পূর্ণ ভালোবাসা

পূর্ণ ভালোবাসা

‘সারাদিন শুধু অফিস,অফিস আর অফিস। এ্যাই,তোর ইচ্ছে করে না আমাকে সময় দিতে?তাহলে ভালোবাসলি কেন?আমাকে বিয়ে করলি কেন?’চোখজোড়া আগুনের মত হয়ে আছে হিয়ার। বউ এর কাছে এমন ব্যাবহার সবসময়ই প্রত্যাশিত ঈশানের। ভালোবাসার প্রকাশ হয় এতে। মোজাইক করা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে ঈশান নিশ্চুপে। বউ এর মেজাজ এখন ঊনপঞ্চাশে। এই মুহুর্তে ভালো কথা বললে বউ পেয়ে বসবে। তাই প্রতিক্রিয়া টা হওয়া চাই বিপরীত। মনে মনে ঈশান ও রেগে আছে। বউটা একদম বে আক্কেল। স্বামী এত গরমের মধ্যে জ্যাম ঠেলে অফিস সেরে বাসায় এসেছে, কোথায় স্বামীকে একটু আদর করে ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দেবে,তা না উল্টা ঝাড়ি!!

-জানো হিয়া,আজ কি হয়েছে?
-চুপ কোন কথা না।
-একটা মেয়ে ‘একটা মেয়ে’ কথাটা শুনে ঈশানের দিকে ফিরে তাকায় হিয়া। ‘কি হয়েছে একটা মেয়ে?’- কলার চেপে ধরে সে।

-বাসে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
-ও আর ওমনি তুই মজনু হয়ে গেছিস তাই না? দাড়া মজা দেখাচ্ছি।
-কি মজা?
-তোর আজ ভাত বন্ধ। যা গিয়ে গোসল কর। বাড়ন্ত ভুড়িটা একটু আগে চলছে ঈশানের। আর ঈশান ভুড়ির ঠিক পিছনে। এক মাত্র ছেলে এসে জাপটে ধরে ঈশান কে।

-আব্বু তোমার পেট এত মোটা কেন?
-জানিনা আব্বু।
-তুমি কি মহিলা?
-মহিলাদের পেট মোটা হয়?
-হুম, আম্মুর ও তো ছিল, যখন আমি আকাশে ছিলাম। ঈশান থতমত খেয়ে যায়। ছয়বছর বয়সী ছেলে এত কিছু জানে কিভাবে?
-তোমাকে এসব কে বললো?
-কেন কাল তুমিই তো ছবি দেখিয়ে বলেছো।
-কি বলেছি?
-একটা ছবিতে আম্মু মোটা ছিল তখন আমি জিগেস করেছিলাম এ ছবিটা কার?তখনই তো তুমি বললা।

ঈশান সাহেব জিহ্বার আগায় কামড় বসিয়ে দেন। ছেলেটা এরকম ইচড়েপাকা হবে এটা ভাবা যায় না । ‘চলো বাবা,আজ আবার ছবি দেখবো।’-ঈশান সাহেব বললেন তার ছেলেকে। ছবি দেখানোর এক পর্যায়ে ঈশান সাহেবের ছেলে তাকে জিগেস করলো,’আব্বু এই ছেলেটা আর এই মেয়েটা কে?’ঈশান সাহেব উত্তর দিলেন,’এরা তোমার আব্বু আম্মু’।

পিচ্ছি ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বললো,’আমার আব্বু আম্মু এত ছোট!!তাহলে তোমরা কারা?’ ঈশান সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে বললেন,’এটা আমাদের ছোট কালের ছবি ‘ তার ইঁচড়েপাকা ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বললো,’তোমরা এত ছোট বয়সে বিয়ে করেছিলে!!আব্বু আমিও করবো ‘ ওয়ারড্রব এর কোনা ঘেসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে শাড়ির কোণা পেচাতে পেচাতে এসব দেখছিল হিয়া। অবস্থা এখন বড়ই বেগতিক। এই ছেলে বাবা মার মান সম্মান শেষ করে দিবে। হিয়ার মুচকি হাসিটা কানা চোখে দেখছিল ঈশান। খুব শান্তি পায় সে। হিয়ার হাসির মাঝে যেন স্বর্গ খুজে পাওয়া যায়। ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি,তোমায় দেখতে আমি পাইনি ‘হুম হিয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে শান্তি।

ভালোবাসা আর কাছে থাকার অটুট বন্ধন। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা- কলেজ গামি এক তরুণীকে দেখে ভীষণ ভালো লাগে ঈশানের। কলেজ পোশাকে সব মেয়েকে ভালো লাগে না, কিন্তু এ মেয়েটা ঈশানের বুকের ভেতরে থাকা কলিজার ভেতর তীর ছুড়ে দিয়েছে।ভাব জমায় ঈশান। কিন্তু না ভাব হয় না। সুন্দরী মেয়েদের ইগো বেশি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়। ঈশান সেটা চায় না। ঈশান চায় ভালোবাসতে,কাছে টানতে। কলেজ থেকে কতদিন যে হিয়ার পিছু নিয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু হিয়া বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবে না তাকে। প্রেক্টিক্যাল খাতাও লিখে দিতো হিয়া। ঈশানকে মানসিক অনেক সাপোর্ট দিলেও তারা শুধুই বন্ধু। না, এভাবে চলে না। ঈশান চাচ্ছে না এভাবে।

-দেখ হিয়া,তুই যদি আমাকে ভালো নাই বাসিস তাহলে প্লিজ লিভ মি…

-দেখ ঈশান আমরা বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু
-আমাকে ভালোবাসতে সমস্যা কোথায় তোর?
-আমার পরিবার….
-যদি তোর পরিবার কে রাজী করাই?
-আমি জানিনা।
-শোন তাহলে, আজ থেকে এই মুহুর্ত থেকে আমাদের সব কিছু শেষ!!

হিয়া ধীর পায়ে ঈশানের থেকে দূরে সরে যায়। এক দিন,দুই দিন যায়। হিয়ার মন আর মানছে না। সে তার অজান্তেই ঈশানের হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিটা মেয়ের কাছেই তার পরিবার আগে। কখনোই চাইবে না পরিবার কষ্ট পাক নাহ…ঈশানকে চাই। কলেজের শেষ দিন আজ। এর পর কে কোথায় যায় তার কোন ঠিক নেই। ঈশানকে খুজছে হিয়া। পাচ্ছে না। কোথাও পাচ্ছে না। কোন জায়গায় নেই সে। সেদিন তো পেলোই না,এর পরের তিন বছরেও ঈশানকে পেলো না হিয়া। হটাৎ একদিন ঈশান তার বাসায়। ঈশান ভালো জায়গায় পড়ে,ভবিষ্যত উজ্জল।

এখন নিশ্চয় হিয়ার আর আপত্তি নেই…কিছু শোনার আগেই ঈশানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হিয়া। সবার সামনে। হাত দিয়ে মারতে থাকে তাকে। ‘তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলি,তুই জানিস না ভালোবাসি তোকে আমি। ছেলেটাও আবেগী হয়ে পড়ে। সবার সামনেই শক্ত করে ধরে মেয়েটা কে। কিছু বছর পর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় তাদের। সংসার আলো করে আসে ছোট্ট একটা ছেলে। তবে তারা এখনো একে অপরকে তুই করে বলে। হিয়ার নির্দেশ এটা। বিয়ের পর এটা হিয়ার প্রথম চাওয়া ছিল। দরজায় খিল দিয়ে ঈশান যখন রূমে ঢুকলো হিয়া সরে গিয়ে এই কথাটাই বলেছিল-

-এ্যাই শোন্,আমি আগে তোর বন্ধু পরে বউ।

যদি কখনো বউ হিসেবে আমার কাছে কিছু লুকাতে চাস তাহলে বন্ধু হিয়াকে বলবি। নইলে তোর খবর আছে। ঈশান হাসে। তারো ইচ্ছে করে রবি ঠাকুরের মতো বলতে,’আমি পাইলাম,ইহারে আমি পাইলাম,সে আমার সম্পত্তি নয় সে আমার সম্পদ’ আর এভাবেই শুরু হয় দুটো মনের লুকানো স্বপ্ন যাত্রা। এভাবেই আজ তারা দুজন দুজনের। একটি বিশেষ দিন কিছুক্ষণ পরই। হিয়া মনে মনে ক্ষেপছিল। এই ছেলেটা ভুলে গেছে এই দিনটাকে। কিছুই আনলো না। হাতে করে একটা তরমুজ এনেছে। কিপ্টা কোথাকার। রাত দশটা। হিয়া ডাইনিং সাজায়। পিতা, পুত্র খেতে আসে। হিয়াও খায়। হিয়া বারবার ঈশানের দিকে তাকাচ্ছিল। তার চোখে মুখে আজকের দিনের অনুভুতির ছিটেফোঁটা ও নেই। খাওয়া শেষে হিয়া কঠিন গলায় বললো,’তরমুজ কাটবো?’ বাম পাশের দাত দিয়ে ভাত চিবুতে চিবুতে নিষেধ করল ঈশান।

রাত বারোটা।ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ড্রয়িং রূমে টিভি দেখছিল হিয়া। ঈশান ডেকে বললো, ‘হিয়া তরমুজ খাবো,গরম পড়েছে খুব’ তরমুজ কাটতে যেয়ে হিয়া প্রচন্ড রকম শক খেলো । তরমুজের ভেতর এটা কি?হাত দিয়ে ধরতেই টোন দিলো,’হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি। হিয়া এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে একটা লাল খাম ও আছে। ভিজে গেছে তরমুজের রসে। হিয়া খুলে দেখে। ‘একটু ছাদে আসবা?’ লিখাটা দেখেই হিয়া দৌড় দিয়ে ছাদে উঠে। একটা পাঞ্জাবি পরে আছে ঈশান। হিয়া ধীর পায়ে তার দিকে এগুয়।

-কি ভেবেছিলে?আমি ভূলে যাবো?
-তুই একটা শয়তান…এত ভালোবাসিস কেন আমায়? হিয়া কেদে দিচ্ছে। ঈশানের বুকে মাথা রাখে।

ঈশান তার একটা হাত চেপে ধরে। হিয়া আরো আবেগী হয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশে একটুও মেঘ নেই। আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা নৌকা ভাসছে। অর্ধ চাদ!! আজ তাদের পূর্ণিমা রাত!! অর্ধ না, পূর্ণ পূর্ণিমা আর পূর্ণ ভালোবাসা। পেছনে বোমা ফোটার মত কয়েকটা বেলুন ফোটার আওয়াজ আর পার্টি স্প্রে হিয়া আর ঈশানকে এলোমেলো করে দিলো। ‘হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি টু মাই প্যারেন্টস’ ছোট্ট ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো। বাবা মা দুজনই ছেলেটাকে কাছে টেনে নিল। এক সাথে চাদের আলো দেখছে সবাই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত