একটা ডিভোর্স পেপার

একটা ডিভোর্স পেপার

আট বছরের সম্পর্কে থাকাকালীন কত হাজারবার তাকে সন্দেহ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। মনে প্রাণে চাইতাম আমার সন্দেহ মিথ্যে হোক। ঠিকি শেষমেষ প্রমাণ করেছে যে, সে নির্দোষ। জয়টা তার হলেও খুশী হয়েছিলাম সবচেয়ে বেশী আমি।
অবশ্য কিছুকিছু পরাজয়ে থাকে জয় পাওয়ার সুখ।

আট বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে আমরা বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হই গত দুই বছর আগে।
গত কয়েকমাস আগেও আমরা বেশ সুখী ছিলাম। হাজার ঝগড়ার পরেও বেলাশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জন্য তার বুকটা ঠিকিই কাছে পেতাম।
তার সাথে ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে গেলে শেষে তার কাঁধটাই পেতাম মাথা রাখার জন্য।
হয়তো কিছু মাস আগেও সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলাম আমরা দুজন।

নাহ। শুধু আমি ছিলাম। সে নয়। যদি সেও আমার মতো ভালো থাকতো তবে ভালো থাকার সেকেন্ড অপশন সে খুঁজতো না।

আমার ব্যর্থতা এই যে আমি তাকে ভালো রাখতে পারিনি। স্ত্রী হিসেবে আমি ব্যর্থ। অদ্ভুত তাই না! আট বছর ধরে প্রেমিকা ছিলাম অথচ স্ত্রী হয়ে আর প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারিনি।

যতদূরে যাচ্ছিল ততো তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমি তার অবহেলাকে কর্ম ব্যস্ততা ভেবে ভুল করেছিলাম৷

প্রথম যেদিন তার ফোনে এক মেয়ের টেক্সট পাই সেদিন অজানা এক আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠে। কিন্তু আট বছরের জমে উঠা বিশ্বাসের কাছে হেরে যায় তা।

একরাতে যখন সে গভীর ঘুমে মগ্ন তখন আমারই চোখের সামনে সেই একই নাম্বার থেকে একটার পর একটা ম্যাসেজ এসে যাচ্ছিল।

ঠিক সেদিনও কেনো জানিনা তাকে হারানোর ভয়ে কেঁদে উঠি। আমার কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়।
ঠিক আগের মতোই আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে।

আমি কিছু না বলে ফু্ঁপিয়ে কেঁদে উঠি। সে তড়িঘড়ি করে আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়।
প্রচন্ড প্রশান্তির জায়গাটায় ঠাঁই পেয়ে কিছুক্ষণ আগের ভয়টার কথা ভুলে যাই।
সেদিনও তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি।

আমাদের দুজনের মোবাইলই সেইম ছিল। একদিন সে ভুল করে আমার মোবাইল নিয়েই অফিসে চলে যায়।

সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বারবার কল আসতে থাকে তার মোবাইলে। একটা নাম্বার ছিল। বারবার কল আসছে দেখে ভাবলাম আর্জেন্ট কিনা।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি ভয়েস ভেসে আসে,,,,,
—- কি ব্যাপার শুভ কই তুমি? আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করছি জান। আধ ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছো আজকে। সো ত্রিশবার কান ধরে উঠবস করতে হবে। আর আমাকে আইস্ক্রিম খাইয়ে দিতে হবে।
কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন শুভ?

আমি মেয়েটার কথা শুনে সেখানে ফোন হাতে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু বলার কিংবা করার শক্তি যেনো লোপ পেয়েছে। কিছু না বলে ফোন রেখে দিয়ে ধুপ করে ফ্লোরে বসে যাই৷

এদিকে বারবার রিং হয়ে যাচ্ছে৷ হয়তো শুভর প্রিয়তমা কল দিয়ে যাচ্ছে।
এক সময় কল অফ হয়ে যায়। কিন্তু আমার বুকের ব্যথা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।৷ হুট করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। বুক ফেটে যাচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে আমার৷ চিৎকার করে কেঁদেই যাচ্ছি। আমার সংসারে অন্য কেউ আসবে৷ আমার সাজানো বাগানের মালিক হয়ে যাবে অন্য কেউ৷ নাহ! আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।

কিছুতেই ভাবতে পারছিলাম না এসব৷ ঠিক যেখানটায় শুভর বুকে আমি মাথা রাখি ঠিক সেখানটাই অন্য কেউ মাথা রাখবে৷ আমার জায়গায় অন্য কারো বাস৷ এটা শুভ কি করে করতে পারে? কি করে শুভ পারবে এই ঘর এই সংসারে আমার প্রতিটা স্পর্শ মুছে দিতে? নাহ শুভ এটা আমার সাথে করতে পারবে না৷

আমার বুকটা ছিঁড়ে কেউ যেনো কলিজাটা নিয়ে যাচ্ছে। শুভ তুমি এসে দেখে যাও তোমার তরুর কতটা কষ্ট হচ্ছে। শুভর নাম ধরে কেঁদেই যাচ্ছি। অথচ আমার শুভ!! হয়তো এতক্ষণে তার প্রেয়সীর কাছে পৌছে গেছে।

আচ্ছা মেয়েটা কি শুভর বুকে মাথা রেখেছে? শুভ নিশ্চয় ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে নতুন সংসারের স্বপ্ন সাজাচ্ছে৷
নাহ আমার সংসারের ভাগ আমি দিবোনা। কেনো দিবো? আমি সাজিয়েছি নিজের হাতে যে সংসার তা কেবল আমার।৷
এত কাঁদলাম, চিৎকার করে কেঁদে শুভকে ডাকলাম, এভাবে ফ্লোরে গড়াগড়ি করে কাঁদলাম কই আমার শুভ তো এলো না৷ আচ্ছা তবে কি আমার কান্নার আওয়াজ তার কাছে পৌছায়নি?
শুভ ফিরে এসো প্লিজ শুভ ফিরে এসো।

কি যেনো ভেবে দৌঁড়ে বারেন্দায় যাই৷ দেখি নিচে সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে৷ তবে কি শুভ এলো? এটা ভাবতেই কলিং বেলের আওয়াজ।
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলি৷ শুভ আমার দিকে তাকিয়ে চমকে যায় আমার অবস্থা দেখে।

আমার মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে, চোখের পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,
— কি হয়েছে বউ? এমন অবস্থা কেন? অমাবস্যা নেমে এলো কেন চেহারায়? আমার তরুর চুল, চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?

আমি কিছু না বলেই শুভর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠি৷ শুভ বারবার জিজ্ঞেস করছিল,, “কি হয়েছে আমার! ”

কিন্তু আমি কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছিলাম না।
শুভ আমার মুখে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে দেয়৷ এক গ্লাস পানি খাইয়ে দিয়ে আমাকে সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,
—- কি হয়েছে এবার বলো? মনে হচ্ছে সারাজীবনের কান্নাকাটি সব একদিনে করে ফেলেছো? বলো আমায় কি হয়েছে? শরীর খারাপ লেগেছে?

আমি ফের কেঁদে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে বলি,,,
—- আমি তোমাকে হারাতে চাইনা শুভ৷ আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ৷ আমি থাকতে পারবোনা তোমাকে ছাড়া। একদম মরে যাবো। আমি সত্যি তোমার ভাগ কাউকে দিতে পারবোনা৷ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি শুভ।

শুভ আস্তে করে আমার মাথাটা তার বুক থেকে তুলে জিজ্ঞেস করে,,,,
— কে বলেছে আমি আমার এই পাগলি বউকে ছেড়ে চলে যাবো? এমনটা কখনো হয় বলো?

আমি বললাম,,,
—- তাহলে ওই ফোন কল?
শুভ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,,,
— কোন ফোন কল?

বললাম,,,
— একটা মেয়ে যে তোমাকে চাইলো! তোমার নাম ধরে ডাকলো। জান ডাকলো।

শুভ হেসে উঠে খুব জোরে। ওর হাসিতে সরলতা ছিল। আচ্ছা হাসিতে কি সরলতা থাকে? নাকি আমি বোকার মতো ওর হাসিতে সরলতা খুঁজতে গেছি।

শুভ আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,,,,
— পাগলি ওখানে কোনো নাম ছিল? নাকি আননোন নাম্বার?

বললাম,,,
—- আননোন নাম্বার।

ও বলল,,,
— তাহলে৷ এভাবে কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা কেনো করেছো বোকা মেয়ে? হয়তো সে অন্য কোনো শুভকে চাইছিলো? পৃথিবীতে কি শুধু তরুরই শুভ আছে? আর কারো নেই?

আমি বাচ্চাদের মতো শুভর কথা বিশ্বাস করে যাই। কারণ খুব করে বারবার চাইছিলাম সব মিথ্যে হয়ে যাক। শুভ আমার থেকে যাক।

শুভ আমার কপালে চুমু দিয়ে বলে,,,
— এবার তো একটু হাসো বউ। এভাবে আমার বউকে মানায় না।

আমি শুভকে জড়িয়ে ধরে বলি,,,
— আগে আমাকে ছু্ঁয়ে বলো কখনো ছেড়ে যাবে না? কখনো অন্যকারো হবে না? বিশ্বাস করো তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

শুভ আমাকে না ছুঁয়ে বলে,,,
— ধরো তোমাকে ছু্ঁয়ে কসম দিয়ে বলেও আমি ছেড়ে চলে গেলাম তাহলে?

আমি ভয়ে কেঁপে উঠে আরো শক্ত করে শুভকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফু্ঁফিয়ে কেঁদে উঠি। শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,,
—- অনেক হইছে পাগলি। আর কাঁদতে হবেনা। এই তোমাকে ছুঁয়ে কসম দিয়ে বললাম তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোনা।

আমি শুভর প্রতিটা কথায় বাচ্চাদের মতো নাড়িয়ে যাই। বিশ্বাস করে যাই।

কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারি আমার শুভ আর আমার নেই। সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ।
আমায় ঠকাচ্ছে আমারই শুভ।

একদিন সকালে উঠে দেখি শুভ নেই। ঠিক যেই জায়গায়টায় শুভ ঘুমোয় সেই জায়গায় দুটো কাগজ

যার একটা ছিল ডিভোর্স পেপার। পাশের কাগজটায় লিখা ছিল,,,
তরু,
আমায় মাফ করে দিও। আমি তোমার সাথে ভালো নেই। আমি অন্য কাউকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। এতো বছরের সম্পর্কের পর ডিভোর্স পেপারটা সামনাসামনি দিতে আমার কেমন যেনো লাগছিলো তাই রেখে চলে গেলাম৷ দয়া করে তাতে সিগনেচার করে দিও।

এই মুহুর্তে আমার পুরো পৃথিবীটাকে অন্ধকার করে দিয়ে শুভ চলে গেছে। আমি জানতাম এমন একটা দিন আসবে। তবুও কেন এতো কষ্ট হচ্ছে?
আমি সিগনেচার না করেই পাশের কাগজে লিখে রেখে এসেছিলাম সেদিন,,,,
— ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করার মতো শক্তি নেই আমার। কিন্তু তোমার ভালো থাকার জন্য তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে দিলাম। আচ্ছা শুভ একটা ডিভোর্স পেপারের সিগনেচার কি একজনের ভালোবাসা মুছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত