মায়ের ছায়া

মায়ের ছায়া

রীতি আমার মেয়ে।ওর আজ বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।ওর বাবা জাবিরের পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে ঠিক হল।সেতুর বয়স কাটায়কাটায় আঠার।এবার আই এ পাশ করল মাত্র কিন্তু জাবিরের এক কথা সে মেয়েকে বেশিদিন ঘরে রাখবে না।মেয়ে নাকি অন্যের আমানত।তাই যত তারাতারি তাকে পাত্রস্থ করা যায় ততই ভাল।তাহলে নাকি পূন্য হয় বাপ মায়ের।

সেই বিশ্বাসের জেরেই জাবির তার পছন্দের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করল।ছেলে মাশাল্লা দেখতে শুনতে ভালই।কম্পিউটার ইন্জিনিয়র।অনেক ভাল চাকুরী করে।সব খোঁজ খবর জাবির নিজেই করেছে।আর শুধু আমাকে সেতুকে জানিয়েছে যে সেতুর বিয়ে।ব্যস এই পর্যন্তই।কারন জাবির কখনো আমাকে তার কোন ব্যপার শেয়ার করার জন্য উপযুক্ত মনে করে না।তাই সে শুধু কোন ব্যপার হলে সেটা আমাকে জানানোর জন্য জানায়।এর চে বেশি অধিকার বা মতামত অথবা অমত করা নিয়ে বাকবিতন্ডা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না কখনো।

এবার বলি জাবিরের চারিত্রিক কিছু ব্যপার।সে প্রচন্ড বদ মেজাজী।সবকিছুতে পুরুষের আধিপত্য বিস্তারকারী একজন মানুষ।ঘরের বউ শুধু তার হুকুমের গোলাম।সে যা বলবে তাই হবে।এমনটা সাধারণত অনেক পুরুষের মাঝেই থাকে।কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আশ্বচর্যের বিষয় হল সে আমাকে কেন জানি দুরে সরিয়ে রেখেছে সর্বদা।এর একটা কারনও অনেক পরে তার মুখ থেকে শুনেছিলাম।আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে বউদের প্রতি স্বামীদের যে আবেগ অনুরাগ ভালবাসা তা আমি কখনো পাই নি।যেমন বউকে ভালবেসে দুটো কথা বলা বা পাশে বসিয়ে মনের ভাব বিনিময় জাবিরের সঙ্গে আমার হয় না।এক্ষেত্রে তবে তার সাথে আমার বিয়ের ছোট একটা গল্প জড়িত আছে তা একটু বলা দরকার।

আমার বিয়েটা ছিল একটা শর্তের বিয়ে।বিয়ে আবার শর্তের হয় নাকি?হ্যা আমার বিয়েটা তেমনি একটা বিয়ে।আমার নাম রোকসানা।আমি তখন মাত্র ক্লাশ ফোরে পড়ি।আর জাবির মেট্রিকে অনেক ভাল রেজাল্ট করেছে।দেখতেও অনেক সুন্দর ছিল।সে যে পরিনত বয়সে একজন সুপুরুষ হবে ঐসময়ের চালচলনে বোঝা গিয়েছিল।কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে তাকে পড়াশুনা করানো সম্ভব নয়।জাবিরের আব্বা আর আমার আব্বা একই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন।সেই সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধু সুলভ একটা সম্পর্কও আছে।আমার আব্বার পৈত্রিক সম্পত্তি মোটামুটি ভালই ছিল।কিন্তু জাবিরের আব্বার কি একটা অসুখের কারনে তিনি তেমন কাজ কর্ম করতে পারতেন না।তাই যেটুকু জমি জিরাত ছিল তা দিয়ে তাদের সারা বছরের খাবারের যোগান দিতেই কষ্ট হত।তার উপর জাবিরদের তিন ভাই দুই বোনের লেখাপড়া চালানো খুবই কষ্ট সাধ্য ছিল।কিন্তু জাবিরের ইচ্ছা ছিল সে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে যত কষ্টই হোক।তাতে তার আব্বা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন।তিনি তার ছেলে জাবিরের এই ইচ্ছার কথাই একদিন কথায় কথায় আমার আব্বার সাথে বলেছিলেন।

তখন জাবিরদের এই অপারগতার সুযোগ নিয়ে আব্বা একটা ফন্দি আঁটলেন।আমি দেখতে অসুন্দর ছিলাম।তার উপর সারা বছর অসুখবিসুখ লেগেই থাকত।বড় হয়েও আমার রংরুপ যে তেমন একটা ফুটে বেরুবে না তা নিয়ে আব্বার টেনশনের শেষ ছিল না।তার এমন কালো কুৎসিত মেয়েকে কে বিয়ে করবে?তাই তিনি জাবিরের বাবার কাছে একটা শর্ত রাখলেন।তিনি নিজ দায়িত্বে জাবিরকে যতটুকু ইচ্ছা লেখাপড়া করাবেন।তার বিনিময়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে।এই ছিল আমার শর্তের বিয়ে।জাবিরের বাবা কোন চিন্তা না করেই সায় দিলেন।এমনকি যার সারাজীবনের প্রশ্ন তাকেও কোনকিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না।

বরং বললেন জাবির তো এখন বাচ্চা মানুষ।সে আর কি মত দিবে?আমি যা বলব তাই তাকে করতে হবে।ব্যস কথা পাকা হয়ে রইল।আমি এখোন চিন্তা করে পাইনা যে আমি কি এতই গলগ্রহ ছিলাম যে ঐইটুকু বয়সে আমাকে পাত্রস্থ করার জন্য আব্বা এতটা চিন্তিত ছিলেন?ভবিষ্যত কি হবে না ভেবেই একজনের সাথে আমাকে বেঁধে দিলেন।যদি পরিণত বয়সে দুটো ছোটছোট ছেলেমেয়ের মতের মিল না হয়?তখন কিভাবে তারা সারাটা জীবন একসাথে কাটাবে?সে চিন্তা তখন কারো মাথাতেই আসেনি।এবং হয়েছেও তাই।বাবার অনুরোধের ঢেঁকি তো জাবির গিলেছিল।কিন্তু মন থেকে মানতে পারেনি কোনদিন।বড়দের কথামত,জাবির আর আমার মধ্যে একটা শর্তের বন্ধন তৈরি হয়ে গেল।জাবির কলেজে ভর্তি হল।ভালভাবে লেখাপড়া শুরু হল।তার সব ভার আমার আব্বা কাঁধে তুলে নিলেন।জাবির তখন আমাদের বাড়ীর অলিখিত জামাই।

নানী দাদীরা তাদের নাতজামাইকে নিয়ে কত হাসি তামাশা করে।আমিও হাসতাম কিন্তু বুঝতাম না কিছুই।আমার জগত তখন স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে পুতুলের বিয়ে দেয়া আর গ্রামের মাঠ ঘাট জুড়ে ছুটোছুটি করা।যখন জাবিরের সাথে বিয়ের শর্ত তৈরি হয়েছিল তখন থেকে আম্মা একটু একটু শাসন করতেন।যেন এভাবে ছুটোছুটি না করি।কিন্তু কে শোনে কার কথা?আমি আমার দুরন্ত শৈশব উপভোগে লিপ্ত। দেখতে দেখতে জাবির গ্রামের কলেজ থেকে ভালভাবে আই পাস করল।এখন তার ইচ্ছা সে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন ভাল কলেজে পড়বে।কথামত এর সব ব্যয়ভার আমার আব্বার বহন করতে হবে।এমন অবস্থায় আব্বা কি চিন্তা করলেন কে জানে,তিনি জাবিরের বাবাকে বললেন জাবির ঢাকায় পড়তে যাওয়ার আগে বিয়ের কাজ সেরে রেখে যেতে হবে।আজো জানি না আব্বা কেন এতটা উতলা ছিলেন।

জাবিরের মত সুপাত্র যেন হাত ছাড়া না হয় সেজন্য হবে হয়ত।যে কথা সেই কাজ।ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া এক সদ্য কিশোরীকে একটা লাল শাড়ীতে পেঁচিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল।কারন ঐ বয়সে শাড়ী কিভাবে পড়তে হয় তাই তো জানি না।তাই চাচী ফুপুরা এক প্রকার পেঁচিয়েই দিল শাড়ী দিয়ে।মোটামুটি ঘড়োয়া ভাবে আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হল।যদিও ঐ সময় বাল্যবিবাহ নিয়ে এতটা তোড়জোড় ছিল না।থাকলে হয়ত আমি বেঁচে যেতাম।শুধুমাত্র দেখতে অসুন্দর হওয়ার অপরাধে অবুঝ বয়সে আমাকে যে শর্তের বলি হতে হয়েছিল,সেটা হয়ত হত না। জাবির ঢাকায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হল এবং নিজের থাকার বন্দোবস্ত তৈরি করতে যা যা করার সব আমার আব্বা করে দিলেন।কারন জামাই বলে কথা।এখন আব্বা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।তার মেয়ের জামাই এখন পুরোপুরি শিকলে আটকে গেছে।তার মেয়েকে ছেড়ে অন্য কোথায় যাবেনা।

এই বিশ্বাসে আব্বা জাবিরকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লাগলেন।আমি যখন নাইনে পড়ি তখন জাবির একদিন কলেজ ছুটিতে বাড়ী এসেছে।আমাদের বাড়ী এসে সে আমার দাদীকে আকড়ে ধরল।আকড়ে ধরার কারন হল সে এখন আমার সাথে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করতে ইচ্ছুক।ওহ এর মাঝে আরো একটা শর্ত ছিল যতদিন জাবিরদের ঘরবাড়ী উন্নত না হয় ততদিন আমি আমার বাবার পরিবারেই থাকব।জাবির ভাল একটা চাকরী পেলে আমাকে অনুষ্ঠান করে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হবে।তাই জাবির যখন বাড়ী আসত তখন শুধু তার সাথে আমার কথা হত কেমন আছিস,ভাল আছি এই পর্যন্তই।আমার পরিবার আমাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে আমি এখন শুধু মেয়ে না।একজনের বিয়ে করা বউ।তাই যা ইচ্ছা তা করা যাবে না।শশুরবাড়ীর অমতে চলা যাবে না।

স্বামী নামক ব্যক্তিটির সব কথা মেনে নিয়ে চলতে হবে।তাকে নাখোশ করা যাবেনা।এমন আরো অনেক নিয়মনীতি আমাকে শেখানো হত প্রতিনিয়ত।জাবির যেহেতু দেখতে আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব্যের অধিকারী তাই তাকে খারাপ লাগার কোন প্রশ্নই আসে না আমার মত অসুন্দর একটা মেয়ের কাছে।বরং দিনে দিনে তার প্রতি কিশোরী মন আকৃষ্ট হতে লাগল।মানব মানবীর প্রেমবোধটা তাকে দেখলে বুকের ভেতর একটু একটু করে জাগ্রত হতে লাগল।সে যখন দাদীর কাছে আমাকে কাছে পাবার আবদার জানালো তখন আমি একটু ভয় একটু ভাল লাগা একটু প্রেমবোধে শিহরিত হলাম।পনের ষোল বছরের প্রেমবোধ যেমন হয় আর কি।দাদী কি করে সবাইকে কিভাবে কি বুঝালেন জানি না।এরপর থেকে সিদ্ধান্ত হল জাবির যখন গ্রামে ছুটি কাটতে আসবে সে আমাদের বাড়ীতেই জামাই আদরে থাকবে।

আমার দাদী বলে দিলেন বউ জামাইকে বেশিদিন দুরে রাখা ঠিক না।শুরু হল আমার বিবাহিত জীবন।জাবির বাড়ী এলে মনে হত সে বুঝি শুধুমাত্র আমার সাথে রাত কাটতেই এসেছে।তার ভিতরে নাটক সিনেমার প্রেমিকদের মত কোন প্রেম ভালবাসা খুজে পেতাম না।আমার সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করা মনটা তার কাছে যে প্রেম চাইত,তা সে কখনই দিত না।আবেগে আপ্লুত প্রেমের স্রোতে আমি ভাসতে চাইতাম,সে আবেগের জোয়ার তার কাছে কখনই উপলব্ধি করিনি।আমি তখন ভেবেই নিয়েছিলাম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বুঝি এমনি হয়।কিন্তু গল্পের বইয়ের বা সিনেমার প্রেম কি তাহলে বঅন্যকিছু?তা কি বাস্তবে হয় না?নাকি বইয়ের ভাষা শুধুই বইয়ের ভাষা?এসব রহস্যের উত্তর খুঁজে পেয়েছি অনেক পরে এসে।

আমার এস এস সি পরীক্ষার পর পর হঠাৎই ভীষণ অসুস্থ বোধ করা শুরু হল।সবাই কেমন যেন খুশি আবার শংকিত।দুটোই তাদের মাঝে বিদ্যমান।দাদীকে অসুস্থতার লক্ষণ বলার পর তিনি আদর করে বুকে নিয়ে বললেন-এইবার পায়ে শিকল পড়ল তবে!আমি না বুঝে দাদীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলে দাদী বললেন-নাত জামাইরে খবর দে।মিষ্টি নিয়া যেন বাড়ীত আসে।দাদী আমাকে আদর করে বুঝিয়ে দিলেন আমি মা হতে চলেছি।আবারও সেই কিছুটা ভয় আর লজ্জা আমাকে জড়িয়ে ধরল।আব্বার কানে এই কথা পৌঁছা মাত্রই জাবিরের আব্বাকে ডেকে পাঠালেন।আব্বার উদ্দেশ্য এই খবর সবার মুখে মুখে ছড়ানোর আগেই আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে তুলে দেয়া।আব্বার যেই কথা সেই কাজ।

আব্বা নিজ দায়িত্বে আমি জাবিরদের বাড়ীতে যে ঘরে থাকব সেই ঘর ঠিক। করালেন।আরো যা যা করা দরকার আমার সুখ সুবিধার জন্য সব করে দিলেন।জাবিরকে খবর পাঠানো হল।জাবির বাড়ী এলে তার মুখ কেমন যেন থমথমে মনে হল।ঐ বয়সে বেশিকিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম জাবির হয়ত পুরো ব্যপারটাতে কোন আনন্দ পাচ্ছে না।আমাকে সে জিজ্ঞেস করেই বসল-আমার পরীক্ষার সামনে এসব ঝামেলা এখন না করলে হত না?আমি বললাম আমি কি জানি আব্বা যা বলবেন তাই তো হবে।সে আঁকারে ইংগিতে আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে বলেই ফেলল বাচ্চা হওয়ার কি দরকার ছিল?আমি বেকুবের মত আবারও বললাম সেটার আমি কি জানি।দাদীই তো বলল আমার পেটে নাকি বাচ্চা আছে।তাই আব্বা আমাকে আপনাদের বাড়ী পাঠাতে চায়।সে রেগে গিয়ে বলল তুই বাচ্চা রাখলি কেন?আমি আরো বেকুব বনে গিয়ে বললাম,তো কি করব?সে ঝাঁজের সাথে বলল নষ্ট করতে পারলি না?জাবির আমাকে তুই করেই বলে আর আমিও তাকে আপনি সম্বোধনেই রয়ে গেছি।

আমার পেটে যে বাচ্চা সেটাই তো বুঝতে পারিনি আবার নষ্ট কিভাবে করে?যাক সে সময় তার কথার মাথা মুন্ডু কিছুই আমার বোধগম্য ছিলনা।দারুন একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাকে জাবিরদের বাড়ীর বউ করে পাঠানো হল।সমাজকে ঘটা করে জানিয়ে দেয়া হল যে আমার পেটের বাচ্চাটা জাবিরদের বংশ প্রদীপ।আমাকে বেশিদিন সেখানে রাখেননি আমার মা।কিছুদিন পর আবার আব্বার বাড়ীতে নিয়ে এলেন যাতে এই অবস্থায় যত্নের কমতি না হয়।সকলের আদর যত্নে একটি কন্যা সন্তানের মা হলাম সতের বছর বয়সেই।আমার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হল না।এর মাঝে মেট্রিক পাশের ফল পেলাম।কিন্তু পড়াশুনায় ছেদ পড়ল।

এভাবেই দিন যেতে লাগল।জাবির মাঝমাঝে বাড়ী এসে থেকে যায়।আমি মেয়েকে সামলাতে পারি না বলে মার কাছেই বেশি থাকা হয়।মেয়ের বয়স যখন তিন বছরে পড়ল তখন জাবির খুব ভাল একটা চাকরী পেয়ে গেল।আর সেই থেকেই আমার আব্বা জাবিরকে চাপাচাপি করতে লাগলেন আমাকে আর মেয়েকে নিয়ে যেন ঢাকায় বাসা করে রাখা হয়।আব্বার চাপেই কিনা জানি না জাবির আমাকে আর মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে এল।আমাদের নতুন বাসার যা যা দরকার সব আমার আব্বা কিনে ঘর সাজিয়ে দিলেন।

যেন আমার কষ্ট না হয়।নিজের সংসার করার একটা গোপন সুখ আমাকে শিহরিত করতে লাগল।সেই সাথে জাবিরের সংগে সবসময় থাকতে পারার আনন্দও পেয়ে বসল।মেয়েকে ঢাকার স্কুলে লেখাপড়া করাবো সেটাও অনেক বড় স্বপ্ন।কিন্তু সংসার শুরু করার পরপরই আমি আমার প্রতি জাবিরের ঔদাসিন্য টের পেলাম।কথা তেমন একটা বলত না আগেও।শুধু প্রয়োজনের কথা ছাড়া।কিন্তু এখন দেখছি দিনদিন তার মোজাজ যেন তপ্ত হতে শুরু করেছে।আমার কোনকিছুই যেন তাকে সুখি করতে পারেনা।সবকিছুতেই বিরক্তি।প্রচন্ড রকম চিৎকার চেচামেচি যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।রীতি কিছু বুঝতে না পেরে দিনদিন তার বাবাকে ভয় পেতে শুরু করে দিল।

যদিও বাবা মেয়েকে ভালবাসে।কারন নিজের অবয়বকে বোধহয় অগ্রাহ্য সবাই করতে পারেনা।তাই মেয়ের প্রতি ভালবাসার কমতি নেই তার।আমি দিনেদিনে এটা বুঝতে পারি যে আমার প্রতি জাবির আগ্রহ হারিয়েছে।শুধু ঘরে বউ রাখা দরকার তাই রেখেছে।কিন্তু বাইরের জাবির একদম ভিন্ন মানুষ।তার অফিস কলিগ বা বন্ধুবান্ধবরা কখনই বুঝতে পারেনা যে সে বাসায় তার স্ত্রীকে কতটা হেয় করে কথায় কথায়।বয়স তো কিছুটা হয়েছে।তাই তার এই কথায় কথায় অপদস্ত করাটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।যেমন রান্না একটু উনিশ বিশ হলেই তরকারির বাটি ছুড়ে ফেলত।আর চলত বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ।এমন আরো অনেককিছু।যখনই একটু প্রতিবাদ বা মুখ খুলেছি তখনই শুরু করে দিল গায়ে হাত তোলা।আর দু একটা চড় থাপ্পরে চলত না।

অনেক সময় ঠোঁট মুখ ফেটে রক্ত ঝরিয়ে তবেই ক্ষান্ত হত।সেসব দেখে দেখে মেয়েটাও ভয়ে কুকড়ে যেতে।দুই তিন বাবার কাছে যেতে চাইত না।কিন্তু মেয়ের ভয়টা জাবির নিজেই ভাঙ্গিয়ে তাকে কাছে ডেকে নিত।আমি অবাক হয়ে ভাবতাম এই মানুষটাই কি আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে?আবার বিছানার সম্পর্কও তো সব স্বাভাবিক।তবে শুধু দিনের আলোয় আমার সাথে এত রূঢ় আচরণ কেন করে?কি আমার দোষ বুঝতে পারি না।নিজেকেও বুঝি না।আবার তাকেও বুঝতে পারিনা।মার সাথে যখন দেখা হত তখন মাকে বললে মা বলত স্বামীর রাগের মাথায় এমন একটু করেই।এটা কোন ব্যপার না।আর আব্বাকে তো এসব বিষয় বলার মত সহজ সম্পর্ক তার সাথে হয়নি কখনো।তাই নিজের ভেতরেই তিলতিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

একটা সময় জাবিরকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম যে কেন আমার সাথে সে এমন করে?আমাকে মেরে রক্তাক্ত করতে তার কি মায়া হয় না?আর আমার প্রতি যদি মায়াই না থাকে তবে বিয়ে করে সংসার করার দরকার কি ছিল?তখনি সেই বহু প্রতিক্ষীত প্রশ্নের উত্তর সে আমাকে দিয়েছিল।সে আমাকে বিয়ে করেছে বাধ্য হয়ে।যাকে বলে নিরুপায় হয়ে অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছিল।তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা পথ ছিল মাত্র আমাকে বিয়ে করা।তার বাবার যদি টাকা পয়সার দৈন্যতা না থাকত তবে নাকি সে কোনদিনও আমার মত গেঁয়ো ভুতকে বিয়ে করে শহরে নিয়ে আসত না।এবার আমার কাছে সব পরিষ্কার।সে আসলে আমার বাবার দেয়া শর্তের জালে আটকে আছে।আমি তার চাহিদার পাত্রী ছাড়া বেশি কিছুই না।

এসব যখন বুঝলাম তখন আমি মেয়ের সামনে নিজেকে যাতে অপদস্ত হতে না হয় তাই নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিলাম।জাবির যাতে ক্রুদ্ধ না হয় সেভাবে চলার চেষ্টা করতে লাগলাম।ততদিনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার আর মুক্তি নেই।এভাবেই বাকী জীবন কাটাতে হবে।রীতির যখন ছয় বছর বয়সে স্কুলে দেয়া হল তখন আবার গর্ভধারণ করি।কারণ জাবিরের ছেলে চাই একটা।ছেলেই হতে হবে এটা তার শেষ কথা।যাইহোক আমাকে এই তিলতিল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতেই বুঝি আমি ছেলে সন্তানের মা হলাম।নাম রাখা হল রিসাদ।রিসাদের জন্মের পর জাবির যেন অনেকটা ঠান্ডা হয়ে এল।চিৎকার চেচামেচি করে কিন্তু মারধোর করাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এল।

এভাবেই নিরবে নিভৃতে দুই সন্তানকে বড় করায় মনোযোগী হলাম।প্রয়োজন ছাড়া জাবির আমার সাথে কোন কথা বলত না।অফিসের বাইরের সময়টুকু ছেলেমেয়েকে নিয়েই কাটাত।তার কিন্তু শুধু সিগারেট খাওয়া ছাড়া কোন বাজে অভ্যাস ছিল না।দিনে দিনে এতটুকু বুঝে গিয়েছিলাম যে সে কোন কারনে হয়ত আমাকে মন থেকে সেই উচ্ছাসে ভরপুর ভালবাসা দিতে পারে না,যেমনটা নাটক সিনেমায় দেখি।কিন্তু দায়িত্ব থেকেও পিছ পা হয় না।আমি আমার দুই সন্তানকে সে তার দায়িত্ব থেকেই দেখভাল করে যাচ্ছে।যাক এটাইবা কম কিসে?

রীতি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে জিগেজ্ঞ করলাম সে তার বাবার পছন্দে রাজী কিনা।নাকি তার নিজের কোন পছন্দ আছে।যেহেতু আজকালকার ছেলেমেয়ে।নিজের পছন্দ থাকতেই পারে।রীতি জানালো না বাবার মতের বাইরে তার কোন মত নেই।কিন্তু সে একটা বিষয়ে ভীত।যদি তার স্বামীও তার বাবার মত হয়!কারন ছোট থেকে আমার সাথে করা জাবিরের ব্যবহারই রীতি কে আজ এই প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।

সে বলল মা,আমি তোমার মত এত অত্যাচার মুখ বুজে যদি সইতে না পারি?আমি মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিলাম সব মানুষ তো এক হয়না।আর তাকেও এ ও বললাম নিজেকে শক্ত করে তৈরি করতে হবে।যেন সে কোন প্রতিকুল অবস্থায় ভেঙ্গে না পড়ে।মেয়েকে শেষে একটা কথা বলে দিলাম আমার পাশে কেউ ছিল না।কিন্তু তোমার পাশে তোমার মা আছে।যখনই প্রয়োজন হবে আমাকে তোমার কাছে পাবে।তোমাকে আগলে ধরার জন্য মায়ের হাত সর্বদা প্রস্তুত থাকবে।তোমার মা তোমার ভরসার জায়গা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত