কাছে আসা

কাছে আসা

ঠিকমতো লাঞ্চটা করে নিও কিন্তু! সামিয়ার কথা শুনে সাদাফ একবার পিছনে ফিরে তাকায়। চোখমুখ দেখে বুঝার উপায় নেই ও কি ভাবছে।

– আচ্ছা।

ছোট করে উত্তর দিয়েই সাদাফ আরকিছু না বলে পিছনদিকে ফিরে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। আর সামিয়া ফ্ল্যাটের দরজা লাগিয়ে ওর রুমে চলে যায়। ইদানীং সাদাফ, সামিয়ার চেহারার দিকে তেমন একটা তাকায় না। কি প্রয়োজন অযথা মায়া বাড়িয়ে!

সাদাফ আর সামিয়ার মধ্যকার সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রী। তবে আর দশটা সাধারণ দম্পতির মতো ওদের দাম্পত্যজীবন ততোটা স্বাভাবিক নয়। এই সম্পর্কের অস্বাভাবিকতার পিছনে শুধু একটাই নাম রয়েছে – ‘রিয়াদ’। অবশ্য রিয়াদ নিজেও এসব ব্যাপারে তেমন কিছু জানে কিনা সন্দেহ। সাদাফ যথাসম্ভব অফিসে চলে আসে। এটা একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। উচ্চশিক্ষিত সব কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এটি পরিচালিত। তাদের মধ্যে সাদাফও একজন। নিজের কর্মক্ষেত্রে সময়ানুবর্তী হিসেবে ও সবার প্রিয়। নিজের ডেস্কে গিয়ে বসার পর ওর কলিগ অমিয় এসে একটা ফাইলের ব্যাপারে কিছু কথা বলে চলে যায়। এরপর আসে নুহা।

– হাই সাদাফ! (নুহা)
– হ্যালো! (সাদাফ)
– কেমন আছো?
– এইতো ভালোই। তুমি?
– দেখতেই পাচ্ছো যে আমি ভালো আছি।

নুহা মেয়েটা খুবই চঞ্চল। অফিসে সবার সাথেই খুব মজাকরে কথা বলে। বলতে গেলে অফিসের সবাইকে মাতিয়ে রাখার অবৈতনিক দায়িত্বটাও সে পালন করে। নুহা মনেমনে সাদাফকে পছন্দ করে। কিন্তু সাদাফের বিয়ে হয়েছে বলে নুহা এসব অনুভূতিকে নিজের মনেই চেপে গেছে। এখন শুধু বন্ধুর মতো আচরণেই সীমাবদ্ধ দুজন।
নুহা চলে যাবার পর সাদাফ, সামিয়ার ব্যাপারে ভাবতে শুরু করে। ওদের দুজনের বিয়ে অনেকটা কাল্পনিক গল্পের মতো। সাদাফের সাথে সামিয়ার বিয়ের উদ্দেশ্যে ওদের মা-বাবারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি। সাদাফের সাথে সামিয়ার বিয়ের কোনো প্রশ্নই ছিলোনা। উক্ত বিয়ের কন্যা ছিলো সামিয়ার চাচাতো বোন মারিয়া। ফ্যামিলি এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ যাকে বলে! কিন্তু বিয়ের দিন মারিয়াকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভালোভাবে খোঁজার পর জানা গিয়েছে যে সে তার প্রেমিকের হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে! একথা জানাজানি হবার সাথেসাথে বাড়ির আনন্দঘন মুহূর্তটা আমাবস্যার কালো অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়। ঐদিকে আবার বরযাত্রীরা সবাই এসে গিয়েছে। মারিয়ার বাবা ও সাদাফের বাবা, দুজনেই নিজস্ব অঞ্চলে খুব সম্মানীয় দুজন ব্যক্তি। কিন্তু এমতাবস্থায় মারিয়ার বাবা যেনো কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন। তাই অন্তত সাদাফের পরিবারের কথা চিন্তা করে পরিবারের লোকজন বরপক্ষের সাথে বোঝাপড়ার পর জোর করে সামিয়াকে বৌ সাজিয়ে সাদাফের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এরপূর্বে সামিয়ার অনুরোধ, বুকফাটা আর্তনাদ, চোখের পানি কেউই গুরুত্ব দেয়াতো দূরে থাক, প্রত্যক্ষ পর্যন্ত করেনি। ঘটনায় সাদাফ আর সামিয়া, দুজনেই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র!

– ভাই দুপুরের খাবার খাবেন না?

জুনিয়র কলিগ হাসানের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে সাদাফ। এতোক্ষণ শুধু পুরানো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলো। অর্থাৎ ঘোরে ছিলো।

– অহ আচ্ছা আমি আসছি। (ঘোর কাটিয়ে)

সাদাফ ঘোর কাটানোর পর লাঞ্চ করতে চলে যায়। সেখানেও একটু আনমনে থাকে। এতোদিন যাবৎ ওর এই আনমনা ভাবটা অফিসের কারোই চোখ এড়ায়নি। এমনকি সামিয়ার চোখও এড়ায়নি।

– আচ্ছা আমি কোনো ভুল করছি নাতো?

রুমের মধ্যে একা বসে সামিয়া নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। “সাদাফের থেকে আলাদা হওয়াটা কি ঠিক হবে?” “কিন্তু এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো? ” “মনে হচ্ছে, মনের মধ্যে সহস্রটন বোঝা চেপে আছে। এই মিশ্র অনুভূতির নাম আসলে কি? ” নিজেই প্রলাপ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার আরেক চিন্তা মাথায় ভর করে। অবশ্য এটাকে চিন্তা না বলে স্মৃতিচারণ বললে বেশি ভালো হবে।

বিয়ের দিন সকল জল্পনাকল্পনার অবসান হবার পর রাত ১২টার দিকে সাদাফ বাসরঘরে প্রবেশ করে। এতোক্ষণ কি হতে কি হয়েছে বা হয়ে গেলো সেসব ঘটনা মস্তিষ্কে অন্যরকম বার্তা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ওদের দুজনের মধ্যেই যে কবুল বলার মুহূর্ত থেকে এখনোব্ধি ‘হিপনোটিজম’ কাজ করেছে, সেটা সাদাফ নিজেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে। নিজের সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর ও বিছানার দিকে তাকায়। তাকিয়ে দেখে বিছানার মাঝখানে সামিয়া লালচে লেহেঙ্গা পরে বসে আছে। তার চোখে হয়তো শ্রাবণের ধারা নেমেছে। নিঃশব্দে, চোখ বন্ধ করে মেয়েটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সাদাফ চিন্তা করছে, “কাঁদাটা স্বাভাবিক কিন্তু তাইবলে এতো কাঁদছে কেনো?” কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় যে বিয়েটা সম্পূর্ণ সামিয়ার মতের বিরুদ্ধে হয়েছে। এমনটা হলে যে কেউই ঘটনা মেনে নিবেনা। মেনে নিলেও পর্যাপ্ত সময় লাগবে। মেয়েটার এমন কান্নামাখা মুখ দেখে ওর নিজেরো খুব মায়া হচ্ছে। মনে একটু ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি এই বিয়েতে খুবই কষ্ট পেয়েছেন? ”

কিন্তু ওর উদ্ভট কথাতেও মেয়েটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের মনে চোখ বুঝে কান্না করেই যাচ্ছে। একটু জোর গলায় আবারো জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি ঠিক আছেন? ” এই কথাটাতে সামিয়ার সম্বিৎ ফিরে আসে। সে ধীরেধীরে চোখদুটো খোলার চেষ্টা করে। এতো কান্না করার দরুন চোখদুটি ফুলে গেছে। এমনিতেই সামিয়া ফর্সা। তাছাড়া হঠাৎ এতোকিছু হয়ে যাওয়াতে ওকে কোনোপ্রকার মেকআপ করা ছাড়াই বিয়ের আসরে তুলে দিয়েছে। চোখের কাজল লেপ্টে এক অসম্ভব সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে, আর সাদাফ সেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে।

– আ.. আপনি এ.. এখানে! অস্ফুটভাবে এই সামান্য কথাটুকু বলে সামিয়া। কিন্তু সাদাফ অবাক হয়ে যায়। ওর স্ত্রী ওকে চিনেই না!
– আমার সাথেই আপনার বিয়ে হয়েছে।

কথাটা শুনে সামিয়া, সাদাফকে আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নেয়। এই মানুষটার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, ভাবতেই কলিজাটা যেনো ফেটে যাচ্ছে। সাদাফ এক পা এগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসার পর সামিয়ার কাছে যেতেই সামিয়া দ্রুত সরে বসে।

– আপনি প্লিজ আমার কাছে আসবেন না!

সামিয়ার এই অদ্ভুত আচরণ আর কথায় সাদাফ খুব অবাক হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে নিলো, যে ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো ভুলভাল বলছে। ও নিজেও সামিয়ার সাথে একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।

– কিন্তু কেনো? আপনার কি আমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা অনুভূত হচ্ছে? (সাদাফ)
– না।

উত্তর শুনে সাদাফ আবার জানতে চাইলো, “তাহলে? ” এবার সামিয়া চুপ করে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। ও কিছু না বলে চোখের পাতা বন্ধ করলো। সাদাফ অধীর আগ্রহে উত্তরের আশায় রয়েছে। হয়তো এই অপেক্ষার কাছে ভ্রমান্ডের গতিও নিতান্তই তুচ্ছ। সামিয়া চোখ মেলে তাকায়।

– আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।

সামিয়ার কথা শুনে সাদাফের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। যেই মেয়েকে হঠাৎ জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়েছে, তার কাছ থেকে এমন কথা শুনতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছুনা। সাদাফ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কে উনি, যাকে আপনি ভালোবাসেন? ” জবাবে সামিয়া ধীর কণ্ঠে বলে, “রিয়াদ।” সাদাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনের মোড়টা যে এভাবে ঘুরে যাবে, সেটা ও দুঃস্বপ্নেও আশা করেনি। সামিয়াকে জোর করলে যে মন বিহীন শুধু দেহটাই পাওয়া যাবে! নিজেকে যথেষ্ট সংবরণ করে রেখে বলে, “আমরা দুজন কি ভালো বন্ধু হতে পারি? কথা দিচ্ছি আপনার সম্মান আমি অক্ষত রাখবো! ”

সাদাফের কথায় সামিয়া চমকে যায়। বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও তার মধ্যে ইতস্ততভাব থেকেই যায়। সেই সম্পূর্ণ রাতটা সামিয়া আর সাদাফ গল্প করেই কাটিয়ে দেয়। সামিয়ার গল্পগুলি বেশিরভাগই ছিলো রিয়াদকে ঘিরে। রিয়াদ আর সামিয়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ফ্যাকাল্টিতে পড়তো। রিয়াদ যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে, সামিয়া তখন ফার্স্ট ইয়ারে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে ওর তেমন একটা কষ্ট করতে হয়নি। ক্লাস, আড্ডা – এসবের মাঝে দিন ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।

বান্ধবীদের প্ররোচনায় পড়ে সামিয়া নিজেও মনের মতো কাউকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টায় লেগে যায় এবং রিয়াদকেই এই ক্ষেত্রে সঠিক মনে করে নেয়। ওকে প্রথম দেখেছিলো নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। হলুদ পাঞ্জাবি পরে ওদের সবাইকে ফুল দিয়ে বরণ করেছিলো। অনুষ্ঠানে গান করা, কবিতা আবৃতির ব্যবস্থাও করেছিলো। এরপর যতবার দেখা হয়েছে, প্রতিবারই দেখা গেছে হাতে একটা না একটা বই রয়েছেই আর ও গভীর মনোযোগে সেটা পড়ছে। ক্যাফেটেরিয়াতে প্রতিদিনই ওরা আড্ডা দিতো। সদা হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল এই ছেলেটিকেই সামিয়ার ভালো লেগে যায়। তাই একদিন প্রপোজ করে বসে! সামিয়ার মতো একটি মেয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করার সক্ষমতা কোনো ছেলেরই হবেনা। তদ্রূপ সত্যিতা রিয়াদের ক্ষেত্রেও ঘটে যায়।

সেই থেকে শুরু হলো একসাথে পথচলা। প্রতিদিন কিছু হলেও আড্ডা দেয়া হতো। কিন্তু কেউ কখনো একে অন্যের হাতে হাত রেখে দুদণ্ড কথা পর্যন্ত বলেনি। এভাবেই ২বছর পেরিয়ে যায়। রিয়াদ মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করার পর পিএইচডি করার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায়। সেখানে এতো বেশি ব্যস্ততার মাঝেও সামিয়ার সাথ নিয়মিত যোগাযোগ চালিয়ে যেতে থাকে। এতে দুজনেই খুশি। নিজের স্বপ্ন অনুযায়ী ক্যারিয়ার গড়ার চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে এলে যে কেউই খুশি থাকবে। এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত ডিগ্রী পাবার আশায় প্রহর গুনছে। কিন্তু সব আশাকে, হতাশায় রূপান্তর করে দিলো সামিয়ার আকস্মিক বিয়েটা!

এতোক্ষণ এসবের স্মৃতিচারণ করছিলো সাদাফ। বিয়ের কিছুদিন পরেই ও সামিয়াকে নিয়ে ব্যস্ততার শহরে ফিরে আসে। এরপর ১১মাস কেটে যায়। এসময়ে সামিয়া একবারের জন্যেও নিজের বাবার বাড়িতে যায়নি। ও এমনিতে প্রচণ্ড রাগি। আর এতোদিন সাদাফ আর সামিয়া রাতে আলাদা বিছানায় ঘুমিয়েছে। মাঝরাতে সাদাফের ঘুম ভেঙ্গে গেলেই ও সামিয়ার মায়াবী মুখটা দেখতে পেতো। এভাবেই ধীরেধীরে ও সামিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এখন কোনো লাভ নেই। কারণ ১৫দিন পরেই রিয়াদ বিদেশ থেকে ফিরে আসছে।

– আজ ফিরতে এতো দেরি হলো যে? সাদাফ রাতে একটু দেরি করে বাড়ি ফিরেছে বলে সামিয়া একথা জিজ্ঞেস করে।
– না এমনিই আজ কাজের চাপ একটু বেশি ছিলো।

জবাব দেয় সাদাফ। সামিয়া ভেবে পায়না সাদাফ এতো ভালো কেনো! একটা মেয়ে এতোদিন ধরে তার সাথে একই ছাদের নিচে আছে, অথচ সে নিজের চেতনাকে ঠিক রেখেছে। কখনো লোভাতুর দৃষ্টিতে পর্যন্ত তাকায়নি!
অন্যদিকে সাদাফ এখন সামিয়ার সাথে তেমন কথা বলতে চায়না। কারণ এতে যে বেশি মায়ায় পড়ে যাবে! যে তার বাড়িতে কিছুদিনের অতিথি এবং অন্যের আমানত, তার প্রতি আবেগ বাড়ালে যে কষ্টটাও বেড়ে যাবে। তাই সে দুরেদূরে থাকছে। এমনি করতে করতে ১৫দিন কেটে যায়। সামিয়া আজ চলে যাবে। হ্যাঁ! চিরতরে চলে যাবে সাদাফের জীবন থেকে। সামিয়া যাবার আগে সাদাফকে সবকিছুর ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলছে। বিশেষকরে খাবারের ব্যাপারে। কারণ সাদাফের আলসারের সমস্যা আছে। সামিয়া যাওয়ার আগে ফ্ল্যাটটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। সাদাফ ওকে নিয়ে পৌঁছে যায় পার্কের সামনে। গিয়ে দেখে সেখানে রিয়াদ এসে আগে থেকেই বসে আছে। সাদাফকে বিদায় জানিয়ে ওরা গাড়িতে ওঠে। সাদাফের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে দৌড়ে আবার গাড়িটার কাছে যায়।

– আমি কি আপনাদের সাথে একটু পথ যেতে পারি? (সাদাফ)
– অবশ্যই! (রিয়াদ)
– সামিয়া, এই সময়টুকু তুমি পিছনে এসে আমার সাথে বসবে? কথা দিচ্ছি একটু পরেই আমি নেমে যাবো!

সাদাফের এই অনুরোধ কেউ ফেলতে পারেনা। সামিয়া তখনি পিছনে গিয়ে সাদাফের পাশে বসে যায়। ঘণ্টাখানেক পর একটা বাসস্টপেজে সাদাফ নেমে পড়ে। এতোক্ষণ সে হাতে হাত রেখে শুধু সামিয়ার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিলো। একটু পরপর চোখ মুছেছে। চোখজোড়া শুধু একটা কথাই বলছিলো, “সামিয়া, আমাকে একা করে দিয়ে যেওনা! তোমায় যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।” এদিকে আবার সামিয়ার চোখ বেয়েও পানি পড়ছে। রিয়াদ লুকিং গ্লাসে পিছনের সবকিছুই এতোক্ষণ দেখেছে।

সারাদিন ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যার সময় সাদাফ বাড়ি ফিরে আসে। আজকে যে সে বড্ড একা! তার মনের কথা শেয়ার করার সঙ্গী নুহাকেও যে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। ছুটির দিন, তাই অফিসের কলিগদের আড্ডায় গিয়েও নিজের মন হালকা করতে পারেনি। চোখে অঝর শ্রাবণ লেগেছে। ঝাপসা চোখে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে যেয়েই ও থমকে দাঁড়ায়। কারণ সেটা আগে থেকেই খোলা। এরপর ও ভিতরে ঢুকে আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। কেননা বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছে সামিয়া! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?

সাদাফের উপস্থিতি টের পেয়ে সামিয়া নিজেই দাঁড়িয়ে যায় এবং ওর কাছে চলে আসে। সাদাফ যেনো মূর্তির মতো একপলকে তাকিয়ে আছে! সামিয়া নিজেই বলা শুরু করলো, “আজ তুমি চলে আসার পর আমি রিয়াদের একটা পরীক্ষা নিয়েছি। ওকে বলেছি, তোমার সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। আর দশটা স্বাভাবিক দম্পতির মতো আমাদের মাঝেও সবকিছু ছিলো। আর জিজ্ঞেস করেছি, ও আমাকে এই অবস্থাতেও গ্রহণ করতে পারবে কিনা! ” সাদাফ জিজ্ঞেস করে, “উনি কি বললেন? ”

– ও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমার মতো মেয়েকে নাকি বিয়ে করা সম্ভব নয়। হয়তো শুধু শরীরটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে!

এটুকু বলেই সামিয়া কান্না করে সাদাফকে জড়িয়ে ধরে। প্রথমবার এতো কাছে পেয়ে সাদাফও ওকে পরম আবেগে বুকে জড়িয়ে নেয়। ওকে যে কখনো কষ্ট পেতে দেবেনা! এভাবে একে অপরকে কতোক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলো সেব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা যাবেনা। হঠাৎ সাদাফের মোবাইলে একসাথে বেশকিছু মেসেজ টোন ওর ভাবনায় ছেদ ঘটায়। সাদাফ, সামিয়াকে বুকে জড়িয়ে রেখেই সেসব মেসেজ ওপেন করে। একসাথে বড় এসএমএস করা সম্ভব নয়, তাই হয়তো অনেকগুলো। “অনুভূতি! সেতো নিজেই জানেনা ঠিক কিসের জন্য খেলা করছে। কখনো প্রচুর উষ্ণতার মধ্যে ঠাণ্ডাভাব পেতে চাইছে, কখনোবা ঠাণ্ডাভাব থেকে উষ্ণতা। কিন্তু এসবের মাঝখানে শুধু রেখে যায় কিছু মিশ্র মুহূর্ত! ” সাদাফ ভাবে কে এই মেসেজ দেবে! কিন্তু পরেরগুলো দেখে চমকে যায়।

“সাদাফ সাহেব, আপনি এতো ভালো কেনো? সামিয়া যখন আজ আমাকে ঐসব বলেছে, তখনি আমি বুঝে নিয়েছি ও আপনাকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আমার প্রতি যেটা ছিলো, সেটা ওর ক্ষণিকের আবেগ মাত্র। প্রকৃত ভালোবাসা যে শুরুই হয় ধীরেধীরে! ” এরপর লিখা ছিলো, “সামিয়া খুবই ভালো একটি মেয়ে। ধীরেধীরে আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছে। একজন তরুণ অধ্যাপক হিসেবে এটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। শিক্ষক হয়ে কাউকে প্রিয়জনের থেকে আলাদা করার মতো ঘৃণিত কাজ আমার দ্বারা হবেনা। আমার অনুরোধ, ওকে দয়াকরে কখনো কষ্ট দেবেন না। আপনাদের জন্য রইলো শুভকামনা!” শেষে ছিলো, “আর হ্যাঁ, আমি কারো কাছে আজীবনের জন্য অপরাধী হয়ে থাকতে চাইনা সঠিক সময় বুঝে সত্যিটা সামিয়াকে জানিয়ে দেবেন। আর এমন ভালোমানুষি কখনো অন্যকারো সাথে দেখাতে যাবেননা যেনো!
শুভকামনা…!

‘রিয়াদ’ ” সাদাফ সাথেসাথেই সামিয়াকে এসব মেসেজ দেখিয়ে দেয়। রিয়াদকে ভুল বুঝার জন্য সামিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে ঐদিকে রিয়াদ খুশি যে সামিয়া নিজের সুখ, প্রকৃত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে! বেঁচে থাকুক সবার ভালোবাসা! রিয়াদ বিড়বিড় করে বলছে, “একটি রংধনু যেমন সবাইকে কিছুক্ষণ মুগ্ধতা বিলিয়ে আবার আকাশের ঐ নীলিমায় হারিয়ে যায়, হয়তো আমিও ঠিক তেমনিভাবে তোমার জীবনে এসেছিলাম। কিন্তু আমার অস্তিত্বের স্থায়িত্বকালটা একটু বেশি হয়ে গেছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত