বিব্রত বোধ করে, পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সৌভিক। চোখ বড় বড় করে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে অরণী। সৌভিক খুব যন্তে রেখেছে কাগজটি। “নিশ্চয়ই লাভ লেটার। নিশ্চয়ই সৌভিক তার সমস্ত ভালবাসা এই চিঠিতে ঢেলে দিয়েছে। আচ্ছা এই পাগল ছেলেটা তার ভালবাসার মানুষকে কতটা ভালবাসে?”, এসব ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই কাগজটার দিক হাত বাড়ায় অরণী। কিন্তু সামান্তার ডাকে ঘোর কেটে যায়।
সৌভিক সামান্তার কাছে চলে গিয়েছে। দুজনকে একসাথে দারুণ লাগছে, ড্রেসের কালারও ম্যাচিং। সামান্তা আজকে খুব সুন্দর করে সেজেছে। বেশ খুশিও দুজন। মনের অজান্তেই অরণীর চিবুক বেয়ে নোনা জল নেমে আসে। অরণী তো জানতই এমনটা হবে? তবে কেন তার এত কষ্ট হচ্ছে, কেন এত কান্না পাচ্ছে? কিচ্ছু জানে না সে। না, সে জানে! খুব ভালমতই জানে কারণটা। শুধু মানতে চাইছে না।

কথা বলতে বলতে ওরা দুজন অরণীর দিকে এগিয়ে আসে। অরণীর হাত কাঁপতে থাকে। নিশ্চয়ই সৌভিক এসে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, “এই দেখ তোর ভাবি”। অরণী কি সেটা সহ্য করতে পারবে? নাহ! সে পারবে না। এখনি সে কান্না আটকাতে পারছে না, এটা শুনে হয়ত হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিবে। তাদের মাঝে দেয়াল হওয়ার কোন ইচ্ছা নাই অরণীর। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসে অরণী। আশেপাশের মানুষ সব অরণীকে হা করে দেখছে। রিক্সায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে ও। এমন ওয়েদারে রিক্সাওয়ালা মামা মনের সুখে ধীর গতিতে চালাচ্ছে। হঠাত সৌভিক লাফ দিয়ে সেই রিক্সায় উঠে পড়ে। উঠেই হাপাতে থাকে। অরণী মুখ আড়াল করে তার চোখ মুছতে থাকে। এমন সময় সৌভিকের গলায় নিজের লেখা একটা কবিতা শুনে চমকে উঠে।

“কোন একদিন ভিজে একাকার হব  বৈশাখের ঝড়ো বৃষ্টিতে, পিচঢালা পথে  সেদিন থেমে যাবে সময়,  থেমে যাবে সব কোলাহল  ঝুম বৃষ্টিতে তুমি-আমি,  হারিয়ে যাব দূর বহুদূর  একদিন দুজন মিলে কাকভেজা হব  এ শহরের রাজপথে, হাতে হাত রেখে কোন একদিন” সেদিন ফিন্যান্স পড়া বাদ দিয়ে অরণী এই কবিতাটা লিখেছিল। সৌভিক রাগ করে পেইজটা ছিড়ে ফেলেছিল। আজও সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে সেটা। কিন্তু কেন? অরণী কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছে না।  “অরণী, তুই কোন এক বৈশাখের বৃষ্টিতে এভাবে ভিজতে চেয়েছিলে। দেখ মিলে গেল না? কিন্তু আমি শুধু আজকের দিনে না, এরকম অযস্র বৈশাখের বৃষ্টিতে তোর সাথে এবং শুধু তোর সাথেই হাত ধরে ভিজতে চাই। আমার এই শূন্য হাত কি পূর্নতা পাবে?”

ঢ্যাবঢ্যাব করে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে আছে অরণী। এখনো তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতেই অরণী চিৎকার করে উঠে, “এই আপনার সমস্যাটা কি? একটু আগে একজনের সাথে প্রেম করে এসে এখন আবার আমার সাথে ফ্লারট করছেন। আপনার লজ্জা করে না একটুও? এই অল্প বয়সে আপনি এত খারাপ কেমনে হলেন?”  ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সৌভিক, “অ্যাঁ?! রাস্তায় এগুলা কি যা তা বকতেছিস? এক চড় দিয়ে ড্রেনে ফেলে দিব” “ওহ, আমি যা তা বকি? একটু আগে সামান্তাকে প্রপোজ করে রেখে এসে, এখন আবার আমার সাথে ইটিশপিটিশ। এটা খুব ভাল কাজ তাই না?”

“হু? কি? সামান্তাকে আমি প্রপোজ করতে যাব কেন? ও তো আমার ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড। ফ্রেন্ড লজ্জা পায় দেখে আমি ওদের কথা বলার ব্যবস্থা করি, সেই থেকে মেয়েটাকে চিনি। আজকে মিনহাজের বার্থডে। ওকে গিটার গিফট করবে দেখে আমার কাছ থেকে সাজেশন নিয়েছিল, সেটার জন্যই থ্যাংকস বলল তখন। এই তোর মাথায় এগুলা ঢুকছে কেমনে?”

“তো আপনি আজকে এত ফিটফাট হয়ে কাকে মনের কথা জানাতে আসছেন?”  “তোকে! কিন্তু তুই তো মুডটাই নষ্ট করে দিলি। নিজেও কিছু বলিস না, কারো সাথে দেখলে খালি পটকা মাছের মত ফুলতে থাকিস। আমাকেও এতগুলা কথা শুনায় দিলি। ফাজিল কোথাকার”  হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অরণী। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর সে বুঝতে পারে যে, এতক্ষণ যা শুনেছে সব সত্যি, যা ঘটছে সব বাস্তব। খুশিতে তার জোরে জোরে হাসতে মন চাচ্ছে, আবার অনেক কান্নাও পাচ্ছে! সৌভিকের দিকে তাকায় অরণী। রাগ করে মাথা আরেক দিকে ঘুরিয়ে বসে আসে। রাগ ভাঙাতে কিছু একটা করা দরকার। কিছুক্ষণ ভেবে একটা উপায় বের করে।

“গোল গোল চশমা চোখে,  গোস্বা গোস্বা ভাব  কে বলে কিউট তারে?  ভুতুম সেই জন”  কি থেকে কি বানিয়ে, কি যে বলল, অরণী নিজেও জানে না। তবে এতে তার কাজ হয়ে গিয়েছে। এমন উদ্ভট ছড়া শুনে হোহো করে হেসে দিয়েছে সৌভিক। অরণী মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে। ছেলেটা কত কিউট! মুখ ফিরিয়ে অরণীর দিকে তাকাতেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সৌভিক কিছু না বলে আস্তে করে অরণীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। আরো একটু নিচু হয়ে যায় মাথাটা, সেই সাথে চিবুক জুড়ে গোধূলির মত হালকা একটা লাল রেখাও ভেসে ওঠে।

এমন ভাবেই হাত ধরে দুজন চুপচাপ বসে আসে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা ঝড়ো বাতাসে অরণীর ভেজা চুল গুলো সৌভিকের মুখের উপর আছড়ে পড়ছে, সেই সাথে রাস্তার ধারে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে ছিড়ে যাওয়া ফুলগুলোও। ওদের রিক্সা আপন গতিতে সামনে এগিয়ে চলছে। আর পেছন ফেলে যাচ্ছে, কৃষ্ণচূড়া ফুলে ছেয়ে থাকা বৃষ্টিভেজা রাজপথ যা, কবিতায় লেখা বৈশাখের বৃষ্টি ছুঁয়ে যাওয়া এক ভালবাসার কথা বলে!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত