তুমিহীন শুন্যতা

তুমিহীন শুন্যতা

শেষ বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি। বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছেন ওয়াজেদ চৌধুরী। ঠান্ডা বাতাস সাথে হালকা বৃষ্টির ঝাপটা পরিবেশটাকে কেমন যেন মাতিয়ে তুলেছে। অরিত্রি বেঁচে থাকলে আজ হয়তো এক কাপ কফির আবদার করেই বসতেন কিন্তু এখন আবদার করতে কেমন যেনো সংকোচ হয়। এতোকিছুর পরেও যে বেঁচে আছেন এইতো অনেক। তখনি দিঘি পেছন থেকে ওয়াজেদ চৌধুরীকে এক কাপ কফি বারিয়ে দিয়ে বলল, ভাইয়া, কফি টা নিন।

এই সময়ে কফির ধোঁয়া যেন মুক্ত প্রকৃতিতে নিজেকে ভাসিয়ে ফেলার মতো। ওয়াজেদ সাহেব কফি টা নিয়ে দিঘির দিকে তাকালেন। দিঘি উনার দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়াজেদ চৌধুরী ভাবছে, এই মেয়েটা কেমন করে যেন বুঝে যায় তার ইচ্ছে গুলো। অরিত্রি বেঁচে থাকলে হয়তো এই মেয়েটাকে নিজের বোনের মত আগলে রাখতো। ওয়াজেদ সাহেব কফিতে এক চুমুক দিয়ে সামনে তাকিয়ে দিঘিকে বললেন, তুমিও এক কাপ কফি নিয়ে এখানে বসতে পারো। দিঘি হাসিমুখে রাতুলকে ডেকে দুকাপ কফি নিয়ে ওয়াজেদ চৌধরীর পাশে বসে পরল। এরপর আবারও নিরবতা সামনের আলোচিত বৃষ্টিকে ঘিরে।

পরন্তু বিকেলে ক্যাম্পাসে হাঁটছি। গন্তব্য সামনের মোড়ে চা খাবো। তখনি পেছনে থেকে কে যেন ডাকছে। মামুন ভাই, মামুন ভাই বলে অনেক দুর থেকে ডাকছে রিধি। আমি হাঁটা থামিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে পরলাম। কাছে এসে ও বড় শ্বাস নিতে নিতে বলল, খবর শুনেছেন কিছু? প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি বললাম, কি খবর? ও কাঁদতে কাঁদতে বলল, অরিত্রি ম্যাডাম নাকি সুইসাইড করেছে। এটা শুনে আমার মাথা যেন কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিল। মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মানে, কি বলছো তুমি এসব? রিধি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, রাতুল ভাই বাসায় নেই। উনি মনে হয় এখনো জানে না।

উনাকে একটু খুজতে হতো। আমি আর কিছু না বলে ওকে নিয়ে রাতুলকে খুঁজছি। ক্যাম্পাসের পুকুরের শান বাধানো ঘাটের ওখানেই পেয়ে গেলাম ওকে দিঘিকেসহ। ওকে বলতেই ও দৌড়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। ওর পেছনে আমরাও আসছি। বাড়িতে আসতেই ওয়াজেদ স্যারকে দেখলাম সোফায় চুপ করে বসে আছে। পুলিশও এসে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাতুল দৌড়ে এসে ওয়াজেদ স্যারের পায়ে পরে বলল, ভাইয়া , কিভাবে কি হল? ভাবী কেন এটা করলো ভাইয়া? বলো, উত্তর দাও তুমি? এসব বলেই সে চিৎকার করে কাঁদছে। ওয়াজেদ স্যার তখনও জিবন্ত এক মূর্তির ন্যায় চুপ হয়ে আছে।

রাতুল এবং আমি একই ভার্সিটিতে একই বিভাগে পড়ি। আমরা যখন দ্বিতীয় বর্ষে তখন প্রথম বর্ষ থেকে পরিচিত হই দিঘি আর রিধির সাথে। দিঘি আর রাতুল আগে থেকেই একে অপরকে জানতো। হয়তো আগে থেকেই একজন আরেকজনকে ভালওবাসতো। আগের ব্যাপার জানি না তবে ভার্সিটিতে রাতুলের বন্ধু হওয়ার সুবাদেই দিঘি আর রিধি আমাকে জানতো। রাতুল আর আমি সবসময় একসাথে থাকতাম। তেমনি রিধি আর দিঘিও একসাথেই কাটাতো সময়। দিঘি আর রাতুল যখন দেখা করতো তখন তাদেরকে আলাদা সময় কাটাতে দেওয়ার জন্য আমি আর রিধি অন্য জায়গায় যেতাম।

এর জন্য রিধির সাথেও আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ডঃ অনিরুদ্ধ ওয়াজেদ চৌধুরী আমাদের ভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। আমরা তাকে ওয়াজেদ স্যার বলেই ডাকি। আবার উনি আমার বন্ধু রাতুল চৌধুরীর বড় ভাই। চৌধুরী বংশ আরকি। অন্যদিকে ইংলিশ বিভাগের অরিত্রি ম্যাডাম হলেন রাতুলের ভাবী মানে ওয়াজেদ স্যারের স্ত্রী। আমাদের ক্যাম্পাসে অনেক মার্জিত আর সবার ভালবাসার কাপল ছিলেন ওয়াজেদ চৌধরী আর অরিত্রি চৌধুরী। একসাথে ক্যাম্পাসে আসতেন, একসাথেই খাবার খেতেন আবার একসাথেই বাড়িতে যেতেন। তারা যেমনি শিক্ষার্থীদের সাথে ফ্রি ছিলেন তেমনি অনেক জ্ঞানেরও অধিকারী ছিলেন।

রাতুলের বন্ধু হওয়ার সুবাদে ওদের বাসায় আমার প্রায়ই যাওয়া আসা হতো। আর তাই ওয়াজেদ স্যার আর অরিত্রি ম্যাডামের সাথেও অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল। তারা যে অনেক ভাল মনের মানুষ সেটা তাদের ব্যবহারেই বোঝা যেতো। ওয়াজেদ স্যার অনেক করে বলেছিল যেন আমি তাকে ভাইয়া বলেই ডাকি। আমি চেষ্টা করবো বলেও কখনও পেরে উঠিনি। আমার মুখে ওই স্যার আর ম্যাডামই চলে আসতো। এটা নিয়েও তারা অনেক মজা করতো আমার সাথে। তবে স্যার আর ম্যাডামের মাঝে ভালবাসা আর বিশ্বাস যে অগাধ সেটা রাতুল আর আমি খুব ভালভাবে জানতাম।

ভার্সিটি থেকে ওয়াজেদ স্যারকে ট্রেনিং এর জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হল দুমাসের সময় নিয়ে। স্যার চোয়েছিল ম্যাডাম কে নিয়ে যেতে কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাথে পেরে উঠেনি। এদিকে ম্যাডামও কেমন যেন তার যাওয়াতে অনেক মলিন হয়ে গেলেও হাসিমুখেই বিদায় দিয়েছিল স্যারকে। স্যার চলে গেলে ম্যাডামকে আমি, রাতুল, রিধি আর দিঘি মিলে সময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। স্যারের সাথে প্রতিদিন কথা হলেও অনেক সময় স্যার খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। কারন ওখানে তিনি অনেক ব্যস্ততার মাঝেই থাকতেন।

এদিকে ম্যাডাম নিজের একাকিত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বিদ্ধস্ত। অন্যান্য কলিগরা মিলো গল্প আর ক্লাস বাড়িয়ে নিয়েই সময় কাটে। এরই মাঝে ম্যাডামের এক বন্ধু তার সাথে দেখা করতে আসে। ম্যাডামের সাথে তার সম্পর্ক অনেক ভাল এটা তাদের সখ্যতা দেখেই বুঝেছিলাম। ঠিক দুমাস পর যখন স্যার দেশে আসলো তখন ম্যাডামকে যতটা খুশি থাকার কথা ছিল ততোটা ছিল না। দুদিন পর ম্যাডামের সেই বন্ধু ম্যাডামের সাথে দেখা করতে আসলে অনেকটা চিৎকার করেই সেই বন্ধুকে ম্যাডাম চলে যেতে বলে। সেদিন স্যারকে দেখা যায় নি আশেপাশে। তবে আমরা ম্যাডামের কাছে গেলে ম্যাডাম সোজা বাসায় চলে আসেন। আমরা কেউই বুঝতে পারিনা কি হচ্ছে। হঠাৎ করে কি এমন হল যে ম্যাডাম এভাবে রিয়েক্ট করলো?

পুলিশ ম্যাডামের লাশটাকে ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে ওয়াজেদ স্যারের কাছে আসলেন কিছু শোনার জন্য। রাতুল, আমি, রিধি আর দিঘি তখন পাশেই ছিলাম। পুলিশ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন স্যারকে, উনি কেন সুইসাইড করলেন বলতে পারেন মি. ওয়াজেদ? স্যার কিছু বলছেন না দেখে রাতুল বলল, ইন্সপেক্টর উনাকে একটু সময় দিন। আপনারা পরে এসে জিজ্ঞেস করুন এসব। এটা শুনে তারা বলল, স্টেটমেন্ট না নিয়ে তো আর যেতে পারি না। আর বলা যায় না, এটা সুইসাইড না হয়ে খুনও তো হতে পারে। রাতুল রেগে গিয়ে বলল, কি যাতা বলছেন আপনারা? তখনি ওয়াজেদ স্যার বলেন, ইন্সপেক্টর খুনটা আমি করেছি। একান্তই ব্যক্তিগত একটা সিদ্ধাত নিয়ে তার সাথে আমার সমস্যা হয়েছিল যার এক পর্যায়ে আমাকে খুন করতে বাধ্য হতে হয়। এটা শুনে রাতুল আমি দাড়িয়ে গেছি। ধপ করে রাতুল ওয়াজেদ স্যারের পাশে বসে হাতটা ধরে বলল, ভাইয়া এসব কি বলছো তুমি। তুমি এ কাজ কখনও করতে পারো না। ইন্সপেক্টর আপনি আমাদের একটু সময় দিন।

ভাইয়া নিশ্চয়ই তার ভ্রম থেকে এসব বলছে। ইন্সপেক্টর একটু চুপ থেকে বললেন, এটা যে খুন সেটার কোন আলামত আমরা পাই নি শুধুমাত্র পোড়া কিছু কাগজের ছাই ব্যাতীত। তবে উনি যা বললেন তারপরে আর কিভাবে সময় দেই বলুন। ওয়াজেদ স্যার ইন্সপেক্টর কে বললেন, ভয় নেই ইন্সপেক্টর, আমি পালিয়ে যাবো না। তবে ময়নাতদন্ত শেষ হলে একটু বলবেন কারন আমি শেষবারের মতো আমার স্ত্রীকে একটু দেখতে চাই। ইন্সপেক্টর কি বুঝলো জানি না তবে পরেরদিন ম্যাডামকে দাফন করানোর আগে ওয়াজেদ স্যার ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, অথচ আমরা চাইলেই আরও সুখে থাকতে পারতাম যদি না মানুষের কাছে একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য স্বামী ছাড়া অন্য কোন মানুষ খনিকের জন্য অনেক বেশি আপন মনে হয়। কিন্তু তুমি সেই আমাকে ধোঁকা দিয়ে নিজের কাছেই বাঁচতে পারলে না। ভালবাসতাম তো অনেক। তবে আমাদের আর একসাথে থাকা হল না।

এরপর ওয়াজেদ স্যারের সশ্রম যাবৎ জিবন কারাদন্ড হয়। স্যার শুধু এটুকু বলেছিল আমাদের, একটা মৃত মানুষকে সাথে নিয়ে থাকার থেকে আলাদা থাকা অনেক ভাল। তোরা বরং তোদের ভাবির খেয়াল রাখিস। এটা ছিল স্যারের থেকে জেলে যাওয়ার আগের শেষ কথা। আমার মনে তখন অনেক প্রশ্ন। বিশেষ করে ম্যাডামের লাশটার সামনে স্যারের বলা কথাগুলোর জন্য। কি হয়েছিল তাদের মাঝে? রাতুলও মেনে নিতে পারছিলো না যে ওর ভাই ওর ভাবিকে খুন করতে পারে। এরকম একটা আবছায়ার মধ্যেই দিন কাটছিলো। কিছুই আর আগের মতো নেই। খুব করে চেয়েও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না আমরা।

হুট করে সুখের এক জিবনটা কেমন যেনো কালো রং এর মরিচিকা হয়ে গেলো। এর মাঝেই ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একদিন ম্যাডামের সেই বন্ধুকে দেখা গেলো। আমি দৌড়ে গেলাম তার কাছে। নিজের পরিচয় দিয়ে যখন তাকে প্রশ্ন করলাম যে কি হয়েছিল তখন উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। একটু পরে শান্ত হলে উনি আমাদের কিছু বলতে পারবেন না বলে উঠে চলে গেলেন। উনার চলার পথে যখন আমরা চেয়ে আছি তখনই সামনে আসা ট্রাকের সামনে পরে নিজেকে ভিড়িয়ে দেন জিবনের ওপারে। দৌড়ে গিয়ে তার সামনে যেতেই তার বিভৎস বিক্ষত শরীরটা দেখে দিঘি হরহর করে বমি করে ফেলে। ঘটনার পরে থেকে আমরা কেউই শান্তিতে থাকতে পারছি না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে কাল ওয়াজেদ স্যারের সাথে দেখা করবো আমরা।

পরেরদিন সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর এর সাহায্য নিয়ে আমরা ওয়াজেদ স্যারের সাথে দেখা করি। তাকে ওই বন্ধুর ঘটনা খুলে বলতেই উনি কিছুক্ষন চুপ হয়ে গেলেন। তিনি উঠে চলে যাবেন তখন আমি বললাম, স্যার, ধোঁকা যেই দিয়ে থাকুক না কেন, সেটা যে ধোঁকা নয় এটা আপনিও ভালভাবেই জানেন। এটা শুনে স্যার থেমে গেলো। ঘুরে দাড়িয়ে আমাকে আর ইন্সপেক্টর কে রেখে রাতুলদের বাইরে যেতে বললেন। রাতুল আমার ঘাড়ে হাত রেখে বাইরে চলে গেলো।

দেশের বাইরে যাওয়ার পর অরিত্রিকে খুব একটা সময় দেওয়া হত না। আমি জানতাম তার অনেক খারাপ লাগতো আমাকে ছাড়া। দেশে আসার পরে ভেবেছিলাম ওর হাসিমুখটা আবার ফিরিয়ে দেবো কিন্তু কেন যেনো আমার অরিত্রিকে আমি তার মাঝে খুজে পাচ্ছি না। কাছে পেতে চেয়েও তারই থেকে মৃদু অবহেলা পেয়েছি যেটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তার পরেরদিন তো অরিত্রি হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে গেলো। সকালে উঠেই আমার জন্য বিরিয়ানির সাথে পিয়াজ মরিচ দিয়ে আলুর ভর্তা করেছিলো। নিজ হাতে বসিয়ে খাইয়েছিলো আমাকে। আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। গালে হাত রেখে বলেছিলাম কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে? আজ কি কোন স্পেশাল দিন? ওর চোখ দিয়ে পানি গরিয়ে পড়তেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলো অরিত্রি।মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলাম, এই পাগলি কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে বলো আমাকে? ও কেঁদেই চলেছিলো।

একটু শান্ত হতেই আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বলো আমাকে? ও মুচকি হেসে আমার শার্ট টা ঠিক করে দিয়ে বলল, কিছু না। তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। তারাতারী ভার্সিটিতে যাও আর জলদি চলে এসো কিন্তু। আমি বলেছিলাম, তুমি যাবে না ভার্সিটি? ও মাথা নেড়ে বলেছিলো, আজ ছুটি নিয়েছি তোমার জন্য। কাজ আছে একটু। তুমি বরং জলদি চলে এসো। আমি কিছুক্ষন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কিন্তু কিছু বুঝতে পারি না। হাতে এক লোকমা বিরিয়ানি নিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়ে হাত ধুতে যাবো এমন সময় মনে পরলো এক লোকমা খাওয়াতে নেই। তাই আর এক লোকমা নিয়ে খাইয়ে দেই।

আবারও তার চোখের পানি গড়িয়ে পরে। হাত ধুতে ধুতে ভাবলাম আজ আমিও ছুটি নিয়ে চলে আসবো। যখন বের হয়ে যাই তখনও অরিত্রি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। বলতে থাকে, আমাকে ক্ষমা করে দিও কেমন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাই আবারও, কি হয়েছে বলো আমাকে? ও আমার গালে হাত রেখে বলে, ভালো থেকো সবসময়। আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম, মানে কি? ও তখন স্বাভাবিক হয়ে বলে, ভালভাবে এসো? আর অন্য কলিগদের দিকে নজর দিও না যেনো কথাটা বলতেই ওর মুখটা কেমন যেনো কান্নার মত ধরে আসছিলো। তবুও শেষে ও আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলো। আমি মনে মনে ভাবছি, আমি আসছি অরিত্রি। তোমার জন্য আমাকে জলদিই আসতে হবে।

বাসায় ফিরতেই অনেকবার কলিংবেল চাপার পরও যখন দরজা খুললো না তখন দরজার এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুললাম। ভেতরে গিয়ে সারপ্রাইজ দেবো ভেবে ভেতরে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম। দেখলাম আমার অরিত্রি ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। চিৎকার দেবো এমন সময় বুঝলাম আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। তড়িঘড়ি করে ওকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। ততোক্ষনে সে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। দিকবিদিক হয়ে কতোক্ষন যে ওর পাশে আবোল তাবোল বকেছি জানি না। এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই যখন বিছানার পাশে গোলাপসত একটা পাতা দেখি তখন আমার সন্বিত ফিরে আসে। খাতার পাতাটা হাতে নিয়ে পড়া শুর করলাম,

প্রিয় অনিরুদ্ধ, যখন তুমি চিঠিটা পড়ছো তখন হয়তো আমি আর নেই। শুরুতেই একটা কথা বলতে চাচ্ছি তোমায়। সেটা হলো, আমি তোমার মতো আর কাউকে ভালবাসিনি। বিশ্বাস করো, আমার ভালবাসায় কিন্তু ত্রুটি ছিল না। আমরা অনেক ভালই সংসার করছিলাম তাই না। তুমি কি জানো আমিও একটা ভাল মানুষ তাই বুকের ভেতরে অপরাধ নিয়ে আর বেঁচে থাকতে পারলাম না। রিহান কে তুমি তো চেনই। তুমি বাইরে যাওয়ার পর একদিন ভার্সিটিতে ওর সাথে দেখা হয়। ওর এক ভাতিজাকে ভর্তি করাতে এসেছিলো। সেদিন ভার্সিটিতে হালকা নাস্তাপানি খাইয়েছিলাম তাকে। জানোই তো ও আগে থেকেই এতিম। তাই রাতুলরা যেদিন ট্যুরে গেলো সেদিন ওকে বাড়িতে ভালমন্দ কিছু খাওয়ানোর জন্য ডেকে নেই। ভেবেছিলাম রাতুলদের সামনে ওকে আনলে ওরা ব্যাপারটা যদি অন্যভাবে নেয় তাই সেদিন কেউ না থাকায় ওকে ডাকা আরকি। বিকেলে ও যখন আসলো তখন ওকে খেতে দিয়ে আমি সামনে বসে ছিলাম আর টুকটাক গল্প হচ্ছিলো। সন্ধ্যায় যখন ওর যাওয়ার সময় হয়ে এলো তখনি ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। রিহান যেতে পারলো না। চুপচাপ দুজনি বসে আছি তাই ভাবলাম চা নিয়ে আসি।

বারান্দায় ওকে এক কাপ চা দিয়ে আমিও পাশে বসে গল্প করছি। এমন সময় হঠাৎ ও আমার হাতটা চেপে ধরে। আমি ওর দিকে তাকালে ও নিখুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যখন ওকে বললাম, তোমার চলে যাওয়া উচিৎ। তখন মুখটা নিচু করে ও বলল, দুঃখিত। আসলে আমাদের এতো চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই। আমরা এতিম তাই। এসব বলে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে তোমাকে একটা কথা বলাই হয় নি। বিয়ের আগে রিহান আমাকে পছন্দ করতো। কলেজে পড়াকালীন যখন ওকে অসহায় ভাবে পরে থাকতে দেখতাম সেদিন থেকেই ওকে যখনি পেতাম কিছু না কিছু কিনে দিতাম। বিনিময়ে সেও কম করেনি। আমার ছোট ভাইটাকে বাঁচাতে সে নিজেই মরতে বসেছিল যেটার ঋন শোধ করার নয়। তাই সেদিন যখন সে আবারও হাত ধরে জোর গলায় নিবেদন করছিল, পারিনি আটকাতে। পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে কি পেরে ওঠা যায়? তাই কিছু করতে চেয়েও পারিনি।

প্রতিটা মানুষের ভেতরেই একটা পশু আছে তবে সেটা ব্যক্তিত্বের কাছে কিছুই নয়। রিহান পারেনি নিজেকে আটকাতে আর আমি পেরে উঠিনি তার পশুত্বের সাথে। ভেবেছিলাম এটা নিয়েই কিছুটা যদি তার মনে শান্তি হয়। বিশ্বাস করো তখন একটাবারের জন্যও তোমার কথা মনে হয় নি। মনে হল তখন, যখন সে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে আমার শরীরটাকে ছেড়ে দিল। আমিও ধরপরিয়ে উঠে নিজেকে ঠিক করলাম। কিন্তু ততোক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমি তখনিই হেরে গেছি নিজের বিবেকের কাছে। তখন বারবার মনে হচ্ছিলো তোমার কথা। রিহান কেঁদে কেঁদে বলছিলো, সত্যি বলছি অরিত্রি, আমি এরকমটা চাই নি। ও বুদ্ধিও দিয়েছিল যে কাউকে না জানাতে। তাহলে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। সে চলে যাওয়ার পর এই কথা ভেবে অনেক হেসেছিলাম আমি যে, কাউকে না জানালেই কি আবারও সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো?

এর কিছুদিন পরেই তুমি এলে। এতোদিন ভেবেছিলাম তুমি আসলেই আমি সবটা তোমাকে বলবো কিন্তু বলতে গিয়েই কোথায় যেন আটকে গেছি আমি। তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি সেটাও আবার নিজের মুখে বলবো। অনেক বার বলতে চেয়েছি তোমায়। তুমি যখন আমার কাছে আসতে চাইতে তখন তোমাকে দুরে সরিয়ে দিতাম। ইচ্ছে হয় নি তোমার পবিত্র শরীরটাতে নিজের অপবিত্র শরীরে জড়াতে। তোমার অভিমানে ভরা মুখটা আমি দেখতে পারতাম না আর সেই তুমি কত অভিমান মনের মাঝে রেখেই ঘুমিয়ে যেতে। পুরো রাত কেঁদেই কাটাতাম। তবে আর কতদিন এভাবে? নিজেকে ক্ষমা করা হয়ে ওঠেনি আমার। শুধু ভেবেছি আমি তোমার জায়গায় থাকলে কি মানতে পারতাম এসব? উত্তর পেয়েছি, আমি পারতাম না। তাইতো আজ তোমাকে শেষবারের মত ভালবেসেছি। সত্যি বলতে খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো যে আমি বাঁচতে চাই অনিরুদ্ধ। একবার মনে হল ভুলটা বলেই তুমি যদি আর ভালো নাও বাসো তবে তোমার দাসী হয়েই কাটিয়ে দিব কিন্তু ভয় হল আমার। যদি এটা শুনে তুমি নিজেকেই শেষ করে দাও। তাই চলে যাচ্ছি তোমায় ছেড়ে। ভালবাসাটা তোমার প্রতি যে নিখুত ছিল তা প্রমানের জন্য নয় বরং তোমাকে ধোঁকা দিয়ে নিজের কাছে বাঁচতে চাই নি আমি। তাই তো আজ আমি ওপারে।

ভালো থেকো তুমি। আর হ্যা, রাগ করো না কেমন? পারলে ক্ষমা করে দিও আর দোয়া করে চিঠিটা পড়া হলে আমার মৃত কপালে একটিবারের জন্য একটা ভালবাসার পরশ দিও। এটা চেয়ে নিচ্ছি তোমার থেকে। মনে রেখো আমি তোমায় ধোঁকা দেই নি, শুধু ভালবেসেছি। শুধুই ভালবেসেছি তোমায় প্রিয়। ইতি তোমার ধোঁকাবাজ ভালবাসা।

চশমা খুলে চোখটা মুছে আবারও চশমা পড়লেন ওয়াজেদ স্যার। বললেন, সেদিন আমি এই চিঠিটা পুরিয়ে দেই তখনি, যেনো তার সমন্ধে মানুষ অন্য কিছু না ভাবে। আমি জানি পুরো মুহুর্তটাই ছিল একটা ভ্রম।সবটা শোনার পরে ইন্সপেক্টর বলল, তবে কেন আপনি এই সুইসাইড কে খুন বলে নিজেকে আসামি প্রমান করলেন? স্যার বললেন, এটা তো খুনই। ও তো আমার জন্যই মরেছে। আমার কাছে যেন সবসময় সে আমার অরিত্রি হয়েই থাকে এজন্যই তো সে চলে গেছে। আমি বললাম, স্যার, সবি বুঝলাম তবে আপনি নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন কেন? স্যার বলল, দোষটা আমার মামুন। আমার ভালবাসার প্রতি আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। আমি কি তাকে ভালবেসেছিলাম? যদি ভালবেসেই থাকি তবে কেন হারিয়ে ফেললাম তাকে? একটাবার যদি সে বলতো আমায় তবে আমি হয়তো রেগে থাকতাম। এটাও মানছি যে তার প্রতি একটু খারাপ লাগা কাজ করতো তাই বলে কি ছেড়ে যেতাম ওকে? তাকে কি বোঝাতে পারিনি আমি যে কতোটা ভালবাসি আমি তাকে? তাই নিজেকে শাস্তি দেওয়াটা বেশি জরুরী ছিল। আর আমি আর বেঁচে নেই মামুন। জীবিত মানুষ আমি তবে ভেতরটা অনেক আগেই মরে গেছে।

ইন্সপেক্টর আর আমি জেলখানার ভেতর থেকে বাহিরে আসছি। যাওয়ার সময় উনি স্যারকে বলেছিলেন যে চাইলে তার শাস্তি কমিয়ে আনা সম্ভব। জবাবে স্যার বলেছিলেন, আমি নিজেই এটা ঠিক করেছি ইন্সপেক্টর।আর কোন কথা হয় নি। ইন্সপেক্টর বললেন, জিবনে অনেক কেস দেখেছি তবে কারও প্রতি নিজের অভিমান আর ভালবাসা যে এতোটা হতে পারে এটা জানতাম না। উনার কাছে বিদায় নিয়ে পরে রাতুল, দিঘি আর রিধিকে সবটা বলি। এটা জানতে পেরে ওয়াজেদ স্যার আর অরিত্রি ম্যাডামের প্রতি শ্রদ্ধাটা বেরে গিয়েছিলো। অরিত্রি ম্যাম এটা বুঝিয়েছে যে ভাল মানুষেরা কোন অপরাধ করে নিজের বিবেকের কাছে বেঁচে থাকতে পারেনা। আর সেটা যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটা হয় তবে তো কথাই নেই। নিজের সবচেয়ে মুল্যবান জিনিস যেটাতে শুধু নিজের স্বামীর হক আছে সেটা যদি কোন কারনে অন্যের হয়ে যায় তবে এই ধোঁকা কি বাঁচতে দেয় মানুষকে? অরিত্রি ম্যাম তাই বাঁচতে পারেনি। একটি ভুল কেরে নিলো তিনটে প্রান। ওয়াজেদ স্যার হয়তো বেঁচে আছে তবে আসলেই কি এটাকে বেঁচে থাকা বলে। অন্যদিকে ওয়াজের স্যার এটা বুঝিয়েছেন যে, সুইসাইড কোন সমাধান নয়। চাইলেই সবকিছু ঠিক করা যায়। মনে রাখা উচিৎ, জিবনে এমন কোন পাপ নেই যেটার কারনে মানুষকে সুইসাইড করতে হয়।

দিঘির সাথে রাতুলের বিয়ে হয় ঐ ঘটনার চার বছর পরেই। এদিকে রিধিরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু বিয়ের দিন মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে। রাতুলসহ আমি খুজতে গেলে ওকে আমার বাড়ির সামনে পাই। আমি আর রাতুল সামনে আসতেই মেয়েটা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বলল, বিয়ে খেতে গেছিলে তাই না? কিছু বোঝনা তুৃমি না? পাশে থেকে রাতুল বলল, ও একটু এরকমি কিছু করার নেই। রিধি এটা শুনে আমার বুকে এলোপাথারি কিল মেরে আবারও জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি তখন ওকে জড়িয়ে নিয়ে হেসে ফেলি। সত্যি তো মেয়েটা আমার এতো কেয়ার করে অথচ আমি খেয়ালই করিনি এসব। এই শহরের ব্যস্ততায় যে মাদকতা খুজে পেয়েছি তাতে যে রিধির মায়াটা বুঝতেই পারিনি। তবে এখন থেকে এই মায়ায় কাটাতে চাই। তারপর তো দু পরিবারের সম্মতিতে রিধিকেই বিয়ে করি।

দশবছর পরে ওয়াজেদ স্যারের জামিন হয়। যদিও চৌদ্দ বছর সময় কিন্তু উনার ভাল ব্যবহার আর সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য চার বছর মওকুফ করা হয়। এরপর বাড়িতে এসে উনি খুব একটা স্বাভাবিক না হলেও দিঘি আর রাতুল সবসময় তার সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। আর তাইতো আজও রাতুল দিঘি আর ওয়াজেদ স্যার বারান্দায় বৃষ্টি বিলাশে ব্যস্ত।

হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে সবারই এই বৃষ্টির মাদকতার ঘর ভেঙ্গে গেলো। রাতুল এসে দরজা খুলে আমাদের দেখেই বলল, এতোক্ষনে আসলি? ভেতরে ঢুকতেই দিঘি আমাদের কাকভেজা দেখে হেসে বলল, একটু আগে বের হলেই পারতেন। আমি বললাম, রিধি সাজতে বসলে সময় কোন দিকে যায় টেরই পায় না। একটা টাওয়েল বারিয়ে দিয়ে দিঘি বলল, তা তো হবেই, সুন্দরী বউ আপনার বাপু। আর আমাদের তো আজকাল কেউ ঘুরেও দেখে না। রাতুল বুঝলো যে কথাটা তাকেই খোচা মেরে বলল দিঘি। রাতুল তখনই দিঘিকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি ঘুরে তাকানোর সুযোগ দিচ্ছো কোথায় হুম? রিধি আর আমি হেসে ফেলি। একটু পরে ওয়াজেদ স্যার আমাদের কাছে এসে বললেন, অনেকদিন পর এলে তোমরা। ভুলে যাচ্ছো নাকি এই বুড়োটা(নিজেকে দেখিয়ে) তোমাদের আর আগের মতো ক্লাস নিতে পারে না? আমি ধীর গলায় বললাম, না স্যার। আসলে অফিসের কাজের চাপে আসাই হয় না। স্যার তখন রাতুলকে বলল, আজ রাতে রান্নাটা আমি করবো। দেখি তোদের রান্নার স্বাদ দিয়ে মন ভোলাতে পারি কি না। তবে এখন আমাদের জন্য চা করে নিয়ে আয়। রাতুল হাসলো এটা শুনে।

চায়ের কাপে চুমুকের সাথে হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে চলছে আমাদের গল্পের আসর। আমি ভাবছি অরিত্রি ম্যাডাম বেঁচে থাকলে আজ পুরোটাই পুর্ন হতো। তবে স্যার মনে হয় এখানে উপস্থিত আরেক সত্তাকে শুনিয়ে চলেছে যে এতোকিছুর মাঝেও তুমি ছাড়া আমি একা। এটা ভাবতেই আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। একটু পরে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, আমি এখনো তাকে অনুভব করি শুধু বলতে পারিনা নিজের অনুভুতি গুলো। বলতে পারিনা আলতো চুমুর স্পর্শে, ভালোবাসি এখনো সেই তোমাকে…..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত