প্রথম প্রেম

প্রথম প্রেম

আমার মেজমামা ভীষণ রাশভারী লোক। আর্মিতে চাকরি করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। কার্গিল যুদ্ধে রীতিমত বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলেন। কাঁধে একটি গুলিও খেয়েছেন। এখনো গভীর ক্ষত হয়ে আছে। মেজমামার ছেলে ঋজুদা বাবার মত আর্মি হয় নি। AIIMS থেকে ডাক্তারি পাস করে এখন দিল্লীর বাসিন্দা। মামা ও মামিমা এখন ছেলের কাছেই থাকেন। বড় মামার ছোট ছেলে অর্ণব দাদাভাই এর বিয়েতে আমরা সকল আত্মীয়-স্বজন, ভাই বোনেরা কোলকাতায় মিলিত হয়েছি। আমার তিন মামা আর দুই মাসি আর তাদের সব মিলিয়ে দশ জন ভাই বোন। আমার মা সব থেকে ছোট এবং আমি সব ভাইবোনদের থেকে সবচেয়ে ছোট। সেই কারণে সকলের ভীষণ প্রিয়। সামনে বছর আমি HS দেব। আমরা থাকি কৃষ্ণনগরে। অর্নবদার বিয়ের তিনদিন আগে থেকেই আমি আর মা কলকাতায় হাজির। সব নিকট আত্মীয়-স্বজন প্রায় উপস্থিত। কলকাতার বুকে বড়মামার বিশাল বাংলো সাইজের বাড়ি। কলকাতার এক নামি কন্ট্রাক্টর তিনি। আমরা সবাই হৈ হৈ করে কাটাচ্ছি। মজা, ফুর্তি, আনন্দ আর ধরে না। বৌভাতের রাতে যখন খাওয়া প্রায় শেষ। তখন আমরা সকলে মিলে বসেছি বৌদির সাথে জমিয়ে আড্ডা মারতে। সকল ভাইবোন তো আছেই আর আছে মেজমামা। আমরা সবাই মিলে মেজমামাকে ধরলাম একটা ভাল গল্প বলার জন্য। কোনো রোমাঞ্চকর যুদ্ধের গল্প! মামা বললেন, “চল, আজ তোদের অন্য একটা গল্প বলি। যে গল্প কোনোদিন কাউকে বলে ওঠা হয়নি। বহুদিন আগেকার এক সত্যি গল্প।”

আমি বললাম, ” ইন্টারেস্টিং, শোনা যাক”।
ঋতুদি বলল, ” কোনো ভয়ঙ্কর ভুতের গল্প নয়তো? তাহলে আমি নেই।”
মামা বলেনন, “আরে না না। এ গল্প আমার প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প।”
এটা শোনার পর ঘরের মধ্যে কিছুক্ষনের জন্য একটা pin drop সাইলেন্ট হল। আমরা পরস্পরের দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে তারপর সমস্বরে বলে উঠলাম , “শুনবো শুনবো।”

আসলে মেজমামার মত এরকম একটি লোক আমাদের সবাইকে প্রেমের গল্প শোনাবে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। মাঝখান থেকে বেচেরা ঋজুদা উঠে গেল। হাজার হলেও বাবার প্রেমের গল্প। লজ্জা পেয়েছে। সিউলিদি বলে উঠল, “এই রিজু কোথায় যাচ্ছিস? আহা শুনেই যা না। ছেলেটার এতো লজ্জা, ভাবা যায় না।” মামা বললেন, “যেতে দে, আমিও একটু ফ্রী ভাবে বলতে পারবো।” এবার মামা শুরু করলেন তার প্রথম প্রেমের গল্প।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন বিকেল বেলা বাড়ির পিছনের বারান্দায় ফেলুদার একটা বই নিয়ে বসেছি। দু দিন আগে half-yearly এক্সাম শেষ হয়েছে। আমাদের সময় বছরে দুটি করে পরীক্ষা হত। তোদের মত মাসে মাসে পরীক্ষার রেওয়াজ তখন ছিল না। গল্পে ভীষণ মজে ছিলাম। হঠাৎ এক অচেনা মেয়ের গলা পেয়ে মগ্নতা ভাঙলো। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম একটি আমার বয়েসী মেয়ে একটি ছেলেকে ডাকছে আর বলছে

—-ভাই ওদিকে যাস না, কুকুর আছে কামড়ে দেবে।
মেয়েটিকে এবং তার ভাইটিকে এ পাড়াতে আগে কোনোদিন দেখিনি। ভাবলাম কারো বাড়ি হয়তো বেড়াতে এসেছে। নীল রঙের একটি ফ্রক পড়ে ছিল। ফর্সা, গোলগাল, একটু পাতলা গড়ন, চোখ দুটো টানা টানা, মুখে অদ্ভুত একটা মায়াবী হাসি। আমি চোখ তুলে তাকাতে সে একটু হাসলো। আমিও অবুঝের মত একটা ক্যাবলা মার্কা হাসি দিলাম। ভাই আর দিদি চলে গেল। বইয়ের পাতা বন্ধ করে দেখলাম ওরা আমাদের বাড়ির যে ডানদিকের গলিটা চলে গেছে তার দুটো বাড়ি পর ঢুকে গেল। মানে সঞ্জয়কাকুদের বাড়ি।

এই পাড়াতে একমাত্র সঞ্জয়কাকুরা বাড়ি ভাড়া দেয়। তাহলে কি নতুন ভাড়াটিয়া এলো? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম। দুই তিনদিন পরে ছোড়দির কাছে জানতে পারলাম মেয়েটির ভাল নাম সঞ্চারি রায়, ডাকনাম বিহু। আমার মতই ক্লাস এইটে পড়ে। বাবা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। কোন ইনফরমেশন জানতে হলে আমি সরাসরি প্রশ্ন করতাম না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঠিক জেনে নিতাম। ছোড়দি ছিল আমার গুগল। ওর কাছ থেকে সারা রাজ্যের খবর পেতাম। ছোড়দির কাছ থেকে মেয়েটির বিষয়ে সব কিছু জানতে আমার মাত্র দুই দিন সময় লেগেছিল। আমাদের পাড়াতে আমার বয়েসি কোন মেয়ে ছিল না। বেশিরভাগ আমার থেকে 2 বা 3 বছরের ছোট ছোট পুঁচকে কিংবা ইঁচড়ে পাকা দুই এক বছরের বড় কয়েকটি দিদি। ওদের কথা বার্তায় এমন হাব ভাব যেন আমি ওদের কাছে দুধের শিশু। একটাকেও আমার পছন্দ হত না। রিনাদিকে একটু একটু ভাল লাগতো। কিন্তু যখনই শুনলাম এবার ক্লাস নাইনে ফেল করেছে ওমনি ভাললাগা সব উধাও হয়ে গেল। পড়াশোনাতে কাঁচা মেয়েদের আমার একদম নাপসন্দ ছিল।

তাও মেনে নেওয়া যেত যদি টেনেটুনে পাস করত। পাড়াতে আমার সমবয়সী ছেলে বন্ধু অনেকে ছিল। তার মধ্যে সমীরণ ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বিকেল হলেই আমরা পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা কালী মন্দিরের সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা পড়ে ছিল সেখানে খেলাধুলা করতাম। কত সব খেলা খেলতাম তখন!বুড়ি ছোঁয়া, পঞ্চাশ চোর, পাতা আনাআনি, পিট্টু, কুমির ডাঙ্গা, London। তোরা তো আর সেসব বুঝবি না। কারণ তোদের এখন খেলাধুলা সবই মোবাইলে হয়। ফেসবুক হোয়াটসআপ ই তোদের জীবনের অঙ্গ। যাইহোক আমরা শুধু ছেলেরা খেলেলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। আর সবাই একসাথে হলে ওই সব খেলতাম। দুএকদিনের মধ্যে বিহু আমাদের সাথে খেলতে এল। প্রথমদিন কালীমন্দির প্রাঙ্গন এসে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের খেলা দেখছিল। আমি খেলার সময় আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকে দেখছিলাম। দ্বিতীয় দিন পিন্টুর বোন সিমটি বিহুকে বলল , দিদি তুমি খেলবে? বিহু এক কথাই রাজি হয়ে গেল। ওইদিন আমরা কুমির ডাঙ্গা খেলছিলাম। মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল খেলাধুলোতে একদম কাঁচা কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম ও কিন্তু ভীষণই চৌখস।
কয়েকদিনের মধ্যে আমার এক অদ্ভুত ভালোলাগা জন্মে গেল তার প্রতি। সে যদি কোনোদিন খেলতে না আসতো আমিও কিচ্ছুক্ষন পর খেলা ছেড়ে বাড়ি চলে যেতাম। দেরি করে এলে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকতাম। তার নাম ধরে কোনদিন ডাকতে পারিনি। নাম বলতে গেলেই কেমন যেন একটা সংকোচ হত। কিন্তু সে অবলীলায় আমাকে ডেকে যেত। খেলাধুলায় একটু চিটিং বাজি করলেই সে ধরে ফেলত।

‘এরকম করলে কিন্তু আমি খেলব না, আমি চললাম’ বিহু একবার বললেই হত ওমনি আমি বলতাম ‘ঠিক আছে আর করব না’। ‘তুমি যেও না please’ এইটা মনের মধ্যেই রাখতাম। ও কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পেরেছিল যে আমি তাকে পছন্দ করছি। আমার সাহচর্য সেও পছন্দ করত। কোনদিন আমাকে রাগানোর জন্য খেলতে খেলতে কিছুক্ষণ পরে বাড়ি চলে যেত। ওমনি আমিও একটু পরে পালতাম। কিন্তু আমি কোনদিন খেলা ছেড়ে, তাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। ধীরে ধীরে অনেক ইশারা চলতে লাগল আমাদের মধ্যে। কোনদিন যদি বিহু মাথার চুল বেঁধে খেলতে আসতো আর আমার পছন্দ নাহলে ইশারায় ঠোঁট বাঁকাতাম। তেমনি খেলতে খেলতে কখন যে অজান্তে ও চুল খুলে ফেলত বুঝতেই পারতাম না। ও কোনদিন ইশারা করে জামা দেখিয়ে মাথা নারলে সেই জামা পরে আমি দ্বিতীয়বার ওর সামনে যেতাম না। কোনদিন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে টিউশন পড়তে যাওয়ার সময় যদি সুন্দর গোলাপি রঙের ফ্রক পড়ত আমি আঙুলের ইশারায় বলতাম “আজ তোমায় দারুন দেখাচ্ছে! আর মনে মনে বলতাম বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি খেলতে এসো কিন্ত”। এই ইশারার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল। এই ভাষা শুধু ও আর আমি বুঝতাম।

ক্রমাগত আমি বিহুর জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছিলাম। আমার চিন্তায়, স্বপ্নে, জাগরণে, আমার সারা শরীর জুড়ে তখন শুধুই বিহু। একটা বেলা তাকে দেখতে না পেলে মনে হত এই বুঝি আমার ভেতরের শিরা উপশিরায় রক্ত থেমে যাবে। সে ছিল আমার প্রাণবায়ুর মত। তার জামার প্রত্যেকটা রং, ঘন কালো চুল, হাঁটাচলা, প্রাণখোলা হাসি সবকিছুর সাথে আমার অন্তরের পরিচয় ছিল। কোনদিন বারান্দায় বসে আছি, হটাৎ করে মৃদু নুপুরের শব্দ। ধীর থেকে ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট শুনতে পেতাম। বুঝে যেতাম এ তার হেঁটে চলার শব্দ। এ শব্দের মধ্যে এমন মাদকতা ছিল যে আমি অন্তহীন নিরলস শুনে যেতে পারতাম। কোনদিন যদি সামনে থেকে আসার সময় আমার দিকে চোখ না মেলাতো, সেদিন সে রাত্রি যে আমার কিভাবে কাটত তা আমিই জানতাম! ঈশ্বরকে মনে মনে বলতাম, আমার অন্যায় কোথায়? কেন ও আমার দিকে চাইল না আজ? তার পরদিন ওর স্কুল টাইমের অনেক আগে থেকেই পথ চেয়ে বসে থাকতাম। অধীর ভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে হটাৎ পায়ের শব্দ পেলেই আমার হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যেত। ওর চলাফেরার শব্দও আমার কাছে অতি পরিচিত ছিল। সামনে বা পিছন থেকে হেঁটে এলে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতাম। গুনগুন করে গান গেয়ে উঠতাম তখন। যেন তাকে বোঝাতাম, বিহু আমি তোমার পথ চেয়ে তোমায় দেখব বলে সেই সকাল থেকে বসে আছি। একবার চেয়ে দেখ। সে তাকাতো, আর মিষ্টি একটা হাসি দিত। সাদা অপার আর হলুদ লোয়ার পড়া ড্রেসে তাকে দারুন লাগত! আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতাম। একটা চাপা অভিমানে তাকে যেন বলতে চাইতাম , কাল কেন আমার দিকে না চেয়ে চলে গেছ? জান, আমি সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছি। যদি আমি কোনদিন তোমার পথ চেয়ে বসে না থাকি? তুমি স্কুলে যেতে গিয়ে দেখ আমি নেই। কেমন লাগবে তোমার? জানিনা আমার এ ভাবনা, এ অভিমান, অভিযোগ তার কাছে পৌছাতো কিনা?

আমার প্রায়ই তার উপর অভিমান হত। ভাবতাম আজ আর তোমার জন্য দাঁড়াবো না। কিন্তু সময় হলেই নিজের অজান্তেই কিভাবে যে আমি ঐ বারান্দায় এসে যেতাম তার কারণ আমি নিজেও জানতাম না। শুধু আমার মন নয় আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিহুর অধীন ছিল। বিহুর ব্যাপারে সবকিছুই আমার অনিয়ন্ত্রিত, লাগামছাড়া।

এবার মামা একটু থামলেন। ঘরে তখন এক আশ্চর্য নীরবতা। দেখলাম সেই রাশভারী লোকটিও কেমন ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। আমি বলে উঠলাম,

“মামা তারপর কি হল? তুমি ওকে বলেছিলে তোমার মনের কথা?”
মামা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তারপর আবার শুরু করলেন
তার সাথে একবার আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। পাশের বাড়ির এক বন্ধুর জন্মদিনে আমরা দুজনেই নিমন্ত্রিত ছিলাম। কেক কাটার পর কেক খেতে খেতে আমি তার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছিলাম। অনেক্ষন ধরে সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে যখন পেয়ে গেলাম তখন কি প্রশ্ন করব সেটা আর ভেবে পেলাম না। হটাৎ করে বলে ফেললাম “তোমার অঙ্ক কোন চ্যাপ্টার চলছে?” আমার দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল “পাটিগণিত, জ্যামিতি, শেষ আর বীজগণিত দুটো অনুশীলনী আছে।” তারপর আবার দুজনে চুপ। আবার একটু পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?” ও হেসে বলল, “রামকৃষ্ণপুর”। আমি আর কিছু প্রশ্ন করলাম না। ভাবলাম আমি কি শুধুই প্রশ্ন করবো নাকি? ও তো কিছুই জানতে চাইছে না।

আমি কি এতোই হ্যাংলা নাকি? ভীষণ রাগী রাগী মুখ করে বসে থাকলাম। তারপর হটাৎ দেখি সে বলে উঠল, ” জানতো আমি একদম ঝাল খেতে পারি না, সেরকম ঝাল হলে আমি তো কিছু খেতেই পারবো না”। আমি বললাম, “তাই? আগে বলবে তো”। আমার হাব ভাব এমন যেন আমিই রাঁধুনি। রান্নাঘরে কাকিমাকে বলতে গেলাম , “কাকিমা আমি কিন্তু বেশি ঝাল খেতে পারি না”, বহু চেষ্টা করেও বিহুর কথা বলতে না পেরে নিজের নামে চালিয়ে দিলাম। কাকিমা বললেন, ওমা সেকি, আগের বছর যখন সবাই খেতে গিয়ে হু হা করে হাঁপাচ্ছিল তখন তো তুই বেশ চেয়ে চেয়ে খাচ্ছিলিস। আমি বললাম, কাকিমা আমার জিভে একটা ঘা হয়েছে তাই ঝাল খেতে পারছি না। ভাগ্য ভাল যে খাবার সময় আমরা পাশাপাশি খেতে বসেছিলাম। তারপর আমি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিহুর সাথে আমার মাংসের বাটি বদলে ফেলি। ইশারা করে জানতে চাইল এই বদলাবদলী কেন? আমি মুখে অল্প হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়লাম। মাংসের ঝোল একটু মুখে দিতেই সে বুঝে গেল। তার চোখে মুখে এক কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। তখন মনে হচ্ছিল আমি এই পৃথিবীতে সব থেকে বড় সৎ কাজটি সমাধা করেছি।

মামা কিছুটা থামল। আমি বলে উঠলাম
—–তোমার সাথে আর কোনোদিন তার কথা হয় নি।
—– না, ওটাই প্রথম আর ওটাই শেষ।

বাকি অংশটা শোনার জন্য আমরা সকলে উৎসুক হয়ে চেয়ে ছিলাম মামার দিকে। মামা আবার শুরু করল —-
সামনেই পুজো ছিল। পুজোর ছুটি পড়ার আগেই আমার ভীষণ মন খারাপ। কারণ লম্বা ছুটিতে ওর বাবা মা নিশ্চয় এখানে থাকবে না। গ্রামের বাড়ি যাবে। আমার ভাবনা একদম ঠিক হল। ছুটি পড়ার একদিন আগেই ওরা চলে গেল। আমি সেদিন তাকে ভাল করে দেখবার জন্য সকাল থেকেই বারান্দায় বসে আছি। কিন্তু তার দেখা নেই। পরে জানতে পারলাম কাল বিকেলেই তারা চলে গেছে। প্রতি বছর পুজোতে হৈ হৈ করে কেটে যায় কিন্তু এবারের পুজো যেন কাটতেই চায় না। অনবরত চেয়ে থাকি ওদের ছাদের দিকে। ওর সমস্ত ফ্রক আর গুটিকতক চুড়িদারের সমস্ত রং আমার চেনা ছিল। রাস্তায় ওই রঙের পোশাক পরা কোন মেয়ে দেখলে একমুহূর্ত চমকে যেতাম। পরক্ষনেই সেই চমকের অবসান হত। সেজেগুজে যখন মণ্ডপে যেতাম যখন শুধু মনে হত সেও হয়ত আমার মত নতুন জামা পড়ে আমার কথায় ভাবছে। রাতে একদিন বিহুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম।”
আমরা সমস্বরে জানতে চাইলাম

—-কি স্বপ্ন?

মামা একটু ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে চেয়ে নিলেন তারপর বললেন
“দেখলাম বিহু আর আমি কালিমন্দিরের বারান্দায় বসে আছি। আশেপাশে কেউ নেই। ও আমায় জিজ্ঞাসা করছে “তুমি কখন ঘুম থেকে ওঠো?”
আমি বললাম,

—7 টাই, আর তুমি?
—আমি আরো সকালে উঠি। এই ধরো 6 টাই। তোমরা কোথাও বেড়াতে যাও না?
—- হ্যাঁ যাই তো। এই তো গরমের ছুটিতে দার্জিলিং গেছিলাম। আমার পাহাড় দেখতে খুব ভাল লাগে। আর তোমার?
—সমুদ্র আমার খুব পছন্দের। জানতো একবার পুরী গিয়ে সমুদ্রে একঘন্টা ধরে স্নান করেছিলাম।
— আমারো ভাল লাগে। তুমি সাঁতার জানো?
—হ্যাঁ, গ্রামে আমাদের একটা বড় পুকুর আছে। বাড়ি গেলেই খুব মজা করে স্নান করি। আধ ঘণ্টা ধরে স্নান চলে।
—-তোমার মা বকে না?
—–বকে তো। আমি ছোট থেকেই ভীষণ দুস্টু। তুমি দুস্টুমি করো না?
—-আমার বাবা হিটলার টাইপের লোক। দুএকবার যা প্যাঁদানি খেয়েছি তারপর থেকে দুস্টুমি বন্ধ হয়ে গেছে। আচ্ছা তোমার ছেলে বন্ধু আছে?
—-হ্যাঁ, গ্রামে বিলু, সুমন, বাবুয়া আরো অনেকে আছে।
ছেলে বন্ধু অনেক আছে শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তারপর আবার প্রশ্ন করলাম
—তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?
—-বিলু।

মনটা আরো খারাপ হল। এবার কিছুক্ষন চুপ থেকে ভাবলাম একটা প্রশ্ন করি যে সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে নাকি? কিন্তু এই প্রশ্ন করার আগেই তার চশমা পড়া ভাইটা কোথা থেকে হাজির হয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকালো তারপর বলল,

—-দিদি মা ডাকছে।
আমার তৎক্ষণাৎ মনে হল ওর ভাইয়ের চশমাটা খুলে একটা গামছা দিয়ে চোখটা বেঁধে মাথাতে আচ্ছা করে চাঁটি মারি। যাইহোক তা আর হল না। আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে রাগে সারা শরীর গজগজ করতে লাগল। মনে হল সত্যি সত্যি এসব কিছু এখুনি ঘটল। শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল ওকে আমি প্রশ্নটা করতে পারলাম না।
সেদিন ছাদে উঠে পেয়ারা পাড়ছিলাম। হটাৎ করেই মনে হল বিহু কথা বলছে কারো সাথে। প্রথমটা ভাবলাম ভুল হচ্ছে হয়ত। কিন্তু দুএকবার শোনার পর নিশ্চিত হলাম ওটা বিহুর গলা। আমি ছাদ থেকে গলা বারিয়ে দেখতে পারতাম তাকে। কিন্তু রাগে অভিমানে তার দিকে চায়নি। মনের মধ্যে যতটা আনন্দ হয়েছিল তারথেকে অভিমান বেশি ছিল। আমি পন করেছিলাম ওর দিকে কমকরে দু-তিন দিন তাকাবো না। আমি এখানে তার অপেক্ষায় দিন রাত কষ্ট পেলাম আর সে এতদিন পর এল। জানতাম তার বাবা মা না চাইলে তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়, তবুও এক অর্থহীন অভিমান জমে ছিল মনে। তারপর কয়েকদিন পর আবার সেই ইশারা, দাঁড়িয়ে থাকা, আর বিকেলে খেলাধুলা।

বড়দিনের ছুটিতে দিন তিনেকের জন্য মামারবাড়ি কলকাতা বেড়াতে এলাম। এখানে আমার কয়েকজন ইঁচড়ে পাকা বন্ধু ছিল। ব্যাপারটা তাদেরকে বলতেই তারা ভীষণ হাসাহাসি শুরু করল। তাদের কিছু কিছু মন্তব্য আমার আজো মনে আছে।

—-সেকি রে, এতো ভাল লাগে আর সেভাবে এখনো কথা বলার সুযোগ বের করতে পারলি না?
—-শোন, একটা চিঠি লিখে ওর হাতে দিয়ে দে। কি লিখতে হবে আমার বলে দিচ্ছি।
—-একটা বই চেয়ে নে পড়ার জন্য। তারপর ফেরত দেওয়ার সময় কিছু একটা লিখে দে।
—-আরে, ভাইটাকে আগে হাত কর। চকোলেট দিয়ে ওর মাধ্যমেই ব্যবস্থা কর।

ওদের কারো পরামর্শ আমার সেভাবে মনে ধরল না। মনে মনে ভাবলাম বেশ তো চলছে আমাদের মনে মনে ইশারায় ইশারায় কথা। এইতো বেশ ভাল আছি আমি। কি দরকার এর থেকে বেশি কিছু পেয়ে। এসব কিছু করতে গিয়ে যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে তো বাবা আমাকে আদা ছিলা করে ছিলে দেবে। তাছাড়া বিহু যদি এসব পছন্দ না করে। তাহলে আমার কি হবে? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এবার বাড়ি গিয়ে আমার স্বপ্নের সেই না বলতে পারা কথাটা তাকে বলব।

“তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে?”
তারপর কিছুক্ষন মামা চুপ করে রইলেন। ঘড়িতে তখন রাত 12 টা। মামা বললেন
—বাকিটা কাল শোনাবো।
এই সোনার পর আমরা সমস্ত ভাইবোন কোরাসের সুরে বলে উঠলাম
“না না , আজকেই শুনব।”
মামা এবার একটু দম নিয়ে শুরু করলেন।

— 29 সে ডিসেম্বর মামার থেকে বাড়ি এলাম। তারিখটা আমার এখনো মনে আছে। বাড়ি ফিরেই বিহুর ছাদের দিকে তাকালাম। দেখলাম ছাদে ওর কোনো জামা মেলা নেই। ভাবলাম ছুটিতে বাড়ি গেছে। কিন্তু আমি মামারবাড়ি যাবার সময় কিন্তু ওরা ছিল। তাহলে পরে গেছে হয়তো। মনটা একটু খারাপই হল। দুএকদিন পর স্কুল খুললো। কিন্তু বিহু এলো না। ভাবলাম গ্রামের বাড়িতে কেউ মারা গেছে, নয়তো কোথাও ঘুরতে গেছে। ভুল ভাঙলো তখন সেদিন, যেদিন কথাপ্রসঙ্গে ছোড়দি বলল বিহুর বাবা বদলি হয়ে চলে গেছে। মৌ কাকিমাদের বাড়িটা ফাঁকা হয়েছে। সেটা শোনার পর সেই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা তোদেরকে বোঝানোর মত ভাষা আমার নেই। শুধু কিছুক্ষনের জন্য পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেছিলাম। চোখের সামনে যেন একটা অন্ধকার গ্রাস করল।

নিজের রাগ আর জমানো দুঃখ যে কার সাথে ভাগ করবো তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কোনো অন্ধকার কুঠুরিতে বসে দিন রাত কেঁদে মরি। ঈশ্বরের প্রতি আমার সমস্ত বিশ্বাস উড়ে গেছিল। কি পাপের শাস্তি যে তিনি দিলেন তা বোঝার শক্তি আমার ছিল না। তার সম্পর্কে তো কিছু খারাপ ভাবিনি। তার হাত দুটোকে নিজের হাতে রাখবো—এ ভাবনাও কোনোদিন মনে আনিনি। শুধু সকাল বিকেল দুবেলা তাকে দুচোখ মেলে দেখতে চেয়েছিলাম। এই চাওয়া কি অনেক বেশি কিছু ছিল?

আমি আর ওদের বাড়ির দিকে তাকাই না। বারান্দার আসি কম। তবুও মাঝে মাঝে ভুল করে চোখ চলে যায় ছাদের উপর। যদি আবার সে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে বারান্দায় আসি যদি কোনো নুপুরের শব্দ পাই। বিকেল বেলা হলে আর কালীমন্দির প্রাঙ্গনে খেলতে যায় না। যারা খেলে তাদের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে তাকে খুঁজে পাই। আমি ইশারা করছি আর সে বাঁধা চুল খুলে দিচ্ছে। ছুটে চলেছে এদিক ওদিক। কোনোদিন সে বুড়ি হলে আমি তাকে ছুঁতে গিয়ে থমকে যাচ্ছি। হাতে হাত রেখে তালি মারতে গিয়ে শিউড়ে উঠছে আমার শরীর। এভাবে কতদিন তার কথা ভেবেছিলাম জানি না। তবে তার স্মৃতি এখনো বয়ে নিয়ে বেড়াই। সব ব্যথা আনন্দ যন্ত্রনা আজো আমার কাছে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। মস্তিষ্কের কোনো এক গোপন কোনে সে আজো রয়ে গেছে অবিকল সেই পুরোনো বাল্যকালের মত।

ব্যাস এইটুকুই আমার প্রথম প্রেমের গল্প। মামা এই বলে থামলেন।
আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। আমি sure ছিলাম যে সকল ভাইবোনরা তখন নিজের নিজের প্রথম প্রেম নিয়ে ভাবছিল। গল্প শেষ হলে মামাকে অনেক question করেছিলাম কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেন নি। শুধু এইটুকু বলেছিলেন তার সাথে মামার আর কোনদিনও দেখা হয়নি। আমি মামার পুরো কথাটা মোবাইলে রেকর্ড করেছিলাম মামার অজান্তে মামার ছেলেকে শোনাবো বলে। বাবার প্রেম কাহিনী সে লজ্জায় শুনতে পারিনি। কিন্তু ইন্টারেস্ট ছিল। যাইহোক আমরা সকলে সেদিনকার মত উঠে গেলাম।

রাতে আমি শুতে গিয়ে মামার প্রেমের বিষয়ে ভাবছিলাম আর আমার প্রথম প্রেমের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমার প্রথম ভালোলাগা বৃষ্টিদি, আমার থেকে বছর দুএকের বড়। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় কলেজ যেতে দেখেছিলাম। সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, পরিপাটি সেজে, মাথায় খোঁপা করে বৃষ্টিদি কলেজের সোসালে যাচ্ছিল। সে দৃশ্য সযত্নে বন্দি করে রাখা আছে আমার মস্তিষ্কের চিলেকোঠায়। যখন মন খারাপ করে তখন বার বার দেখি। বার বার সে স্বপ্নে আসে। আমি হয়তো তার স্বপ্নে কোনোদিন আসি না।

সত্যি প্রতিটি মানুষের জীবনেই এই রকম প্রথম প্রেমের স্মৃতি থাকে। যার বেশিরভাগই অসফল। এ প্রেমে এক ছেলেমানুষি আছে, আছে পাগলামো, আছে নিষ্পাপ চাহনি, স্বর্গীয় অনুভূতি। জীবনে কত প্রেম তারপরে আসে কিন্তু প্রথম ভালোলাগা বা প্রেম যাই বলিনা কেন তার স্মৃতি চিরন্তন রয়ে যায় মনের গভীরে।

~ সমাপ্ত ~

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত