সোনাবন্ধু

সোনাবন্ধু

“আমি আবীর, তুমি চাইলে আমাকে স্যার ডাকতে পারো, আবার ভাইয়াও ডাকতে পারো। কি ডাকবে সেটা তোমার ইচ্ছা। আর হ্যাঁ, তোমার নামটা ভুলে গেছি। কি যেন বললে?” “ফারেহা সুলতানা মীম৷ আপনি চাইলে আমাকে সুলতানাও ডাকতে পারেন, মীমও ডাকতে পারেন। কি ডাকবেন সেটা আপনার ইচ্ছা।” একটু বিদ্রুপ করে স্যারের ভঙ্গিতেই বলে চুপ করে গেলাম। বেশি কথা বলার মানেই হয় না। একে তো অংক পড়াবে, তার উপর প্রথম দিন।

আমার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় হচ্ছে অংক। ক্যাডেট কলেজ থেকে অল্প কিছুদিনের জন্য বাসায় আসতাম, সেই অল্পদিনের মধ্যেও এসব টিচারের যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না। তবে নতুন অংক স্যারটা বেশ ভদ্র, কথা বলার চেয়ে বেশি হাসে। হোমওয়ার্কও অল্প অল্প দেয়।

আম্মা প্রতিদিনই স্যারকে যখন খাবার দিতেন, যা দিতেন তার সবটুকুই স্যার খেতেন। দেখে মনে হতো স্যার অনেক ক্ষুধার্ত। প্রায় প্রতিদিনই আমি অংকের মাঝে মাঝে খাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। খুব মায়া লাগতো!

প্রায়দিনই স্যার একটা নীল শার্ট পরে আসতেন, আর মাঝেমাঝে একটা পাঞ্জাবি। হালকা সবুজ রঙের। স্যারের কাছে পড়ছি প্রায় এক বছর হয়ে গেলো। এই দুটি জিনিস ছাড়া আর কিছুই পড়তে দেখিনি। একবার ঈদের আগে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম – “ঈদে কি কিনেছেন স্যার?” ” ঈদ কি বড় মানুষের নাকি! কেনাকাটা তোমাদের মত ছোটদের জন্য। আমার পাঞ্জাবি আছে। ওটাই পরবো।”

আমি হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে বললাম – “ওই যে সবুজ পাঞ্জাবিটা? ওটা আর কয়দিন পরবেন? ওইটা পরলে গাছের মত লাগে আপনাকে! কাঠবাদাম গাছের মতো।” “পাঞ্জাবিটা আমার খুব পছন্দের, তাই। বেশি কথা না বলে অংক করো।” চুপচাপ অংক করা শুরু করলাম। মনে মনে বললাম – “আপনাকে সবুজ পাঞ্জাবিতে খুব সুন্দর লাগে। খুব!” স্যারকে আমার প্রচন্ড রকম ভালো লাগে। তার কথা বলা, তাকানো, লাজুক ভঙ্গিতে হাসি সব কিছুই। মানুষটাকে দেখলেই কেমন জানি নার্ভাস লাগে ইদানীং। ভয়ও লাগে যদি কোনোভাবে বুঝে ফেলে মনে মনে উনাকে কতকিছু বলি!

আমি বড় হয়েছি একটা বাড়াবাড়ি ধরনের রক্ষনশীল পরিবারে৷ কোনো ছেলে বন্ধু দূরের কথা, কথাই হতো না কারো সাথে। নিজস্ব কোনো ফোন ছিলো না, ফেসবুক একাউন্টও না। আব্বা-আম্মা পড়াশোনার ব্যাপারে খুব বেশি সিরিয়াস। তাদের ইচ্ছা আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো।

আম্মা সবসময় সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন-নিয়ে আসতেন। আর সিক্সের পর থেকে তো ক্যাডেট কলেজেই। ছুটিতে আসলে স্যারের সাথেই বন্ধুর মতো কথা বলতাম। হিসাব করে বের করলাম স্যার আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। কিন্তু আমার সাথে যখন গল্প করেন মনে হয় একদম একই বয়সে বাস করছি আমরা!

একবার ছুটিতে যেয়ে শুনি স্যারের খুব জ্বর। টাইফয়েড হয়েছে তাই আমাকে পড়াতে পারবেন না। আমার এত খারাপ লাগলো! কোনোকিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। প্রচন্ড ছটফটানিতে দিন কাটাচ্ছিলাম। প্রতিবার ছুটিতে আসলে আর যেতে ইচ্ছা হয় না। আর এবার মনে হচ্ছে ছুটিটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক। আর নিতে পারছিলাম না। স্যারকে না দেখে থাকা আমার জন্য একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো। শেষমেষ একদিন আম্মাকে না বলেই কাঁদতে কাঁদতে স্যারের বাসায় চলে গেলাম।

যেয়ে দেখি স্যার ঘুমাচ্ছেন। স্বল্প আলোর স্যাঁতসেতে একটা ঘরে একাই থাকেন৷ হ্যাঙ্গারে সেই শার্ট আর সবুজ পাঞ্জাবি, এ দুটি জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই। বিছানার পাশে অর্ধেক খাওয়া মুড়ি আর গুড়।

জ্বরের তোপে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি স্যারের সামনে। চোখ দিয়ে ঝর্নার মতো পানি গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। আমি জানি না কেন কাঁদছি। কিন্তু এই মানুষটাকে আমার প্রচন্ড ভালো লাগে। হঠাৎ এক পা ভাঙা ধুলোয় মোড়ানো টেবিলে চোখ পড়লো৷ একটা কালো ডায়েরী। খুলবো কি না ভাবতে ভাবতেই খুলে ফেললাম! অর্ধেকের বেশিই লেখা।

ডায়েরীর প্রতিটা অক্ষরে আমি যতটা ভালোবাসা দেখেছি, এত ভালোবাসা কোনো গল্প-উপন্যাসেও দেখিনি। কিন্তু এতসব কার জন্য? হঠাৎ ভয় লাগা শুরু হলো। যদি অন্য কেউ হয়? মনে হচ্ছে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করি। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা জায়গায় চোখ আটকে গেলো – “মীম, তোমাকে বড় চুলে খুব সুন্দর লাগে। চুল কাটা আমার একদম পছন্দ নয়। আর কক্ষনো কাটবে না।” এতক্ষন মনে হচ্ছিলো কেউ গলা চেপে আছে, ডায়েরির এ পর্যায়ে এসে আমার মনে হচ্ছে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমাকে নিয়ে লেখা। অথচ এ মানুষটা কত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার সাথে ছিলো!  একদম শেষ পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেলো। বাঁকা বাঁকা অক্ষরে লিখা – “মীম, আমি জানি তুমি আসবে।” আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। নিঃশব্দে কাঁদলে কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা থেকে যায়।

স্যারেকে ধাক্কা দিয়ে বললাম- “আবীর, ওঠো, আমি এসেছি।” ভাঙা গলায় খুব আস্তে আস্তে বললাম। আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছি। পৃথিবীর সব ভালোবাসা হাতের মুঠোয় পাওয়া কি সম্ভব? স্যার খুব শান্ত ভঙ্গিতে ঘুম থেকে উঠে বসলেন৷ যেন আমি আসবো এটাই স্বাভাবিক। হাত চেপে ধরে চোখ মুছে দিয়ে বললেন – “বাসায় যাও মীম। পরে কথা হবে।”

আমার আম্মা প্রচন্ড চালাক প্রকৃতির মহিলা। চোখমুখ দেখেই সব বুঝে ফেলেন। সেদিনের পর থেকে আবীরের কাছে আমার পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার বাসায় গেলেই। তবে কথা বলতাম কলেজ থেকে, টিচারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে। ততদিনে আবীর আমার মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো বাসা বেঁধে ফেলেছে৷ আমার রক্তের মধ্যে যেন আবীর নামের প্রবাহ প্রবল বেগে ধেয়ে চলছে।

বিশাল মরুভূমির মধ্যে এক ফোঁটা পানি, কিংবা প্রচন্ড রোদে ছোট্ট একটা ছাউনির নাম ছিলো আবীর। প্রতি মুহুর্তে যেন আবীরের প্রতি ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার একটাই চাওয়া ছিলো, সেটা হচ্ছে আবীর।  আমাদের ধর্মে আছে, আজানের সময় আর বৃষ্টির সময়ের দোয়া বিফলে যায় না। ওকে পাওয়ার জন্য রোজা রাখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানত করা পর্যন্ত সবকিছু করেছি। যতভাবে চাওয়া যায়, আমি চেয়েছি।

এভাবেই আস্তে আস্তে চোখের পলকে তিনটা বছর কেটে গেলো। ততদিনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। মেডিকেল ভর্তি কোচিং শুরু করেছি। ওদিকে ত্রিশ পেরোনো আবীরের বাসা থেকে বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে। অনেকবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে আবীর, বিনিময়ে অপদস্থ হতে হয়েছে শুধু।

আমার বাবা-মা যে কোনোভাবেই যেন ছিনিয়ে নিয়ে আসবে আবীরের কাছ থেকে। কোথায় ক্যাডেট কলেজে পড়া, ভবিষ্যৎ ডাক্তার মেয়ে আর কোথায় একজন অংকের স্কুল শিক্ষক! কিন্তু বাবা-মাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না সুখে থাকা কতটা জরুরি। বাহ্যিকতা দিয়েই সুখ মাপা যায় না এ কথাটা বুঝতেই চাইছিলো না কেউ।

তবে এতকিছুর পরেও আমি নির্ভীক ছিলাম। বিশ্বাস ছিলো যে কোনো মূল্যেই হোক, আবীরের ঘরেই যাবো।
গল্পে সিনেমায় নায়িকার বিয়ে হয়ে যায়। বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। আবীর ছাড়া অন্য কাউকে আমি ভাবতেই পারি না! আবীর নামের বাক্সে বন্দি হয়ে আছি আমি, এখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব। দিন গেলো, আমিও মেডিকেলে ভর্তি হলাম। কোনো এক বসন্তের সকালে শুনলাম পরিবারের তুমুল চাপে আবীর বিয়ে করে ফেলছে। আমার বাবা-মাকে সফল করে দিয়ে আবীর অন্য কাউকে নিজের ঘরে তুলে নিলো৷

আমার কাছে মনে হলো বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না৷ সেদিনই আবীরের পছন্দে সযত্নে বড় করা কোমর সমান চুল নিজ হাতে ছেটে ছেলেদের মতো করেছি। এরপর থেকে প্রতিটা রাত কেটেছে ঘরের সিলিংয়ে তাকিয়ে, শেষ রাত পর্যন্ত আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতাম, আমাকে অংক করাচ্ছে আবীর। সবুজ পাঞ্জাবীটা পরে মুচকি হেসে লজ্জা পেয়ে বলছে – “বেশি কথা বলো না, অংক করো।” আমি অপেক্ষা করতাম, কিসের জন্য অপেক্ষা করতাম জানি না। বোধহয় অসম্ভব কিছুর জন্য! প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতাম বালিশ ভিজে আছে চোখের পানিতে। আমার কাছে মনে হতো সময় থেমে আছে। আবীরহীন জীবন যে আমার কাছে একদম মূল্যহীন! এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমিও বাবা-মার পছন্দমতো এক নামীদামী ডাক্তারকে বিয়ে করেছি।

গ্রীষ্মের এক দুপুরে একজন মা তার বাচ্চা নিয়ে চেম্বারে আসলো। বাচ্চার খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহা, খাওয়ার সাথে সাথে বমি করে বের করে দেয়। বাচ্চার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে মনে হলো আমি কোথায় যেন দেখেছি একে, খুব চেনা মুখ, গালের ভাঁজ, চোখ, জোড়া ভ্রু! মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম- “আপনি কি আগে এসেছিলেন আমার কাছে?” “না তো আপা। এবারই প্রথম!” “ও আচ্ছা! সারাদিন বাচ্চাদের নিয়ে মা-বাবা আসে। ওর মত বোধহয় কাউকে দেখেছি। আচ্ছা আমি প্রেসক্রিপশন দিচ্ছি। বাচ্চার নাম?” “আবরার।”  ‌ “বাবার নাম?” “আতিকুল ইসলাম আবীর।” কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো শরীর জমে বরফ হয়ে আছে। লিখতে যেয়ে দেখি আঙুল চলছে না। কত বছর পর আঁকাবাকা অক্ষরে আবার সেই নামটা লিখলাম, মনে করতে পারছি না! ইচ্ছা করেই ভদ্র মহিলাকে অনেকক্ষন সময় দিলাম। জীবনযাত্রা শুনলাম, স্বামী-সংসারের গল্প শুনলাম। বাচ্চার বাবা আগে অংকের মাস্টার ছিলেন, বিয়ের পর অংক পড়ানো ছেড়ে দিয়েছে। এখন ব্যবসা করে।

আমার স্পষ্ট চোখে ভাসছে কে যেন হাত চেপে বলছে – “বাসায় যাও মীম, পরে কথা হবে!” খুব কষ্ট হচ্ছে আমার, সেই ধারালো কষ্টটা যেন আবার ফালিফালি করে টুকরা করে ফেলছে আমাকে। ভদ্রমহিলাকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে দিলাম। দরজা পর্যন্ত যেয়ে আবার পেছন ফিরে বললেন – “আপা, আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। আরেকদিন আসবো। কিন্তু আসলে আপনার নামটা ভুলে গেছি…” কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম- “ফারেহা সুলতানা মীম। আপনি চাইলে সুলতানাও ডাকতে পারেন, আবার মীমও ডাকতে পারেন!”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত