যে রাতে আমরা পালিয়ে বিয়ে করলাম, সেই রাতে নাকি বাবা হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আমি দুটো ব্যাগে কাপড়-চোপড় আর লকাপ থেকে ৩৭ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। বগুড়া শহরের সাতমাথার একটি রেস্তোরাঁয় সুমন আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সুমন সুদর্শন এক যুবক। রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে দর্শনে মাস্টার্স করছিলো। তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম ফেসবুকের কল্যাণে। একদিন অনেক রাত অবধি ফেসবুকে চ্যাটিং হয় আমাদের। এরপর থেকে প্রতি রাতেই অনেকটা নেশাগ্রস্থতার মতো ওর সঙ্গে চ্যাটিং করতে লাগলাম। আশ্চর্য! ওর সঙ্গে কথা বলতে তখন এত্তো সুখ আর রোমাঞ্চ লাগছিলো!! মনে হচ্ছিলো, আমি যেন কোনো স্বপ্নপুরীর দেশে সুখের ভেলায় ভেসে ভেসে চলেছি। রাত কোনদিকে কেটে যেতে লাগলো বুঝতেই পারছিলাম না। এরপরে একদিন ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হলো। ফোনে নিয়মিত কথা হতে লাগলো আমাদের। আমার মনে হতে লাগলো, “ঠিক এই ছেলেটির জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। আমার আর ওর চিন্তার কত কত মিল! ওকে আমার চাই-ই চাই।” আমরা সংসার সাজানোর স্বপ্ন বুনে ফেললাম। ঘর- দোর কিভাবে সাজাবো, বাচ্চা-কাচ্চাকে কিভাবে মানুষ করবো; সেসব স্বপ্ন নিয়মিত বুনতে লাগলাম। ভালো লাগছিলো, অসম্ভব ভালো লাগছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো, এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী আর একজনও নেই।
বগুড়া পলিটেকনিক থেকে আর্কিটেকচারে ডিপ্লোমা শেষ করে বাসায় বসে আছি। খুব একটা কাজের ব্যস্ততা নেই। বাবা আর ভাইয়া মাঝে মাঝে বিএসসিটা করে ফেলতে বলতেন। আমি এর ওর কাছে থেকে ডুয়েটের প্রিপারেশন সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতাম। কিন্তু খুব একটা আগ্রহ বোধ করছিলাম না কিছুতেই। আমার চোখে কেবলই ভাসতে লাগলো, সুমন আর আমি একটা ছোট্ট সংসার গড়েছি। রান্না করছি, ঘর গোছাচ্ছি, ফ্লোর ঝকঝকে করে মুছে রাখছি। আমাদের ফুটফুটে বাবুটা ঘরময় ছোটাছুটি করে ফ্লোরটা নোংরা করে ফেলছে। আমি একটুও বিরক্ত না হয়ে আবার ফ্লোর মুছে দিতে দিতে আমার বাবুটাকে জড়িয়ে ধরে বলছি, “আমার সোনা বাবুটা…..!” এ জাতীয় ভাবনার কাছে ডুয়েটকে বারবার পরাস্ত হতে দেখে আনন্দ লাগতো, পৈশাচিক এক আনন্দ। ডুয়েট বেচারাকে যে কী অসহায় দেখাতো তখন! মায়া লেগে যেতো!!
ততোদিনে সুমন আমার জীবনে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। একটা মুহূর্ত ওকে ছাড়া ভালো লাগে না। আমরা লুকিয়ে কয়েকবার দেখাও করেছি। সপ্তাহান্তে ও রাজশাহী থেকে এসে দেখা করে যেতো। আমার বাবা বগুড়া শহরে বহুল পরিচিত একজন মানুষ। ধার্মিক ও সজ্জন হিসেবে সবাই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। বাবা ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে ধর্মের আদলেই মানুষ করতে চেষ্টা করেছেন। হালাল-হারাম জ্ঞান শিখিয়েছেন। আমি জানতাম ছেলে মেয়ের বিয়েপূর্ব যে কোনো সম্পর্কই ইসলাম অনুমোদন দেয় না। বাবার ইচ্ছে ছিলো তিনি ধার্মিক, ভদ্র একটা ছেলের সঙ্গে শহরের গন্য মান্য ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত করে ধুমধামের সাথে আমার বিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখে ফেলেছি অন্যকিছুর।
বাবা আমাদের প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবেন তা আমি সুমনকে বলেছিলাম। সুমন ছেলে হিসেবে ততোটা ধার্মিক নয়। নিয়মিত স্মোক করে। মাদকাসক্ত বলেও একবার জানতে পেরেছিলাম। ওর পড়াশুনাও তখন শেষ হয় নি। চাকরী অনেকটাই অনিশ্চিত। ওর সঙ্গে নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলা মানে নিশ্চিত একটা ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাওয়া। একজন বাবা কিছুতেই তার আদরের রাজকন্যাকে এরকম একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে সাহস করবেন না। আমার বাবাও নিঃসন্দেহে তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু সুমনকে ছাড়া আমি আমার জীবনকে কল্পনাও করতে পারছিলাম না। বাবার সম্মান আর তার সারাজীবনের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা আমার কাছে নিতান্ত হয়ে উঠলো, বড় হয়ে দেখা দিলো স্বল্প দিনের পরিচিত এক যুবকের ভালোবাসা। সকল মায়ার বাঁধন, সুখ-স্মৃতিকে পিছনে ফেলে আমি বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে।
পথে যেতে যেতে বাবাকে নিয়ে আমার ছোটবেলার স্মৃতি চোখে ভাসতে লাগলো। অনেক রাত তখন। বাবা এসে দেখলেন আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। মা কাঁদছেন। তাঁর চোখের উষ্ণ অশ্রু আমার শরীরে লেগে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায়ও সেই পবিত্র অশ্রুর স্পর্শ আমাকে শিহরিত করে তুলছে। হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রণার প্রকোপটাও কমিয়ে দিচ্ছে একটু আধটু। বাবার চেহারায় বিধ্বস্ত ভাব। সারাদিনের কাজের ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়েছেন। আমার বয়স কতই বা হবে তখন; ৭/৮। বাবা বসলেন না। আবার বেরিয়ে পড়লেন বাজারের উদ্দেশ্যে। এতো রাতে সুজিত কাকার ঔষধের দোকানটা খোলা থাকবে না। তবুও বেরিয়ে পড়ার অন্তরালে যে শক্তিটি প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে তা হলো সন্তান বাৎসল্য। হয়তো সুজিত কাকাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনবেন। বলবেন, “আমার মেয়েটা খুব অসুস্থ সুজিত দা। তোমাকে আসতেই হবে।” সেই অসুস্থতার রাতগুলোতে বাবা আমাকে সারারাত কোলে নিয়ে বেড়াতেন; বাড়ির উঠোনে, পুকুর পাড়ে। প্রতিবার আমি অসীম বিস্ময় নিয়ে অনুভব করতাম, বাবা কোলে নিলেই আমার অসুস্থতার যন্ত্রণাটা প্রশমিত হতো। সেইসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ভিজে এলো। বাসে পাশের সিটে বসে থাকা সুমনকে বুঝতে দিলাম না একটুও।
আমাদের বিয়ে হলো মগবাজার কাজী অফিসে। শুরু হলো আমার কষ্টের দিন। টিকাটুলির গলির একটা এক কামরার বাসায় নিদারুণ কষ্টে কাটতে লাগলো আমার দিবস রজনী। সুমন আর রাবি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিটা নিতে পারলো না। নিয়মিত নেশা করে বাসায় ফিরতে লাগলো। খাবারের কোনো ব্যবস্থা করলো না। প্রায় রাতেই আমাকে না খেয়ে ঘুমাতে হলো। ঝগড়াঝাটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। একদিন এসে আমাকে প্রচন্ড মারধর করে রক্তাক্ত করে ফেললো। ধীরে ধীরে ওর আসল চেহারা আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগলো। আমার বারাবার মনে হতে লাগলো, বাবাকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে আমি বড় ভুল করে ফেলেছি, মস্ত বড় ভুল। একদিন সুমনের এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওর ঢাকায় আরেকজন স্ত্রী আছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
বিভীষিকাময় এ জীবন ছেড়ে একদিন আমি সাহস করে লজ্জার মাথা খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। প্রয়োজনে গিয়ে বাবার পায়ে পড়ে যাবো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই একজন প্রতিবেশী মহিলা আমাকে দেখেই বললো, “এমন মেয়ে যেন কারো ঘরে না জন্মায়। বাবাটাকে মেরে ফেলেছে।” আমার বুকটা ধক করে উঠলো। বাড়িতে প্রবেশ করতেই সুনসান নীরবতা লক্ষ্য করলাম। আমার আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেছে। আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার তিনদিন পর বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ভাইয়া এগিয়ে এসে চুপচাপ আমার দিকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা খুললাম। যেখানে লেখা, “বাবাকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেললি রে মা! বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেললি। তোকে প্রচন্ড বিশ্বাস করেছিলাম। পারলে বাবাকে মাফ করে দিস।”
সমাপ্ত