– আচ্ছা তুই কি কোনদিন সিরিয়াস হবি না ?
– আমি তো সবসময়ই সিরিয়াস, হাহাহা !
– আচ্ছা সবসময় তুই ফাজলামো কেন করিস ?
– আজব আমি কি ফাজলামো করলাম ?
– দেখিস একদিন তোর এই ফাজলামোর জন্যই আমাকে হারাবি ।
স্যার আসবো ? এই ডাকেই অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে জাহিদ । নীলার সাথে শেষ কিছুদিনের কথাপকথনগুলো আনমনা হয়ে ভাবছিলো সে এতোক্ষন । কথাগুলো কোনভাবেই ভুলতে পারে না জাহিদ । সেক্রেটারি আনিলার ডাকে তার ভাবনায় ছেদ পড়লো ।
– কি ভাবছিলেন স্যার ?
– কিছু না !
– আপনি প্রায়ই এমন আনমনা হয়ে কি যেন ভাবেন।
– কাজ করতে করতে আগের দিনের কথা মনে পড়ে এই যা !
– স্যার আপনি বিয়ে করবেন কবে ?
– আনিলা, তোমাকে না নিষেধ করেছি !
– সরি স্যার ।
– বিয়ে টিয়ের কথা অফিসে বলবে না !
– আচ্ছা স্যার আরেকটা প্রশ্ন করি ?
– নাহ, আজ কার কার সাথে মিটিং আছে বলো ?
জাহিদ এখন একটা কর্পোরেট কোম্পানির এমডি। সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । কাজ ছাড়া তার কাছে আর কোন কিছুরই যেন মূল্য নেই। নিজের কর্মদক্ষতার জন্যই আজ তার এই অবস্থান । অথচ ১০ বছর আগে তার থাকার জন্য ঘর ছিলো না । তবুও যেন আজকের এই অবস্থান থেকে তখনই সে সুখি ছিলো । তখন তার নীলা ছিলো । ভালোবাসাময় এক জীবন ছিলো ।
– স্যার আজকে কি আমার সাথে লাঞ্চ করবেন ?
– আনিলা তুমি আমাকে কারো সাথে লাঞ্চ করতে দেখেছো ?
– স্যার, আমি জানি কিন্তু আজকে খেতেই হবে আমার সাথে ।
– কেন আজকে কি কোন বিশেষ দিন ?
– জী স্যার, আজকে আমার বার্থডে ।
– কিন্তু আনিলা আমি তো সবসময় একা একা লাঞ্চ করি !
– স্যার প্লিজ না করবেন না প্লিজ ।
– আচ্ছা আজকেই প্রথম এবং আজকেই শেষ ওকে ?
– থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ স্যার ।
– তা বার্থডে গিফট কি চাও ?
– সেটা স্যার লাঞ্চের সময় বলি ?
– আচ্ছা !
জাহিদ সবসময় একা থাকতেই পছন্দ করে । কারো সাথেই কাজ ছাড়া তেমন কথা বলে না । নিজের জগতটা যেন সে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে । জাহিদের মা-বাবা অনেক আগেই গতো হয়েছেন । জাহিদই তার মা বাবার একমাত্র ছেলে । মা-বাবা মারা যাবার পর অনেক কষ্টে সে আজ এই পর্যায়ে এসেছে । জাহিদের জীবনে একমাত্র পাওয়া যেন নীলাই যাকে সে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে ফেলেছে ।
– আচ্ছা জাহিদ তুই কি আমাকে ভালোবাসিস ?
– এটা কেমন প্রশ্ন নীলা ?
– উত্তর দে ।
– আমি তোকে কখনো কি বলি নি ?
– আচ্ছা তুই প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন কেন করছিস ?
– হ্যাঁ আমি তোকে ভালোবাসি ।
– আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি ?
– আচ্ছা তুই কি ইদানীং বাংলা সিনামা দেখছিস ? হাহাহা !
– আবার ফাজলামো ? তোকে না নিষেধ করেছি ?
– তুই সবসময় এতো সিরিয়াস কেন বলতো ?
– আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতি ।
স্যার, আবারো আনিলার কথায় পূরনো ভাবনাটা বেশিদুর এগোলো না জাহিদের । যাক ভালোই হলো কষ্টটা কিছুক্ষণ ভুলে থাকা যাবে হয়তো । নীলার সাথের সময়গুলো যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো । তাইতো এখন সবকিছু হাতে পেয়েও যেন এইসবের মূল্য ফিকে মনে হয় তার কাছে ।
– স্যার, আপনি এখনো কাজ করছেন ?
– অফিসে তো কাজ করতেই আসি আনিলা !
– স্যার, লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে সেই কখন ।
– হুম দেখেছি । যাও তুমি গিয়ে লাঞ্চ করো !
– স্যার, এর মধ্যে ভুলে গেলেন ?
– কি ভুললাম ?
– আমাদের না আজকে একসাথে লাঞ্চ করার কথা ?
– ওহ হ্যাঁ তাই তো । দেখছো ভুলে বসে আছি !
– স্যার, আপনার কি হয়েছে বলেন তো ?
– আসলে বুড়া হয়ে গেছি তো !
– মাথা, চলেন দেরী হচ্ছে ।
– হুম চলো !
জাহিদ তার সেক্রেটারি আনিলাকে নিয়ে একটা রেস্ট্রুরেন্টে যায় । আসার সময় অফিসের সবাই ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো । যেন এই ঘটনা ১০ বছরে ১ বার ঘটে মাত্র । জাহিদ অনুভুতিহীন থাকলেও আনিলাকে বেশ খুশি খুশিই দেখা যাচ্ছিলো ।
– এই জাহিদ ।
– হুম বল নীলা !
– বললি না অনেক ক্ষুধা লাগছে ?
– হুম লাগছিলো তো !
– তো খাচ্ছিস না যে ?
– কই খাচ্ছি তো !
– রান্না মজা হয় নায় তাই না ?
– আরে না অনেক মজা হইছে !
– জানি মিথ্যা বলতেছিস ।
– আরে হইছে তো বাবা অনে মজা !
– হুম তোর খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে ।
জাহিদ আর আনিলা খাবারের অর্ডার করেঠায় বসে আছে । জাহিদ আবার কল্পনায় ডুব দিয়েছে । আনিলা ভাবছে এতো কিভাবে কল্পনায় ডুব দিতে পারে একটা মানুষ ? তবে আনিলার জন্য ভালোই হলো । কাছ থেকে জাহিদকে ইচ্ছামতো দেখার সুযোগ পাওয়া গেলো । আনিলা জাহিদকে সেই কবে থেকে ভালোবাসে । কিন্তু মেয়েটা কোনভাবেই জাহিদকে বলতে পারে না । হাজার হলেও বস তো ।
– স্যার, একটা কথা বলি ?
– হুম বলো আনিলা !
– আপনি কাউকে ভালোবাসতেন ?
– জানাটা কি খুব জরুরী ?
– হ্যাঁ অনেক জরুরী ।
– হ্যাঁ বাসতাম আর এখনো বাসি !
– মেয়েটার ব্যাপারে আমাকে বলবেন ?
– না বলবো না !
– কেন ?
– এটার উত্তরও বলবো না !
– আচ্ছা স্যার, আপনাকে একটা কথা বলবো ?
– আমি জানি তুমি কি বলবে আনিলা !
– তাহলে স্যার আপনার উত্তরটা কি ?
– আমার উত্তর কি সেটা তুমি ভালো করেই জানো !
আনিলার চোখের কোণে কাজল লেপ্টে যাচ্ছে চোখের জ্বলে । জাহিদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে । সে খাবার খাচ্ছে নির্বাকভাবে । আজ যেন আনিলার কাঁদার দিন। জাহিদ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলো আনিলার ব্যাপারটা । কিন্তু জাহিদ কখনো নীলার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবে না । তাই আজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনিলার সাথে লাঞ্চ করতে এসেছে । বাধ্য হয়েই আনিলার মন ভাঙছে । যাতে আনিলা তার এই ভালোলাগাকে এখানেই শেষ করে দেয় ।
– আনিলা !
– হ্যাঁ স্যার ।
– আমি তোমাকে নীলার কথা কেন বলিনি জানো ?
– কেন স্যার ?
– আমি যদি ওর কথা তোমাকে বলি তাহলে তোমার মনে হবে ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে । আমি ভালো করেই জানি ওর কোন দোষ ছিলো না । বরং দোষ আমারই ছিলো । আমিই ওকে হারিয়ে ফেলেছি আমার খামখেয়ালির জন্য । আর আমি চাই না আমার নীলাকে কেউ দোষী ভাবুক । কারণ আমি ওকে এখনও ভালোবাসি । আমার পক্ষে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় । আর প্রতিনিয়ত আমি ওর কথাই মনে করি । তুমি কি বুঝতে পেরেছো ?
– হ্যাঁ স্যার ।
– চলো এখন উঠি !
জাহিদ আনিলাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে এল । আজ আর তার কাজে মন বসবে না । আজ তার মন খারাপের দিন । নীলার কথা খুব মনে পড়ছে খুব । ইশ সেদিন যদি নীলার হাত ধরে অজানাতে চলার সাহসটা করতো জাহিদ তাহলে হয়তো আজ এই দিন দেখতে হতো না । আচ্ছা মেয়েটা কি এখনো জাহিদের কথা ভাবে ? নাকি সব ভুলে টুলে দিব্বি সংসার করছে ? হাহাহা এইসব চিন্তাগুলো যেন জাহিদের চারপাশে ঘুরছে আর ঘুরছে । এই চিন্তার শেষ কই সেটা জাহিদ নিজেও জানে না । জাহিদ কেন কেউই জানে না ।
কিছু ভালোবাসার কোন উদ্দেশ্য থাকে না, কোন লক্ষ্য থাকে না । হারিয়ে ফেলার পরও
তাকে ভালোবেসে যাওয়াটা বোকামি ঠিকি কিন্তু যে ভালোবাসে তার কাছে এটাই হয়তো ভালোবাসার অন্য রূপ । আবার কেউ কেউ লুকিয়ে ভালোবাসে হয়তো গোপনে । পৃথিবীতে নিজের দোষ স্বীকার করার মতো ভালোবাসার মানুষ খুব কমই আছে । আর দিনশেষে ভালোবাসাটাই বেঁচে থাকে, ভালোবাসার মানুষ নয় !