মিহিনঃ বারান্দায় বসে আছি। মেজেতে। কয়টা বাজে সেটা আমার জানা নেই। অনুমানও করতে পারছি না। আমার অনুমান শক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। আরো অনেক কিছুই লোপ পেয়েছে এ কদিনে। খেতে পারি না ঠিক মতো। গলা দিয়ে খাওয়া নামে না। ঘুম আসে না। ভোর বেলা যা ঘুম হয়। আটটা কি নয়টা বাজে আবার উঠে যাই। কিছু একটার তাড়না আমাকে জাগিয়ে তোলে। ঘুমাতে দেয় না। আমি ঘুম থেকে উঠি। বিছানা গোছাই স্বাভাবিক ভাবে। বাঁ’দিকের বালিশটা ধরলেই আমার কান্না চলে আসে। আমি বালিশ জড়িয়ে ভীষণ কান্না করি। চিৎকার দেই। কেউ শোনে না আমার চিৎকার। দিন যায় বড় অবহেলায়। অবচেতনে। একাকিত্বে। যেমনটা আমি করেছিলাম কেউ একজনকে। অবহেলা। একাকিত্বে ছেড়ে নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করেছিলাম। যে ছিল আমার সুখ। আমার দুঃখ। আমার গোপন। আমার অবচেনতেনের কারণ।
যার কারণে আজ এই পৃথিবী আমাকে অবহেলা করছে। একাকিত্বে ভোগাচ্ছে। আমি যে ভোগকে মেনে নিয়েছি নিজের শাস্তি হিসেবে। কেবল মানুষটিকে দেওয়া একটি কথা আমি রাখতে পারিনি। এ নিয়ে বড় আক্ষেপ আমার। সে খুব চাইত, আমি সুখে থাকি। ভালো থাকি। যার জন্যে আমাকে সে ছেড়ে যায়। একটু ভুল বোঝাবুঝি। অনেকখানি জমাট বাঁধা কষ্ট। যেটা তাকে ভোগায়। আমাকেও ভোগায়। আমি সুখে থাকতে পারি না। সুখ আসে না। কারণ সে তো জানে না আমার সুখ তার কাছেই। সে-ই আমার আনন্দ। আমার বেদনা। আমার দিনের আলো। আমার সুখতারা। আমার পৃথিবী। তার নাম সাকের আহমেদ তাসফি। আমি তার স্ত্রী। আমার নাম মিহিন। মিহিন চৌধুরী। হ্যাঁ এই গল্পটি আমার। আমার গল্প। আমাদের গল্প।
বারান্দায় রোদ পড়ছে। কড়া রোদ। আমি রোদ থেকে খানিক দূরে বসে আছি। ডায়েরি পড়ছি। নীল রঙের একটি গোপন ডায়েরি। যেটা সে নীরা নামক কেউ একজনকে দিয়ে যেতে বলে। আজ তিনদিন হলো। কেউ আসেনি। আমি একা একা বসে ছিলাম। ডায়েরিটা পাশেই ছিল। কি জানি ভেবে ডায়েরিটা হাতে নেই।প্রথম পেইজ উল্টাতেই আমাকে চমকাতে হলো। আমার নাম লেখা সেখানে। প্রথম পৃষ্ঠার পুরোটাতেই সে আমার নাম লিখে রেখেছে। আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। আমার আর তার খুনসুটিতে ভরা রঙিন দিন গুলোর কথা সেখানে লিখা ছিল। ভার্সিটি লাইফের প্রতিটি মূহুর্তের কথা সেখানে লিখে রেখেছে। যেগুলোর অনেকটাই আমি ভুলে গিয়েছি। ভুলতেছি প্রতিনিয়ত। মানুষটা ডায়েরি লিখত। আমি জানতাম না।
তার এই গোপনটা পর্যন্ত আমি জানতাম না। আমি কি আসলেই তাকে ভালোবেসেছি। আসলেই? কিন্তু সে তো আমাকে ভালোবেসেছে। জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। প্রতিটি মূহুর্তে আগলে রেখেছে। আমি কি মানুষটিকে ঠকিয়েছি? সে তো আমার চাইতে আরো ভালো একজনকে পেত। যে তাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসত। আমার মতো অবহেলা করত না। আচ্ছা আমি কি তাকে ভালোবাসতে পারিনি? হাহা! পেরেছি কই? পারলে কি সে আজ যেতে পারত? আমাকে একা রেখে থাকতে পারত? দোষটা আমারই। আমিই মানুষটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। তাকে ঠকিয়েছি। আমি ঠকবাজ। প্রতারক। কিন্তু এই ঠকবাজটা ওই মানুষটাকে ভুলতে পারেনি। একদমই ভুলতে পারেনি। প্রতিটি মূহুর্ত তার ভাবনায় জড়িয়ে থাকে। তার স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে পাগলে মতো কান্না করে। মানুষটা যদি দেখত! তার কি মায়া হতো?
আমি ঠকবাজ। ঠকবাজের জন্যে তার মায়া হবে কেন? ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললাম। আর পড়তে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। আমি থামাতে পারছি না। আমি এই পানিকে থামাতেও পারি না। কোনো ভাবেই না। এটি নিজের মতোই প্রবাহিত হয়। নিজের মতো করে চলে। অথচ এটি জানে না অবাধ্য কোনো কিছুর ভালো কখনই হয় না। আমারো হয়নি। আমি ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে নিলাম। কান্না করতে করতে মেজেতে শুয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। আমি চট করেই উঠে পড়লাম। ও আসেনি তো। আসতেও তো পারে। হয়তো কিছু একটা নিতে ভুলে গেছে। সেটা নিতে এসেছে। ও কি সত্যিই এসেছে? আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে। দরজা খুলতেই দেখলাম একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকাপাতলা গড়নের একটি মেয়ে। রূপবতী। ফর্সা। গোল গোল চোখ। গাঢ় কাজল দেয়া চোখে। এক কথায় অসাধারণ। মেয়েটা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,
-ভাবি আসসালামুয়ালাইকুম। আমি খানিকটা অবাক হলাম। এই মেয়েকে কি আমি চিনি? কোথাও দেখেছি? আমি বললাম,
-কে আপনি? মেয়েটা হাসি মুখে বলল,
-নীরা। নীরা রহমান।
আমি কেবল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। এই কি সেই নীরা? ওর কথাই কি তাসফি বলে গিয়েছে? ওকে ডায়েরী দিতে বলেছে? ওকে কেন? নিজের ডায়েরী সে অন্য কোনো মেয়েকে কেন দিবে? কে এই মেয়ে? আরেহ! একে তো আমি হাসপাতালেও দেখেছি। তাসফির পাশে বসে ছিল। মুখ মলিন করে ছিল। কেন মলিন ছিল? তাসফি কিছু বলেছে? তাসফি কিছু বললে এই মেয়ের মুখ মলিম হবে কেন? আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। মেয়েটা বলে উঠল,
-আপনি মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি। আসলে চিনারও কথা না। আমি আপনার হাজবেন্ড, মানে তাসফি ভাইয়া কে রাস্তা থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় দেখলাম কতগুলো লোক মিলে উনাকে মারছিল। ওরা ছিন্তাইকারী মনে হয়। আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। আপনাকেও আমি দেখেছিলাম এর আগে। অনেকবার দেখেছি। কিন্তু কখনও কথা হয়ে উঠেনি। মেয়েটা থেমে গেল। আমি কেবল তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। তার চোখের দিকে। কিছু একটা খুঁজছিলাম সেখানে। খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-ও আচ্ছা। তা কী মনে করে এখানে এসেছেন?
-এমনিই। ভাইয়াকে দেখতে এলাম। কই উনি? কেমন আছেন?
-ভেতরে আসুন। বলছি।
আমি মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে এলাম। আমার মনের ভেতরে কেমন জানি করছিল। তাসফির সাথে তার কী সম্পর্ক সেটা আমার জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাকে জানতেই হবে। আমি ওকে সোজা আমার রুমে নিয়ে গেলাম। বললাম,
-এই যে দেখেন। এই আপনার ভাইয়া। দেখেন দেখেন। কী সুন্দর করে তাকিয়ে আছে? ভালো করে দেখুন। ও হ্যাঁ দাড়ান,আপনার জন্যে একটি বিশেষ উপহার আছে। দাঁড়ান। আমি বারান্দায় গিয়ে ডায়েরীটা নিয়ে এনে তাকে দিলাম। তারপর দেয়ালে লাগানো তাসফির ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
-ও দিয়ে গিয়েছে এটা। বলেছে আপনাকে দেওয়ার জন্যে। একটু থেমে খানিকটা কড়া স্বরে বললাম,
-কই? সে তো আমাকে এমন কিছু দিয়ে যায়নি। কেবল এক পাহাড় বেদনা ছাড়া। আর আপনাকে দিল তার ডায়েরী। তার সবচে গোপন। কেন? আপনাকে দিয়ে গেল কেন? কোন কারণে? কে আপনি? ওর কী হোন? আমি জানতে চাই? বলুন প্লিজ।
নীরাঃ আমার অনেক গুলো অপছন্দের কাজের মধ্যে সর্বপ্রধান হলো তাসফিকে ভাইয়া ডাকা। তাকে আপনি করে বলা। আমি যখনই ওকে ভাইয়া বলে ডাকি তখনই আমার বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠে। কাঁপন ধরে। কষ্ট লাগে। যে মানুষটাকে আমি প্রচণ্ডরকম ভালোবাসি তাকে কীভাবে ভাইয়া বলে ডাকা যায়? যদিও আমি তাকে খুব একটা ভাইয়া বলে ডাকিনি। একবার ডেকেছি মনে হয়। না না একবার না। দুইবার ডেকেছি। এই দুবার ডাকাতেই ভাইয়া শব্দটা আমার কাছে চরম অসহ্যকর লাগতে শুরু করেছে। এমনকি আমি আমার ভাইয়াকেও ক’দিন ভাইয়া বলে ডাকিনি। কী পাগলামোটাই না করেছি।
অথচ কেউই জানল না আমার পাগলামির কারণ। কেউই না। কেবল আমি আর আমার ডায়েরী ছাড়া। ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি আশক্ত ছিলাম। কেন জানি না বই পড়তে আমার অসহ্য লাগত না। খুবই ভালো লাগত। আনন্দ পেতাম। এই বই পড়ুয়া মেয়েটা একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে যায়। ক্লাস করা শুরু করে। সারাটাক্ষন বইয়ের সাথে লেগে থাকে। ক্লাসে মনযোগী হয়। স্যারের লেকচার মন দিয়ে শুনে। প্রশ্ন করলে দ্রুত উত্তর দেয়। টিচারদের প্রিয় হয়ে উঠে মেয়েটা। আর ক্লাসমেটদের কাছে বোরিং টাইপ পড়াকু মেয়ে হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। কেউ পড়াকু কিংবা বোরিং বলেও ডাকে। মেয়েটা গায়ে মাখে না এসব। তার কাছে বই এবং বাসা এই দুটো ছাড়া অন্যসব কিছু গুরুত্বহীন। তার আনন্দ বইয়ের মাঝে। কিন্তু হুট করেই সব পরিবর্তন হয়ে গেল। মেয়েটার পুরো ভেতরটা পালটে গেল।
একটা ছেলেকে দেখে। ফর্সা করে একটা ছেলে। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। কী চমৎকার করে হাসে সে। কারো হাসি তার কাছে কখনই এতো হৃদয়স্পর্শি মনে হয়নি। সেদিন হয়েছিল। ছেলেটার হাসিটা একদম বুকের ভেতর গেঁথে যায়। পুরো মস্তিষ্কের পড়াকু সিস্টেমটা হ্যাক করে ফেলে সেই হাসি। এখন একটু সময় পেলেই ছেলেটা কল্পনায় এসে হাসে। মেয়েটার সাথে গল্প করে। মেয়েটার জীবনটা একদম পালটে যায়। অন্যরকম হয়ে যায়। রঙিন লাগে সব কিছু। মনের মাঝে একরকম আনন্দ খেলা করে। আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। এই আনন্দের ঝড় বয়ে নিয়ে আসা ছেলেটার নাম তাসফি। সাকের আহমেদ তাসফি। আমার প্রথম ভালোবাসা। প্রথম প্রেম। আমার প্রথম প্রেমের শীতল শিহরণ। আমি নীরা। নীরা রহমান। এই গল্পটি আমার নয়। কিন্তু আমি এই গল্পটির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাকে ছাড়া হয়তো গল্পটা শেষ হতো না। হয়তো হতো। অন্য কোনো ভাবে। সে আমার জানা নেই। আমি জানতেও চাই না। কেবল এটা জানি যে এই গল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পেরে আমি খুশি। চরম খুশি।
এই মূহুর্তে আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছি। আমার হাতে একটা ডায়েরী। নীল রঙের। ডায়েরীটা আমার পড়া শেষ। একবার পড়েছি। একবার পড়ে মনে হচ্ছে এর প্রতিটি শব্দ আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। এর ভেতরের প্রতিটি কথা আমি জানি। তাসফি মিহিন ভাবিকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। আমার কেমন জানি লাগছে। ভালো লাগছে না। সবচে খারাপ লাগছে শেষের লেখাটা পড়ে। লেখাটা সম্ভবত ভাইয়ার ডিভোর্স এর আগে লিখেছেন। মনে হয় আগেরদিন। তারিখ দেয়া আছে। আমার মন ভীষণ খারাপ হলো। মিহিন ভাবির প্রতি রাগ হলো ভীষণ। তিনি এমনটা কীভাবে করতে পারলেন? কীভাবে এমন একটা মানুষকে এড়িয়ে গেলেন? মিহিন ভাবির প্রতি আমার শ্রদ্ধাটা কমে গেল। আমি তাকে কি না ভাবতাম। বিশ্বের সেরা ভাগ্যবতী মেয়ে ভাবতাম। আর সে কী না এমন একটা জঘন্য কাজ করল? আমি শেষের লেখাটা আবার পড়তে শুরু করলাম।
ডায়েরীর শেষের লেখাঃ
ডায়েরিটা আমার খুব প্রিয়। গোপন ছিল এতদিন। কেউই জানতে পারেনি। এমনকি তোমার ভাবিও না। জানবেই বা কীভাবে? সে তো আমার কাছে থেকেও দূরে ছিল। দূরে যাচ্ছে। নীরা তুমি ভাবতে পারো যে আমি কেন তোমাকে ডায়েরিটা দিলাম। কিংবা কেন তোমাকে নিয়ে এই লেখাটা লিখলাম। এর উত্তর আমি তোমাকে পরে দিব। তার আগে তোমাকে কিছু কথা বলি। আমার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ কেউ থাকলে সেটা হবে তোমার ভাবি। মিহিন। আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। এই মানুষটি সুখের জন্যে আমি কী না করিনি? সে যা চাইত তাই দিতাম। যা করতে বলত তাই করতাম। একটা সময় সেও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। কিন্তু হুট করেই মানুষটা পরিবর্তন হয়ে গেল। যেটা আমি একদমই মেনে নিতে পারিনি। বিয়ের আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু বিয়ের পর যে কোনো মেয়ের দায়িত্ব থাকে, সংসার থাকে সেটা হয়তো মিহিন বুঝতে পারেনি। সে বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবনে পার্থক্য করতে পারেনি।
বিয়ের আগে সে যা যা করত বিয়ের পর সে তা তা করতে থাকে। আমি তাকে অনেক বুঝাই। বিয়ের পর এভাবে চলে না কেউ। এত স্বাধীনতা ভালো না। আমি বুঝানোর কমতি রাখিনি। সে হয়তে বুঝতে কমতি রেখেছে কিংবা বুঝার চেষ্টাও করেনি। এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছে অন্য কান দিয়ে বের করেছে। সে রিতিমত ক্লাব, বার, পার্টিতে যেতে থাকল। রাত করে বাসায় ফিরত। ড্রিংক করত। যেটা আমার ভীষণ অপছন্দ।আমি এমন মিহিনকে কখনই চাইনি। মোটেও না। কিসের প্রভাবে তার এমন পরিবর্তন হলো সেটা আমি বুঝতে পারিনি। একটা সময় মনে হলো আমি আর পারছি না। এভাবে কন্টিনিউ করা আমার পক্ষে পসিবল না। আর সহ্য হয় না এসব। তাই আমাদের এমন বিচ্ছেদ। তিন মাস অপেক্ষা এখন। তারপর হয়তো দুজনের কেউই ‘আমার’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারব না।
‘মিহিন আমার’ এমনটা হয়তো আর বলা হবে না। যাই হোক, যা হচ্ছে হয়তো ভালোর জন্যেই হচ্ছে। আমার কথা এখানে শেষ। তোমার কথা বলি। নীরা, তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর একটা মেয়ে। ভালো মন্দের হিসেবটা বুঝো। তুমি যে আমার কাছে, এই পৃথিবীর কাছে, তোমার কাছের মানুষ গুলোর কাছ থেকে আমাকে লুকিয়েছো, আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে গিয়েছো সেটা আমি জানতে পেরেছি। ভার্সিটিতে একদিন তোমার ডায়েরিটা হারিয়ে যায়। সেদিন তুমি কী কান্ডটাই করলে। সে কী কান্না তোমার! তুমি সারা ভার্সিটি ডায়েরিটা খুঁজেছ। আমি তখনও বুঝতে পারিনি এর ভেতরে কী আছে যে তুমি এমন হন্যে হয়ে খুঁজছো। এমন পাগলপারা হয়ে যাচ্ছো। কৌতুহলবসত যখনই আমি এর প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাই এবং আমার নাম দেখি, সত্যি বলতে আমি চমকে উঠি। আমার পাঁয়ের তলার মাটি সরে যায়।
হ্যাঁ ডায়েরিটা আমি পেয়েছি এবং আজ পর্যন্ত সেটি যত্ন করে রেখেছি। রাখবও। ওটা আমার কাছে থাকুক। আমারটা না হয় তোমার কাছে থাক। স্মৃতি হিসেবে। তুমি বড্ড জেদি একটা মেয়ে। বাবা মায়ের কথা শুনছো না। ভালো ভালো বিয়ের সম্বন্ধ এলেও তুমি তা এড়িয়ে যাচ্ছো। কেন নীরা? কিসের আশায়? ভালোবাসাটা অনুভবের ব্যাপার। তুমি কাউকে ভালোবেসেছো। এটা তোমার গুন। তোমার মাঝে ভালোবাসার ক্ষমতা আছে। মনে প্রানে কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা সবার থাকে না। প্রকৃত ভালোবাসা এই পৃথিবীতে পাওয়াই যায় না আজকাল। নীরা, তোমার ভালোবাসা তোমার মনের ভেতরেই থাকুক না। থাক না একটু গোপন। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু কিছু অপূর্ণও থেকে যায়। তোমারটাও না হয় অপূর্ণ থাকল। ভেবে নিও এই অপূর্ণতাটাই আমি। আমার বিশ্বাস, তুমি আমার কথা গুলো বুঝতে পেরেছো।
আমি আশা করব তুমি তোমার মা বাবা কথা শুনবে এবং খুব জলদি নিজের মতো কেউ একজনকে খুঁজে নেবে। তবে সে যেন আবার বিয়ের পর পরিবর্তন না হয়ে যায়। কিংবা তুমি। আমাকে মুছে ফেলবে হৃদয় থেকে। তাকে স্থান দিবে। খুব করে ভালোবাসবে। যেমনটা আমাকে বেসেছিলে। তাকেও বাসবে। আমি জানি তুমি পারবে। তবে একটা কথা, অবহেলা করো না। কষ্ট দিও না তাকে। কারণ আমি বুঝি অবহেলা কেমন কষ্টকর। কেমন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পারে। তুমি ভালোবাসবে। নিজের করে নিবে তাকে। জীবনটা রঙিন করে নিবে। এটা আমার আদেশ। তোমাকে শুনতেই হবে। যদি ভালোবেসে থাকো। ভালো থেকো। আজীবন। কী অবেগ, কী কষ্ট নিয়ে লিখল মানুষটা। একেবারে হৃদয়ে লাগে। আমি ডায়েরিটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম। অযথাই কান্না পেল আমার। আমি কান্না করতে থাকলাম।
তাসফিঃ কলিংবেল বেজে উঠল। একবার। দুবার। কেউ একজন বিরতিহীন ভাবে বেল বাজাতেই থাকল। আমি বিরক্ত হলাম। সাতসকালে কার কী এমন প্রয়োজন পড়ে গেল যে এমন ভাবে বেল বাজাতে হচ্ছে! আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতড়ে নিয়ে সময় দেখলাম। তিনটা চল্লিশ বাজে। খানিকটা অবাক হতে হলো। তিনটা চল্লিশ কিভাবে বাজতে পারে। আমি বুঝে উঠলাম না। ফোনের টাইম ঠিক নেই ভেবে এড়িয়ে গেলাম। ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে দরজার কাছে গেলাম। দরজা খুলতেই আমাকে অবাক হতে হলো। আমি কেবল হা করে থাকলাম নীরার দিকে। পাশের ছেলেটাকে খেয়ালই করলাম না। অকপটে বলেই ফেললাম যে,
-কী ব্যাপার নীরা? তুমি এত সকাল সকাল এখানে? নীরা কেমন করে যেন তাকাল। তার পাশের ছেলেটাও। কিন্তু এই ছেলেটা কে? চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। এ তো সেই ছেলে যে আমার মিহিনের হাত ধরেছে। আমি প্রায় সময়েই দেখতাম ওকে।মিহিনের পার্টি শেষ হলে এই ছেলেই বাসায় নামিয়ে যেত। মিহিনের হাত ধরে মিহিনকে গাড়ি থেকে নামায়। একে অপরের হাত ধরে হাসাহাসি করে। আরো কত কি করে কে জানে? কিন্তু এই ছেলে এখানে কী করে? কেন এসেছে এখানে? তাও আবার নীরার সাথে? নীরা অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল,
-এই যে? সকাল সকাল মানে কী বলতে চাইছেন? এখন তিনটা বেজে একচল্লিশ মিনিট হয়েছে। বুঝতে পেরেছেন?
-মানে? কী বলছো তুমি?
-এই যে, ঘড়ি দেখুন।
নীরা তার হাতের ঘড়িটা দেখাল। আমি ওটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ধাক্কার মতো খেললাম। তার মানে সকাল হয়ে দুপুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে অথচ আমি বলতেও পারবো না? অহ গড। হঠাৎ-ই নীরা বলে উঠল,
-তা আমাদের কি বাইরে দাঁড় করিয়েই রাখবেন নাকি? আমি মেকি হাসলাম। বললাম,
-আরে না না। কী যে বলো না। আসো আসো। ভেতরে আসো। নীরা এবং ছেলেটা ভেতরে ঢুকল। আমি বললাম,
-আসলে নতুন বাসা তো, তাই গোছানো হয়নি ঠিক ভাবে।
-না না। ঠিক আছে। সমস্যা নেই। তা ড্রইংবুক রুম খালি কেন? সোফা টোপা? অন্তত একটা চেয়ার তো রাখা উচিৎ ছিল?
-আসলে কেউ আসে না। আর এমনিতেই কিনতাম। ভাবছিলাম সব একদম গুছিয়ে নেই আগে। কেনা কাটা টা একটু পরে করব আরকি।
-ওহ আচ্ছা। রুম কয়টা? বাসা তো ছোট মনে হয়?
-একা মানুষ! এত বড় বাসা দিয়ে আর কী হবে। আর রুম মোট দুইটা। এটা আর একটা আমার বেড রুম। কিচেন আর একটা বাথরুম। ব্যস! এতটুকুই।
-চলুন,আপনার রুমেই যাওয়া যাক। খাট আছে তো? আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-আসলে এখনও সময় করে কেনা হয়নি। কিছুই কেনা হয়নি।
-খাওয়া দাওয়া?
-হোটেল থেকে নিয়ে আসি। কথাটা শুনে নীরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল। আমি এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
-চল, আমার রুমে চলো। ওখানে চেয়ার আছে একটা। বিছানাটা ফ্লোরেই করেছি। আসো। আমি নীরাকে নিয়ে নিজের রুমে এলাম। নীরা রুমে এসেই দেয়ালের ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকল। কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটিকেও দেখলাম তাকিয়ে থাকতে। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে আমি তার চোখে জল দেখলাম। আমি ঠিক বুঝে উঠলাম না ব্যাপারটা। নীরা বলে উঠল,
-মিহিন ভাবিও ঠিক এই কাজটাই করেছেন। আপনার ছবি বড় করে দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছেন। যেন ঘুম থেকে উঠেই আপনার চেহারা দেখেন। এখন দেখছি আপনিও কম যান না। ভাবির ছবি দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছেন।
-হাহাহা। বাদ দাও এসব। চেয়ার টেনে বসো। তারপর ছেলেটিকে বিছানায় বসতে বললাম,
-আপনিও বসেন। ছেলেটি বসল। আমিও অন্য পাশে বসলাম। বললাম,
-কী খাবে বলো? আমি অনলাইনে অর্ডার করে দেই। দ্রুত চলে আসবে।
-আমি এখানে খেতে আসিনি। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
-কথা বলতে এসেছো? কী কথা?
-অনেক কথা। আপনার কি সময় হবে?
-অবশ্যই। বলো কী বলবে?
-এই যে এই ছেলেটিকে দেখছেন? এর নাম সাদিক। সাদিকুর রহমান। চিনতে পেরেছেন? আমি ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে বললাম,
-পেরেছি। কিন্তু…
-আপনার কিন্তু পরে শুনব। আগে আমার কথা শেষ হতে দিন।
-আচ্ছা বলো।
-সাদিক কে আপনি চেনেন? জানেন ওর সম্পর্কে কিছু?
-না।
-বেশ। তাহলে আপনি কোন কারণে সাদিক আর মিহিন ভাবির সম্পর্কে বাজে কিছু ভাবছেন। যেহেতু আপনি এইছেলেকে জানেনই না। তার চরিত্র সম্পর্কেও না। তারা তো ভালো বন্ধুও হতে পারে?
-নীরা,তুমি কি এসব কথা বলতে এখানে এসেছ?
-আমি আপনার ভুলটা ধরিয়ে দিতে এসেছি।
-আমার ভুল? তুমি বলছো আমি ভুল করেছি? তুমি মনে হয় পুরোটা জানো না নীরা। আমি পুরোটা জেনেছি। সব জেনেই এখানে এসেছি। আপনি তো নিজেকেও ধোকা দিচ্ছেন। নিজে কষ্ট পাচ্ছেন।
-ওর অবহেলার কাছে আমার এই কষ্ট কিছুই না। বরং এখন আমি কিঞ্চিত ভালো আছি। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মিহিন নামটা অধরা হয়ে যাবে।
-কিছুই ঠিক নেই ভাইয়া। কিছুই ঠিক নেই। আপনি জানেন না,মিহিন ভাবি কী করছে, কেমন আছে। হয়তো আর অল্প কিছুদিন এভাবে গেলে উনি মারা যাবেন। না খেয়ে না খেয়ে মারা যাবেন উনি?
-ও খাচ্ছে না কেন? এখানে আমার কী দোষ।
-দোষটা আপনারই। আপনি উনাকে ভালোবেসেছেন। নিজেকে উনার ভেতরে প্রবেশ করিয়েছেন। উনি এখন আপনাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চান না। দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।
-ওটা ভালোবাসা ছিল না। আবেগ ছিল আবেগ। ওকে আবেগ থেকে বের হতে হলো। এত আবেগ ভালো না।
-বেশ তো। এত আবেগ ভালো না। ভালোই বলেছেন। কিন্তু আপনি? কই আপনি তো বের হতে পারলেন না। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলেন তো? আপনি ভালো আছেন?
আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। আমার পাশের ছেলেটা আমার দিকে আরেকটু সরে এল। বলল,
-আমি যদি মিহিনের বিয়েতে থাকতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। আপনি তখনই জানতে পারতেন আমাদের কেমন সম্পর্ক।
আমি খানিকটা কড়া গলায় বললাম,
-আসলেই। তাহলেই ভালো হতো। অন্তত মিহিনের সাথে আমার বিয়ে হতো না। আমরা দুজনেই ভালো থাকতাম। আমাদের এমন দিন দেখতে হতো না।
-আপনি ভুল ভাবছেন ভাইয়া। বিষয়টা আপনি যেমন করে ভাবছেন তেমন না। আমরা দুজন ছোট বেলা থেকেই খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। আজো আছি। আমাদের মাঝে কেবল একটাই রিলেশন ছিল। সেটা হচ্ছে আমরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। আমি যতটা না ওর জন্যে করেছি ওর ভাইয়েরাও ওর জন্যে ততটা করেনি। আমার ভাই বোনেরাও ততটা করেনি যতটা ও আমার জন্যে করেছে। পাশাপাশি বাসা ছিল। তাই চলাচলও এক সাথে ছিল। আমরা দুজন দুজনের ছায়া হয়ে ছিলাম। ভাই বোনের মতো। সেই হিসেবে আমি ওর হাত ধরতাম। ওকে বাসায় ড্রপ করতাম। আমি কেবল ওর হাতই ধরেছি। বিশ্বাস করেন ভাই, আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমি তেমন কিছু ভেবে ওর হাত ধরিনি।
-আপনি বললেন,আর আমি বিশ্বাস করে নিব? এত সহজ? ছেলেটা ভেজা গলায় বলল,
-প্লিজ ভাই! অন্তত আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন। তা না হলে আমার সুইসাইড করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
-সুইসাইড? সুইসাইড কেন করবেন?
-তা না হয় কী করব ভাই। বাবা অসুস্থ, তাকে দেখতে যেতে পারছি না। তার উপর আমাকে ঘর থেকে বের করে
দেওয়া হলো। কেউই আমাকে বিশ্বাস করতে চায় না। কেউই না। ছেলেটা কান্না করে দিল। কোনো পুরুষ মানুষকে এত কাছ থেকে এই প্রথম কান্না করতে দেখলাম। আমার কেমন জানি খারাপ লেগে উঠল। আমি বললাম,
-আপনাকে কেন বের করে দিয়েছে ভাই?
-কেন আবার?
আপনাদের বিয়ে ভাঙ্গার দায়ে। মিহিনের বাবার সাথে আমার বাবার খানিকটা ঝামেলা চলছিল। পারিবারিক ভেজাল। সেদিন যখন মিহিনের বাবা আপনার কাছ থেকে জানতে পারল যে কোনো ছেলের সাথে ও ঘুরছে তখনই বুঝতে পারলেন যে ওই ছেলে আমিই। তবুও খোঁজ লাগালেন। জানতে পারলেন মিহিন আমার সাথেই ছিল। তারপর আর উনাকে আঁটকায় কে? বাসায় এসে যাচ্ছে তাই বলে গেলেন। সবার সামনে অপমান করে গেলেন। সেদিন প্রথম আমি আমার বাবাকে কান্না করতে দেখি। উনার চেহারা দেখেই আমার কান্না চলে এল। আমি অনেক বুঝালাম। তিনি বুঝলেন না। বিশ্বাস করলেন না। আমাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন। এর প্রায় আধঘণ্টা পর আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে। বড় ভাবির নাম্বার থেকে। তিনি জানা বাবা স্ট্রোক করেছেন। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশ্বাস করেন ভাই? আমাকে কোরান দিন। আমি কোরান ছুঁয়ে বলতে পারব আমি তেমন কিছু ভেবে ওর হাত ধরিনি। প্লিজ ভাই। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি চট করেই কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। ঘরময় খানিকটা নিরাবতা নেমে এল। আমি বললাম,
-আপনার জন্যে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। ওর পাশে আপনাকে একদমই সহ্য হচ্ছিল না। আমি ওকে ভালোবাসি। ও কেন আপনার হাত ধরবে?
-সেটা ভুল ছিল। আমি আর কখনই ওর হাত ধরব না। প্রয়োজন পড়লে ওর সামনেও আসব কোনোদিন। তবুও ভাই নিজেদের মাঝে মিউচুয়াল করে নিন না।
-সরি ভাই। আমি সেটা আর করছি না। আমি এত কষ্ট সহ্য করতে পারব না আর।
নীরা বলে উঠল,
-একবার ফিরেই দেখুন না। ওই বাসায় গেলে আপনি নিজেও অবাক হয়ে যাবেন। প্রতিটি দেয়ালে ভাবি আপনার ছবি লাগিয়ে রেখেছে। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে আর কান্না করে। আপনার একটা শার্ট রেখে এসেছিলেন মনে হয়। আমি কাল গিয়ে দেখলাম উনি ওটা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। কান্না করছেন। ভাইয়া, উনি মনে হয়না আর নিতে পারবেন। মানসিক প্রেশার বেশি পড়লে সমস্যা হতে পারে। উনি পাগল হয়ে যাবেন।
-দেখো নীরা, আমার কাছে প্রথম প্রথম মনে হয়েছে মিহিন আমাকে কেবল ভালোবাসে না। পাগলের মতো ভালোবাসে। শেষে কী হলো? সব শেষ হয়ে গেল।
-সময় বদলেছে ভাইয়া। ভাবি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। উনার অপরাধবোধ উনাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কাল বলেছিলেন, “তোমার ভাইয়াকে কেবল কথা দিয়েছিলাম সুইসাইড করব না। তা না হলে কবেই চলে যেতাম। এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না নীরা।” ভাইয়া প্লিজ! একটা সুযোগ দিন। আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। আমার কেমন জানি লাগতে থাকল। মিহিনেত কথা গুলো শুনে ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকল। হঠাৎই আমার মনে হলো আমার এখনই মিহিনের কাছে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু? ও যদি আমাকে আবার অবহেলা করে? যদি আবার ছুড়ে ফেলে দেয়? আমি হয়তো মারাই যাব তখন। আমি বললাম,
-তোমরা চলে যাও। আমি যাব না। নীরা রেগে গেল চট করেই। বলল,
-আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি মানুষটা মোটেও ভালো না। একে তো নিজে কষ্ট পাচ্ছেন। উনাকেও কষ্ট দিচ্ছেন। এমনটা কেন করছেন আপনি?
-নীরা আমার ভয় হয়। যদি আবার তেমন কিছু হয়? আবার অবহেলা?
-আপনি অন্তত একবার এসে দেখুন। কেবল দেখে যান। এরপর যদি ইচ্ছে হয় আপনি চলে আসবেন। আমরা কেউই বাধা দিব না।
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। চুপ করে মাথা নিচু করে রাখলাম। গাড়িটা বাসার সামনে থেমেছে। আমি নেমে পড়লাম। আমার বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকল। গা কাঁপতে থাকল। যেন জীবনে প্রথম আমি এই বাড়িতে এসেছি। বুকের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি হতে থাকল। ধপ ধপ শব্দটা বাড়তে থাকল ধীরে ধীরে। লিফটা বন্ধ। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হচ্ছে। আমি ধীর পাঁয়ে উঠছি। আমার পাঁ কাঁপছে। বুক কাঁপছে। বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে যেন। নীরা আর সাদিকও পেছন পেছন এল। আমি আমার বাসার সামনে যেতেই দেখলাম বাসার দরজা খোলা। বসার ঘরে লাইট জ্বলছে। প্রতিটি রুমে লাইট জ্বলছে। আমি দরজার সামনে গিয়্র দাঁড়ালাম। আমার হৃদয়টা যেন এবার বেরিয়ে আসবে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম ভেতরটা দেখতে থাকলাম ভালো করে।
দেয়ালে দেয়ালে আমার ছবি। আমার নাম লেখা। গুটি গুটি অক্ষরে কেউ লিখে রেখেছে ‘ভালোবাসি’। আমি ভেতরে পাঁ দিলাম। কয়েক পাঁ গিয়ে থেমে গেলাম আমি। আমার হার্টবিট যেন মিসিং হলো। গা কাঁপতে থাকল। ধপ ধপ শব্দটা বেড়ে চলল নিজের মতো করে। মিহিন দাঁড়িয়ে আছে। অন্য রুমের দরজার কাছে। হাতে আমার ছবি। তার চোখ ফোলা ফোলা। লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। চোখ দুটো ছোট হয়ে গিয়েছে যেন। মুখটা শুকিয়ে আছে। আমার বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল। এ কোন মিহিনকে দেখছি আমি। মিহিনের হাত থেকে ছবিটা পড়ে গেল। ওর চোখে জল জমতে থাকল। দৌড়ে এল আমার দিকে। পাগলের মতো করে জড়িয়ে ধরল আমায়। কান্না শুরু করে দিল ও। সেকি কান্না! আমিও কান্না করে দিলাম। বুকের ভেতরের জ্বালাটা কমে গেল চট করেই। সেখানে যেন এক সমুদ্র ভালো লাগায় ভরে উঠল। মিহিন আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভেজা গলায় বলল,
-আমি তোমাকে আর যেতে দিব না। প্লিজ। আর যেও না। আমাকে ছেড়ে আর কোথাএ যেও না। আমি আর কখনই তোমার কথা অমান্য করব না। তুমি যা বলবে তাই মেনে নিব। তবুও প্লিজ আমাকে একা ফেলে যেও না।
আমি ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
-যাব না। কোথাও যাব না আমি। মিহিন আমিও ভালো ছিলাম না। তোমাকে ছাড়া আমার দিন গুলো কেমন জানি যাচ্ছিল। ফিকে ফিকে লাগছিল।
মিহিন কিছু বলল না। আমাকে কেবল শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমিও ধরলাম। ওর চুল ভর্তি মাথায় চুমু খেলাম। ও আমার বুক থেকে মাথা সরিয়ে নিল। আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো। গভীর ভাবে চুমু খেল ও। সেই কোমল শিহরণের চুমু। এই জিনিসটা ভীষণ মিস করতাম আমি।
লেখকঃ দরজার কাছে দুজন মানব মানবি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চোখেই জল। সুখের জল। অজানা সুখে কান্না করছে তারা। চোখ ভর্তি অনাবিল প্রাপ্তি খেলা করছে। যেন মিহিন-তাসফির মিলনে ওদের খুশিটাই বেশি। কিংবা হয়তো তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দর দৃশ্য দেখছে যেটা সব সময় দেখা যায় না। খুবই কমই দেখা যায়।