ক্লাশ ফাইভ কমপ্লিট করেই সোজা ঢাকায় চলে আসলাম।নামকরা এক স্কুলে ভর্তি হলাম।কিন্তু কয়লা ধুলে কি আর ময়লা যায় ?
আমার অবস্থাও তাই হলো। সিক্স থেকে সেভেন এই দু’বছরে কোন সাব্জেক্টেই ৩৫ এর বেশি পাই নি।
কি আর করা আবার জামালপুর পাঠিয়ে দিলো। বাড়ীর কাছেই একটা হাই স্কুল ছিলো। সেটাতে এইটে ভর্তি হলাম।
প্রথম যেদিন ক্লাশে যাই গিয়ে দেখি পুরো ক্লাশ ভর্তি ছাত্র ছাত্রী। কোন সীটই ফাকা নাই। তাই ফার্স্ট বেঞ্চে বসা এক ছেলেকে বললাম,” ওই ব্যাটা চাপ। ”
ছেলেটা কেন যেন কেঁদে ফেললো। সে ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। আমি ওর ব্যাগটা মেঝেতে রেখে ওর জায়গায় বসলাম।
খানিকবাদে একজন ম্যাডাম আর ওই ছেলেটা আসলো।ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করলো আমাকে, ” তুমি ওকে কি বলছো ? ” আমি বললাম,” ওই ব্যাটা চাপ। ”
ম্যাডাম এবার বললো,” ও ক্লাশের ফার্স্টবয় এবং ক্যাপ্টেন। ও এই জায়গাতেই বসবে। ” কি আর করা আমি একটু চেপে বসে ওকে বসতে দিলাম।
এই ছিলো আমার নতুন হাইস্কুলের রঙিন বারান্দায় প্রথম দিন।
ক্যাপ্টেনের সাথে এমন ব্যবহারের কারণে ক্লাশের বেক বেঞ্চাররা আমায় খুব পছন্দ করলো।
খুব নিমিষেই জাহাঙ্গীর,সাইফুল, শানু, শাহিন,ফারুক,লিখনের সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
ক্লাশের দ্বিতীয় দিন টিফিন পিরিয়ডের ঘটনা। জাহাঙ্গীর এসে বললো,” চল বউ চি খেলি। ” আমি বললাম,” আমি কোনদিন খেলিনি।
সে আমাকে নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিলো। খেলা হচ্ছে আমাদের দুই গ্রুপে।এক গ্রুপে ক্লাশের মেয়েরা এক গ্রুপে ক্লাশের ছেলেরা।
যাই হোক মেয়েরা দম দিবে। এ সময় জাহাঙ্গীর বললো তুই বউয়ের কাছে থাক।বউ বের হলেই ছুঁয়ে দিবি।
এদিকে বউ হয়েছিলো মুন্নী। সে আবার ছিলো জাহাঙ্গীর এর প্রেমিকা।এদিকে শানু এসে কানে কানে বললো,” জিজ্ঞাসা কর বউ কে? ”
আমি তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
মুন্নী বললো,” আমি।” এবার শানু শিখিয়ে দিলো, ” বল আমি বউয়ের স্বামী।” স্বামী মানে যে স্বামী তা
আর আমি জানতাম না।আমিও বলে বসলাম মুন্নীকে, ” বউয়ের স্বামী আমি।”
তারপর ঠাশ!!মুন্নী খুব জোরেই আমার কানের নিচে তার ডান হাতখানা ছুঁয়ালো। আমিও কম যাই না।আমিও ঠাশ।
মুন্নীও ছেড়ে দেবার বান্দা না। একের পর এক কিল ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে আমায়।খানিকবাদে ব্যাপারটা ছেলে বনাম মেয়েদের মারামারি হয়ে গেলো।
হেডস্যার এসে ব্যাপারটা থামালেন।এর কিছুদিন পরেই আমি আবার ঢাকায় আসি।প্রায় তিনমাস থেকে আবার যখন স্কুলে আসলাম।
ম্যাডাম বললেন,” বাহাত্তর দিন স্কুলে আসিস নি।প্রতিদিনের জন্য দশ টাকা জরিমানা।কাল সাতশো বিশ টাকা নিয়ে আসবি। ”
যাই হোক পরদিন নিয়ে সাতশো বিশ টাকা নিয়ে আসলাম।স্কুলে আসার পর শানু বললো, ” পাশের থানার সিনেমা হলে নতুন মুভি এসেছে।
নাম নিষিদ্ধ নারী। ”
আমি বললাম,” চল তাইলে টিফিনের সময় চলে যাই। ” শানু জানালো কারো কাছেই টাকা নাই।
আমি বললাম, ” আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তবে জরিমানার। ম্যাডামরে ফাঁকি দিতে পারলে হতো।”
এই কথা শুনা মাত্রই শানু একটা বুদ্ধি দিলো।শানুর বুদ্ধি মোতাবেক যখন ক্লাশে ম্যাডাম এসে রোল ডাকলো আমি দাঁড়িয়ে প্রেজেন্ট বললাম।
এবার ম্যাডাম বললো,” জরিমানার টাকা কই ? ” আমি এবার শানুর বুদ্ধি মোতাবেক বললাম,” ম্যাডাম এতো টাকা দিয়ে কি করবেন ? বাচ্চার দুধ কিনবেন ? ”
বুদ্ধিটা কাজে লাগলো। ম্যাডাম রেগে আমায় কয়েক ঘা বেত দিয়ে লাগালেও আর টাকা নিলেন না।
আমরাও টিফিনের সময় ফাঁকি দিয়ে দেখে আসলাম নিষিদ্ধ নারী।
তার কিছুদিন পর বাবা মারা গেলেন। পড়ালেখার প্রতি যতটুকু মনোযোগ ছিলো ; তাও গেলো।
একদিন স্কুলের পাশে বাজারের কুমারশালায় বসে সিগারেট টানছি। লাইফের প্রথম সিগারেট খাওয়া। তাও আবার ফারুকের সৌজন্যে।
আমাকে আর ফারুককে স্কুলের অনেকেই সিগারেট টানতে দেখেছে। কে জানি গিয়ে বিচারও দিয়েছে।
তাই সেদিন প্রথম ক্লাশে আসলেন মৌলভী স্যার। হাতে একগাদা মোটা মোটা বাশের চটি।
আমাকে আগে দাঁড় করালেন।জিজ্ঞাসা করলেন,” সিগারেট খেয়েছিস কেন ? ”
পাশ থেকে জাহাঙ্গীর শিখিয়ে দিলো, ” বল আমার বাবা মারা গেছে। তাই কষ্টে খাইছি।”আমিও তাই বললাম।
মৌলভী স্যার আমায় মাফ করে দিয়ে এবার ফারুককে দাঁড় করালেন।ফারুক দাঁড়িয়েই বলে ফেললো,” স্যার আমাকে রিফাত
সিগারেট কিনে দিছে খাওয়ার জন্য। এবং রিফাতই খাওয়া শিখাইছে। ”
বলে রাখি রিফাত ছিলো আমাদের স্কুলের সবচেয়ে সুন্দর,সুদর্শন,ভদ্র ছেলে।
যার ফলস্বরূপ ফারুক যেই মেয়েকে ভালবাসতো ; সেই মেয়ে রিফাতকে ভালবাসে।তাই ফারুকের এমন মিথ্যে উত্তর।
এদিকে রিফাতের নামে এই কথা শুনে মৌলভী স্যার খুব কষ্ট পেলেন। তিনি রিফাতকে পিটাতে পিটাতে রক্তাক্ত করে দিলেন।
তখন মেয়েরা বলে উঠলো,” স্যার ফারুক মিথ্যে বলেছে। ”
ফারুক এবার বললো,” স্যার ক্লাশের সব মেয়েরা আমার সাথে সিগারেট খাইছে।সবাইরে পিটান। ”
মৌলভী স্যার এবার ফারুককে মারতে চাইলেও পারলে না।কারণ বাশের চটিগুলো সব রিফাতকে মেরে ভেঙে ফেলেছেন।
এভাবেই চলছিলো আমার হাই-স্কুলবেলা।হাসি,দুষ্টুমি,স্যারের পিটুনি। একবার জ্যামিতি পারি নি বলে বি.এস.সি স্যার দু’হাতের
দশটা আঙুল কাটা কম্পাস ছিদ্র করে দিয়েছিলো।
এরপর থেকে যতবার স্যারের বাসার সামনে দিয়ে যেতাম তার টিনের ছাদে ঢিল ছুড়ে পালাতাম।
ক্লাশ নাইনে উঠার কিছুদিন পর শুনলাম একটা ভলিবল ও একটা ফুটবল দিয়েছে।
জীবনে কোনদিন ভলিবল খেলি নি।তাই নেমে পড়লাম খেলতে।কিন্তু সমস্যা হলো ভলিবল লম্বা লোকদের খেলা।আমি খাটো মানুষ।
তাই ঠিকমতো বল মারতে পারছিলাম না।এ সময় স্পোর্টস টিচার বললেন,” যেই বলটা হাত দিয়ে পারবে না সেটা পা দিয়ে মেরে দিবে।”
স্যার নিয়ম শিখিয়ে বিপদে পড়ে গেলেন।এখন আমি সব বল পা দিয়ে মারি। আরেকবার একটু জোরেই পা দিয়ে মেরেছিলাম ;
বল গিয়ে পড়লো সোজা স্কুলের ছাদের।
টিনের স্কুল। নাটগুলো আকাশমুখী। যা হবার তাই হলো।বল নাটের উপর পড়ে বাদ হয়ে গেলো।
তার পরদিন স্যারকে রিকুয়েস্ট করে ফুটবলটা নিলাম।এখন থেকে ফুটবল খেলবো।
স্যারের রুম থেকে ফুটবলটা বের করে মাঠে এসেই শট মারলাম।কপাল মন্দ হলে যা হয়।
একদম গিয়ে পড়লো ছাদের উপর।ঠিক কাল যেখানটায় ভলিবল পড়েছিলো।
সেদিন সারাদিন স্যার কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো স্কুলের মাঠে।
পড়ালেখার ছিলো যাচ্ছেতাই অবস্থা। এমন সময় জাহাঙ্গীর আর মুন্নীর ব্রেকাপ হলো। কিন্তু আমার কপাল খুলে গেলো।
কিভাবে যেনো মুন্নী আমার প্রেমিকা হয়ে গেলো।মুন্নী ছিলো ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল। আমাদের বিশাল বাড়ীতে আমি একাই থাকতাম।
মা ঢাকাতেই থাকতো।মন চাইলে কাকাদের বাসায় গিয়ে খেতাম ; মন চাইলে হোটেলে খেতাম।
মুন্নী রাতটা বাদে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি আমার সাথেই থাকতো। আমার বাসায় এসে রান্না করে দিয়ে যেতো।
বিকেল বেলা উঠোনে বসে একটু আধটু প্রেমও করতাম।আবার সন্ধ্যে হলে হাত ধরে পড়তে বসাতো।
মজার বিষয় হলো – মুন্নীর হাত ধরে পড়তে শিখে মুন্নীর চেয়ে বেশি নাম্বার পেতাম পরীক্ষায়। ক্লাশ টেনে তো রোল ১ হয়ে গেলো।
যেই ছেলেটাকে প্রথম দিন বলেছিলাম, ” ওই ব্যাটা চাপ”- সেদিন সে নিজে থেকেই জায়গা ছেড়ে দিলো।
কিন্তু সুখ কপালে সয় না বেশিদিন। মেট্রিক পাশ করে আবার ঢাকা। যান্ত্রিক শহর,যান্ত্রিক সব বন্ধু, রুটিন বাধা জীবন।
এসবে বাধা পড়ে আজ ভুলে গিয়েছি হাই স্কুলের রঙিন বারান্দা। এখনো হুট করে মনে পড়ে যায় শানুর কথা, জাহাঙ্গীর এর কথা,বউচি খেলার কথা।
কোন কাজল টানা চোখের মেয়েকে স্কুলে যেতেই দেখলে মুন্নীর কথা মনে পড়ে যায়।বছর খানেক আগে গিয়েছিলাম জামালপুর।
খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম ওদের বাসায়।গিয়ে শুনি দু’বাচ্চার মা হয়ে গেছে। অবশ্য ওদের বাসা থেকে খালি হাতে ফিরি নি।।
মুন্নীর ছোট বোন আমার পকেটের মাঝে একটা প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছিলো।
আজ প্রায় অনার্স কমপ্লিট করে ফেলেছি। কিন্তু মনটা বার বার ফিরে যেতে চায় সেই ফেলে আসা হাই-স্কুলের রঙিন বারান্দায়।