তোমার প্রচন্ড ভালোবাসি

তোমার প্রচন্ড ভালোবাসি

একটা ছেলে দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে|মিরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে এমন ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে|ছেলেটার পরনে একটা কালো শার্ট|শার্টের হাতা কনুইয়ের উপরে উঠানো,বেশ যত্ন করে ভাঁজ করা|শার্টটা মিরার বেশ চেনা চেনা মনে হল কিন্তু ঠিক চিনতে পারল না|ও মনে করার বৃথা চেষ্টা করল কিছুক্ষণ|নাহ!মিরা চিনতে পারে নি|তবু কেমন যেন চেনাচেনা লাগতে থাকল ওর|মিরা ভাবতে পারে না আর। মাথা ভার হয়ে আসে|মাথার ভেতরে যেন জিম জিম করছে|

কেউ একজন শব্দ করে কাঁদছে যেন|মিরা চোখ ফিরিয়ে নিল এবার|মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে রাখল কিছু সময়!ঠিক তখনি একটা শব্দ পায় মিরা|চট করে সামনে তাকায়|ছেলেটা ডাকছে ওকে|নাম ধরে ডাকছে|মিরা অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করল যে ছেলেটা মিরাকে জানে কিন্তু মিরা তাকে জানে না|অবাক কান্ড! এটা কিভাবে সম্ভব?মিরার মাথা ভার হয়ে আসে আবারো|মিটমিট করে প্রথমবারের মত ছেলেটার চোখে চোখ রাখে ও|চমকে উঠে এবার|ছেলেটার চোখ দুটো যেন চোখ নয়|গভীর ঘনত্বের কোন সাগর|যেখানে কষ্ট গুলো দলা ধরে এপাশ ওপাশ দৌড়ে বেড়ায়|অদ্ভুত শূণ্যতা বিরাজ করে সেথায়|ছেলেটার এত কষ্ট কিসে?মিরা জানে না|জানতে চাইবে কি?

মিরা দু’এক পাঁ সামনে এগোয়|আরেকটু সামন এগুতেই লক্ষ্য করল যে ছেলেটা কান্না করছে|লাল হয়ে থাকা চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঝরে|লাল রঙের আগুন|ছেলেটা শব্দ করে কাঁদে|প্রতিটি শব্দ যেন এক গুচ্ছ বেদনায় ভরা !মিরা বেশ মনযোগ দিয়ে কান্নার শব্দ শুনে|প্রতিটি শব্দ একটা তিক্ষ্ণ তিরের মত মিরার হৃদয় ছেদ করে|কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠে মিরার হূদয়ে|প্রচন্ড রকমে নীল কষ্টে ভোগে মিরা|চোখে জল জমে|খানিকটা গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে|মিরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে কান্না করতে থাকা ছেলেটাকে ও চিনে|বেশ ভালো করেই চিনে|তাসফি! এটা তো তাসফি! কিন্তু ও এখানে কি করছে|আজানা ভয়ে মিরার বুকে কেঁপে উঠে|বাঁপাশের ধপ ধপ শব্দটার মাত্রা বৃদ্ধি পায় চরম ভাবে|মিরা চিৎকার দিয়ে উঠে এবার|বলে,

-তাসফি তুমি এখানে কেন? এখানে কিভাবে এলে?

তাসফি কিছু বলতে চায়|কিন্তু বলতে পারে না|গলা দিয়ে শব্দ আসে না|দম বন্ধ হয়ে আসে ওর|নিজের গালা চেপে ধরে তাসফি|খুব চেষ্টা করে একবার ভালোবাসি বলার|বলতে পারে না|চিৎকার দেয় খুব জোরে|চিৎকারের সাথে সাথে মুখ দিয়ে দলা ধরা কষ্ট যুক্ত রক্ত বের হয়|তারপর নাক দিয়ে|শেষে চোখের কোনা বেয়ে লাল রাঙা রক্ত গাল বেয়ে পড়ে|তাসফির ফর্সা মুখটা মুহুর্তেই লাল হয়ে যায়|মিরার বুকের বাঁপাশের ধপ ধপ শব্দের মাত্রা বাড়ে|তাসফির এমন অবস্থা দেখে তাসফির নাম ধরে চিৎকার দেয় বেশ জোরে|সাথে সাথে ঘুম ভাঙ্গে ওর|বিছানায় উঠে বসে|কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওর|বিছানার পাশে গ্লাশে থাকা পানি এক ঢোকে গিলে ফেলে |বুকের বাঁপাশের উত্তেজিত হয়ে থাকা ধপ ধপ শব্দটা এখনো যায় নি|মিরা স্থির হতে পারছে না|ক’দিন ধরে একই স্বপ্ন বারবার দেখছে ও|ভীষণ ভয় লাগে ওর|তাসফিকে হারানোর ভয় আঁকড়ে ধরে ওকে প্রচন্ড ভাবে|বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নেয় খুব জলদি|ডায়াল কলে গিয়ে তাসফির নামের উপর ক্লিক করে|প্রথম বার রিং হয়|কিন্তু ফোন ধরে না কেউ|মিরা আবার কল দেয়|কিছু সময় পর ওপাশ থেকে খট করে কল ধরার আওয়াজ পাওয়া যায়|ওপাশ থেকে খানিকটা বিরক্ত ভাব নিয়ে তাসফি বলে,

-কি ব্যাপার মিরু?এখন আবার ফোন দিলে যে? মিরা খানিকটা স্বস্তি ফিরে পায়।একটা ভারি থেকে হালকা হওয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও|এতক্ষণ ভারি একটা পাথর যেন চাপা পড়ে ছিল বুকে|তাই বুকটা বেশ ভারি লাগছিল|এখন খানিকটা হালকা লাগছে|মিরা বলে,

-ঘুমোচ্ছিলে? তাসফি যেন আরেকটু বিরক্ত হয়|বলে,
-রাত কয়টা বাজে দেখছো? মিরা নিজের ফোনের স্ক্রিনে তাকায়|বলে,
-তিনটা বেজে বেয়াল্লিশ মিনিট হয়েছে|
-এত রাতে একজন মানুষকে ফোন দিয়ে কি বলা উচিৎ যে সে ঘুমোচ্ছিল কি না? মিরা অনেকটা সময় চুপ করে থাকে|কিছু বলে না|ওপাশ থেকে তাসফি বলে,

-কি ব্যাপার!কথা বলছো না কেন? মিরা এবারেও কিছু বলে না|ফোন কানের পাশে রাখে|বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় |বারান্দার দিকে এগোয়|বাইরে জোৎস্নায় ভরা।বারান্দার গ্রীল ভেদ করে একঝাক জোৎস্না হুড়মুড়ি খেয়ে ভেতরে ঢুকে স্বচ্ছ টাইলস করা মেজেতে লেপ্টে থাকে|মিরা গ্রিল ধরে দাঁড়ায় কিছু সময়|ও আসতেই মৃদু বাতাস ওকে জড়িয়ে ধরে|মিরা অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করল যে ওর ভয় লাগছে না আর|বেশ ভালো লাগছে|ওপাশ থেকে কিছু সময় বিরতি নিয়ে তাসফি বলে,

-মিরু তুমি ঠিক আছো?
-হু!বেশ আছি|
-তাহলে এখন আবার ফোন দিলে যে?
-ভুল করেছি?
-না|তা করবে কেন|আসলে তোমার সাথে কথা হয়েছে যে ঘন্টা দুয়েক হবে|তাই এখন আবার ফোন দেওয়াতে বেশ আবাক হলাম|তুমি ঘুমাও নি?
-হু|ঘুমিয়েছিলাম|কিন্তু…
-কিন্তু কি?

মিরা কিছু বলে না|চুপ করে থাকে|স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগা আঁকড়ে ধরে ওকে|মিরার চোখে জল জমতে থাকে খুব জলদি|অনেকটা সময় চুপ থেকে তাসফি বলে,

-আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছো? মিরার গলা ভিজে আসে এবার|চোখের কোনা বেয়ে পানি পড়তে থাকে|বলে,

-হু!
-মিরু তুমি কি কান্না করছো?একদম কাঁদবে না বলে দিলাম| মিরা কান্না করতে থাকে|শব্দ করে কাঁদে এবার|তাসফির খারাপ লাগে ভীষণ|আর যাই হোক ও মিরার কান্না সহ্য করতে পারে না|একদমই পারে না|তাসফি কড়া স্বরে বলে,

-এই মিরু!তোমাকে কান্না করতে নিষেধ করেছি কিন্তু|একদমই কান্না করবে না|তা না হলে ফোন কেঁটে দিবো|ফোন কেটে দেই? ওপাশ থেকে মিরার কান্নার শব্দ আসে না আর|মিরা চুপ হয়ে যায়|কিছু সময় পর বলে,

-ফোন কাটবা না|আমি কান্না থামিয়েছি|শুয়ে আছো এখনো?
-হু|
-উঠে বারান্দায় যাও|
-এখন?
-হু|এখুনি|উঠেছো?
-এই যে উঠলাম|বারান্দায় যাচ্ছি|
-দেখো! কি সুন্দর চাঁদের আলো!
-মিরু তোমাকে একটা বলি?
-আমি জানি তুমি কি বলবে?
-তা ম্যাম বলেন তো আমি কি বলবো?
-স্যার, আপনি এই মুহুর্তে বলবেন সে চাঁদের আলো মোটেও সুন্দর না।এর চেয়ে আমার মিরু অনেক সুন্দর! আমি ঠিক বলি নি?
-তা বলেছ বটে।কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
-এর আগেও এমন মুহুর্তে তুমি ঠিক এই কথাই বলেছ।আর তোমাকে আমি মুখোস্ত করা হয়ে গিয়েছে আমার।তোমার অন্তর আত্মাকে পড়ার ক্ষমতা রাখি আমি।তুমি কি জানো না সেটা?

:তা তো বেশ জানি।আচ্ছা এই মুহুর্তে কি তোমার মন ভালো হয়েছে!
:শুনো!

তোমার সাথে কথা বললে আমার মন এমনিতেই ভালো থাকে।জোর করে ভালো থাকতে হয়।কিন্তু একাকিত্বে আমাকে জোর করে ভালো থাকতে হয়।জানো,আমি তখন মোটেও ভালো থাকি না।ওই স্বপ্ন তখনো আমার পিছু ছাড়ে না।আঁকড়ে ধরে থাকে আমায়।কষ্ট দেয় ভীষণ।তাসফি তুমি সত্যি করে বল,তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না।কখনো যাবে না! বল তাসফি!

-আচ্ছা বলছি।শুনো মেয়ে, এই আমি তোমাকে ছেড়ে কখনই কোথাও যাব না।যাবই না।তোমাকে বিয়ে করে বউ বানিয়ে দুজনে বুড়ো-বুড়ি হবো।আমাদের রাত জাগা স্বপ্ন গুলো পূরণ করব।ঠিক আছে মিরু!

-না ঠিক নেই।তুমি চলে যাবা।আমি জানি।ওয়েট, এই জোৎস্না ছুঁয়ে বল কখনই আমায় ছেড়ে যাবে না।কখনই না।
-এই ছুঁয়ে বললাম, যাব না।যাব না।যাব না।মিরু তুমি এবার খুশি হয়েছো!
-হ্যাঁ ! খুশি হয়েছি।
-মেয়ে,তুমি আমাকে এত ভালোবাস কেন?
-তুমি এত ভালোবাস বলে।
-হা! বুঝেছি।তা মহারানি, এবার কি ঘুমাবে?
-তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমাবো।
-আচ্ছা! তাহলে একটু কল্পনা কর।আমাকে তোমার পাশে পাবে।মিরু চোখ বন্ধ করেছো।
-হ্যাঁ! করেছি।

কিছু সময় কোন কথা হয় না।চুপচাপ,বেশ নিরাবতায় কাটে।তারপর মিরু আস্তে আস্তে চোখ খোলে।পাশে তাকাতেই দেখে তাসফি ওর পাশে বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা মেলে বসে আছে।মিরু হঠাৎই ভীষণ খুশি হয়। খুশিতে জড়িয়ে ধরে তাসফি কে।একেবারে লেপ্টে যায় ওর বুকের সাথে।তারপর হুট করে কান্না শুরু করে দেয়।তাসফি বেশ রেগে যায়।বলে,

-মিরু, এমন জানলে আমি আসতাম না।তুমি কান্না করবা না প্লিজ।আমার সহ্য হচ্ছে না।মিরু! প্লিজ।কেঁদো না আমি কিন্তু চলে যাব।
-না।তুমি যাবা না।আমি কাঁদব না আর।এই দেখো! আমি আর কাঁদছি না।
-এবার একটু হাসবে! তোমার হাসিটা অনেক দিন দেখি না।

মিরু চোখে জল নিয়ে মৃদু হাসে।চোখে জল নিয়ে হাসতে থাকা মানুষ গুলোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। মিরু কে সুন্দর লাগছে।শুভ্র জোৎস্না ওর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।মিরা তাসফির বুকের সাথে লেপ্টে আছে।এক হাতে জড়িয়ে আছে ওকে।অন্য হাত দিয়ে তাসফির এক হাত বেশ ভালো ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে।তাসফি অন্য হাত দিয়ে মিরার চুলে বিলি কেটে দেয়।পরম মায়ায় হাত বুলিয়ে দেয়।মিরা বড্ড তৃপ্তি পায়।বেশ ভালো লাগে ওর।ও বেশ তৃপ্ত ভাবে নিজের দু’চোখ বুঝল।মিরার চোখে ঘুম ধরে খুব জলদি।একরাশ আনন্দ নিয়ে মিরা ঘুমিয়ে পড়ে।তাসফি ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে।হাত বুলাতে বুলাতে তাসফির চোখে জল জমে।গাল বেয়ে পড়তে থাকে।সে মাথা ঠেকায় দেয়ালের সাথে।বেশ সাবধানে! বুকে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।

তার ঘুম ভাংগানোর কোন ইচ্ছে তাসফির নেই।সে বসে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে কবিতা বলে ও।জামাল সাহেবের বিল্ডিংটার চতুর্থ তলার বাঁ পাশের প্ল্যাটের ডানদিকের রুমটার পশ্চিমের বারান্দা থেকে কারো মৃদু শব্দে কবিতা বলার আওয়াজ পাওয়া যায়।কিন্তু আপসুস! কেউ সেই কবিতা শুনতে পায় না।মিরাও না।তবুও সে কবিতা গেয়ে যায়। “তোমাতে পেয়েছি শান্তি তোমাতে পেলাম আজ যত ক্লান্তি। এত মায়া দিলে এত ভালোবাসা দিলে এত অবহেলা দিলে কি অপরূপ বন্ধন গড়লে আজ যত কষ্ট পেয়ে ছুটে আসি আমি তোর ডাকে বড্ড ভালোবাসি বলে। মিরার ঘুম ভাঙ্গে বেলা দশটায়।ঘুম ভাঙ্গার পর নিজেকে আবিষ্কার করে ফ্লোরে।একা একা শুয়ে আছে ফ্লোরে।মিরা উঠে বসেই বিড় বিড় করতে থাকে।

-ছেলেটা চলে গিয়েছে।আবার চলে গিয়েছে।আজ দেখা হোক।দেখাবো মজা ওকে। বিড়বিড় করতে থাকে ও।পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে চট করেই ফোন দেয় ওকে।বেশ কয়েকবার ফোন দেয়।বেশ কিছু সময় পর তাসফি ফোন ধরে।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,

-শুভ সকাল!
-শুভ সকাল সে কখন হয়ে গিয়েছে। এখন উঠ।দেখা করব।
-দেখ মেয়ে, এত ঘন ঘন দেখা…
-আমি বলার পর সেখানে আর দু কথা হবে না।যা বলেছি তাই। আসতে বলেছি আসবে।রাখি।

মিরা চট করেই ফোন রেখে দেয়।তারপর মৃদু হাসে সে।মুখে হাত দিয়ে হাসে।যাক। ছেলেটাকে একটু ভড়কে দেয়া গিয়েছে। তাসফিকে হতভম্ব করতে পেরে মিরার ভীষণ আনন্দ লাগছে।এর পূর্বেও এমন হয়েছিল।ওকে কেউ ভড়কে দিলে ওর চেহারার স্টাইল পাল্টে যায়।তখন দেখতে বেশ মায়া লাগে।মিরার আনন্দের সাথে সাথে খানিকটা আপসুসও লাগছে।ইস! যদি ওর চেহারাটা দেখা যেত! নাস্তার টেবিলে মিরাকে দেখে বেশ অবাক হল ওর মা বাবা।ছোট ভাইটাও বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মিরা ঠিক বুঝতে পারছে না এরা এত অবাক হচ্চে কে।এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন ও এই প্রথম নাস্তার টেবিলে খেতে বসেছে।মিরা ভ্রু কুছকে বলল,

-কি ব্যাপার! তোমার সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে কি দেখতে খারাপ লাগছে?
মিরার মা চট করেই বলে উঠল,

-না না মা। এমন হবে কেন? তোকে তো বেশ দারুন লাগছে। আজ অন্য রকম লাগছে! এত সেজেছিস কেন?
মিরা বেশ মজা পেল। ওকে ভালো লাগছি।মিরার টেনশন হতে লাগল যে তাসফি ওকে দেখে কি ভাববে! কি বলবে! ওর কি পছন্দ হবে? অনেকটা সময় চুপ থেকে ও বলল,

– তাসফির সাথে দেখা কিরতে যাবো মা।ওর সাথে অনেক দিন দেখা হয় না। এই বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং হন হন করে চলে গেল।মিরার বাবা চুপচাপই থাকলেন।কিছু বললেন না।তবে মিরার মায়ের উজ্জ্বল চেহারাটা চট করেই কালো হয়ে গেল।মেয়েটা এখনো ছেলেটাকে ভুলতে পারর নি।
মিরার বাবা পাশ থেকে বললেন,

-আমার মোবাইলটা দাও তো। সিমুলকে একটু ফোন করব। মিরার মা কিছু বললেন না।মুখটা কালো করেই চলে গেলেন ফোন আনতে। সিমুল হল সদ্য ডাক্তারি পাশ করা একটা ছেলে।একজন ভালো সাইকোলজিস্ট। মানুষিক রোগের চিকিৎসা করে ও।মিরার ট্রিটমেন্টটা ও নিজেই করছে। মিরার মা ফোন এনে জামাল সাহেবকে দেন।উনি সিমুলকে ফোন দেন।

সিমুল অনেক্ষণ মেয়েটাকে দেখল।মেয়েটা কথা বলছে কারো সাথে।দুহাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।তবে কার সাথে কথা বলছে এটা বুঝতে পারছে না সিমুল।যেদিকে তাকিয়ে কথা বলছে সে দিকটা একেবারেই ফাঁকা।মিরা ঘাসের উপর বসে আছে।ওর ঠিক উল্টো দিকে ক হাত দূরে একটা বেঞ্চি আছে।সেখানে মিরার কালো রঙের ভ্যানিটিব্যাগ ব্যাগটা দেখা যাচ্ছে।সেটা কাত হয়ে পড়ে আছে।ব্যাগের মুখ গলে খয়েরি রঙের একটা ডায়েরির কোনা বের হয়ে আছে।সিমুল এগিয়ে গেল।খুব সাবধানে ডায়েরিটা নিল।

প্রথম অনেক গুলো পেজ ফাঁকা।একশ নব্বই এর পর একশ একানব্বই পেজটা উল্টানোরর শক্তি পেল না সিমুল।সে চট করেই বইটা বন্ধ করে দিল।ছোট একটা অসমাপ্ত গল্প।সেখানে অনেক গুলো কষ্ট মিসে আছে প্রতিটা শব্দের সাথে। সিমুল গল্পটা এর আগেও পড়ছে এবং পড়ে সে নিজেও ঠিক থাকতে পারল না।ওর চোখে সেদিনও জ্বল জমেছে।আজও জমেছে।সিমুল চোখের চসমা খুলল।নিজের চোখ মুছল। ঠিক তখনই চোখের সামনে একটা তারিখ ভেসে উঠল। তেইশে অক্টোবর দুহাজার আঠারো। তারিখটা বেশ জঘন্য।এটা মনে করতে চায় নি ও।তবুও মনে পড়ে গিয়েছে।সিমুল তারিখটা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারল না।আর কখনই হয়ত পারবে না।সিমুল ডায়েরিটা বন্ধ করে বসে থাকল।ওর পিছনে মিরা অদৃশ্য কারো সাথে বকবক করে যাচ্ছে।নানান কথা বলছে।অদৃশ্য মানুষটাকে শাসাচ্ছে।সিমুল বোকার মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে কেবল।এত ভালোবাসে বাসে কিভাবে?

ডায়েরির গল্পঃ ২৩ শে অক্টোবর ২০১৮ রাত সাড়ে বারোটা। ডায়েরি লিখার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিল না।কখনো লিখিও নি।এই অভ্যাসটা তাসফির ছিল।ওর সকল কথা ও নিজের একটা ডায়েরিতে লিখে রাখত।এটা আমার তখন বেশ বিরক্ত লাগত।এখন লাগছে না।আমি আজ ডায়েরি লিখছি ওর জন্যেই। আজ লিখার একটা কারণ আছে।ছোট করে একটা বড় গল্প লিখব।লিখছি।

তাসফির সাথে আমার দীর্ঘ দু বছর প্রেম ছিল।তারপরেই আমি ওর প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হই।ওর লেখা-লেখির প্রতি একটা জোক ছিল।প্রবল আগ্রহ নিয়ে ও নিজের লেখা-লেখি চালাচ্ছিল।এতে আমি বিরক্ত হই ভীষণ।এত কাব্যিকাতা আমার পছন্দ নয়।সেদিন ওকে ঢেকে পাঠলাম।সিরিয়াস কিছু কথা শোনাতে হবে ওকে।আমি নিজেকে প্রস্তুস করি।কড়া কথা শুনাবো ওকে।কিন্তু আমি যতই সিরিয়াস হতে যাই ততই যেন দূর্বল হয়ে যাই।ছেলেটার চোখের দিকে তাকালেই আমি যেন নাই হয়ে যায়।ভেতরের সব কথা গুলিয়ে যায়।আমি তবুও যাই।সিরিয়াস ভঙ্গিতে সিরিয়াস কিছু কথা বলি।ছেলেটাকে আঘাত পায় ভীষণ।আমার কাছ থেকে এমন কথা শুনবে এমনটা আসা করে নি নিশ্চই।আমি কড়া স্বরে বলি,

-হয় লেখা-লেখি নয়ত আমি।কোনটা তোমার চয়েজ।এটাই প্রমাণ করবে তুমি আমায় কতটা ভালোবাস।
ছেলেটা মাথা নিচু করে থাকে অনেক্ষন।তারপর চট করেই আমার দিকে তাকায়।ও তাকাতেই আমার ভেতরের সব যেন গুলিয়ে যায়।ওর চোখের জ্বল আমার সহ্য হয় না।মোটেও না।আমি নিজেকে কন্ট্রলে রাখার চেষ্টা করি।ও ভেজা গলায় বলে,

-মিরু তুমি আমার গল্পের প্রাণ। আমার কবিতার ছন্দ তুমি।তোমাকে ছাড়া আমার এসব লেখা-লেখি বৃথা।
এই বলে হুট করেই ও আমার হাত ধরে। বলে, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।সত্যিই বাঁচাবো না।তুমিই আমার সব।প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না।আমি তোমার প্রচন্ড ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া আমার থাকাটা একেবারে অসম্ভব।

আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম।ভীষণ কষ্ট নিয়ে কথা গুলো বলছে ও।ওকে দেখে আমার মায়া হল ভীষণ।কি করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সেদিন পুরোটা সময় আমার হাত চেপে ধরেছিল ও।একটা কথাও বলে নি।চুপ হয়ে ছিল।সেদিনের পর থেকে তাসফি চুপ হয়ে যায়।একটা কথাও বলে না।যা বলার আমি বলি।তাসফি নিজেকে আঁটকে রাখার চেষ্টা করেছে অনেক।এটা ওকে দেখলেই বুঝা যেত।শেষমেশ পারে নি।লেখা-লেখি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে পারে নি যার কারনে আমাকে ছাড়তে হয়েছে।ছেড়ে দেয় নি ও।আমি ছেড়ে দিয়েছি।অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগের। আমি পথ খোলা রাখি নি। রাতবিরেত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত।কথা তো দূরে থাক।তাকিয়েই চাই নি।বারান্দায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।বিছানার পাশের জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছি।কয়েকদিনের জন্যে তাসফি নামক শব্দটাকে চারদিক থেকে ঘিরে বন্ধ করে অন্ধকারে ফেলে দিয়েছি।তারপরের কিছু দিন আর ওকে দেখি নি।

ও আসে নি।ক’দিন দেখি না ওকে। আমার অস্বস্তি শুরু হয়।অস্থির হতে থাকি।অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করি যে এই ছেলেটাকে আমি এক মূহুর্ত না দেখে থাকতে পারছি না।দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।বিছানার পাশের জানালা খুলে দেই। বারান্দায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকি ওর জন্যে। ওকে এক নজর দেখব বলে।দেখি না ওকে।হন্ন হয়ে খুজতে বেরই।খুঁজতে খুঁজতে পাগল প্রায়।কি আশ্চর্য! ওকে সেদিন আমিই তাড়িয়েছিলাম।আর আজ খুঁজতে বের হয়েছি।অদ্ভুত এই জিবন।টানা বাইশ দিন ওকে দেখি নি।আমার অবস্থা পাগল প্রায়।কথা হয় না ওর সাথে।দেখা হয় না।যে মানুষটার সাথে আগে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হত আজ তার দেখাই পাচ্ছি না।এই ব্যাথা সওয়ার মত না।আমি ওকে প্রচন্ড ভাবে মিস করতে থাকি।বারবার নিজেকে নিজেই গালি দেই।নিজের জেদের কারনেই আজ ওকে হারাতে বসেছি।

হারিয়ে ফেলেছি ওকে! ভাবতে পারি না আর। কষ্ট হয়। চোখে জল নামে।বালিশে মুখ লুকাই।ছেলেটা কখন যে আমার ভেতরে প্রবেশ করে ফেলেছে সেটা ঠিক আমি টেরই পাই নি।আজ তার শুন্যতা আমাকে জানান দিচ্ছে যে আমি তাকে কত ভালোবাসি।আমার কতটা জুড়ে তার রাজ সেটা টের পাই আমি। ওকে যে করেই হোক আমার চাই।তা না হলে আমার বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে।আমার কেবল মনে হতে থাকল আমি মারা যাবো।তাসফির সাথে দেখা না হলে আমার দম বন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো।আমি ওকে ফোন দেই।বার বার ফোন দিতে থাকি।ভাগ্য বোধহয় সহায় ছিল। বারবার ফোন দেওয়াতে হঠাৎই একবার ফোন ঢুকে গেল।তারপর খট করে রিসিবের আওয়াজ।ও পাশ থেকে তাসফি বলে,

-হ্যালো! কেমন আছো! সরি তোমাকে বলে আসতে পারি নি।গ্রামে এসেছি অনেকদিন হল।এদিকে একটা দূর্ঘটনা ঘটে যায়।হুট করেই আমার দাদু মারা যায়।তাই গ্রামে আসতে হয়। আসার পথে বাস থেকে ফোনটা চুরি হয়।তাই সিম উঠিয়ে,ফোন কিনতে বেশ সময় লেগে যায়।এদিকে দাদুর মারা যাওয়ায় বেশ আপসেটও হয়ে পড়ি।তাই খোঁজ নিতে পারি নি। কেমন আছো তুমি? আমি অবাক হই ভীষণ।মানুষটা একটু রাগ করে নি।খানিকটা অভিমানও না।নিজের উপর ধিক্কার জাগে আমার।ফোনের ওপাশের মানুষটার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি কান্না করতে থাকি।ভীষণ কাঁদি।ওপাশ থেকে ছেলেটা ঝাড়ি দিয়ে বলে,

-কাঁদবা না একদম। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না।কান্না করলে কিন্তু ফোন কেটে দিব। আমি কান্না করতে করতে বলি,
-সরি। আমি সত্যিই খুব সরি।ক্ষমা করে দাও প্লিজ। প্লিজ। এই বলে কান্না কান্না করতে থাকি।ওপাশ থেকে বলে,
-আমি জানতাম। তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।মোটেও পারবে না। আমি কান্না করতে করতে বলি,
-জলদি আসো।তোমাকে দেখতে হবে আমার।অনেক দিন দেখি না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।তুমি আসতেই সর্ব প্রথম তোমাকে জড়িয়ে ধরব।আমাকে বাধা দিতে পারবে না।জলদি আসো প্লিজ।

-কাল সকালেই রওনা দিব।হাতে টিকিট আছে।তুমি কেবল অপেক্ষা কর কিছু মূহুর্ত। এসেই তোমার মুখ দেখতে চাই বুঝেছো পাগলি।
-জলদি আসো।আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া।এতদিন আমায় ভুলে থেকেছো কিভাবে? খারাপ লাগে নি?
-তোমাকে আমার ডায়েরিটা দেখাবো।ওটা দেখলেই বুঝবে কত কষ্টে ছিলাম। শুনো।একটা কাজ কর।তোমার ডায়েরি আছে?
-থাকলেও আমি ডায়েরি-মায়েরি লিখতে পারবো না।
-কেন?
-অসহ্য লাগে।
-উঁহু! তা বললে হবে না।

শুনো।তোমার এই কয়েকদিনের অনুভূতি গুলো সুন্দর করে ডায়েরিতে লিখে ফেল।আমি আসলে তোমারটা পড়ব আর তুমি আমারটা।তারপর বুঝব কে বেশি কষ্ট পেয়েছে।ঠিক আছে? এই হচ্ছে আমার আজকের ডায়েরিটা লিখার কারন। কেবল ওরর জন্যে লিখছি কথা গুলো।ওকে দেখাবো বলে। প্রিয় তাসু,তোমার অপেক্ষায় রইলাম আমি।জানি না আজ রাতে ঘুম হবে কি না।হোক বা না হোক তোমার অপেক্ষায় আমি থাকলাম।আছি,থাকবো।পাগল তোকে ছাড়া মন টিকে না রে।

– মিরু

এতটুকু লিখা আছে ডায়েরিটাতে। আর লিখা নেই।লিখা না থাকলেও বাকিটা জানা আছে সিমুলের।সেটুকুই বেশ কষ্ট দেয় সিমুলকে। একটা জ্যান্ত প্রান কিভাবে এভাবে চলে যেতে পারে বিশ্বাস হয় না ওর।মনে পড়তেই ডুকরে কান্না আসে ।একজনকে এতটা ভালোবেসে কেউ যদি এভাবে মাজ পথে অপর সাথিকে একা ফেলে চলে যায় তাহলে সেটা কেউ সহ্য করতে পারবে না।মিরা তো নাই।সহ্য করতে না পারার কারনে আজ এ অবস্থা ওর।সেদিন তাসফি ঠিকই ফিরে আসে।তবে সেটা জ্যান্ত লাশ হয়ে।তাসফি মারা যায়।আসার পথে বাস এক্সিডেন্ট হয়।হাসপাতালে বারো দিন বাঁচার যুদ্ধ করে শেষে অতৃপ্তিকর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই কঠোর পৃথিবি হতে বিদায় নেয়।তাসফির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে নি মিরু।মানসিকভাবে অনেক প্রেশার পড়ে ওর উপর। যার ফলে এ অবস্থা। সিমুল আবার পিছন ফিরে মিরুকে দেখে।সে বকবক করেই চলছে।খুব কথা বলছে।এমনভাবে কথা বলছে যেন ওর সামনে কেউ বসে আছে।ওর বকবক শুনছে।

ওখানে কেউ নেই। ওটা মিরুর কল্পনা। নিজের কল্পনায় ও তাসফিকে তৈরি করছে এবং তার সাথে সারাদিন কথা বলে বেড়াচ্ছে।ওর ফোনে সিম নেই।তবুও ফোন কানে দিয়ে তাসফির সাথে কথা বলে যাচ্ছে।এমন পরিবেশ ও নিজেই তৈরি করছে।ও ভাবছে ও তাসফির সাথে কথা বলছে।কিন্তু আসলেই তা না।ও ওর কল্পনাতেই ভেসে বেড়াচ্ছে।কল্পনাতেই তাসফির সাথে কথা বলছে।সিমুল উঠে ওর দিকে এগিয়ে গেল।ওর পাশে বসতেই ও বলল,

-আরে, ডাক্তার বাবু যে।কেমন আছেন? সিমুল কথা বলে না।মৃদু হেসে মিরার দিকে তাকায়।মিরা আবার বলে,

-ও হ্যাঁ।পরিচয় করিয়ে দেই।তাসফি এ হচ্ছে ডাক্তার সিমুল।অনেক ভালো মানুষ। আর ডাক্তার বাবু এই হল তাসফি। আমার পৃথিবী।

সিমুল মাথা নিচু করে রাখল অনেকটা সময়।ভয় পাচ্ছে সে।সামনে তাকাচ্ছে না।তাকালেই দেখবে কেউ একজন বসে আছে। চোখে রাজ্যের বিষন্নতা নিয়ে।বা চোখে জল দেখবে।সিমুল তাকাবে না।মাথা নিচু করে রাখল।তারপরেই আস্তে আস্তে মাথা উপরে উঠাতে থাকল।হুট করেই সামনে তাকাল ও।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত