ভালোবাসা

ভালোবাসা

– সিয়াম? এই সিয়াম? উঠো না?
– আর একটু ঘুমায় না প্লিজজজজ?
– না একদম না। এখনই উঠো? আহা তোমার অফিসে যেতে লেট হয়ে যাবে তো?
– আজ অফিসে যাইতে ইচ্ছা করছে না সাফা।
– কেনো যেতে ইচ্ছা করছে না শুনি?
– আজ সারাটা দিন আমার কিউট বউটাকে টাইম দিবো।

– ইস রে। আর টাইম দিতে হবে না। অনেক টাইম দিছো। এখন তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি।
– আজকে অফিসে না গেলে হয় না?
– সিয়াম আমি কিন্তু রেগে যাবো? জলদি এসো। আমিও নাস্তা করিনি একসাথে করবো বলে।
– ওক্কে আসতেছি।
– এই তো আমার পাগল বরটা কত্তো ভালো হিহিহি। তাড়াতাড়ি এসো।

সিয়াম আর সাফা দুই জন, দুই জনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে আজ দুই বছর হলো। সিয়াম একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে সিয়ামকে এমন ভাবে ডেকে দিতে হয় সাফার। সাফাকে এত বেশি ভালোবাসে যে ওকে এক মুহূর্তও কাছ ছাড়া করতে চাইনা। অনেক বেশি ভালোবাসে সাফাকে। বিয়ের আগে যতটা ভালোবাসতো? তার থেকেও বেশি ভালোবাসে বিয়ের পরে। বিয়ের আগে সাফা প্রায়ই সিয়ামকে বলতো, বিয়ের পরে নাকি ভালোবাসা কমে যাই। কিন্তু সাফার সেই ধারনা মিথ্যা প্রামান করে দিয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে সিয়াম ওকে। সাফা টেবিলে নাস্তা দিয়ে সিয়ামের জন্য অপেক্ষা করছে। সিয়াম ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসতে বসতে বললো,

– আজকে কি নাস্তা বানিয়েছো সাফা?
– আচ্ছা সিয়াম, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না?
– হুম পাচ্ছি তো। সামনে আমার পরীর মত বউটা বসে আছে।
– উফফ তোমাকে নিয়ে আর পারিনা। আমি কি আমার কথা বলেছি? নাস্তার কথা বলেছি।
– আমি শুধু আমার বউকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না।
– তাই না?
– হুম।
– এখন খেয়ে নাও। সিয়াম একটুকরো পরাটা আর একটুকরো ডিম ভাজি নিয়ে সাফার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
– হা করো? সাফা মুচকি একটা হাসি দিয়ে হা করলো। তারপর সিয়াম সাফাকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেলো। সাফা বললো,
– আচ্ছা সিয়াম তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেনো?
– এই পাগলি, এটা আবার কেমন কথা হুম?

আমি তোমাকে ভালোবাসবো না তো কাকে ভালোবাসবো হুম? এই বুকে যত ভালোবাসা আছে সবই আমার বউটার জন্য। এটা বলেই সিয়াম সাফার কপালে একটা চুমু একে দিলো। এবার আমার চা দাও। চা টা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। সাফা তাড়াতাড়ি করে চা বানিয়ে সিয়ামের কাছে দিলো। সিয়াম চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বললো,

– এই এটা কেমন চা বানিয়েছো?
– কেনো গো?
– চা খাচ্ছি না কি খাচ্ছি কিছুই বুঝতেছি না। না মিষ্টি হইছে? না তিতা।
– তাই না? আসলে তাড়াতাড়ি করে আনতে যেয়ে চিনি দিতে ভুলে গেছি হয়তো।
– সাফা তুমি একটু খেয়ে দেখো তো কেমন হইছে? এমন ভুল করে কেউ? সাফা মন খারাপ করে সিয়ামের হাত থেকে চা’টা নিয়ে তাতে এক চুমুক দিয়ে দেখলো। তারপর বললো,
– সিয়াম কোই চা তো ঠিকই আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সিয়াম বললো,
– এতক্ষন ঠিক ছিলো না কিন্তু এখন ঠিক হইছে।
– মানে?
– মানে তুমি চায়ে চুমুক দেয়াতে চা ঠিক হয়ে গেছে। আগে কেমন বিষাদ লাগছিলো কিন্তু এখন অমৃতর মত লাগছে।
– ইস পাজি। তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিছিলে? আমি তো ভাবছি সত্যি সত্যি বুঝি চা খারাপ হইছে।
– হাহাহা আমার বউ এর হাতের চা আবার খারাপ হয় নাকি? তুমি যা ই করো না কেনো তা আমার কাছে সবই ভাল্লাগে।
– হইছে আর ঢং করা লাগবে না।

সাফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে গেলো সিয়াম। অফিসে পৌছে সাফাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো যে ও অফিসে পৌছে গেছে। সিয়াম ওর অফিস রুমে বসে কাজ করছে। তখন ওর রুমে ঢুকলো সিফাত। সিফাত ওর কলিগ। সিয়াম বললো,

– সিফাত ভাই কেমন আছেন? দাড়িয়ে কেনো বসেন? সিফাত চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ভালো আছি ভাই। সিয়াম ভাই আপনার কাছে আসছি একটা দরকারে।
– কি দরকার বলেন?
– ভাই আপনি তো জানেনই আমার ওয়াইফ প্রেগনেন্ট।

এমন সময় হাতে কিছু টাকা রেখে দিতে হয়। কিন্তু আমার কাছে এখন এই মুহূর্তে তেমন কোনো টাকা নাই। আর এখনো তো মাসের অনেক দেরি। বেতন তো এখন দিবে না। তাই আপনার কাছে আসা।  যদি কিছু টাকা ধার দিতেন? তাহলে অনেক উপকার হত ভাই। সমস্যা নাই বেতন পেলেই দিয়ে দিবো।

– সিফাত ভাই, এমন ভাবে বলছেন কেনো? টাকা নিয়েন আর যখন ইচ্ছা দিয়েন সমস্যা নাই। আমার কাছে কিছু টাকা আছে অপাতত লাগতেছে না।
– অনেক ধন্যবাদ ভাই।
– আরে ভাই ধন্যবাদই দিচ্ছেন কেনো?

আমরা আমরাই তো তাই না? আমরা যদি আমাদের কাছের মানুষদের বিপদে এগিয়ে না আসি তাহলে কি হয় বলেন? অফিস শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিলো সিয়াম। বাসায় যাওয়ার পথে একটা ফুল কিনে নিলো সাফার জন্য। গোলাপ ফুল সাফার অনেক পছন্দের। ফুলটা পেলে অনেক খুশি হবে ও। আর সাফার এই খুশি খুশি মুখটা দেখতে সিয়ামের অনেক ভালো লাগে। ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল চাপলো সিয়াম। দুইবার চাপার পরেই দরজা খুলে দিলো সাফা। দরজা খুলে দিয়েই সিয়ামের হাতে গোলাপটার উপর চোখ গেলো ওর। সিয়ামের হাত থেকে ফুলটা নিতে নিতে বললো,

– ওয়াও অনেক সুন্দর ফুলটা। থ্যাংক ইউ ।
– শুধু থ্যাংক ইউ দিলে হবে না। আরো কিছু চাই।
– আরো কিছু? কি হুম?
– দাড়াও দেখাচ্ছি।
– এই পাজি না একদমই না। এখন কোনো দুষ্টামি না। ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।

সাফা চলে গেলো। সিয়ামও ফ্রেশ হয়ে এলো। এসে দেখে সাফা খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। তারপর দুজন মিলে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। সাফা সিয়ামের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর সিয়াম সাফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সিয়ামের বুকে মাথা না রাখলে সাফার ঘুমই হয় না। সিয়াম বললো,

– সাফা?
– হুম বলো গো।
– আচ্ছা আমাদের যখন বাবু হবে। তখন তো বাবু আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। তাহলে তুমি কোথায় ঘুমাবে তখন?
সিয়ামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে- আদর মাখানো গলায় বললো,

– এই বুকটাতে শুধু আমি ঘুমাবো। এখানে আর কাউকে ঘুমাতে দিবো না আমি।
– এই পাগলি? ও তো আমাদের বাবু। আর আব্বুর বুকের উপর কি সন্তান ঘুমাবে না?
– না ঘুমাবে না। ও বালিশে ঘুমাবে আর আমি তোমার বুকে।
– তাই?
– না গো। ও তো আমাদের বাবু। বাবুর জন্য ছাড় আছে হিহিহিহি।
– হাহাহা পাগলি একটা।
– হুম তোমার পাগলি।

দুই মাস পরে। সিয়াম অফিসে বসে কাজ করছে। তখনই একটা ফোন আসলো ওর ফোনে। ফোনে তাকিয়ে দেখে সাফা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই, ওই পাশ থেকে সাফা বললো,

– সিয়াম? আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো।
– কেনো কোনো সমস্যা?
– একটা গুড নিউজ আছে। বাসায় এসো তারপর বলছি। এখন রাখছি। বলেই ফোনটা কেটে দিলো সাফা।

সিয়াম বসে বসে ভাবতে লাগলো। কি গুড নিউজ দিবে ওকে? অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করেই বাসায় চলে গেলো ও। বাসার কাছে এসে দেখে, সাফা বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে। সিয়ামের জন্য অপেক্ষা করছে। সিয়ামকে আসতে দেখে দরজা খুলে দিলো। সিয়াম বললো,

– কি ম্যাডাম? কি গুড নিউজ দিবে? সিয়ামের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
– জানো সিয়াম, আমাদের বাসায় নতুন মেহমান আসতেছে।
– মেহমান মানে কে আসতেছে?
– তুমি আব্বু হতে যাচ্ছো। এটা বলেই দুহাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে রাখলো সাফা।
– সত্যি? ইয়াহু আমি বাবা হবো।

সাফাকে কোলে নিয়ে নাচতে শুরু করলো সিয়াম। সাফাকে জড়িয়ে ধরে বললো,  আজ আমি অনেক খুশি সাফা। বাবা হওয়ার আনন্দ যে এতো, সেটা আগে জানতাম না। এই খুশিতে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো আমি।

– হুম হইছে তো। এবার আমাকে কোল থেকে নামাও পাগল একটা। রাতে খাওয়া শেষ করে সাফাকে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। সিয়াম অবশ্য ছাদে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সাফা যেতে চাইলোনা আর তাই বেলকনিতে গিয়ে বসলো। সাফা সিয়ামের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। দেখতেছে রাতের শহর। দুরে সোডিয়াম লাইটের নিচে প্রতিদিনের মত আজও চটপটি ফুসকা বিক্রি করছে রহিম চাচা। সেখানে অল্প কয় জন মানুষ। তাছাড়া এদিকে আর কেউ নেই। সিয়াম বললো,

– সাফা?
– হুম।
– আমাদের বাবু যখন ছোট ছোট পায়ে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াবে তখন কেমন লাগবে, বলো তো? যখন আধো আধো বুলিতে আব্বু আম্মু বলে পাগল করে দিবে, তখনই বা কেমন লাগবে?

– হিহিহি অনেক ভালো লাগবে।
– আচ্ছা প্রথম যখন কথা বলা শিখবে। তখন আমাকে আগে ডাকবে নাকি তোমাকে?
– জানিনা তো আমাদের বাবু আগে কাকে ডাকবে। বাবু তো মা ডাকটাই আগে বলা শিখে।
– হুম তা অবশ্য ঠিক বলছো।
– আজ যদি আব্বা মা বেঁচে থাকতো তাহলে উনারা সব থেকে বেশি খুশি হত।
– মন খারাপ করোনা গো। মানুষ তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না।
– সাফা আমাদের বাবু ছেলে হোক বা মেয়ে ওকে কিন্তু হাফেজি মাদ্রাসায় পড়িয়ে হাফেজ বানাবো হুম?
– কেনো?
– শোনো আমাদের সন্তান হাফেজ হইলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে। মিথ্যা কথা বলবে না। ওর মনে আল্লাহর ভয় থাকবে সব থেকে বেশি। আর যখন আমরা মারা যাবো, তখন নামাজ পড়ে আমাদের জন্য দোয়া করবে। এটাই আমাদের সব থেকে বড় পাওয়া হবে।

– আচ্ছা ঠিক আছে। এবার চলো শুতে যায়। অনেক ঘুম পাচ্ছে আমার।
– হুম চলো।

সাফা ঘুমিয়ে আছে। ও পাশে হাত দিয়ে দেখে সিয়াম নেই। গেলো কোথায় ও? ও তো এতো সকালে ওঠে না। রিতিমত টেনে হিচড়ে ওঠাতে হয় ওকে। কিন্তু আজ এতো ভোরে উঠে গেলো? হয় তো বাথরুমে গেছে (মনে মনে বললো সাফা)। হুম উঠতে হবে এবার। নাস্তা বানাতে হবে। আজ তো শুক্রবার ওর অফিসও নেই। ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে উঠে পড়লো সাফা। তখনই রুমে সিয়াম এলো। সিয়ামকে দেখে সাফা বললো,

– সিয়াম আজকে সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠেছে?
– সূর্য প্রতিদিন যেদিক দিয়ে ওঠে। প্রতিদিনের মত আজও সেই দিক দিয়েই উঠেছে, কোনো ব্যাতিক্রম হয়নি। এখন তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসো। নাস্তা করবো।
– ঠিক আছে। আমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানিয়েদিচ্ছি। একটু ওয়েট করো হুম?
– তোমার বানাতে হবে না ম্যাডাম। আমি বানিয়ে ফেলিছি। তুমি এসো।
– হিহিহি তুমি বানিয়েছো? এই কারনে তো বলি আমারপাগল বরটা এতো সকালে কোথায় হারিয়ে গেলো? তা তুমি বানাতে গেলে কেনো কষ্ট করে? আমিই বানাতাম।
– জি না ম্যাডাম। তোমার এখন মোটেও কষ্টের কাজ করা চলবে না। এখন তোমাকে রেষ্টে থাকতে হবে। আজকের জন্য সব কাজ আমি করবো আর কাল থেকে একটা কাজের মেয়ে খুজে খুব জলদি বাড়িতে নিয়ে আসবো।

– সিয়াম তুমি কি পাগল হইছো? আমার বাবু হতে এখনো অনেক দেরি। এখন কাজ করলে কোনো সমস্যা হবে না। আর আমাদের বাড়িতে তেমন কোনো কষ্টের কাজ নাই বুঝেছো?
– হুম আমি সব বুঝেছি। তুমি এবার চুপচাপ যা বললাম তাই করো। আমি যা ভাবছি সেটাই করবো।
– তোমার যা খুশি তাই করো।

রাগ করে চলে গেলো সাফা। সাফা রাগ করে চলে যাওয়াতে সিয়াম মুচকি মুচকি হাসছে। অপর দিকে সাফাও জানে সিয়াম যা বলেছে তাই ই করবে। ও একটুও কাজ করতে দিবে না ওকে। এমন করলে কি হয়? পৃথিবীতে কি আমিই একমাত্র বাবুর মা হচ্ছি? পাগলটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। ওর ধারনা এখন থেকেই রেষ্টে থাকতে হবে। তবে আমি সত্যিই ভাগ্যবতী সিয়ামের মত একজন মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে। ও আমার অনেক কেয়ার করে, অনেক বেশি ভালোবাসে। কত জন মেয়ের ভাগ্যে এমন স্বামী জুটে? সে হিসাবে আমি সত্যিই লাকি। ভাবতে ভাবতে এসে দেখে টেবিলে নাস্তা রেডি। সিয়ামের কান্ড দেখে সাফা রিতিমত অবাক। ওকে কোনো কিছুতে হাতই দিতে দিলো না। নিজেই সাফাকে খাইয়ে দিলো। প্রতিদিনই অবশ্য সিয়াম নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। কিন্তু আজক একটু বেশি বেশি খাওয়াতে শুরু করলো সাফাকে। ফল ডিম আরো অনেক কিছু। সাফা বললো,

– এই সিয়াম কি করছো? আর কত খাবো?
– এখন থেকে বেশি বেশি খাইতে হবে তাহলে আমার বউ + বাবু দুইটাই ভালো থাকবে। আর এই সময় তো বেশি বেশি খাইতে হয় তাই না?
– হিহিহি তুমিও না। উফফ তোমাকে নিয়ে পারা যায় না।
– নাও হাঁ করো তো?
– না গো জানু আর না। অলরেডি অনেক খেয়ে ফেলছি। আর পারছি না সিয়াম।
– আচ্ছা অল্প একটু।
– ওকে দাও।

সাফা খেতে পারছে না তবুও সিয়ামকে খুশি করার জন্য ও খাচ্ছে। কারন সাফাও সিয়ামকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। বিকালে সাফাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো সিয়াম। অনেক ঘুরলো সাফাকে নিয়ে। তারপর শপিং করলো। সাফার নীল রং পছন্দ তাই ওর জন্য একটা নীল শাড়ি আর কিছু রেশমি চুড়ি কিনলো। আর ওদের অনাগত বাবুর জন্য অনেক খেলনা কিনলো। রিকসায় যেতে যেতে সাফা বললো,

– সিয়াম? এখনি খেলনা কেনার কি দরকার ছিলো? খেলনা তো পরেও কেনা যেতো তাই না। শুধু শুধু অনেক গুলো টাকা খরচ করলা।
– সবার জন্য কেনাকাটা করলাম। এখন যদি বাবুর জন্য না কিনি তাহলে বাবু রাগ করবে না? অভিমান করবে তো আমাদের সাথে।
– ইস! আল্লাহ কবে একটু বুদ্ধি দিবে তোমাকে?
– হাহাহা আল্লাহ আমাকে অনেক বুদ্ধি দিয়েছে আর দরকার নাই। তবুও যদি কম পড়ে যায়। তোমার তো বেশি আছে সো এতেই আমাদের দুজনের ভাগেযোগে চলে যাবে।
– হুম হইছে এবার চুপ থাকো।

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে একটা মাঝ বয়সি মেয়েকে সাথে নিয়ে আসলো সিয়াম। মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়ে সাফা জিগ্যেস করলো,

– সিয়াম উনি কে? উনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। মুচকি হেসে সিয়াম বললো,
– এর নাম হচ্ছে মিনা। আজ থেকে তোমার দেখা শোনা করবে আর বাড়ির কাজ করবে।
– আমি কি ছোট নাকি আমাকে দেখা শোনা করবে?
– শোনো, আমি তো সেই সকালে যাই আর রাতে আসি।

সারক্ষন বাড়িতে তুমি একা থাকো । তাই মিনাকে নিয়ে আসা। ও কাজ করবে, ওর সাথে তুমিও একটু কাজ করলে আর গল্প করলে, তোমার মন ভালো থাকবে। তোমার সময়ও ভালো যাবে। আর এই সময় তো একটু হাসিখুশি থাকতে হয় তাই না?

– আচ্ছা একটা কথা বলো তো? সাফাকে কাছে টেনে এনে বললো,
– কি কথা?
– তুমি কাল বললে একটা কাজের মেয়ে কথা। আর কাল বলতে বলতে তুমি আজ ওকে কোথায়পেলে?
– ও এই কথা হাহাহা।

শোনো পরশু দিন যখন তুমি আমাকে বলেছিলে, আমি আব্বু হতে চলেছি। তার কিছুক্ষন পরই আমার কলিগ সিফাত ভাইকে ফোন করে বলি একটা কাজের মেয়ের কথা। উনি বলেছিলো দেখবে। তো উনাদের বাড়িতে যে কাজের মহিলা থাকে? উনি মিনাকে খুজে দিছে। তাই সহজেই পেয়ে গেলাম। নয়তো কবে পেতাম আল্লাহই জানে।

– হুম বুঝলাম। আর ঐ প্যাকেট গুলোতে কি? আর ঐ বোতলে?
– ঐ প্যাকেট গুলোতে হচ্ছে শাক সবজি আর ফল মুল। আর বোতলে হলো খাটি গরুর দুধ তোমারজন্য। সাফা হাসতে হাসতে বললো,
– গরু খাটি আর দুধ কি ভেজাল?
– গরুও খাটি আর দুধও খাটি।

সিফাত ভাই যেখানে থাকে তার পাশে একটা বাসাতে দেখি এক মহিলা গরুর দুধ দোহাচ্ছে। তো ওখান থেকে কিনে আনলাম। ফ্রিজে রেখে দাও প্রতিদিন এই গুলো খাবা আর রাতে এক গ্লাস করে দুধ খাবা আর দুধ দিয়ে ভাত খাবা। আমিই খাইয়ে দিবো কোনো সমস্যা নাই।

– সিয়াম? তুমি তো দেখছি আমাকে মোটা বানিয়ে ফেলবে?
– শোনো মোটা হইলেও তুমি আমার বউ আর শুকনা হইলেও তুমি আমার বউ সো যা বললাম তাই করবা ওকে? সাফা অনিচ্ছা সত্যেও হুম বলে দিলো কারন ও সিয়ামকে কষ্ট দিতে চাই না। আর ও যা করছে তাতো ওরই ভালোর জন্য। সাফার প্রেগনন্সির পাঁচ মাস চলছে। সিয়ামের পাগলামিও আগের থেকে দ্বিগুন বেড়ে গেছে। অবশ্য এটাকে পাগলামি বলা চলে না। ভালোবাসা টেককেয়ার আরো বেড়ে গেছে। সাফা আর সিয়াম দাড়িয়ে আছে বেলকনিতে। হঠাত,

– এই সিয়াম কি করছো?
– চুপ করে দাড়িয়ে থাকো আর আমাকে শুনতে দাও বাবু কি বলছে।  সাফা দাড়িয়ে আছে আর সিয়াম ওর পেটে কান পেতে আছে। সাফা হেসে বললো,

– হিহিহি তো কি শুনলে? বাবু কি বলছে?
– বাবু বলছে, আব্বু আর কয়েক মাস অপেক্ষা করো, আমি চলে আসতেছি তোমাদের কাছে।
– হিহিহি পাগল বর আমার।
– হুম পাগলি বউ আমার। সিয়াম অফিসে বসে কাজ করছে। তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। স্কীনে তাকিয়ে দেখে সাফার নাম্বার। সিয়াম রিসিভ করে বললো,

– হুম সাফা বলো?
– ভাইয়া আমি ভাবি না। আমি মিনা বলছি।
– হ্যাঁ মিনা বলো?
– ভাইয়া ভাবি সিড়ি থেকে পড়ে গেছে।

ভাবির অবস্থা খুব খারাপ। আমি আর পাশের বাসার নীলা ভাবি দুইজনে মিলে ভাবিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি তাড়াতাড়ি সিটি হাসপাতালে চলে আসেন। এটা বলে ফোন রেখে দিলো মিনা। সিয়াম পাগলের মত ছুটে চললো হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালে যেয়ে দেখে মিনা আর নীলা ভাবি দাড়িয়ে আছে। আর সাফাকে ইর্মাজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। একটু পর ডাক্তার এসে বললো,

– রোগীর স্বামী কে? সিয়াম এগিয়ে গিয়ে বললো,
– আমি। ওর এখন কি অবস্থা?
– রক্ত লাগবে। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার কারনে জরুরি রক্ত লাগবে। O+ রক্ত লাগবে। নীলা ভাবি এগিয়ে এসে বললো,
– ভাইয়া আমার O+ রক্ত। আমি সাফা ভাবিকে রক্ত দিবো।

হাসপাতালের বাইরে পাইচারি করছে সিয়াম। চিন্তা হচ্ছে ওর না যানি কি হয়। হঠাত করে যে কি হয়ে গেলো? অনেক সময় ধরে পাইচারি করার পর দেখলো ডাক্তার বের হলো। সিয়াম এক প্রকার ছুটে চলে গেলো ডাক্তারের কাছে। সিয়াম বললো,

– ডাক্তার সাহেব, আমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?
– আপনার স্ত্রী এখন মোটামুটি ভালো কিন্তু স্যরি বাচ্চাটাকে আমরা বাচাতে পারিনি।

পেটে আঘাত লাগার কারনে বাচ্চাটা মারা যায়। সিয়ামের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। কি শুনলো ও? ওদের বাবুটা আর নেই? যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন এতো আশা সে আর নেই? ঢুকরে কেঁদে উঠলো সিয়াম। ডাক্ততার ওকে শান্তনা দিয়ে বললো,

– দেখুন সিয়াম সাহেব শান্ত হোন। এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আরো একটা খারাপ সংবাদ আছে। যেটা আপনাকে না বলে পারছিনা। বলতেই হবে যেহেতু আমি ডাক্তার। আরো একটা খারাপ সংবাদ? কি হতে পারে এটা? একটু ধাতস্ত হয়ে সিয়াম বললো,

– জি বলেন?
– আপনার স্ত্রী আর কোনো দিন মা হতে পারবে না।

সিয়াম যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ডাক্তারকে বার বার বলছে, ডাক্ততার বলেন আপনি যা বলছেন মিথ্যা বলছেন? কিন্তু ডাক্তারের কাছ থেকে আশানুরুপ কোনো রেসপন্স পেলো না। ডাক্তার নিরব। সিয়াম কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এটা। পাগলের মত আচরন করছে ও। তারপর নিজেকে একটু শান্ত করে ডাক্তারকে বললো,

– আমি কি আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারি?
– আপনার স্ত্রীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি।

জ্ঞান ফিরলেই দেখতে পারবেন। সিয়াম চিন্তা করছে, জ্ঞান ফেরার পর সাফা যখন জানতে পারবে আমাদের বাবুটা আর নেই তাহলে কি করবে ও? পাগল হয়ে যাবে হয়তো ও। আবার একই সাথে যদি ও জানতে পারে ও আর কোনো দিন মা হতে পারবে না তাহলে? না আমি কিছুতেই ওকে জানাবো না এই ব্যাপারটা। কিন্তু বাবুর কথাটা তো নিজের জেনে যাবে? তা জানুক কিন্তু এটা আমি জানাবো না। আমি সাফাকে হারাতে পারবো না। প্রায় তিন চার ঘন্টা পর সাফার জ্ঞান ফিরলো। সিয়াম সাফার কাছে গিয়ে ওর পাশে বসলো। তারপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

– এখন কেমন আছো? সাফা কান্না করতে করতে বললো,
– সিয়াম আমাকে ক্ষমা করে দাও? আমি আমাদের বাবুটাকে পৃথিবীতে আনতে পারলাম না। তোমার সব স্বপ্ন আমি শেষ করে দিলাম। সিয়ামের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ও সাফার চোখের পানি একটুও সহ্য করতে পারেনা। সিয়াম সাফার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

– প্লিজ শান্ত হও কেঁদো না। তুমি এখনো অসুস্থ। আর এখানে আমাদের কারোর কোনো হাত নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছাতেই হইছে। নিজেকে দোষারোপ করোনা। সাফা কাঁদতে কাঁদতে সিয়ামের কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। এক সপ্তাহ পরে সাফাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। অনেকটা সুস্থ এখন ও। সারাক্ষন চুপচাপ থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সিয়ামও অফিস থেকে ছুটি নিছে সাফার জন্য। সাফাকে সময় দেয়ার জন্য। যাতে ওর মনটা ভালো থাকে। রাতে সিয়ামের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে সাফা। ওর চোখ যায় রুমে সাজিয়ে রাখা খেলনা গুলোর দিকে। তারপর সিয়ামকে বলে,

– সিয়াম।
– হুম বলো?
– এই সব খেলনা গুলো এবার কি করতে হবে?

আমাদের বাবু তো আর নেই। সিয়াম বুঝতে পারলো সাফা কান্না করছে। ওর চোখের পানি সিয়ামের বুকের উপর পড়তেছে। নিজেকে শক্ত রেখে সাফাকে মিথ্যা কথা বললো সিয়াম। বললো,

– এই পাগলি বাবু নেই তাতে কি? আমাদের বাবু তো আবার হবে। তখন এই খেলনা গুলো নিয়ে খেলবে। সিয়াম ফিল করলো, কথা গুলো বলার সময় ওর গলা কাপছিলো। চোখও ভিজে ভিজে উঠেছে। ও কখনো সাফাকে মিথ্যা বলে না কিন্তু আজ বললো। বললো না বলতে বাধ্য হলো। সাফা সিয়ামকে বললো,

– সিয়াম তুমিও মিথ্যা বলা শিখে গেছো? অবাক হয়ে জানতে চাইলো সিয়াম,
– মিথ্যা? কোই মিথ্যা বললাম? আচ্ছা আমি কি আমার বউটাকে কখনো মিথ্যা বলেছি? সাফা বললো,

– কোনো দিন বলোনি ঠিকই কিন্তু আজ বললে। সিয়াম তুমি তো জানো আমার আর কোনো দিন বাবু হবেনা। তাহলে মিথ্যা বললে কেনো? সিয়াম অবাক হয়ে গেলো এই কথাটা সাফা কিভাবে জানলো? ও আর মা হতে পারবে না? সিয়াম নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে হাসি হাসি মুখে বললো,

– এই পাগলি তোমাকে কে বললো এই মিথ্যা কথাটা?  তুমি আবার মা হবে আর আমাদের বাবু হবে দেইখো।
– না সিয়াম মিথ্যা শান্তনা দিওনা আমাকে।

সেদিন দুইটা নার্স আমাকে নিয়ে কথা বার্তা বলছিলো। তখন কথার এক পর্যায়ে ওরা বলে আমি আর মা হতে পারবো না। তখন আমি শুনে ফেলি। সিয়াম আমি তো পারলাম না তোমাকে বাবু দিতে। কত আশা তোমার, কত স্বপ্ন সব শেষ হয়ে গেলো। সিয়াম কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। কথা বলার ভাষা যেনো হারিয়ে ফেলেছে ও। সিয়াম দেখলো ওর বুক পুরোটাই ভিজে গেছে সাফার চোখের পানিতে। তারপর সাফা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবার বললো,

– সিয়াম আমার একটা কথা রাখবা?
– হুম বলো। তোমার সব কথায় আমি রাখবো।
– সত্যি বলছো?
– হুম সত্যি।
– আমি বলি কি, তুমি আর একটা বিয়ে করো। তাহলে আমাদের ঘরে বাবু সাফার কথা শেষ করতে দিলো না সিয়াম। মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর বললো,
– কি বলছো এটা সাফা? বাচ্চার জন্য আমি আবার বিয়ে করবো? বাচ্চা না থাকলে কি হয়? পৃথিবীতে তো কত মানুষের বাচ্চা নাই। কোই তারা তারা কি বেঁচে নেই? তুমি কি পারবে আমার সাথে অন্য একটা মেয়েকে সহ্য করতে?

– হুম পারবো। আমাকে পারতে হবে। তোমার সুখের জন্য আমি সব পারি।
– কিন্তু আমি পারিনা।

তোমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকতে। আমি পারবো না আমার বুকে তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে রাখতে। বাচ্চা আমাদের না হয় না হোক। দরকার নাই আমাদের বাচ্চার । আমি তোমার আছি আর তোমারই থাকবো।

– এতো ভালোবাসো কেনো আমাকে? সাফাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তুমি যে আমার পরীর মত বউ তাই।
– হিহিহি পাগল একটা।

সাফা এখনো সিয়ামের বুকে মাথা রেখে কাদছে কিন্তু এই কান্না দুঃখের কান্না না। এই কান্না সুখের কান্না, ভালোবাসা পাওয়ার কান্না। একসময় সাফা সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে, সিয়ামের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর সিয়ামও সাফার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়ে। এইভাবেই আজিবন বেঁচে থাকুক সিয়াম আর সাফার ভালোবাসা।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত