কিশোর প্রেম

কিশোর প্রেম

জীবনে প্রথমবার একটি মেয়ের মুখ ভেংচি পছন্দ হয়েছিল। তখন আমার ছাত্র জীবনের অবসান। বন্ধুদের নিয়ে টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ানোটা যে একটা কাজ সেটা তখনই বুঝতে পারি। প্রতিদিন বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া। পাশের এলাকায় গিয়ে ফল চুরি করে খাওয়া। চুপি চুপি মেয়েদের দিকে তাকানো। এই সবই যেন নিত্যদিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেউ যদি বলত বিকেলে খেলা আছে। তখন আমরা বলতাম বিকালে আমার কাজ আছে। আর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর কথাতো বললামই।

একদিন সবাই খেলতে চলে গেছে। আমি আর রবি আছি শুধু। দুজনেই ভেবে নিলাম আজ যেহেতু সাথে বন্ধু বান্ধব কম সেহেতু কাছেই কোথাও ঘুরে আসি। বড় রাস্তা পেরিয়ে আমি আর রবি পাশের এলাকায় গেলাম। শীতের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ মাঠ ঘাটে আছড়ে পড়েছে। সাথে চারটা সিগারেট আর দিয়াশলাইয়ের কাঠি। আর দিয়াশলাইয়ের বারুদের কাগজ একটু ছিঁড়ে নিয়েছি। আমরা অবশ্য এভাবেই সিগারেট নিতাম। সিগারেটের প্যাকেটও নিতামনা। এতে শার্ট বা প্যান্টের পকেট ফোলা থাকতনা। নতুন নতুন সিগারেট খাওয়া যাকে বলে আরকি। মুখ দিয়ে টেনে যে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করতে পারত তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিজেরা চেষ্টা করতে গিয়ে বহুবার যক্ষা রোগীর মত কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়েছিল।

আমি আর রবি ক্ষেতের আইলে মিষ্টি রোদে বসে আছি। হঠাৎ চোখে পড়ল দুটি মেয়ে এদিকেই আসছে। সাথে একটি ছাগল। আসতে না চাইলেও ছাগলকে টেনে হেচড়ে নিয়ে আসার জোর চেষ্টা চলছে। ছাগলও একটু এগিয়ে আবার জোর করে দাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। এক মেয়ে পিছন থেকে হুস হুস করে আরেকজন টানে। ব্যাপারটা খুবই মজার ছিল। কিন্তু ছাগলের করুণ অবস্থা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে। আর চুপ থাকতে পারলামনা।

-ছাগলটাকে তো মেরেই ফেলবেন দেখছি। আসতে না চাইলে জোর করে টানার কী দরকার?  ছাগলের দড়ি হাতে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে আবারো দড়ি ধরে টান, “আয় বলছি”। আমি কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মানুষের মুখ ভেংচি দেখলে রাগ হয়। অথচ এই মেয়ের মুখ ভেংচিটা এত ভালো লাগল কেন? আবারো ইচ্ছে হচ্ছে ভেংচিটা দেখার জন্য। ডাক দিয়ে বলব কিছু একটা। কিন্তু নামতো জানিনা।

-এইযে ছাগলওয়ালী, ছাগলটাকে আর কষ্ট দিয়েননা।
-কী? কী বললেন আপনি? ছাগলওয়ালী মানে কী?

হাত থেকে দড়ি ফেলে দিয়ে ওড়নাটাকে ঘুরিয়ে কোমড়ে পেঁচিয়ে দুই হাত কোমড়ে ধরে বলছে কথাগুলো। আমি তো একপ্রকার ভয় পেয়ে গেছি। মুখ ভেংচি দেখতে গিয়ে তো আরেক সুন্দর চোখে পড়ল। সত্যিই, কিছু কিছু মেয়েরা রাগলে অনেক সুন্দর লাগে। এবার আরেকটু রাগানোর জন্য বলছি,

– আসলে হঠাৎ ভাবছিলাম বাংলা ছায়াছবির অভিনেত্রি রিনা খাঁন চলে এল নাকি।

এবার মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যাচ্ছে। আসলেই মেয়েদের বুঝা বড় দায়। যখন রাগ করার কথা তখন হুট করে হেসে দিবে। এই মুচকি হাসিকেই মনে হয় মায়াবী হাসি বলে।  শেষ অবধি মেয়ে দুটো চলেই গেল।

কৈশোর পেরিয়ে বয়সের প্রথম ধাক্কায় বন্ধু বান্ধবরা অনেক সময় এক মেয়েকেই অনেকে পছন্দ করে। আর তখন মেয়েদের অজান্তেই বন্ধুরা ভাগ বাটোয়ারা করে ফেলে। যেমন আমি রবিকে বলছি, “রবি ছাগলওয়ালী আমার আর পিছনেরটা তোর।” তখন রবি বলছে, “আমার ভাগে যাকে দিলি সেতো আমার চেয়ে লম্বা।” এরপর থেকে প্রতিদিনই আমি আর রবি ছাগলওয়ালীর খুঁজে ছুটে যেতাম। সাথে বন্ধুরা ঘুরতে যাবার সময় আমরা হঠাৎ উধাও হয়ে যেতাম। উদ্দেশ্য হল ছাগলওয়ালী।

একটা দিন যদি ভালো করে কথা বলতাম তাহলে মনকে বুঝানো যেত। আমি তার রাগী চেহারা দেখার জন্য এটা ওটা বলতাম। সেও রাগ করে কোমড়ে হাত ধরে আমাকে কটুকথা শুনাইতো। রবি তো রেগেই যেত আমার প্রতি। “কিরে প্রতিদিন ঝগড়া করলে লাইন করবি কিভাবে?” প্রেম ভালোবাসার একটা দুষ্টু নাম হলো লাইন মারা। আমি ছাগলওয়ালীর প্রেমে পড়ছি কিনা জানিনা। কিন্তু তার রাগী চেহারা আর মুখ ভেংচি দেখার জন্য প্রতিদিন আসব।  মেয়েটিকে বহুবার নাম জিজ্ঞেস করেছি। উত্তরে বলত, “প্রথমদিন যদি জানতে চাইতেন তাহলে নিশ্চয় বলতাম। ছাগলওয়ালী ডাকেন কেন আর বলবনা নাম। ”

আমাকে বান্দর বলত। আর মুচকি মুচকি হাসত। আমি কখনো ভালোবাসা বুঝতামনা। মানুষ নাকি চোখের মাঝেও ভালোবাসা খুঁজে পায়। চলাফেরায়ও ভালোবাসা খুঁজে নেয় অনেকেই। আমি কখনো ছাগলওয়ালীর চোখে আমার জন্য প্রেম দেখিনি। তার ভেংচি কিংবা মুচকি হাসি, রাগী চেহারা বা পিছন ফিরে তাকানোর মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পাইনি। তবুও আমি কিসের টানে যেত ছুটে যেতাম ছাগলওয়ালীর কাছে। ছাগলওয়ালী আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারবেনা। সেটা যখন জানতে পেরেছি তখন মনের কোণে বৃষ্টি হয়েছিল।

একদিন ঘুম ভেঙ্গে বাইরে বের হয়ে দেখি ছাগলওয়ালী আমাদের বাড়ি। ঘুমের ঘোর তখনো কাটেনি। ভাবছিলাম স্বপ্ন কিনা। নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখি ঘটনা সত্যি। তবে কি আমার নামে বিচার দিতে এল? আরেকবার ভেবে নিলাম আমিতো বড় কোন অপরাধ করিনি, আর সেওতো দুষ্টুমি করে মুচকি হাসে। সে কেন আমার নামে বিচার দিবে?  আমাকে দেখে সে উঠে দাড়িয়ে বলছে, “আঞ্জু আমি চলে যাব”। আমার ছোটবোনের নাম আঞ্জুমান। আঞ্জু বলছে “কেন চলে যাবি কেন? এটাতো আমার ভাইয়া”।

-হ্যাঁ চিনি, তোর ভাই আমাকে দেখলেই ছাগলওয়ালী ডাকে।

আঞ্জু আমার দিকে একবার তাকিয়ে হেসে দিল। তারপর বলছে, “ভাইয়া আমার বান্ধবীর নাম পুষ্পা। এত সুন্দর নাম রেখে কী সব বলো?” আমি একটু মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “ছাগলওয়ালীতো আমাকে তার নামটা আগে বলেনি।” পুষ্পার সেই চিরচেনা রাগী চেহারা। সে চলেই যাবে এমন একটা ভাব। আমি এবার নরম সুরে বলছি, “পুষ্পা এভাবে চলে যেওনা। আমি এখন বাইরে বের হবো। তোমাকে রাগাবনা আর। ”

সেদিন বিকেলেই ছোটবোনের কাছে জানতে পারি তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আরো বছরখানেক আগে থেকেই। ভাবতেই অবাক লাগে, কিশোরি একটি মেয়ে। তার এখন ছুটে চলার বয়স। অথচ তার পায়ে অদৃশ্য শিকল লাগানো। আমি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। এপাশ ওপাশ করে বারবার ভেবেছি, গল্পটা অন্যভাবেও হতে পারত। গাছে আমের মুকুল এলে যেমন আম হবার আগেই বৈশাখী ঝড়ে অনেক মুকুল ঝরে পড়ে। তেমনি আমার এক বুক স্বপ্ন আমের মুকুলের মত আঁছড়ে পড়ল মাটিতে।

এর পরের দিনগুলো খুবই কষ্টে কাটত। ঠিকই যেতাম পুষ্পাদের বাড়ির কাছে। তাকে আর রাগানোর চেষ্টা করতামনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যেত। তখন আর অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে পারতামনা। ছলছল করে চোখ দুটো ভিজে উঠত। ঝাপসা চোখে তার চলে যাওয়া দেখতাম। আমার মনের আঙ্গিনা পেরিয়ে এভাবেই চলে যায় পুষ্পা।

একসময় পুষ্পাদের ছাগল বিক্রি হয়ে যায়। তবুও সে আসত, ছাগল ছাড়াই আসত। আমাকে একটিবার মুখ ভেংচি দিতে সে আসত। আমারই কেবল আর রাগানো হতোনা তাকে। একদিন শুধু বলেছিল, “আমাকে আর ছাগলওয়ালী ডাকবেননা? আঞ্জু যদি নাম না বলত তাহলেতো ঠিকই ডাকতেন। ” মনে মনে ভাবতাম, আঞ্জু শুধু তোমার নামটাই জানায়নি, জানিয়েছে আমার কিশোর প্রেমের এখানেই সমাপ্তি ঘটাতে হবে।

পুষ্পার বিয়েতে আঞ্জুকে দাওয়াত দিয়েছিল, সাথে আমাকেও। আমি বা আঞ্জুমান কেউ পুষ্পার বিয়েতে যাইনি। আঞ্জু হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছিল আমার মনের অবস্থা।  আমি ছাগলওয়ালীর সেই মুচকি হাসি, রাগান্বিত চেহারা বা মুখ ভেংচি কখনোই ভুলতে পারবনা। তাকে ফুল বা চিঠি দেয়া হয়নি। কখনো মুখ ফুটে ভালোবাসি বলা হয়নি। তবুও কেন যেন মনে হয় আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। আচ্ছা পুষ্পা কি আমার প্রেমে পড়েছিল? নয়তো ছাগল না থাকার পরও কেন আসত। তাহলে কি কিছু একটা ভুল করে এসেছি আমার কিশোর প্রেমে? ভুলতে পারবনা আমার কিশোর প্রেম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত