-ওই কোথায় রে তুই? আর কত সময় লাগবে?
-এইতো আর একটু। প্রায় চলে এসেছি
-একঘন্টা ধরে তো এই কথাই বলছিস তুই।
-কি করবো বল?অনেক জ্যাম রাস্তায়।
-আচ্ছা সাবধানে আয়।
-মন খারাপ করিস না পাগলি।
-আচ্ছা আয়।
বলেই ফোন কেটে দিলো মিলি। মিলি যে আসিফের উপর রাগ করেছে এটা আসিফ বুঝতে পারছে।তবে জ্যাম হলে তো ওর কিছু করার ও নাই। আসিফ পাবনা থেকে ঢাকা আসছে।অনেক সকালেই রওনা দিয়েছিল তবে শেষ বেলা ঢাকাতেই এত্ত জ্যাম পড়লো।
ঢাকাতে আসার একমাত্র কারণ হলো মিলির সাথে দেখা করা।আর ঢাকা আসিফের তেমন কেউ নেই তাই সকালে রওনা হয়েছে আবার চলেও যেতে হবে। মিলির বাসা কক্সবাজার। আর আসিফের পাবনা।পরিচয়টা ফেসবুকেই।শুরু থেকেই দু’জন দু’জনকে তুই তুকারি করেই বলে। যদিও আসিফের চেয়ে মিলি একটু বড়।ফেসবুকে কথা হলেও কেউ কখনোই কারো ছবি চায় নি। আসিফের কথা তোকে একদম সামনা সামনিই দেখবো।আর মিলিও এ কথায় না করেনি।প্রায় দেড় বছর পর আজ সুযোগ হলো দুজনের দেখা করার। মিলির ইন্টারনিং পরীক্ষা ঢাকাতে।এই জন্যই এসেছে।আর আসিফ সেই সুযোগে দেখা করতে। দু’জনই খুব উত্তেজিত দেখা করবে বলে।ওদিকে মিলি এসে বসে আছে।আর এদিকে আসিফ গাড়িতেই। প্রায় মিনিট পনেরো পর এয়ারপোর্ট এসে নামলো আসিফ। তারপর মিলির কথা মত এয়ারপোর্ট এর পিছনের লেকের পাড়ে চলে এলো। এদিক ওদিক আসিফ মিলিকে খুজছে ঠিক তখনই মিলির ফোন,
-আর কতকাল লাগবে তোর আসতে?
-চলে এসেছি রে।তুই কোথায়? চলে এসেছি!কথাটা শুনেই বুকের স্পন্দন একগুণ বেড়ে যায় মিলির।
-তুই কই এখন?
-পূর্ব পাশে,আর তুই?
-ওখানেই দাড়া আমি আসতেছি।
বলেই ফোন কেটে দেয় মিলি।তারপর তাড়াতাড়ি লেকের পূর্ব পাশে গিয়ে দেখে একটা ছেলে হ্যাবলার মত দাড়িয়ে আছে।তবে এটা আসিফ কি না শিওর হতে মিলি ফোন দেয় আসিফ কে। মিলি দেখলো ছেলেটা তাড়াতাড়ি ফোন বের করছে।ফোনটা কেটে মুচকি হাসলো মিলি।
-অবশেষে তোর দেখা পেলাম। হঠাৎ কারো কথার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে আসিফ।
-আ আপনি!
-আমিই মিলি।
আমিই মিলি।কথাটা যেন কয়েকবার কানে বাজে আসিফের।সাথে সাথেই কয়েকটা পালস্ ও মিস হয়।বুকের ধুকধুকানিও বেড়ে যায়। আসিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে নীল শাড়ী, হাতে নীল চুড়ি, খোলা চুল, চোখে হালকা কাজল পড়ে এসেছে মিলি।অদ্ভূত এক ভালো লাগায় শিউরে ওঠে আসিফ। আসিফের এমন চাহনি দেখে বেশ লজ্জায় পড়ে যায় মিলি।লাল হয়ে আসা মুখটা নিচু করে বলে, কি দেখিস রে? আসিফ যেন মিলির ঐ নীল আঁচলে হারিয়ে গেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য।মিলির কথায় ঘোর কেটে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
-এতোদূর থেকে আসলি ফ্রেশ হবি না?
-হুম। মিলি ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে দেয়।আসিফ মুখটা ধুয়ে মুছবে কিন্তু রুমাল বা টিস্যু কিছুই তো আনেনি।
-মুখটা মুছে ফেল।
-রুমাল টা না আনি নি রে, ভুল করে।
-তুই ও না, কেয়ারলেস একটা। বলেই শাড়ীর আচল দিয়ে মুখটা মুছে দেয় মিলি।আর আসিফ যেন আবার মাতালবনে যায়।
-তোর সাথে খাবো বলে সকালে না খেয়েই এসেছি।চল এখন গিয়ে খাবো।
-আচ্ছা চল। দু’জনে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে আবার লেকের পাড়ে এসে বেঞ্চিতে বসে।তবে একজন এপাড়ে আরেকজন ওপাড়ে।নিরবতা ভেঙে মিলিই বললো,
-তুই কি অস্বস্তি ফিল করছিস?
-হ্যাঁ,একটু।
-এমনি তো সেই বকবক করতি।আর এখন। হিহিহি।
আসিফ লজ্জায় কালো থেকে আরো কালো হয়ে যায়। আসিফের এমন চুপচাপ থাকা দেখে খুব রাগই লাগে মিলির।তাই অভিমান করে মিলিও গাল ফুলিয়ে চুপ করে থাকে। প্রায় দশ মিনিটের নিরবতা ভেঙে হঠাৎই খুব দ্রুততার সাথে আসিফ বলে ফেলে, তোত, তোকে নীল শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছে। নীরবতার মাঝে একফালি অদ্ভূত ভালোলাগা ঢেলে দেয় কথাটি।গোমড়া মুখটা তখনই লজ্জায় আবার লাল হয়।আসিফের এই ছোট্ট কথাটিই যেন এতক্ষণ ধরে শোনার অপেক্ষায় ছিলো মিলি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়।দু’জনে একসাথে বাড়ির সবাই কেমন আছে, কি করছে ইত্যাদি গল্প করে।তারপর আইসক্রিম,ফুসকা খেয়ে পড়াশোনা নিয়ে গল্প করতে করতেই বিকেলটাও গড়িয়ে যায়। গল্পের মাঝেই আসিফ কাঁপা কাঁপা সূরে বলে ফেলে
-আমাকে এখন চলে যেতে হবে রে। কথাটি যেন বিষের মত লাগে মিলির।এ কথা যেন শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই। মিলি যে ছোট-ছোট অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছে আসিফের সাথে দেখা করতে।
-এখনই চলে যাবি?
-হ্যাঁ, এখন গেলেই ভালো হয়।
সারা শরীর কেমন যেন ধরে আসে মিলির। আসিফ চলে যাবে! এখনই যাবে! নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা মিলি।ঝড়ের মতো আসিফের বুকে আছড়ে পড়ে ডুঁকরে কেঁদে দিয়ে বলে,
– তুই কি বুঝিস না আমি কষ্ট পাচ্ছি? মাত্র আসলি আর এখনই চলে যাবি?প্রায় দু’টো বছর ধরে এই একটা দিনের অপেক্ষা করছি।আর তুই চলে যাবি? যেতে দেবো না তোকে। বলেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিলি। টুপ করে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরে আসিফের গাল বেঁয়ে।সেও যে এই দিনটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সাজাতো।তবে “সাহস” জিনিসটা খুব কম।
-ঐ পাগল,তুই কি বুঝিস না তোকে কতটা ভালোবাসি আমি?
-কখনো বলেছিস, যে ভালোবাসিস? বুক থেকে মাথা তোলে মিলি।তারপর ধুমধাম কয়েকটা কিলঘুষি দিয়ে বলে,
-কুত্তা,বলা লাগবে সব?বুঝিস না ভালোবাসি হু? খুব ভালোবাসি তোকে, খুব ভালোবাসি। কোন কথা বলতে পারেনা আসিফ।কারণ স্বপ্নটা আচমকা পূরণ হবে ভাবেনি।প্রায় বিশ মিনিট হয়ে গেল তবুও বুক থেকে মাথা তুলছেই না মিলি।উপায় না পেয়ে আসিফ বললো,
-ঐ পাগলি?
-হু
-আমাকে যেতে হবে তো।
-হু
-ছাড় তাহলে।
-ছাড়বোনা।
-পাগলামি করিস না। ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় মিলি।আসিফের চোখেও জল।ওর ও মিলিকে একদম ছাড়তেই মন চাইছে না।
-এই পাগলি আমি আবার আসবো।এতো কান্না করে কেউ?
-আবার কবে আসবি বল তাহলে।
-যেদিন তুই বলবি সেদিনই।
-যেদিন বলবো সেদিন ই আসবি তো?
-হুম,আসবো।
-না আসলে তোর বাসায় চলে যাবো হু।
-নিয়ে যাবো তো বাসায়।একদম বউ করে।
আসিফের মুখে “বউ” ডাক শুনে লজ্জায় আবারো লাল হয় মিলি। আসিফ দু’হাতে মিলির মুখটা ধরে আলতো করে চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর কপালে একটা ভালোবাসা এঁকে দিয়ে বলে,
-আর কয়েকটা বছর।তাই তোকে আস্ফির আম্মু বানাবো।
খিলখিল করে হেসে দেয় মিলি।আর হাসির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে আসিফ। ধ্যাত ভুলেই গেছি বলেই মিলি ওর ব্যাগ থেকে একটা নীল টি-শার্ট বের করে আসিফের হাতে দেয়।আসিফেরও মনে পড়ে যায় এক বছর আগের কথা।মিলিই বলেছিলো দেখা করার দিন তোকে নীল টি-শার্ট দেবো, যত্নে রাখিস। টি-শার্টটা ব্যাগে রেখে পকেট থেকে সেই অনেক আগে কিনে রাখা পায়েলটা মিলির পায়ে পড়িয়ে দেয়। দু’জনেই চুপচাপ।তবে মিলি লাল হয়ে গেছে লজ্জা আর ভালোবাসায়। দু’জনে হাত ধরে সোডিয়াম আলোতে হাঁটছে। একটু পর বাসস্টপ এ এসে মিলি বললো,
-সাবধানে বাসায় যাবি কেমন।পথে কিছু খেয়ে নিস।
বাসায় গিয়ে জানাবি।আর গাড়িতেও ফোন দিস। আর ফোন অফ রাখিস না একদম হু। আসিফ শুধু মাথা নাড়ায়। যাওয়ার সময় হয়ে যায়।আসিফ গাড়িতে উঠে জানালা দিয়ে তাকায়।মিলির চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে। দু’জন দু’জনকে বিদায় জানায়।
ঝাপসা হয়ে আসা চোখে এক সময় গাড়িটা মিলিয়ে যায়। তবে একটা দিন,এই একটা দিন ই দু’টা মনকে এক করে দিলো।এই একটা দিন দু’জনের কাছে আসাতেই তারা বুঝতে পারলো দু’জন দু’জন কে কতটা ভালোবাসে। এই একটা দিন ই দু’জনকে আরো শক্ত করে ভালোবাসার হাতল ধরিয়ে দেয়।এই একটা দিন দেখা করার মাঝেই দু’জনের ভালোবাসাটা টিকে থাকে।এই একটা দিন কে নির্ভর করেই দু’জনে আরো কয়েকটা বছর কাটাবে।আবার অপেক্ষা করবে ঠিক এমন একটা দিনের।যে দিনে আবার দু’জন কাছে আসবে।