আমার স্ত্রী নগ্ন হয়ে বৃষ্টিতে ভেজে । আমার তাতে কোন আপত্তি নেই । এই জন্য আমরা দুজন সারাক্ষণ একটা বৃষ্টিভেজা রাতের অপেক্ষায় থাকি । কবে রাতে বৃষ্টি হবে ! দিনে হলে আমাদের মন খারাপ হয় । আমার স্ত্রীর নাম পপি সাহা । আর আমার নাম সিরাজুল ইসলাম । মেডিকেলে পড়ার সময় নিজে নিজের নাম রেখেছি বর্ণ । পপি আমার প্রথম ক্রাশ ছিল । পপি আর আমি একই গ্রামের । এমন এক গ্রাম যে গ্রামে কেউ ক্লাস সিক্স,সেভেনের বেশি পড়ে না । সর্বোচ্চ এস.এস.সি ।
সেই গ্রামের বেড়া দেয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন ছেড়া স্যান্ডেল পড়ে যাই,পপি তখন জুতা পড়ে দুই বেণী করে বেণীতে সুন্দর ব্যান্ড দিয়ে স্কুলে আসে । হিন্দু মেয়েদের যেমন গায়ের রং হয়,দুধে আলতা বা দুধে হলুদ রং , পপি তার থেকে বেশি । চুলও তেমন , মাথা ভর্তি চুল । সাথে উকুনও ছিল বোধহয় । আমার মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে,বাবা তখন আরেকটা বিয়ে করে উধাও । পপিদের বাড়িতেও আমার মা ধানের সময় কাজ করতো । পপির বাবা খুব বড়লোক না,তবে সাহ পরিবারের সবার মুদির দোকান আছে,ভালো চলে । একদিন কাঠ ফাঁটা রোদে মাকে ডাকতে পপির বাড়ির আঙ্গিনায় বাঁশ ধরে দাঁড়ায় আছি । পপি দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলো । সে একটা কাসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এল ।
– নাও ।
– কি?
– জল ।
– না । খাব না ।
– আরে বোকা ,কেউ আসার আগেই নাও । মা দেখলে বা দিদিরা দেখলে বকা দিবে । মুসলমানের কিছুতে খেতে নেই , ছোঁয়া বারণ । খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি, আমি ভাগি ।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে খেলাম । খেয়ে অবাক হলাম,পানি না । ছিল শরবত । বাহ! মেয়েটার রূপের সাথে মনও আছে । শুধু মাথার ঘিলুটা নেই । পড়াশুনায় যাচ্ছেতাই । ফেল করতে সে পারদর্শী । প্রতিবার ফেল করে,তারপর মাস্টারকে কিছু টাকা দিয়ে আবার উপরের ক্লাসে ওঠে । কিন্তু মেয়েটাকে আমার ভালোলাগে । ক্লাস এইটে যখন পড়ি,তখন দেখি সে কিছুদিন ক্লাসে নেই । মা কাজ করে যেহেতু,সে খবর আনলো বিয়ের কথা চলছে পপির । মনটা খুব খারাপ হল তখন,পপিকে আর দেখা হবে না । দুই,তিন গ্রাম পড়ে বিয়ে পপির । পপির বিয়েও খেয়েছি আমি । স্বষ্ট মনে আছে ।
সেদিনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি । বিয়ে বাড়ি হালকা রঙ্গিন কাগজে সাজানো । পপিরও হালকা সাজ । অল্প দামের একটা লাল শাড়ি,দুই হাতে দুইটা বালা,গলায় একটা মালা আর একটা টিকলী । বাকি মাথায় টোপর,কপালে সাদা সাদা ফোঁটা দিয়ে সাজানো । তাও পপিকে সুন্দর লাগছে । যেতে মন চাচ্ছিল না,তবে একটা দিন ভালো খাওয়ার লোভে পপির বাড়িতে গিয়েছিলাম । বরযাত্রী আসলো,বরটা আমার একটুও পছন্দ হয়নি,বয়স্ক বর । উলু ধ্বনিতে বিয়ে বাড়ি মুখোরিত হল । বিয়ের লগ্ন মধ্যরাতে হওয়ায় সারাটা দিন রাতই সেখানে থাকলাম , মায়ের কাজ চাপ ছিল মাকেও সাহায্য করলাম । পপির বিদায় হল । হাতে শাখা,সিঁদুর মাথায় নিয়ে পপি চলে গেল ।
এবার আমার জীবনের কঠিন সময় এল । এস.এস.সি পরীক্ষায় বেশ ভালো করলাম । মা খুশি হয়ে বললো,এবার কেরানীর চাকরী কর । কেরানীর চাকরী করতে গেলাম,পাশের আরেক উন্নত গ্রামের কলেজে । চেয়ার,টেবিল মোছার চাকরী । যেয়ে কলেজের রহমান স্যারের সাথে খুব মিল হল । স্যারের বাসায়ও বাজার খরচের কাজ করি । স্যার একদিন আমার রেজাল্ট শুনে তো অবাক । সে বললো,তুমি কলেজে কেন ভর্তি হচ্ছো না ,আরেকটু পড়লে আরও ভালো চাকরী পাবে । আরও ভালো চাকরীর লোভে টাকা জমায় ভর্তি হলাম সেই কলেজেই । চেয়ার,টেবিল মুছি আর পড়াশুনা করি । তারপর এইস,এস,সির রেজাল্ট আরও ভালো হল ।
জীববিজ্ঞানে হায়েস্ট মার্ক দেখে জীববিজ্ঞানের স্যার ডেকে বললো তোমার আরও পড়া উচিত । ডাক্তার হতে পারো । লোভে পেয়ে বসলো,যদি ডাক্তার হওয়া যায় । কিন্তু এবার তো আর কুলাতে পারবো না,এবার বহু টাকার দরকার । স্যারদের বললাম,রহমান স্যার আর জীববিজ্ঞানের স্যার মিলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য বই আর ভর্তি ফর্ম তোলার টাকা দিল । খুব পড়লাম,পড়ে পরীক্ষা দিলাম । চাঙ্স ও পেলাম । ততদিনে আমার সাহায্যের জন্য হাত পাতা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে । আবার বিভিন্নজনের কাছে হাত পেতে ভর্তি হলাম । তারপর আবার বই কেনা,এটা ওটা কেনা । এবার গ্রামের লোকজনের কাছে হাত পাতলো আমার মা । গ্রামের লোকজন যারা একটু বড়লোক,তারার সবাই মিলে কিছু টাকা দিল । এদের মধ্যে পপির বাবাও ছিল । প্রকাশ সাহা,বেশ টাকা দিয়েছিল তখন । ভর্তি হওয়ার পর সব অভাব কেটে গেল টিউশনি,কোচিং করিয়ে ।
মাকে এনে আমার সাথে রাখলাম । ডাক্তারী শেষে যখন ইন্টারনি করছি তখন মা আমার জন্য পত্রী খোঁজা শুরু করলো । তখন একআ বিপদ এসে জুটলো । কলেজের সেই সাহায্য করা রহমান স্যার,তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে চায় । তার মেয়ে কেবল কলেজ শেষ করেছে তখন ।মেয়েটাকে আমার পছন্দ না,কিন্তু না ও করতে পারছি না । সে না থাকলে তো এতদূর আসতেও পারতাম না । শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম,যা আছে কপালে । পরে যদি ভালোলাগে মেয়েটাকে এই আশায়,বহু সান্তানা দিয়ে নিজেই নিজেকে রাজি করালাম ।ভাগ্য ভালো মেয়েটার আগে প্রেম ছিল,এলাকার এক পাতি মাস্তানের সাথে । মেয়েটা বিয়ের আগে পালায় গেল । আমার চেয়ে আমার মা বেশি খুশি হল । তার পাত্রী দেখা আবার পুরোদমে শুরু হলো । আর আমি টাকার চিন্তা করি ।
একদিন তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালের লিফট দিয়ে উঠতে যাব এমন সময় একটা পরিচিত মুখ দেখলাম । বহু বছর পর,পপির বাবা । দেখে কাছে গেলাম,যেয়ে জিঙ্গেস করলাম
– কাকা? আপনি এখানে?
– হুম বাবা । ( কেঁদে অস্থির )। আমার সব শেষ হয়ে গেছে নিঃস্ব আমি ।
– কি হয়েছে? কোন ওয়ার্ডে ,কোন ব্লকে,কোন বেডে?
কাকা হাউমাউ করে কিছু বললো, আমি শুনলাম । তবে তাড়া থাকায় অন্যদিকে গেলাম । কাকাকে কথা দিলাম পরে যাব । পরে খুঁজে খুঁজে বের করলাম । বেডের কাছে যেয়ে তো আমি অবাক । এটা কিভাবে সম্ভব । অর্ধ পোড়া এক রোগী । কিছুই বোঝা যাচ্ছে না তার শরীরের,প্রায় অংশই ঝলসে গিয়েছে । পাশে দেখলাম পপির বাবা । জিঙ্গেস করলাম
– কে?
– পপি,বাবা । পপি ।
– কিভাবে?
– জানি না বাবা ।
ওরা বলে রান্না করতে যেয়ে আগুন লেগেছে গায়ে । এ কেমন কথা,মেয়েটা আগুন লাগার পর এতো চিল্লাইলো,ওর শ্বশুড় বাড়িরে কেউ শুনলো না! সব ষড়যন্ত্র । ওর স্বামীর একটা পরকীয়া ছিল,আমার মেয়েটা কথা বলছিল বলেই ওরা এমন করছে । আমি পপির জ্ঞানহারা মায়ের মত আমিও হতবাগ হয়ে গেলাম । বহু চিকিৎসা হলো । প্রায় তিন মাসের মত পপি মেডিকেলে ছিল । সাথে ছিলাম আমি । কি যে যন্ত্রণায় থেকে থেকে পপি চিৎকার দিয়ে উঠতো । এর মাঝেও খবর এল পপির স্বামী আর পপিকে নিবে না ।
মুখ পোড়া বউ সংসারে এনে সংসারের অমঙ্গল করবে না । সেসব পড়ের কথা,পপি যে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুড়বে সারাজীবন সেটা কে বয়ে বেড়াবে ! আমি বয়ে বেড়াচ্ছি । মন ধর্ম মানেনি । আজও প্রায় রাতে তার চিৎকার আমাকে পাগল করে । তবে বৃষ্টিতে ভিজলে ওর ভালো লাগে । গায়ের পোড়া চামড়াগুলো নতুন একটু আরাম পায় আবার নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার আশায় । তাই আমাদের ছাদে একটা অংশ চাদরে ঘেরা আর আমরা অপেক্ষায় থাকি একটা বৃষ্টিভেজা রাতের ।