“আপনারা তো স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে রুম নিলেন তাহলে সে এখন অস্বীকার করছে কেন?” ম্যানেজার এর এমন প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে পাচ্ছি না।আশে পাশের লোকজনেও অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করছে। আমি তাদের যতই বুঝাচ্ছি আরিশা আমার বিয়ে করা বউ কেউ মানতেই চাচ্ছে না।তাদের ই বা কি দোষ যেখানে আরিশা নিজেই বলছে সে আমাকে চিনে না। একটু আগে হঠাৎ করে আরিশার ঘুম ভেঙে যায়।আমাকে পাশে দেখার পরে চিৎকার দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।আরিশার চিৎকার এ আশে পাশের রুমের সবাই ও জেগে যায়।
একরকম জোর করেই আরিশার ফ্যামিলি আমার সাথে ওর বিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম ও আমাকে মেনে নিতে চাইতো না।তারপর কয়েক মাস পার হবার পর সব ঠিক হয়ে যায়। আরিশা আমাকে ভালো ভাবেই মেনে নেয় এবং আমরা সুখেই আছি।কিন্তু আজকে কেন এমন শুরু করলো সেটাই বুঝতে পারছি না।নাকি আরিশা অন্য কোন প্ল্যান আছে! এসব পরেও ভাবা যাবে।আগে আমাকে প্রমাণ করতে হবে আরিশা আমার স্ত্রী। বিয়ের দুই বছর পরে এসে আরিশাকে নিজের বউ হিসেবে এত গুলো লোকের সামনে প্রমান দিতে হচ্ছে।আরিশাকে রুমে রেখে সবাই আমার সাথে হোটেলের রিসিপশনের সামনে আসলো।
কেউ কেউ পুলিশকে ফোন করার জন্য বলছে।আর চুপ থাকা যাবে না ভেবে, সবাইকে আমার কথা শুনার জন্য বললাম।তারপর ফোনটা বের করে আমাদের বিয়ের ছবি দেখালাম ।ছবি দেখার পর কিছুটা বিশ্বাস করলো যে আরিশা আমার ই স্ত্রী। কিন্তু তাদের মনে হয়ত প্রশ্ন ছিল তাহলে মেয়েটা অস্বীকার করছে কেন? এর মাঝে আরেকজন বলে উঠলো ” এসব ছবি তো বানানোও যায়।ছবি গুলা যে আসল তার প্রমাণ কি”। তার কথার সাথে অনেকেই একমত হলো। এমন সময় যে মেয়ে আরিশার সাথে রুমে থেকে যায় সে এসে বললো আরিশা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি দৌড় দিয়ে রুমের দিকে যাই।আমার পিছে পিছে বাকি সবাই ও যায়।কিন্তু কেউ আমাকে আরিশার কাছে যেতে দিচ্ছে না।
কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর জ্ঞান ফিরে আসে।তারপর আবারো ঘুমিয়ে পড়ে আরিশা।এত সময় পার হলেও আমি একবারের জন্য ও আরিশার পাশে যেতে পারি নাই।বরং কয়েকজন আমাকে ঘিরে রেখেছে যেন আমি পালিয়ে যেতে না পারি।তারপর আমি ম্যানেজারকে বললাম আরিশার ফোন এনে তার বাবা মাকে ফোন দিতে। ম্যানেজার ফোন না দিয়ে সেই মেয়েটিকে দিয়ে তার বাবাকে ফোন দিল।ফোন দিয়ে আরিশার অসুস্থার কথা বলাতেই ওর বাবা আমার কথা জিজ্ঞাসা করে। মেয়েটি একটু বুদ্ধি করেই জবাব দিল যে আমি ডাক্তার আনতে গেছি,ওকে পাশে রেখে। ফোন রাখার সাথে সাথে আরিশার বাবা আমাকে ফোন দিল।আমিও বললাম আরিশা সামান্য অসুস্থ,তাই ওকে রুমে রেখে আমি ডাক্তার আনতে গেছি।এবার সবাই বুঝতে পারলো আমি মিথ্যা বলি নাই।আরিশার মাথার সমস্যা আছে কিনা ভেবে সবাই চলে গেল।আমিও রুমে গিয়ে আরিশার পাশে বসে রইলাম।
সকাল বেলা আরিশার ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে।রাতে যে কোন কিছু হয়েছিল সেটা তার কথাতে মনেই হচ্ছে না।আমিও রাতের কোন কথা আর মনে করাতে চাই নাই।কিন্তু নিজের মনের ভিতরে একধরনের চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।দুইজনে একসাথে বের হয়ে সকালে নাস্তা করতে গেলাম।কাল রাতে যারা ছিল তাদের অনেকের সাথেই দেখা হলো।কয়েকজন রাতের কথা জিজ্ঞাসা করতে চাইলেও তাদের ইশারায় না করে দিলাম। নাস্তা শেষ করে সমুদ্র তীরে কিছুক্ষণ ঘুরলাম দুজনে। এত সুন্দর পরিবেশ আর এত সুন্দর বউ পাশে থাকার পরেও কোন কিছুই উপভোগ করতে পারছি না।বার বার শুধু রাতেই কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।কি এমন হলো যে আরিশা এমন করলো? বা সকাল বেলা উঠেই কেন সব ভুল গেল? বারোটার দিকে দুজনেই রুমে চলে এলাম।আরিশা গোসলে গেল।আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি।
বিয়ের পর শুনছিলাম আরিশার আরেকটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল।কিন্তু আরিশার বাবা মা সেটা মেনে নেয় নি।একপ্রকার জোর করেই আমার সাথে বিয়ে দেয়। তাই আরিশা প্রথম দিকে আমাকে মেনে নিতে পারে নাই।আবার এটাও ভাবছি বিয়ের দুই বছর হয়ে গেছে। এখন ওসব ভুলে গেছে। বিয়ের আগে এমন প্রেম থেকেই থাকে। কিন্তু পরে সবাই ভুলে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম থেকে উঠে দেখি চারটা বাজে। রুমে আরিশা কে পেলাম না। বাইরে এসে হোটেল এর রেস্টুরেন্ট এও খুজলাম সেখানেও আরিশা নেই।কোথাও গেলে তো আমাকে বলে যেত।এভাবে না বলে কোথায় গেল। কখনো আমাকে না বলে কোথাও যায় নি আরিশা।মনের মাঝে উলটাপালটা চিন্তা এসে বাসা বাধতে শুরু করছে। কি করবো কোথায় খুজবো বুঝে উঠতে পারছি না।কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করি তাহলেও লোকজন খারাপ ভাববে।একাই খুজে বের করতে হবে। ম্যানেজারের সাথে দেখা হলো,সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো” আপনি কি আপনার স্ত্রী কে খুজছেন? আমি হ্যা না জবাব দেওয়ার আগেই সে বলে উঠলো” তাকে তো দেখলাম এক ছেলের সাথে বাইরে যেতে, আপনি জানেন না? ” এই কথা শুনে উত্তেজিত হওয়া যাবে না আমার।যদি বলি যে আমি জানি না তবে ঝামেলা হয়ে যাবে।তাই আমি বললাম “না,আমি আরিশাকে খুজছি না,ও যে বাইরে গেছে সেটা আমি জানি।” এই বলে চলে আসলাম হোটেল রুমে। তাহলে কি আমার ভাবনা টাই ঠিক হলো? আরিশা কি অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেল? এসব প্রশ্ন মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।একবার ভাবলাম আরিশার বাবাকে একটা ফোন দেই,কিন্তু মনে হলো আরেকটু সময় অপেক্ষা করি। এখনি সবাইকে জানানো উচিত হবে না।
বাইরে বের হয়ে আরিশাকে খুজতে লাগলাম। কিছুদুর যাওয়ার পরেই দূর থেকে আরিশাকে দেখতে পেলাম।সাথে একটা ছেলেও! কে এই ছেলে।এত দূর থেকে আমি চিনতেও পারছি না।কাছে যাবো কি যাবো না! সেটাও বুঝছি না।সাহস করে কাছেই গেলাম। গিয়ে তো নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। আরিশা আমাকে দেখেই বলে উঠলো” আমার অসুস্থতার কথা শুনে ভাইয়া আমাকে দেখতে আসছে।কিন্তু কখন আমি অসুস্থ ছিলাম নিজেই তো জানি না।হিহিহি!! তুমি ঘুমাচ্ছিলা বলে আর ডাক দেই নাই”। আচ্ছা ঠিক আছে বলে চলে যেতে চাইলাম।আমার সাথে ওরাও চলে আসলো। আরিশাকে রুমে রেখে ওর ভাইয়াকে নিয়ে একটা কাজের কথা বলে বের হলাম।তাকে সব কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে হয়।কাল রাতের যাবতীয় ঘটনা তাকে খুলে বললাম। সব কথা শুনে ভাইয়া শুধু হাসলো।” আরে এইগুলা কোন ব্যাপার ই না। আরিশা মাঝে মাঝেই এমন মজা করতো সবার সাথে। ” কথাটা বলেই সে টপিক চেঞ্জ করে অন্য কথায় নিয়ে গেল। তবে কেন জানি আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।ভাইয়া কোন কিছু লুকাচ্ছে হয়ত,না হলে সেও আরিশার প্ল্যানের সাথে যুক্ত।কোনটা হবে সেটা আমাকেই খুজে বের করতে হবে।
এর মাঝে আর তেমন কোন কিছু হলো না।ঢাকায় চলে আসলাম। কয়েক মাস ভালো ভাবেই কেটে গেল। আবার আরেকদিন রাতের বেলা এক ই অবস্থা।আমাকে দেখেই চিৎকার শুরু করে দিল আরিশা।এবার নিজের বাসায় থাকাতে তেমন বড় কোন সমস্যা হলো না।আব্বু আম্মু রুমে চলে এলো।আম্মুকে দেখে তার কাছে গিয়ে বললো” ও কেন এখানে এসেছে? ও তো রোশান না।” আম্মু তাকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করলো যে আমিই রোশান কিন্তু আরিশা মানতেই চাচ্ছে না। রুমের দেয়ালে থাকা আমার আর ওর ছবি দেখার পরেও সে আমাকে চিনছে না। শুধু বলছে “ও রোশানের মত দেখতে, কিন্তু রোশান না।”আমাকে দেখে ওর চিৎকার বেড়েই যাচ্ছে দেখে আম্মু আমাকে বাইরে যেতে বললো।সেদিন রাতে আরিশা আর আম্মু একসাথে থাকলো।আমি আর আব্বু আলাদা রুমে থাকলাম।সকাল বেলা উঠে আরিশার সাথে দেখা না করেই অফিসে চলে গেলাম।কোন কাজেই মন বসাতে পারছি।ঘটনাটা কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছি না।তখন মনে হলো আরিশার ভাইয়া নিশ্চয় কিছু জানে।তাকে ফোন দিয়ে আসতে বললাম। ভাইয়া নিজে না এসে আমাকে একটা জায়গায় যেতে বললেন।
ভাইয়া এসে সেখান থেকে থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে একটা গোরস্থানের দিকে নিয়ে গেলেন।সেখানে গিয়ে একটা কবর দেখালেন।কবরের পাশে লিখা ” মরহুম আবিদ হাসান, পিতা: মোঃ আমিরুল হাসান”। “আমিরুল হাসান?” এটা তো আরিশার বাবার নাম।তাহলে আবিদ নামে যে আরিশার একটা ভাই ছিল! সেটা তো জানতাম না আমি।আবার সে মারাও গেছে সেটাও জানা ছিল না।আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম “আমি তো এই ব্যাপারে কিছু জানি না।আমি তো জানতাম আপনি একাই ওর ভাই।আরেকজন ছিল সেটার কথা কেউ বলেন নি তো” আমরা আবিদের কথা কাউকে বলি না।আর আবিদের কথা এখানের কেউ জানেও না।আবিদ মারা যাওয়ার পর আমরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যাই।” ভাইয়ার কথার কিছু বুঝতে পারছি না আমি।আমি তাকে ডাকলাম আরিশার ব্যাপারে কথা বলার জন্য।কিন্তু সে আমাকে আবিদের কথা বলছে কেন? “তাহলে কি আরিশাই আবিদ কে”! না এসব আমি কি ভাবছি।
ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম আবিদের মারা যাওয়ার সাথে আরিশার কি সম্পর্ক। আরিশা কি আবিদ কে খুন করেছিল? “না, আরিশা আবিদ কে খুন করে নাই,তবে আরিশার কারনেই আবিদ মারা যায়”। ভাইয়ার কাছ থেকে আবিদের মারা যাওয়ার ব্যাপারে সব কিছু শুনার পর নিজের মনের মাঝে একধরনের ভয় চলে আসলো। আমি বাসায় চলে আসলাম।আমাকে দেখে আরিশা আবারো কালকে রাতের মত শুরু করলো।আমি কিছু বললাম না।না বলে অন্য রুমে চলে গেলাম।রুমে গিয়ে আব্বু আম্মুকে ডাক দিলাম।”সারা দিন আর কারো সাথে কিছু করছে কিনা আরিশা আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলাম।”না,শুধু তকে দেখলেই আরিশা এমন করে।” আব্বু আম্মুকেও অনেক চিন্তিত লাগছে।এভাবে আর কয়দিন দিন!আমি তাদের শান্ত হতে বললাম।তাদের আরিশার ভাইয়ার বলা কথা গুলো বললাম।
“আরিশা আবিদের চেয়ে দুই বছরের বড় ছিল।আরিশা যখন ফাইভে পড়ে তখন একদিন আবিদের সাথে স্কুলের আরেকজন ছাত্রের ঝগড়া হয়। ঐ ছেলেটা আবিদের মাথা ফাটিয়ে দেয়। এটা দেখে আরিশা অজ্ঞান হয়ে যায়। আরিশার জ্ঞান ফিরার পর যতবার আবিদ কে দেখেছে ততবার সে ভয় পেত, এখন আমাকে দেখে যেমনটা করে তখন আবিদকে দেখেও তেমন ই করতো।তারপর ও কোন সময় আবিদ কে আবিদ হিসেবে মেনে নিতে পারে নাই।সব সময় ভাবতো ঐটা আবিদ না।অন্য কেউ আবিদের মত দেখতে। তারপর থেকে আবিদ আর আরিশাকে দূরে দূরে রাখা হতো।একদিন আরিশা অসুস্থ থাকায় সে স্কুলে যায় নি।আর তার আম্মু ডাক্তারের থেকে ওষুধ আনতে যায়।এমন সময় আবিদ স্কুল থেকে ফিরে আসে।আবিদকে দেখে আরিশা আবারো ভয় পেয়ে যায়। পাশে থাকা লাঠি নিয়ে আবিদের দিকে ছুটে যায়।আর আবিদও বাইরের দিকে দৌড় দেয়। রাস্তা পার হবার সময় গাড়ির সাথে আবিদের ধাক্কা লাগে।আবিদ সেখানেই মারা যায়।”
কথা গুলো শুনে আব্বু আম্মুও ভয় পেয়ে গেল। “কিন্তু এসব আরিশার বাবা মা আগে জানায় নি কেন?” আম্মু জিজ্ঞাসা করলো।”আবিদ মারা যাওয়ার পর আর কখনো এমন হয় নাই,সবাই ভেবেছিল আরিশা ঠিক হয়ে গেছে” আমি আম্মুকে বললাম। এমন সময় আরিশা আম্মুকে ডাকতে লাগলো।আমি আম্মুকে ভয় না পেয়ে যেতে বললাম।আম্মু আরিশার কাছে ভয়ে ভয়ে গেল। আমি আর আব্বু বসে রইলাম। পাশের রুম থেকে আম্মু আর আরিশার কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছি।
-মা,ঐ লোকটা আবার এসেছে কেন? আমার রোশান কোথায়?(আরিশা)
– ও ই তো রোশান,
-না মা,আপনারা ভুল করছেন।ও রোশান না,ও রোশানের মত দেখতে অন্য কেউ।ওকে তাড়িয়ে দিন।
– আচ্ছা,দিব।আচ্ছা আরিশা তোমার আবিদের কথা মনে আছে?
-হ্যা,আমার ছোট ভাই
-তো, সে কোথায়?
– আবিদ তো মারা গেছে।
আম্মু কিছু না বলেই চলে এলো।এসেই আমাকে বলতে শুরু করলো “এই মেয়েকে ওর বাবার বাড়ি রেখে আয়, এই মেয়ে খুনী,আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।” আমি আম্মুকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম এমন কিছুই হবে না।কিন্তু আম্মু সেটা মানতেই চাচ্ছে না। পর দিন আরিশার ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম।ডাক্তার মনোযোগ সহকারে আমার আর ভাইয়ার কথা শুনলেন।তারপর তিনি বললেন-
-আরিশা একধরণের বিরল মানুষিক রোগে আক্রান্ত(ডাক্তার)
-কি রোগ?
-রোগের নাম Capgras Delusion ( ক্যপগ্রাস ডিলুশন) ডাক্তার এমন রোগের নাম বললো যেটার নাম জীবনেও শুনি নাই। আমি আর ভাইয়া দুইজনের কেউ কিছুই বুঝলাম না।ভাইয়া আমার দিকে তাকালো আর আমি ভাইয়ার দিকে।ডাক্তার হয়ত বুঝতে পারলেন যে আমরা কিছুই বুঝি নাই।
-একটু বিস্তারিত বলেন স্যার,
– এ রোগে আক্রান্ত রোগী বিশ্বাস করে যে তার জীবন সঙ্গিনী অথবা পরিবারের অন্য যে কোন একজন সদস্য ঠিক তার মতই দেখতে হুবহু অন্য একজন মানুষ দ্বারা রিপ্লেইসড বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
ডাক্তারের কথা শুনার পর ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারলাম।আবিদের সাথে ঐ ছেলের ঝগড়ার পর আরিশার মাঝে এমন একটা বিশ্বাস এসে গেছিল যে আবিদের মত দেখতেই অন্য কেউ আবিদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছিল।সেজন্য সে আবিদ কে সহ্য করতে পারতো না।
-স্যার, এই রোগ হবার পিছনের কারণ টা কি?
– এই ধরণের রোগ শত কোটি মানুষের মাঝে দুই একজনের হয়ে থাকে।তাই সঠিক কারণ এখনো বলা যাচ্ছে না।তবে কোন এক্সিডেন্ট বা হঠাৎ বেশি উত্তেজিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর দেখা দিতে পারে।
– এই রোগ ভালো হয় না?
– হ্যা, হয় মাঝে মাঝে, আরিশার ক্ষেত্রে আবিদের মারা যাওয়ার পর একবার ঠিক হয়ে গেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আবার এসে যায়।
এবার আমার মাঝে কিছুটা ভয় এসে গেল।তারমানে কি আমি মারা যাওয়ার আগে আরিশার আর এই রোগ ভালো হবে না? ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেল আমার। ডাক্তার হয়ত আমার মুখ দেখে মনের ভাষা কিছুটা বুঝতে পারলেন।তারপর বললেন” আপনি যেমন ভাবছেন তেমন না, আমার এক বন্ধু আমেরিকায় এই রোগ নিয়ে গবেষণা করছে।এই রোগে আক্রান্ত রোগী আছে তার একটা।সে এখন সুস্থ হবার পথে।আমি ওর সাথে কথা বলে কালকে আপনাকে জানাচ্ছি”। ডাক্তারের কথা শুনে ভয় একটু হলেও কমলো।এখন কালকে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।আমি যে বাসায় আছি আরিশার সেখানে থাকা উচিত না।তাই বাসায় এসে আরিশা ভাই আরিশা কে নিয়ে গেল।আমি আম্মু আব্বুকে ডাক্তারের বলা কথা গুলো জানালাম।আম্মুর এক কথা,এই মেয়েকে আর বাসায় আনা যাবে না।বাবার বাড়ি চলে গেছে সেখানেই থাক।দরকার হলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে আরেকটা বিয়ে করাবে।তবুও আরিশাকে আর আনবে না।
আমি কিছু না বলে রুমে চলে এলাম। আরিশাকে ছাড়াও আমি থাকতে পারবো না।আবার আরিশাকে নিয়েও থাকা সম্ভব হচ্ছে না।আর আম্মু যা বলছে সেটাও মেনে নিতে পারবো না।কি করবো তাহলে আমি।বড্ড বেশি ভালোবাসি আরিশাকে। কালকেও ওকে ছাড়া দূরে ছিলাম।কিন্তু এক ই বাসাতে ছিলাম বলে এতটাও খারাপ লাগে নাই।কিন্তু আজকে ও বাসায় নেই।প্রচন্ড একা একা লাগছে।বিয়ের পর আজকেই প্রথম আমরা আলাদা বাসায় আছি।সারা রাত আর ঘুমাতে পারলাম না। এখন মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে আরিশার আর আমার ছোট এক্সিডেন্ট টাই সব কিছুর জন্য দায়ী।কক্সবাজার যাওয়ার পথে আমাদের একটা এক্সিডেন্ট হয়।আর সেদিন রাত থেকেই তার পুরনো রোগটা নতুন ভাবে আসতে শুরু করে।কয়েক মাসের মাঝে পুরোপুরি এসে যায়।এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা উঠে আবারো ডাক্তারে কাছে গেলাম।সিরিয়াল নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছি।আজকে আর সময় কাটতে চাচ্ছে না।আধা ঘন্টার মত বসে আছি,কিন্তু মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টা ধরে আছি। ডাক্তার কি বলবে না বলবে সেটা ভেবে এই এসির মাঝেও ঘেমে যাচ্ছি। অবশেষে আমার সিরিয়াল আসলো।ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করলাম।
– স্যার,কথা বলছেন আপনার বন্ধুর সাথে?
– হ্যা, কথা হয়েছে।আপনাকে বেশি চিন্তা করতে হবে না আর।এই রোগ ভালো হবার সম্ভাবণা আছে ৬০% এর মত।আর বাকিটা আল্লাহর হাতে।
– কি করবো এখন তাহলে
– আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সেগুলো নিয়মিত খেলে অনেকটাই কমে যাবে।তবে আপনাকে আরেকটা কাজ করতে হবে
-কি কাজ স্যার?
– প্রায় তিন মাসের মত আপনি আরিশার সাথে যোগাযোগ রাখবেন না।ফোনে কথা বলতে পারেন মাঝে মাঝে। আপনাকে যদি না দেখে আর সাথে মেডিসিন গুলো চালিয়ে নেয় তবে আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।
তিন মাস! সময়টা আমার কাছে তিন বছরের মত মনে হচ্ছে।তবুও সারা জীবন আরিশাকে পাওয়ার জন্য এই টুকু কাজ আমাকে করে যেতেই হবে।বাসায় এসে আরিশার বাবা মা এবং আমার বাবা মা সবাইকে খুলে বললাম ব্যাপার টা।এই তিন মাস আরিশা ওদের বাসাতেই থাকবে।এখানে থাকলে আমার বেশি খারাপ লাগবে।যে বাসায় আরিশা নাই সে বাসাটাকে আমার কাছে খালি খালি মনে হবে।আরিশা চলে যাওয়ার পর দিন ই আমি ফ্রান্সে আমার বোনের ওখানে ঘুরতে যাব।আম্মু আব্বুর ধারণা আপুর কাছে গেলে আমারো হয়ত একটু ভালো লাগবে,আর ঘুরে আসাটাও হবে।
ফ্রান্স এ চলে আসলাম।এখানে আসার পর এখানকার এক ডাক্তারে সাথে কথা বললাম।দেশের ডাক্তারের দেওয়ার প্রেসক্রিপশন গুলা দেখালাম।সব দেখে তিনি বললেন ঠিক আছে।তবে তিন মাসের চেয়ে সময় টা এক বছর হলে বেশি ভালো হয়।তিন মাসের মাঝে ঠিক নাও হতে পারে।আর তার সাথে কোন রকম যোগাযোগ ই করা যাবে না।তারকথা মত আমি সেটাই করলাম।সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।তারপর হাসান ভাই(আপুর স্বামী এর সাথে এখানের তার ব্যবসায় সময় দিতে লাগলাম।ধীরে ধীরে সময় কেটে গেল।
১০ মাস হয়েছে এমন সময় একদিন আরিশা আমাকে ফোন দিয়ে কান্না কাটি শুরু করলো।আমি কেন এত দিন ধরে বাইরে আছি।তার কোন খোজ খবরও নেই না।তার বাবা মার কাছে শুনতে পারলাম আরিশা এখন সুস্থ হয়ে গেছে
সে তিন মাস আগে থেকেই শুধু আমার কথা জিজ্ঞাসা করতো।কিন্তু বিভিন্ন বাহানা দিয়ে এত দিন দূরে রাখছে।কিন্তু এখন আর পারছে না।
দেশে চলে আসলাম। আমি আসার আগেই আরিশা আমাদের বাসায় চলে আসছে।এয়ারপোর্ট এ নেমে দেখি শুধু আব্বু এসেছে নেওয়ার জন্য।আব্বুকে আরিশার কথা জিজ্ঞাসা করলাম।কিন্তু কিছু বললো না।কেন আসে নাই সেটা জানে না হয়ত।অনেক রাত হয়ে গেছে এজন্য হয়ত আসে নাই।বাসায় যাওয়ার আগে আরিশার প্রিয় কাঠ গোলাপ এবং লাল আলতা নিয়ে আসলাম।বাসায় গিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলছি।তবুও আরিশাকে কোথাও দেখছি না।কাউকে জিজ্ঞাসাও করতেও লজ্জা লাগছে আম্মু আমাকে রুমে যেতে বললো।রুমের দরজা খুলতেই দেখি রুমটা সুন্দর করে সাজানো আজ।আর বিছানার মাঝখানে ঘোমটা দিয়ে আরিশা বসে আছে। ধীরে ধীরে কাছে গেলাম।ঘোমটা টা সরানোর সাথে সাথে আরিশা আবারো আগের মতই চিৎকার দিয়ে উঠলো” কে আপনি? আমার রোশান কোথায়? “তাহলে কি আরিশা ঠিক হয় নাই? তবে এবার আর চিৎকার দিয়ে বাইরে গেলো না।চিৎকার শুনে বাবা মা ও রুমে আসলো না। আমি নিজেই চলে যেতে লাগলাম।পিছন থেকে আরিশা এসে জড়িয়ে ধরলো-
-ভালোবাসি তো,আমাকে রেখেই চলে যাবা আবার?(আরিশা)
– তুমি আমাকে চিনতে পারছ?
– হ্যা,চিনতে পারছি।আগে আমি এমন করলে তুমি কেমন করতে সেটা তো বুঝতে পারি নাই, তাই আজকে দেখার জন্য একটি নাটক করলাম।
– খুব ভালো
– সরি তো,আমি আব্বু আম্মুর কাছে সব শুনেছি।আমি বিশ্বাস ই করতে পারছি না আমি তল এমন করেছি তোমার সাথে।আমাকে মাফ করে দিও।আর এমন করবো না। আর হ্যা,অনেক ভালোবাসি তোমায়। আমি কিছু না বলে আরিশার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এক বছর তাকে দেখি নাই।আজ সারা রাত আরিশাকে দেখবো।