-কিরে হারামি ভাবীর জন্য চুড়ি কিনেছিস? কালো,লাল,নীল চুড়ি তাও কাঁচের!
-হুম। চুড়ি পছন্দ করে বুঝি!
-অনেকটাই। কাজল,চুড়ি হালকা কালারের লিপস্টিক তার পছন্দের।
-তাই নাকি!
-হুম।
-আচ্ছা নে ধর একটান দে!
-কিছুদিন আগেও অভ্যাস ছিলো এখন আর নেই। মেয়েটা আমার সবকিছু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে! ছেড়ে দিয়েছি।
-তাই বলে এখন আমাদের সাথেও টানবি না? এতোটাই পর করে দিলি?
-পর করবো কেন হারামি? শুধু এই অভ্যাসটা ছেড়ে দিয়েছি।
-আচ্ছা।
-হুম।
তারপর আমার হাত বেঁয়ে রক্ত পড়ছে। অথচ আমার সেদিকে খেয়ালই নেই তাকিয়ে আছি তাসিন নামের মেয়েটার দিকে! তারপর হঠাৎই রুবেল আর অর্কর ডাকে ওদের দিকে তাকালাম।
-কিরে কি করেছিস! চুড়িগুলো ভাঙ্গলি কিভাবে! হাত থেকে রক্ত পড়ছে। আমিও অবাক হয়ে গেছি! চুড়িগুলো হাতের চাপায় টুকরো টুকরো হয়ে গেলো! রাগ হলে মানুষের শরীরের শক্তি সর্বোচ্চ মাত্রায় চলে যায়।
মেয়েটার স্বামী তো এটা নয়! অন্যের সাথে এভাবে হাত ধরে দ্রুত হাঁটছে! হাতে দুটো বড় বড় লাগেজ। মনে হচ্ছে পালাচ্ছে এমন দেখা যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের আমতলায় দাঁড়িয়ে আছি আর তাকিয়ে দেখছি ওদের দিকে!
শুরুটা ছিলো একাদশে। কোনো এক মহাজ্ঞানী বলেছিলেন প্রত্যেকটা ছেলে তার মেয়ে বেষ্ট ফ্রেন্ডের প্রেমে পড়বেই। আমিও পড়েছিলাম। হ্যা সেই মেয়েটাই তাসিন। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম হয়েছিলো। দুজনের প্রতি দুজনের কেয়ারিং, রাগ, অভিমান, ভালোবাসা অনেকটা বেশি ছিলো সব মিলিয়ে মিষ্টি একটা সম্পর্ক! কলেজের বন্ধুবান্ধবগুলো হিংসে করতো। কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখলেই অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিতো আর তার কৈফিয়ত দিতে হতো আমায়। আমিও ওকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দিতাম না।
-হ্যালো।
-হুম বলো।
-কি করছো?
-মেহেদী লাগাচ্ছি।
-কার হাতে?
-বড় ভাবীর হাতে।
-কি তুমি ভাবীর হাত ধরে মেহেদী লাগাচ্ছো! আমার হাত ছাড়া আর কারো হাত ধরো কি করে তুমি?
-আরে উনিতো আমার ভাবী।
-যাই হোক। পরেরবার মেহেদী লাগাতে হলে হাতে গ্লাভস পড়ে নিবে।
-ঠিকাছে।
কয়েকদিন পর বন্ধুর প্রেমে হেল্প করতে গিয়ে আমি পড়লাম মহা ঝামেলায়। আসলে বাঙ্গালি ছেলেরা প্রপোজ করতে বন্ধুর সহযোগিতা নিবেই। এখন ওর হয়ে আমি গিয়ে ওর পছন্দের মেয়েটিকে লাভ লেটার দিতে হবে। সাথে আবার একটা গোলাপও আছে। যদিও রাহাত আমার সাথেই ছিলো কিন্তু ওই মেয়েকে আমি লেটার আর ফুল দিয়ে ওর কথা বলছিলাম আর এটাই দূর থেকে তাসিন দেখে নিয়েছিলো৷ আমি ওকে দেখিনি। আমি ওর কাছে যেতেই বলতে লাগলো,
-আমার আবেগ নিয়ে এভাবে না খেললেই পারতি।
-আমি কি করলাম।
-বিষ এনে দিতে পারবি?মারলাম জোরে এক চড়! কাঁদতে-কাঁদতে আমায় জড়িয়ে ধরে বলছে,
-আমি তোকে ছাড়া বাঁচবোনারে, সত্যি বলছি। বাঁচলে তোর সাথে আর মরলেও তোর সাথেই। আমায় ছেড়ে যাস না, অবহেলা করিস না। মরে যাবো আমি। খুব বেশি ভালোবাসি রে।
-আমিও তো বাসি।
-তুই কাকে প্রেমপত্র দিয়েছিস তাহলে?
-আরে আমি দিয়েছি ঠিকাছে, কিন্তু আমার জন্য না।
-কার জন্য?
-রাহাতের জন্য।
-সত্যি তো?
-হুম।
ভালোবাসার খুনসুটি ভালোই চলছিলো। তুমি করে সম্বোধন করা হতো। কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতাম না। তারপর অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালে একদিন আমার সাথে ওর কথাগুলো ছিলো,
-আর কতদিন আমি বাবাকে নানা বাহানা দেখিয়ে বিয়েগুলো ভাঙবো? তুমি কিছু করতে পারলে করো নয়তো আমি বিয়ে করে নিচ্ছি।
-অপেক্ষা করতে পারবে? আর পালালে কিন্তু আমি তেমন কিছুই করতে পারবোনা আপাদত, অভাবে থাকতে হবে কিছুদিন।
-পালাতে পারবোনা, আমি পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে চাইনা। অপেক্ষা তো অনেকভাবে বাহানা দেখিয়ে করলাম আর বোধ হয় সম্ভব না। নিজের খেয়াল রেখো।
-তা পাত্র কি করে?
-হেয়ার স্পেশালিষ্ট!
-চুলের ডক্টর?
-হুম।
-আচ্ছা ভালো। শুভ কামনা। তুমিও ভালো থেকো। ভাগ্যিস দেহের খুনের শাস্তি হয়, আত্মার নয়!
-বাই।
-হুম।
অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছি ওর চলে যাওয়ার দিকে। অনেক সম্পর্ক এভাবেই শেষ হয়ে যায়, পরিবারের বিরুদ্ধে আমি যেতে পারবোনা! কেন! হাত ধরার সময় পরিবারের কথা ভাবতে পারেনি একবার! পরিবার তখন বলেছিলো সম্পর্ক করতে? সারাজীবন থাকবে বলে সম্পর্ক করে এখন কেনো বাহানা! তখন কেন বলতে পারো তোমায় ছাড়া বাঁচবোনা, মরে যাবো, ছেড়ে যেওনা, সত্যি বলছি। হুহ আবেগ কি এতোই সস্তা! এতোগুলো কথা দিয়েও রাখতে পারলো কই!এখন কিভাবে অন্যের সাথে ভালো থাকবে! সেদিনকার মতো একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরলাম। অনেকদিন একা হয়ে গেছিলাম, চুপচাপ থাকতাম। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না হওয়ার কারণে অনেক শুকিয়ে গেছি। ঘুম কম হওয়ায় চোখের নিচে কালি জমেছে।
-কিরে হাসিব তুই এরকমই থাকবি সবসময়?
-কি রকম?
-একাকীত্বের সাথে?
-চুপ কেন? এই নে টান দে, রিল্যাক্স লাগবে!
প্রথম দিকে প্রচুর কাশি আসছিলো, পরে ঠিক হয়ে গেছে। নিকোটিনে কষ্ট অনেকটা হ্রাস পায়, হয়তো স্নায়ুতে চাপ পড়ায় কিছুক্ষণের জন্য স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে রাখে। তারপর থেকে এলাকায় যত বখাটেপনা হতো সব আমাদের দ্বারাই। এভাবে কেটে গেলো আরও প্রায় দুটি বছর। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আছি। যদিও এখন আর প্রিন্সিপাল ও প্রফেসরেরা আমায় সহ্য করতে পারেনা। একদিন স্টেশনের ধারে আমতলায় দাঁড়িয়ে বন্ধুরা সহ সিগারেট টানছিলাম। দ্বাদশ শ্রেণীর মেয়েদের একটা গ্রুপ হেঁটে যাচ্ছিলো সামনে দিয়ে। ইভটিজিং করতে গিয়ে আমি ইচ্ছে করেই ওদের মুখের সামনে গিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লাম। ঠিক তখনই একটা মেয়ে আমাকে ঠাস করে গায়ের সব জোর দিয়ে চড় মেরে বসলো। কিছুক্ষণের জন্য মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো আর কান লাল হয়ে গেছে! হাতে জোর আছে মেয়েটার। পরেরদিন আবার সামনে গেলাম৷ সেদিন আমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিলো আর আমার হাতে একটা ললিপপ দিয়ে বললো এইটা খান। আমি থ’ হয়ে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার তো প্রচুর সাহস!তারপর আরোহী মেয়েটার এরকম চাঞ্চল্যকর আচরণ হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করলো। রোজ পিছন পিছন যেতাম।
-এই আপনি রোজ আমায় ফলো করেন কেন?
-চুপ করে আছেন কেন?
-আর করবোনা।
-হুম। আর যাতে না দেখি।
-আচ্ছা।
প্রায় পনেরো দিন পরে। বিকেলে প্ল্যাটফর্মে বসে বসে সিগারেট টানছিলাম। হাজারো কষ্টের মাঝে একচিলতে সুখ! আত্মহত্যা করার চাইতেও কিছুটা কষ্ট কমিয়ে রাখা ভালো, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভাবলে চলে! এমন সময় কোথা থেকে এক বোরখাওয়ালী এসে আমার হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বললো,
-আমি ডিস্টার্ব ফিল করি।
-কিন্তু আমিতো আর ডিস্টার্ব করিনা।
-ডিস্টার্ব করেন না বলেই ডিস্টার্ব ফিল করি। কোথায় ছিলেন এতোদিন? কলেজ টাইমে আসেন না কেন?
-আপনি বারণ করছেন আসতে না তাই।
-আমি বললেই শুনতে হবে?
-আবার চুপ করে আছে! আর শুনেন এইসব ছাইপাঁশ যেন আর খেতে না দেখি। আর খাইলে খান সমস্যা নাই তবে আপনি খেলে আমিও আপনার হাত থেকে নিয়ে খাবো এবার। আর চুল এরকম এলোমেলো কেন! কেমন দেখা যায়!
তারপর আমার এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে আঁচড়িয়ে দিয়ে বললো প্রত্যেক দিন কলেজ যাওয়ার সময় আর ছুটির সময় এখানে দাঁড়াবেন।
-হুম। কয়েকদিন পর,
-এখনও বললেন না?
-কি?
-প্রপোজ করতে লোকে কি বলে?
-বললেই তো হারাতে হয়।
-হারাবেন না আর।
-কিভাবে বুঝবো?
-আমরা কালই যাবো। পরে কেউ মানুক আর না মানুক তা ভেবে হারানোর ভয় করবোনা৷ মানলেও আপনাকে চাই, না মানলেও আপনাকে চাই।
-কিন্তু কাল কোথায় যাবো?
-কাজী অফিসে। নিবন্ধন কার্ড সাথে নিয়েন, রেজিস্ট্রি করতে।
-সিরিয়াস?
-হুম।
পরেরদিন রুবেল, অর্কদের স্বাক্ষী রেখে কোটম্যারেজ করে আসছিলাম৷ পরে অরু ওদের বাড়িতেই চলে যায় কিন্তু আর কাউকে জানানো যাবে না। ওর ইন্টার ফাইনালের পর সবাইকে জানিয়ে তবে নিয়ে আসবো। এবার কেউ মানুক আর না মানুক। কয়েক মাস পর। আমার অনার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে অনেকদিন হলো।
-চাকরি-বাকরি কিছু কি করবেনা নাকি এভাবে আড্ডাতেই সময় কাটাবে?
-হুম। এপ্লিকেশন করছি তো।
-যতদ্রুত সম্ভব তুমি জয়েন করবে।
একটা বেসরকারি এনজিওতে ছোটখাটো অফিসার পোস্টে জয়েন করছি। সরকারি চাকুরিজীবীদের তুলনায় আমার স্বল্প বেতনের চাকরি কিছুই না। ওর ইন্টার পরীক্ষা শেষে ওর বাবা মা বিয়ের কথা বলায় ও বললো আমার রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। তারপর তারা ওকে অনেক কথা শুনালো। এরপর আমায় ডাকালো আর বললো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিতে। আমি স্রেফ করবোনা বলে দিয়েছি। তারপর থানায় আমার নামে ডায়েরি করা হলেও অরুকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তখন তারা আমার কিচ্ছু করতে পারেনি। অরুর সোজাসাপটা উত্তর ছিলো আমি এখন সাবালিকা, আমার সিদ্ধান্ত আমিই নিতে পারি। আপনাদের কোনো রাইট নেই এভাবে টর্চার করার! সেদিন আরোহীর বাবা-মা ওকে বলে দিয়েছে আমায় চাইলে যেনো আর মুখ না দেখায় তাদের। আরোহীও সোজা আমার হাত ধরে আমার সাথে চলে আসছিলো। এভাবে বিয়ে করায় আমার বাবাও প্রথমে মানতে পারেনি। বাবা চেয়েছিলো আমি যেনো ফ্যামিলিগত ভাবেই বিয়ে করি। তাই আমার সাথে কয়েকদিন কথাই বলেনি। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছে।
-হাসু।
-হুম বলো।
-দেখোনা চুলের আগা কেমন ভেঙে যায় শুধু। চলোনা একজন হেয়ার স্পেশালিষ্টের কাছে যাই।
-শুক্রবারে যাই?
-আচ্ছা ঠিকাছে।
-শহরের সেরা সেরা স্পেশালিষ্টদের মধ্যে আফতাব আহমেদ একজন। আরে সেদিন তো তাসিন এই নামটাই বলেছে। ভালোই হলো একবার দেখেও আসা যাবে লোকটাকে।
সেখানে গিয়ে আমিতো ভ্যাবাচ্যাকা! মনেমনে বলেই ফেললাম আরে শালা! ভালোবাসার সময় স্মার্ট খুঁজে, তার পছন্দের শার্ট কিংবা টিশার্ট না পড়লে ঘুরতে যাওয়া নিষেধ ছিলো। অথচ দেখো তার বর একখান মাঝবয়েসী হবে। আর কয়েকবছর গেলেই বার্ধক্য নেমে আসবে! ভুরি একটা যেনো বাংলাদেশ সরকারের আমদানির গোডাউন! আমি হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললাম অরু তুমি উনার সাথে কথা বলো, আমি বাহিরে আছি। কিছুক্ষণ পর অরু ফিরে এসে জিজ্ঞাস করলো,
-ওভাবে হেসে উঠলে কেনো?
-হেয়ার স্পেশালিষ্ট!
-হুম।তো?
-উনার নিজের মাথাই যে ইংল্যান্ডের ডেথ পিচের স্টুডিয়াম যদিও ডান-বাম আর ব্যাক সাইডে একটু গ্যালারি আছে!
অরু আমাকে আলতো একটা কিল দিয়ে হাসতে হাসতে বললো, যা শয়তান একটা।
আমার কেমন একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। তবুও ভাবলাম যাক ওর বাবা-মা যখন ভাবছে ওভাবে হলেই মেয়ে সুখী হবে তাহলে তাই ভালো। এর প্রায় বছর তিনেক পর, অরুর বাবা আমার কলিজার টুকরো বাবুনীটার সাথে খেলা করতেছে। উনি এখন আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। একমাত্র নাতিন দেখার জন্য আর মুখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি তার। এখন মাঝেমধ্যেই আমাদের বাসায় চলে আসে নয়নের সাথে সময় কাটাতে। ভালো নামটা অবশ্য নয়নতারা আর্শিয়া হিমু, আদর করে নয়ন বলেই ডাকে সবাই। হাটতে পারে ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে, কথাও বলে টুকটাক।
-এই শুনোনা।
-হুম বলো।
-আসার সময় রেশমি চুড়ি আনতে পারবে?
-হঠাৎ রেশমি চুড়ি।
-আনতে বলছি আনবে। আগেরগুলো ভেঙ্গে গেছে।
-আচ্ছা।
চুড়ি নিয়ে আসার সময় প্ল্যাটফর্মের আমতলায় রুবেল আর অর্কর সাথে দেখা। কথা বলতে বলতেই খুব চেনা একজোড়া চোখে আমার দৃষ্টি আটকে গেলো! মেয়েটা তাসিন কিন্তু সাথে তো এটা আফতাব আহমেদ না। ওর ভাইকেও আমি চিনি। আমার জুনিয়র বয়সী একটা ছেলের সাথে এতো বড় দুটো ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। আর দুজনের চোখে অস্থিরতার ছাপ দেখে মনে হচ্ছে শহর থেকে দূরে কোথাও পালাচ্ছে! এইটা দেখেই আমি রাগে হাতে থাকা কাঁচের চুড়িগুলো চাপ দিতেই ভেঙ্গে হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছিলো। এভাবেই গেলাম ওদের সামনে।
-কোথায় যাচ্ছিস? এটা কে?
-চুপ করে আছিস কেনো?
-বুঝতে পারছি! কেনো রে এবার তোর বাবার ঠিক করা পাত্র নিয়ে সুখী না? একটা জুনিয়র ছেলের সাথে এখন কেনো পালাচ্ছিস? টাকা-পয়সা তোকে সুখ দিচ্ছেনা? চুপ করে আছিস যে কিছু তো বল! তা কতো দিনের এই সম্পর্ক?
-আসলে আমি সরি। আমি বুঝতে পারিনি।
-এখন আমি চাইলেই ছেলেটাকে ধরে বাঁধতে পারি।
-প্লিজ এমন করিস না। তোর পায়ে ধরে মাপ চাই।
তারপর ওর মুখোশটা টান দিয়ে খুলে আমার হাতের রক্তগুলো মুখে মাখিয়ে দিলাম। আর বললাম ভাগ্যিস মনের খুনিদের সাজা হয়না। তা হলে কবেই তোর মৃত্যুদণ্ড হয়ে যেতো। যা যেখানে যাচ্ছিস। তবুও ভালো থাকিস।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে আসলাম। আবার নতুন চুড়ি এনে, কম্পাউন্ডার থেকে একটু ব্যান্ডেজ করে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। বাসায় ঢুকতেই অরু আমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।
-কি হয়েছে তোমার? হাতে ব্যান্ডেজ কেনো?
-কিছুনা। একটু কেটে গিয়েছিলো।
-কতবার করে বলি সাবধানে চলাফেরা করতে।
-ওই একটুই তো।
-তাতে কি? তবুও সাবধানে চলবে রাস্তাঘাটে।
-আচ্ছা।
রাত এগারোটার দিকে অরু কালো শাড়ী আর রেশমি চুড়ি, খোলা চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। আবার নয়নকেও নতুন ড্রেস পড়িয়েছে। এগারোটা পঞ্চান্ন বাজতেই লোডশেডিং। অনেকগুলো মাটির প্রদিপ একসাথে জালিয়ে দিয়ে লাভ আকৃতির একটা আলোকচিত্র তৈরি করলো আর কোথা থেকে আমার বাবা-মা আর অরুর বাবা-মা এসে পাখার সাথে কয়েকটা বেলুন ঝুলিয়ে নয়নের হাত ধরে খেলনা পিস্তল দিয়ে ওগুলোকে স্যুট করলো আর অনেকগুলো রঙ্গিন কাগজের বৃষ্টি হলো আর সবাই একসাথে বলে উঠলো শুভ বিবাহ বার্ষিকী! আমার তখনই মনে হইছে ঠিক এই তারিখেই আমরা কোটম্যারেজ করছিলাম৷ কিন্তু বিরাট মিস্টেক হয়ে গেছে ভেবে রুবেল আর অর্ককে ফোন দিতে যাচ্ছিলাম এমন সময় রুবেল বলে উঠলো আমরা মিসিং নেই। ভাবী আমাদের আগেই ইনভাইট করে রাখছে।
তারপর অনেক আনন্দ করে উদযাপন করেছিলাম সবাই মিলে। পরে অবশ্য ঘুমানোর আগে আমি আর অরু দুজনেই তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে নিলাম অনেক ভাগ্য করে আমরা একে অন্যকে পেয়েছি। ভালোবাসার খুনসুটি কখনোই কমবার নয়।
প্রায় মাস তিনেক পরে আরোহীর ইচ্ছে হলো ঘুরতে যাবে পার্কে। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেদিকেই তাসিনদের বাসা। দোতলা থেকে দাঁড়িয়ে আগে রোজ আমায় দেখতো। না চাইলেও নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেলো সেই চেনা বারান্দায়! আরে তাসিন বারান্দায় কেনো! ও তো চলে গিয়েছিলো ট্রেনে করে কোথায় যেনো, একটা ছেলের সাথে। তাহলে তো এখন বাড়ি ফেরার কথা না। এমনিতেই সমাজের চোখে আর ওর বাবা-মা ওকে অনেক হেনস্তা করবে। হয়তো মনের ভুল, আগের স্মৃতি থেকে এমন হতেই পারে। তবুও কেমন খটকা লাগলো। রিক্সা থামাতে বললাম।
-অরু তুমি বসো আমি একটু আসতেছি।
-কোথায় যাবে?
-এই উপরে আমার একটা বন্ধুর সাথে দেখা করেই চলে আসবো। পাঁচ মিনিট লাগবে।
-আচ্ছা যাও।
অরু আর নয়নকে রিক্সায় রেখে উপরে দোতলায় গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খোলা হলো! আরে সত্যিই তো তাসিন! আসলেই ভুল দেখিনি।
-তুই না চলে গেছিলি কার সাথে?
-হুম।
-তাহলে এখানে কেনো?
-যার সাথে গেছিলাম ওই ছেলেটা দুই বছর আগে একটা স্মাগলার চক্রের সাথে যুক্ত ছিলো। আমি এটা জানতাম না আগে। হঠাৎই ওকে এনকাউন্টারে স্যুট করে দিয়েছে।
-হুম বুঝলাম। মানুষের মনেরও অভিশাপ আছে, মুখে দিতে হয়না। মনে পড়ে কি সেদিনের মন ভাঙ্গার গল্পটা? আচ্ছা আফতাব সাহেবের নিকট আর গেছিলি? ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।
-হুম গেছিলাম।
-কি বলছে?
-মেনে নেয়নি। কেউই হয়তো এটা মেনে নিবেনা। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিছে৷ বাসায় আসছি পরেও বাবা-মায়ের অনেক কথা শুনতে হইছে! চারদিকে লোকে তো কানাঘুষা রোজই করে।
-তারা কেনো কথা শুনালো! মেয়েকে অট্টালিকা দিতে চেয়েছে, সুখ তো দিতে চায়নি। অট্টালিকায় তাদের মেয়ে সুখী না! এখন বিয়ে করতে চাইলেও বর পাবি ঘরজামাই, যে নিজে কিছুই করতে চাইবেনা। এখন বরের সম্পদ খুঁজবেনা তোর বাবা? যাকগে ছাড়। আমাকে যেতে হবে নিচে অরু আমার নয়নকে নিয়ে অপেক্ষা করে বসে আছে, ভালো থাকিস।
আমি চলে আসলাম একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিলাম ওর চোখ গড়িয়ে শ্রাবণের ধারা বইছে। ঠিকই আছে এমনটা হওয়ারই কথা। আজকের দিনে মেয়ের অভিভাবকগুলো মনে করে মেয়েকে সুখী রাখতে সরকারি চাকরি আর আলিশান বাড়িই সব! তাহলে কেনো ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে! তাও আবার সত্তর শতাংশ ডিভোর্স মেয়েই দিচ্ছে। তাদের আবার বেশিরভাগ সম্ভ্রান্ত পরিবারের বউ! কেনো টাকা তাদের সুখ দিচ্ছেনা? আপনার মেয়ে ভালো থাকবে বলে বিশাল অবস্থা সম্পন্ন ফ্যামিলিতে দিচ্ছেন এবার বর ভুড়িওয়ালা, মধ্যবয়সী, মাথায় টাক থাকুক সেটা আপনাদের মাথাব্যথা না। কিন্তু আদৌ কি ভালো থাকে! জানতে চান কখনও আপনারা তার সুখ কিসে? না হলে এই হারে পরকিয়া কেনো বাড়ছে!
এভাবেই অনেকে স্বামী রেখে পালিয়ে যাচ্ছে নয়তো ডিভোর্স নিয়ে নিচ্ছে! কেনো আপনার ঠিক করা বরের কাছে মেয়ে সুখ পায়না? তখন আপনাদের আত্মমর্যাদা কোথায় যায় যখন এগুলো জেনে সমাজ ছিঃছিঃ করে? টাকাই সব আপনাদের কাছে? লোকচক্ষু আড়ালে আজ এমন অজস্র পরকিয়া আছে যা আপনি আমি কেউ জানিনা। সবগুলো সম্মুখে আসলে আদৌও কি টিকবে আপনার সিলেক্ট করা জামাইকে নিয়ে আপনার মেয়ের সংসার! সত্যি কথাগুলো বললেই হাসিব শান্ত খারাপ হয়ে যায়। তার মুখের ভাষাও কুটিল! কিন্তু আপনাদের নিকট অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছি, জানতে চান কি কিসে সুখী হবে আপনাদের মেয়ে? সত্যিই কি তারা অট্টালিকায় সুখী আছে? ভালোবাসা আর মনের মিল থাকলে অট্টালিকা,আর টাকাপয়সাই সব হয়না, কুঁড়েঘরেও স্বর্গসুখ নেমে আসে। হোক পালিয়ে বিয়ে তবুও সুখ থাকুক।
এমন সুখের কি দরকার যেখানে বিরাট অট্টালিকায়ও আপনার মেয়ে সুখী না! হ্যাঁ টাকা-পয়সারও প্রয়োজন আছে তবে তার আগে আপনার মেয়ের ইচ্ছা আর ম্যাচিউরিটিকে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। এখন আপনি আমি এদেরকে বুঝাতে গেলে বলবে এই ব্যাটা বাস্তববাদী জ্ঞান কম দে। অথচ এই বাস্তববাদী কথাগুলো মেনে বিয়ের সময় মেয়ে কি চায়, মেয়ের ইচ্ছানুযায়ী বিয়ে দিলে এই লোকগুলোই একদিন হাসিব ভাইয়ার নামে একবার করতালি দিবে। সমাজের কথা শুনার আগ অব্দিই আপনাদের আত্মমর্যাদা থাকবে, হঠাৎই একদিন এই সমাজ কথা শুনিয়ে ধূলিসাৎ করে দিবে আপনার আত্মমর্যাদা।