অদিতি আজকেও ক্লাসে এসে দেখলো জুবায়ের ওর জন্য সিট রাখেনি। গত দশদিন যাবত জুবায়ের এমন করছে। ওদের রিলেশন হবার পর এমন কোনো দিন নেই যে ওরা একসাথে বসেনি। জুবায়ের আগে আসলে অদিতির জন্য সিট রাখতো আর অদিতি জুবায়ের এর জন্য। তবে অদিতি বেশীরভাগ দেরী করেই আসে ক্যাম্পাসে। রাতজেগে পড়াশোনা করে বলে সকাল সকাল উঠতে পারেনা। ছুটির পর অদিতি কে বাসায় পৌছিয়ে দিয়ে তারপর বাসায় যেতো জুবায়ের। কিন্তু এখন অদিতি র সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না সময় দিচ্ছে না আর ছুটির পর তার পাত্তাও পাওয়া যায়না। অদিতি ক্লাস শেষ করে ক্যাফেতে গেলো, জুবায়ের একটা মেয়ের সাথে ক্লোজলি বসে আছে।
— জুবায়ের তুমি এখানে কি করছো? আমি তোমাকে খুজছিলাম, ফোন ধরছিলে না কেনো? আর এই মেয়েটা কে? (অদিতি)
–উনি কে জুবায়ের? তোমার সাথে এভাবে কথা বলছে কেনো? (মেয়েটা)
— আমি কে মানে!!! আমি ওর…
— ক্লাসমেট ও আমার ক্লাসমেট। অদিতি তুই লাইব্রেরী তে যা আমি আসছি পরে। রিয়ানা ওঠো। (জুবায়ের) অদিতি দাড়িয়েই রইলো আর জুবায়ের এর চলে যাওয়া দেখছিল। জুবায়ের মেয়েটাকে বলতে বলতে যাচ্ছিল
— আর বোলোনা তুমি তো জানোই আমি ক্লাসের টপ স্টুডেন্ট। এজন্য সবাই আমার কাছ থেকে পড়া দেখিয়ে নেয়। অদিতি দুইতিন দিন ধরে একটা পড়া বুঝিয়ে দিতে বলছে আমি সময় পাচ্ছিনা এজন্য বেচারি এমন চটেছে আমার ওপর। বাদ দাও তো চলো। অদিতির মাথাতে কিছু ঢুকছেনা এসব কি দেখছে আর কি শুনছে ও!! ওর কয়েকটা ফ্রেন্ড ওকে বলেছিলো যে জুবায়ের অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়েছে কিন্তু ও বিশ্বাস করেনি। আজকে তো নিজের চোখেই দেখলো। আর এই মেয়েটার জন্য জুবায়ের ওকে তুই করে বলেছে। তাহলে কি সত্যিই জুবায়ের….??? নাহ আর ভাবতে পারছেনা অদিতি। জুবায়ের এর সাথে ক্লিয়ারলি কথা বলতে হবে কি চাইছে আর কেনো এমন করছে জানতেই হবে ওকে। ও লাইব্রেরী তে গিয়ে বসলো আর অপেক্ষা করতে লাগলো জুবায়ের এর জন্য। প্রায় ঘন্টা খানেক হয়ে গেলো ও আসছেনা দেখে অদিতি ফোন দিলো
— তুমি আসছো না কেনো? তাড়াতাড়ি আসো আমার দরকারি কথা আছে তোমার সাথে।
— আমি তো বাসায় চলে এসেছি। কি বলবা বলো।
— তুমি আমাকে এভোয়েড করছো কেনো আর ওই মেয়েটা কে?
— তুমি কি ন্যাকা? বোঝোনা মেয়েটা কে? রিয়ানা আমার গার্লফ্রেন্ড।
— গার্লফ্রেন্ড!!!! তাহলে আমি কে? তুমি না আমাকে ভালোবাসো? আর আমাদের এতোদিনের রিলেশন তুমি কিভাবে পারছো এমন করতে।
— আমি তোমাকে ভালোবাসিনা ওটা আবেগ ছিলো। আমি রিয়ানাকে ভালোবাসি। আমার সাথে তোমার রিলেশন ছিলো কথাটা তুমি ভুলে যাও।
— ভুলে যাবো মানে? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা আমি। প্লিজ তুমি এমন করোনা।
— তুমি থাকতে পারো কি না পারো সেটা তোমার ব্যাপার।
দ্যাখো অদিতি ক্লাসমেট এর সাথে রিলেশন এমনিতে টেকে না। তখন আবেগের বশেই তোমার সাথে ইনভলভ হয়েছিলাম। তোমার ফ্যামিলি তো আর কয়েকদিন পর তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে, আমি তো আরো দেরীতে বিয়ে করবো আর তোমাকে তো আমি কখনো বিয়ে করতাম না। তোমার সাথে আমার যায়না আমি হাফিয়ে গেছিলাম তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করতে করতে।
— আমার ভুলটা কোথায় সেটা তো বলবে।
— ভুলটা আমার কপালের নাহলে কি তোমার
মতো কামিজ পরা খ্যাত একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করতাম?? ভাগ্যিস রিয়ানা কেপেয়েছিলাম!! মেয়েটা কত স্মার্ট দেখেছো? কি সুন্দর ফিগার ওর!!! আর কোমর টা?? উফফ!! জোস একদম।
— এখন তুমি কি চাইছো আমি ওই মেয়েটার মতো ক্লিভেজ দেখিয়ে বেড়ায়??
— নিজের ফিগার দেখেছো!!! তুমি তো মোটি।
জিন্স টপ্স পরলে ক্লাউন লাগবে তোমাকে। আর শোনো তোমার এতো আজাইরা প্যাঁচাল রাখো, তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই আমার, ও ফোন ওয়েটিং পেলে আবার রাগ করবে। আর কখনো যদি আমাকে ফোন দিয়েছো তাহলে তোমার নাম্বার ব্লাকলিস্টে দিতে বাধ্য হব আমি। অদিতি ফোন রেখে কাঁদতে লাগলো। এটা কি সেই জুবায়ের যে ওর জন্য পাগলপ্রায় ছিলো!!! ওদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিলো তিন বছর আগে। তখন ওরা ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো। অদিতি বরাবরের মতো চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। পড়াশোনায় অনেক ভালো। আর জুবায়ের তার উল্টো, চঞ্চল স্বভাবের। অদিতি যখন মনোযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনতো তখন জুবায়ের অদিতির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। এমন ও হয়েছে পুরো ক্লাসটাইমে জুবায়ের শুধু অদিতির দিকেই তাকিয়ে থেকেছে। এজন্য স্যারের কম বকা খাইনি ও। অদিতির খুব অস্বস্তি লাগতো। জুবায়ের পড়া বুঝিয়ে নেয়ার বাহানায় অদিতির সাথে বন্ধুত্ব করে।
কেউ পড়া বুঝিয়ে নিতে চাইলে অদিতি না করতে পারেনা। পরে আস্তে আস্তে কিভাবে যেনো ওদের রিলেশন হয়ে যায়। জুবায়ের অদিতির প্রতি বেশ কেয়ারিং ছিলো। জুবায়ের পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ, নিজে কখনো এসাইনমেন্ট করেনা, অদিতিকে দিয়ে করায় সবসময়। অদিতি পড়াশোনার ব্যাপারে যথেষ্ট হেল্প করতো জুবায়েরকে আর পরীক্ষার সময় তো নিজে ভালো করে লিখতেই পারতো না জুবায়ের এর জন্য। আর জুবায়ের এর প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও কোনো কমতি রাখেনি অদিতি। আর সেই জুবায়ের আজ অন্য একটা মেয়ের জন্য অদিতি কে এভাবে অপমান করলো আর সম্পর্ক নষ্ট করলো ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে অদিতির। অদিতি চারদিন ধরে ক্যাম্পাসে যাচ্ছেনা। আগে একদিন ক্যাম্পাস এ না গেলে জুবায়ের ফোন দিতে দিতে পাগল হয়ে যেতো কিন্তু এখন অদিতি ক্যাম্পাসে আসুক বা না আসুক জুবায়ের এর কোনো মাথাব্যথা নেই। অদিতি জুবায়েরকে ফোন দিলো
— কি সমস্যা কি? ফোন দিতে নিষেধ করেছিনা তোমাকে।
–জুবায়ের আমি অসুস্থ, একটু কথা বলো আমার সাথে। (অদিতি)
— তুমি অসুস্থ তাতে আমি কি করবো? আমি কি ডাক্তার নাকি? অসুস্থ হয়েছো ওষুধ খাও আর দয়া করে আমাকে ইরিটেট করা বন্ধ করো।
— আমি ক্যাম্পাসে যাচ্ছিনা তুমি কি আমাকে মিস করছোনা?
— না করছিনা।
জুবায়ের ফোন কেটে দিয়ে অদিতির নাম্বারব্লাকলিস্টে দিয়ে দিলো। অদিতি আবারকাঁদতে বসলো। জুবায়ের কে রিয়ানার সাথে দেখে অদিতির অনেক কষ্ট হয়। জুবায়ের এখন ওকে দেখেও দেখেনা চিনেও চেনেনা। অদিতির বাসা থেকে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এতোদিন জুবায়ের এর কথা ভেবে না না করে এসেছে কিন্তু এখন যেহেতু জুবায়ের ওকে চায়না তাই আর ও না করেনি, রাজী হয়ে গেছে বিয়েতে। ওর মা বাবা কানা, খোঁড়া, বোবাকালা যার সাথে বিয়ে দেবে ও তাকেই বিয়ে করবে। ছেলেটাকে সামনাসামনি দেখেনি ও। শুধু ছবি দেখেছে। ছেলেটার নাম নাফিজ। আজকে অদিতির নাফিজের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। অদিতি কোনো সাজগোজ করেনি। সবসময় যেমন সাদামাটা থাকে সেভাবেই গেলো নাফিজের সাথে দেখা করতে। নাফিজ আগেই চলে চলে এসেছে। অদিতি কাছে যেতেই
— অদিতি, রাইট?
— হুম। আপনি নাফিজ?
— জি আমিই নাফিজ। দাঁড়িয়ে আছেন কেনো বসুন।
— কেমন আছেন?
— ভালো আছি, আপনি?
— জি ভালো।
— আপনি ছবির থেকেও সুন্দর দেখতে। আমি তো শুধু ছবি দেখেই পছন্দ করেছি আপনাকে। আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে?
— আপনি তো আমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেননা। শুধু ছবি দেখেই বিয়েতে রাজী হয়ে গেলেন?
— হৈমন্তী গল্পটা পড়েছেন?
— পড়েছি তো।কেনো?
— অপুও যেমন হৈমোর ছবি দেখে প্রেমে পড়েছিল।
আমারও সেই অবস্থা হয়েছিল। আমার বাবা যখন আপনার ছবিটা আমাকে দিয়েছিলো তখন ছবি দেখে অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হয়েছিলো আপনার প্রতি। জানিনা কেনো? আপনার সম্পর্কে যেটুকু জানা ম্যান্ডাটরি সেটুকু জানি আমি। বাকিটুকু জানার সুযোগ যদি আপনি দেন তাহলে জানবো। আপনিও তো শুধু আমার ছবি দেখেছেন, সরাসরি আজ দেখছেন। আপনি বন্ধু ভেবে আমাকে সব বলতে পারেন আপনার যদি এই বিয়েতে মত না থাকে সেটাও বলতে পারেন। আপনি কি এই বিয়েতে রাজী?
— দেখুন নাফিজ সাহেব আমার বাবা মা খোজ খবর নিয়েই বিয়েটা ঠিক করেছেন, তাদের আমার জন্য আপনাকে পারফেক্ট মনে হয়েছে বলেই আপনাকে চুজ করেছে। আর আমারও এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই।
— আলহামদুলিল্লাহ!!
— তবে আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। অদিতি ওর আর জুবায়ের এর কথা সব নাফিজকে বললো।
— মিস অদিতি বিয়ের আগে এমন রিলেশন থাকতেই পারে। আমার কোনো সমস্যা নেই এতে। আর আমিও একটি মেয়েকে অনেক পছন্দ করতাম। তার পেছনে পাগলের মতো ঘুরেছিলাম আমি কিন্তু কোনো পাত্তা পায়নি। যাক ব্যাপার না এগুলো। আপনি যে আমাকে সব বললেন এতে আপনার প্রতি আমার ভালোলাগা আরও বেড়ে গেলো। অদিতি আমি আপনাকে শুধু জীবনসঙ্গিনী নয় একজন বন্ধু হিসেবে আমার পাশে চাই।
— আজকে আমি উঠি।
— সেকি!! কিছুই তো খেলেন না।
বাসায় পৌঁছে দেই আমি? অদিতির সাথে নাফিজের ফোনে কথা হতো টুকটাক। নাফিজ অদিতির ভার্সিটি তেও বেশ কয়েকদিন গেছে দেখা করতে। নাফিজ ছেলেটা ভালোই,ওর মাঝে কোনো কুটিলতা, স্বার্থপরতা নেই। অদিতি ক্লাসে ঢুকে দেখলো জুবায়ের এর পাশের সিট ফাকা, জুবায়ের ওকে বসতে বললো কিন্তু ও পেছনে চলে গেলো বসতে। ছুটির পর অদিতি যখন রিকশায় উঠতে যাবে তখন জুবায়েরও একই রিকশাই উঠে বসলো।
— অদিতি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, আমি বেশী সময় নেবো না।
— বলো।
— তোমার সাথে একটা ছেলেকে দেখি প্রায়ই। কে ছেলেটা?
— আমার ফিয়ান্সে।
— তুমি সত্যি বিয়ে করছো!! কংগ্রাচুলেশনস।
— থ্যাংকস। তুমি এবার রিকশা থেকে নামো।
— না মানে অদিতি বলছিলাম কি যে সামনে তো পরীক্ষা আমার একটু তোমার হেল্প লাগতো।
— আচ্ছা। পরীক্ষার সময় অদিতি জুবায়েরকে যথাসাধ্য হেল্প করলো। শেষ পরীক্ষার দিন পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে
— জুবায়ের চলো কোথাও বসি।
— অদিতি আমি এখন রিয়ানার সাথে ডেটিং এ যাবো আমার সময় নেই।
— আমি তোমাকে প্রেম করার জন্য বসতে বলিনি, আমি তো তোমার ক্লাসমেট, বন্ধুও।সেই হিসেবে বসতে বলেছি।
— অদিতি দেখো এখন পরীক্ষা শেষ, তুমি তোমার মতো থাকো আর আমাকেও আমার মতো থাকতে দাও।অদিতি ভাবছে মানুষ কতটা স্বার্থপর!! অদিতির বিয়ের দিন ও যখন পার্লার থেকেবাসায় এলো তখন দেখে জুবায়ের এসেছে ওদের বাসায়।
— অদিতি প্লিজ তুমি বিয়েটা কোরোনা।আমি এখন থেকে অন্য কোনো মেয়ের সাথেমিশবোনা, কথা বলবোনা এমনকি তাকাবোনা।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, তোমার সবকথা শুনবো আমি। প্লিজ ফর গড সেক..(জুবায়ের)
— কেনো রিয়ানা? তোমার গার্লফ্রেন্ড?(অদিতি)
— ও আমাকে ছেড়ে অন্য কারও সাথে রিলেশন করেছে। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি,অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে আমি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আই বেগ ইউ অদিতি। চেঁচামেচির শব্দ শুনে অদিতির মা বাবা আসলো।
— ছেলেটা কে অদিতি? (অদিতির বাবা)
— আমার সাথে পড়ে, আমার ক্লাসমেট। ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে, এজন্য ও এমন করছে। (অদিতি) জুবায়েরকে বিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। অদিতি নাফিজকে ফোন দিয়ে সব বললো।
— এখন তুমি কি চাচ্ছো? বিয়েটা কি হচ্ছে? (নাফিজ)
— হুম হচ্ছে। জুবায়ের আমার মোহ ছিলো, আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই নাফিজ। কখন আসছেন? (অদিতি)
— বর সেজে বসে আছি, বের হবো একটু পর। আমার হৈমোকে বৌ সাজে দেখার জন্য তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।
— হুম তাড়াতাড়ি আসেন অপু সাহেব।
জুবায়ের বড্ড বেশী ই দেরী করে ফেলেছে। অদিতির আজ কিছুই করার নেই। জুবায়ের একদিন অদিতির ভালোবাসাকে অদিতিকে অপমান করেছিলো,অসম্মানিত করেছিলো। অদিতি জুবায়ের এর জন্য নিজের ফ্যামিলি কে নাফিজের ফ্যামিলি কে অসম্মানিত করতে পারবেনা আর নাফিজকে ও কষ্ট দিতে পারবেনা।
(সমাপ্ত)